Debdutta Banerjee

Fantasy

3.6  

Debdutta Banerjee

Fantasy

ভূত ভবিষ‍্যৎ

ভূত ভবিষ‍্যৎ

7 mins
2.5K


পোড়ো বাড়িটাকে দূর থেকে বেশ কয়েকবার দেখেছে আমন, কেমন যেন অদ্ভুত দেখতে। গ্ৰামের শেষ প্রান্তে মাঠের ধারে সুপুরি আর বাঁশ বাগানের মাঝে কেমন যেন মন খারাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দোতলা বাড়িটা। গ্ৰামের কেউ ওদিকটায় যায় না। কারণ ঐ তারাতলার শ্মশান, আর পুরানো কবরখানার জন্য জায়গাটার বদনাম আছে। ঐ শ্মশানে কাপালিকরা শব সাধনা করে। আর কবরখানাটা পরিত্যক্ত। 


কিন্তু আমনকে আজ এক সপ্তাহ কেমন যেন আকর্ষণ করেই চলেছে বাড়িটা। আমন কলকাতায় হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করে। গরমের ছুটিতে বাড়ি এসেছে কিছুদিন হল। এখন ও ক্লাস এইট, জুডো ক্যারাটে শেখে। ভূত ভয় পায় না, খুব সাহস ওঁর। তবে ওর মূল আকর্ষণ বিজ্ঞান। এই বয়সেই ও বেশ কিছু ছোটখাটো জিনিস বানিয়ে সবাইকে অবাক করে দিয়েছে। ওর মায়ের ইলেকট্রিক রুটি বেলনা, জলের নতুন ধরণেরফিলটার থেকে বাবার গাড়ির ফোর ডায়মেনশন লাইট আরহর্ন সব ওর আবিষ্কার।

গ্ৰামের ছেলে গুলো বড্ড ভূত ভয় পায়। ঐ পোড়ো বাড়িটা মল্লিকদের ও শুনেছে। মল্লিকরা সবাই কলকাতায় থাকে। কোনো বন্ধুই বাড়িটার কাছে যেতে চায় না। কিন্তু এবার এসে প্রায় রোজ রাতে ও ঐ বাড়িটায় আলো জ্বলতে দেখেছে। তবে কি মল্লিকরা কেউ ফিরে এসেছে? নাকি বেআইনি কিছু হচ্ছে ওখানে!! আমনের ঐ বাড়িটার প্রতি কৌতূহল বেড়েই চলেছে রোজ রোজ।

সেদিন মাঝরাতে ঝড় বৃষ্টির পর যখন গোল থালার মত চাঁদ উঠেছিল ও একাই ছাদে উঠে এসেছিল। শহরে বৃষ্টি মানেই জল কাদা, কিন্তু গ্ৰামের বৃষ্টি ওর খুব প্রিয়। বৃষ্টি কমলেও বাতাসের ভেজা গন্ধ তখনো নাকে লেগে, গাছের পাতা থেকে জল ঝরছিল টুপটাপ। কুয়াশার চাদর মুড়ে মল্লিকদের বাড়িটা দাঁড়িয়েছিল একই ভাবে। হঠাৎ আমনের মনে হল একটা চ্যাপ্টা মত তিনকোনা কি যেন উড়ে এলো ঐ বাড়ির ছাদের উপর। ওটা কি ছিল !!বাড়িটা ওকে খুব আকর্ষণ করছিল।


বাড়ির বড়রা সবাই ঘুমিয়ে কাঁদা। চুপিচুপি ছাদের ঘোরানো সিঁড়িটা দিয়ে নেমে এসেছিল ও নিচের বাগানে। তারপর একছুটে রাস্তায়,মাঠের মাঝ বরাবর হেঁটে দশ মিনিটেই পৌঁছে গেছিল বাড়িটার পেছনে। একটা হালকা সবুজ কুয়াশায় মোড়া বাড়িটায় ঢুকতেই ওর গাটা কেমন ছমছম করে উঠেছিল। পাত্তা দেয়নি আমন। একতলার কোনো ঘরেই জানালা নেই। এটা বড় অদ্ভুত ধরনের বাড়ি। ও বারান্দা দিয়ে উঠে সব ঘরের দরজা ঠেলে দেখছিল। সব বন্ধ বহুকাল ধরে। মাকড়শার জাল আর ঝুল সরিয়ে ও সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেছিল। একটা চাপা উত্তেজনা আর কৌতূহলে দম বন্ধ হয়ে আসছিল ওঁর।দোতলায় উঠে একটা ঘরের বাইরে একটা মৃদু আলোর রেখা দেখতে পেয়েছিল ও। প্রথম দুটো ঘর পার করে তিন নম্বর ঘরের দরজাটা ঠেলতেই খুলে গেছিল, আবছা সবুজ আলোয় বেশ কিছু যন্ত্রপাতি আর নতুন ধরনের কম্পিউটার চোখে পড়েছিল ওর। ঘরে ঢুকতেই দরজাটা নিজেই বন্ধ হয়ে গেছিল। কিন্তু এর পরের চমকের জন্য আমন মোটেই প্রস্তুত ছিল না। ঘরের মধ্যে একটা গমগমে গলায় আওয়াজ ভেসে এলো -''ওয়েলকাম টু আওয়ার ওয়ার্ল্ড আমন।তোমার অপেক্ষাতেই ছিলাম। ''

কে কথা বলছে বুঝতে না পেরে সামনের চেয়ারটায় ধপ করে বসে পড়েছিল আমন। যে ওকে লক্ষ্য করছে সে ওর নামও জানে। তবে কি ভূত আছে? নাকি অন্য কেউ!

 আবার গমগমে গলা বলে উঠল -''তুমি বয়স আন্দাজে বুদ্ধিমান, সাহসী। তাই তোমায় আমরা নির্বাচিত করেছি। এখন তোমায় কিছু কাজ করতে হবে আমাদের হয়ে। ''

আমন অবাক হয়ে দেখে একটা সবুজ কুয়াশা পাক খাচ্ছে ওঁর আশেপাশে। ওকম্পিউটারের দিকে তাকায়,মেশিনটা নিজে নিজেই অন হয়ে গেছে। এর পর মেশিনটা ওকে নিয়ে যায় এক অন্য জগতে। প্রথমে মহাকাশের মাঝে পৃথিবীকে দেখতে পায়, একটা নীলচে সবুজ গ্ৰহ। আস্তে আস্তে পৃথিবীর বিভিন্ন অংশ স্পষ্ট হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গার মিষ্টি জল কি করে শেষ হয়ে যাচ্ছে তা দেখায় স্যাটেলাইটের ছবি । এরপর আসে ভারত, কি করে গ্লোবাল ওয়ারমিং এ হিমালয়ের বরফ গলে যাচ্ছে, পাহাড়ে দূষণ ছড়াচ্ছে তা দেখানো হয়। এর পর গঙ্গার দূষণ, কলকারখানার বজ্র কি করে জলকে দুষিত করছে তা দেখায় ঐ মেশিন।


ওদের এই হাবড়া এলাকায় জলস্তরের সমস্যা সবাই জানে। ইদানীং শুরু হয়েছে আর্সেনিক দূষণ। জলস্তর সাংঘাতিক ভাবে নিচে নেমে গেছে, তবুও চারদিকে বসছে অগভীর নলকূপ। চাষের জন্য জল তুলে নেওয়া হচ্ছে ইচ্ছামত। এগুলো সব ফুটে ওঠে স্কিনে। আমনের মনে পড়ে ওর বানানো আধুনিক ফিলটারের কথা। 

এরপর কম্পিউটার স্কিন জুড়ে দেখানো হচ্ছিল এর সুদূর প্রসারী প্রভাব। আস্তে আস্তে সারা রাজ্যে ছড়িয়ে পরেছে এই বিষ, আশেপাশের রাজ্যের একই অবস্থা। যেই জলের অপর নাম জীবন তা আস্তে আস্তে বয়ে আনছে নিস্তব্ধ মৃত্যু। আর্সেনিক ছাড়াও নানারকম সংক্রমণ ছড়াচ্ছে জলের মাধ্যমে, আস্তে আস্তে পুরো নীল গ্ৰহটাই চলে যাচ্ছে নীল বিষের খপ্পরে।

এর পরেই কম্পিউটারে শুরু হল জল সংরক্ষণের পদ্ধতি,নদী নালা পুকুরের জল থেকে ভূগর্ভস্থ জল কি ভাবে সঞ্চয় করা যাবে তা বোঝাচ্ছিল ঐ অদৃশ্য আওয়াজ। জলের অভাবে কি করে ধ্বংস হয়ে গেছে অন্যান্য গ্যালাক্সি তাও দেখানো হল। গাছ লাগিয়ে পৃথিবীকে সবুজ করতে বলা হয়েছে বারবার।কিন্তু মানুষ বোঝে নি। এখনো গাছ কেটেই তৈরি হচ্ছে হাইরাইজ, চওড়া হচ্ছে রাস্তা।  

আমন ভাবছিল এসব তো খুব ভালো কথা, তবে যে এসব বলছে এভাবে লুকিয়ে রয়েছে কেন?

গমগমে গলাটা ওর চিন্তাধারার খবর রাখে। সে বলল -''এই বাড়ির আওতায় কেউ এলেই তার মস্তিষ্ক তরঙ্গকে পড়তে পারে ঐ যন্ত্র। তবে গ্ৰামের সবাই এই বাড়িকে এড়িয়েই চলে। বাড়িটার বেশ বদনাম রয়েছে গ্ৰামে। ''

আমনের চিন্তাসূত্র ধরে সেই গলা বলে -''আমি অনেক কিছু আবিষ্কার করলেও তা বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দিতে অপারগ,কারণ বহুদিন আগেই আমি পঞ্চভূতে লীন হয়ে গেছি,আমার অস্তিত্ব বিশ্বের উপকারে যাতে লাগে তাই নিজেকে বিসর্জন দিয়েছি বলতে পারো । আমার অস্তিত্ব আর নেই, নেই কোনো পরিচয়। তাই তোমায় সাহায্য চাইছি। ''

আমন অবাক হয়ে নানারকম ভাবে জলের সংরক্ষণ দেখতে থাকে। এবার ঐ গলার স্বর বলে -''আমার সবচেয়ে বড় আবিষ্কার, যা এবার তোমায় হাতে তুলে দিচ্ছি মন দিয়ে দেখো। পৃথিবীর তিনভাগ জল। কিন্তু তা আমাদের কোনো কাজে লাগে না নোনতা বলে। আমি ঐ সমুদ্রের জলকে সুস্বাদু মিষ্টি জলে বদলে দেবো ধীরে ধীরে। জলের সমস্যা দূর হবে। এ আমার একান্ত নিজের আবিষ্কার। যা গ্যালাক্সি তিনের সহায়তায় আমি করতে পেরেছি। আর আছে মেঘ তৈরি করা, বৃষ্টি এখন আমার হাতের মুঠোয় বন্দী। আমি চাইলেই কালো মেঘে ঢেকে যাবে আকাশ, মরুভূমিতেও বৃষ্টি নামাতে পারি আমি। ''


স্কিন জুড়ে তখন মেঘ তৈরির প্রোগ্ৰামিং চলছে। কৃত্রিম রোদের সহায়তায় সমুদ্রের জল থেকে তৈরি হচ্ছে মেঘ,তাদের জিপিএস লোকেশন সেট করে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে বৃষ্টিচ্ছায় অঞ্চলে। নির্দিষ্ট সময় বৃষ্টি দিয়ে আসছে তারা পরিমাণ মত। আবার বেশি বৃষ্টি যাতে না হয় , সে কারণে বিভিন্ন জায়গার মেঘদের আবার অন্যান্য জায়গায় পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

 আমন এসব দেখতে দেখতে অবাক হয়ে ভাবছিল এসব যুগান্তকারী আবিষ্কার কে করল?

গমগমে গলা বলে ওঠে, ''মানুষ এই নাম আর ক্ষমতার লোভেই শেষ হয়ে গেল। কে আবিষ্কার করল থেকেও বড় আবিষ্কারটা কি করে মানুষের কাজে লাগানো যায়, কি করে পৃথিবী কে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা যায়। আবিষ্কারক এ ক্ষেত্রে গৌণ। ''

আমন আস্তে আস্তে যেন ঐ গম্ভীর গলার বশে চলে যাচ্ছে। গভীর ভাবে সব কিছু দেখে নিচ্ছিল ও, কিছু ফাইল কপি করে নিজেকে মেল করে দিল ও। এই কম্পিউটার টা অনেক এডভান্স। হঠাৎ ওর মনে হল বাড়িটা বড্ড দুলছে। তবে কি ভূমিকম্প হচ্ছে, নাকি অন্য কিছু!! অয়ন বারান্দায় বেরিয়ে আসে তাড়াতাড়ি। গমগমে গলা বলেই চলেছে, -''নিজেকে শান্ত করো, তোমার কিছুই হবে না। সময় বড্ড কম, সামুদ্রিক জলের প্রক্রিয়াকরণটা দেখে নাও। এটাই পারবে তোমাদের রক্ষা করতে। ''

আমন আবার এসে দেখতে থাকে সব মন দিয়ে। মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করে ওঠে,অনেক কঠিন কঠিন অঙ্ক ও বেশ সহজেই বুঝতে পারছে এখন। একটা চ্যাপ্টা তিন কোনা যন্ত্র বাড়িটাকে পাক খাচ্ছে হঠাৎ দেখতে পায় ও। আমনের মনে হয় এটাই কি তবে ইউএফও। গ্ৰহান্তরের কোনো বন্ধু এসে কি ওর হাতে তুলে দিল জীবনের এক গোপন রহস্যর চাবি?  ও বলে -''বন্ধু, আমায় একবার নিজের পরিচয় দেওয়া কি সম্ভব নয় ?একবার কি দেখা পাবো না তোমার? ''


ঘরের মধ্যে হালকা সবুজ কুয়াশা এ বার ধীরে ধীরে জমাট বাধে, এক কিশোর থেকে তরুণ, তরুণ থেকে যুবকের অবয়ব ফুটে ওঠে ধীরে ধীরে। সামনের কাচের দেওয়ালে আমনের প্রতিচ্ছবির পাশে যে ছবি ফুটে ওঠে সে যে আমনের ভীষণ পরিচিত ছবি। ঠোঁটের পাশের ঐ কাটা দাগ আর নাকের উপর ঐ কালো জড়ুল যে দুজনেরই আছে, ঐ চিহ্ন ওদের দুজনের পরিচয় বহন করছে। হাসছে ভবিষ্যৎ আমন। ছোট্ট আমন অবাক হয়ে দেখছে, আরও পঁচিশ বছর পর হয়তো ও ওরকম হবে। ভেঙ্গে ছড়িয়ে যায় আমনের বড় বেলা। সবুজাভ কুয়াশা ভেদ করে গমগমে গলার স্বর ভেসে আসে পঁচিশ বছর হাতে নেই আমন, এই আবিষ্কার এখনি প্রয়োজন। পৃথিবীকে বাঁচাতে হলে তোমায় এখনি শুরু করতে হবে ঐ কাজ। 

সবুজ কুয়াশা কে সুসে নিয়ে আকাশ যানটা পাক খেয়ে এগিয়ে যায় সুদূর আকাশে। আকাশ যান নয়, ওটা সেই টাইম মেশিন, যাতে চরে ওর ভবিষ্যৎ ওকে দেখা দিয়ে গেলো। এগিয়ে দিয়ে গেল বিজ্ঞানের পথে কয়েক কদম। ঘরের সবুজ কুয়াশাটুকুকে টেনে নেয় ঐ তিনকোনা টাইম মেশিন। আমনের মাথাটা কেমন ঘুরে ওঠে।

ঘুম ভাঙ্গতেই আমন দেখে ওকে ঘিরে জটলা, ড্রইং রুমে শুয়ে রয়েছে সে। ডাক্তার কাকু বাবা মা ঝুঁকে রয়েছে ওর ওপর। ও উঠে বসতেই ডাক্তার কাকু সবাইকে বলে ঘর খালি করতে। আমন ভালো আছে। ওকে নাকি ভোর রাতে মাঠে পড়ে থাকতে দেখতে পেয়েছিল পাড়ার দারোয়ান। ও কেনো বাইরে গেছিল সবাই জানতে চাইছিল। মা এক কাপ গরম দুধ এনে জোর করে খাইয়ে দেয় ওকে। খোলা জানালা দিয়ে মাঠের শেষ প্রান্তে তাকায় আমন, মল্লিকদের বাড়িটা কাল শেষ রাতের ঝড় বৃষ্টিতে মুখ থুবরে পড়েছে সবাই বলছিল। বহুদিন সংস্কার না হওয়ায় বাড়িটা নড়বড়ে হয়ে গেছিল। অবাক হয়ে তাকায় ওদিকে আমন।


একটু পরেই বাড়ি খালি হয়ে আসে। আমন ফিরে আসে নিজের ঘরে। ওর যে এখন অনেক কাজ। তাড়াতাড়ি কম্পিউটারে বসতে হবে এবার। ভবিষ্যতের আমন তার কানে যে মন্ত্র দিয়ে গেছে এবার তা বাস্তবে রূপায়িত করতে হবে ছোট্ট আমনকেই। একটা পুরো পৃথিবীর রক্ষার দায়িত্ব এখন ওর ঘাড়ে।

বাড়ি ফাঁকা হতেই মুচকি হেসে কম্পিউটার অন করে আমন।মেল গুলো চেক করতে হবে এবার, কি করতে হবে পর পর সাজিয়ে নেয় মনের ভিতর। হাতে সময় বড্ড কম। পৃথিবী রক্ষার দায়িত্ব এখন ওঁর উপর। ভবিষ্যৎ আমনের আশীর্বাদ আছে ওঁর উপর। ওকে পারতেই হবে, জিততেই হবে ।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Fantasy