ভুতের সাথে
ভুতের সাথে
আমি যে সময়ের কথা বলছি তখন সবে দেশ স্বাধীন হয়েছে। বাবার চিকিৎসার জন্য বেশ কয়েকমাস বেনিয়াপুকুর অঞ্চলে একটা ঘর ভাড়া করে থাকতে হয়েছিলো। মেডিক্যাল এ চিকিৎসা চলছিল। সমস্যা হলো আমাদের সাথে কোনো চাকর ছিল না। আমি বাইরে থেকে কিনে খাবার খেতে পারলেও বাবা পারতেন না। ওনার লিভারের চিকিৎসাই চলছিল, তাই আমাদের বাড়িওলা কে বলে একজন রান্নার লোক ঠিক করে নিলাম। সে দুদিন এসে আর এলো না।
মাকেও নিয়ে এসে রাখা সে সময় সম্ভবপর ছিল না তাই আবার রান্নার লোক খুঁজে বেড়াতে লাগলাম। রান্নার লোক পাওয়ার জন্য কোন পার্কের বেঞ্চে বসে তার পাশের লোককেও বলতে আরম্ভ করলাম। আসলে বাবার খাওয়ার কস্ট আমি আর সহ্য করতে পারছিলাম না। এভাবে একদিন সন্ধ্যাবেলা হঠাৎ কড়ানাড়ার শব্দ শুনে দরজা খুললাম, দেখি এক মাথা ঘোমটা দিয়ে এক মহিলা দাঁড়িয়ে, আমি বললাম "কাকে চাইছেন আপনি?" ভদ্রমহিলা একটু নিচু স্বরে বলে উঠলেন "আমি মোক্ষদা আপনি রান্নার লোক চাইছিলেন তাই ভবানী বাবু আমাকে পাঠালেন" আমি ভেবে দেখলাম ভবানী বাবু নামে এক দোকান মালিক কে আমি কিছুদিন আগে রান্নার লোকের কথা বলেছিলাম ঠিক।
তাই আর কোন কথা না বলে ওনাকে ভেতরে আসতে বললাম। উনি এবার ঘুমটা টা একটু কম করে বললেন আমি রান্না বান্না সব করে দেবো কিন্তু সকালে আসতে পারবো না, সন্ধ্যেবেলা তেই রোজ আসবো"। আমি দেখলাম এ ছাড়া আমার আর কোনো উপায় নেই, তাই অগত্যা রাজি হয়ে গেলাম ।
পরেরদিন মহিলাটি এল তখন আমি ওকে সমস্ত কাজ বুঝিয়ে দিলাম। দেখলাম বেশ চটপটে, রান্নাও খুব তাড়াতাড়ি করে রেখে, সবকিছু পরিষ্কার করে বাড়ি চলে যেত। বাবার খাওয়ার সমস্যাটা দূর হতে আমি বেশ কিছুটা হালকা হলাম।
একদিন মোক্ষদা দিদি আমাকে বললেন
"বাবার কী অসুখ হয়েছে?"
"ডাক্তার বলছে লিভারের সমস্যা" আমি বললাম। আমাকে অবাক করে দিয়ে উনি বলে উঠলেন "তোমার বাবা আর খুব বেশিদিন নেই, এই অসুখেই উনি শেষ হবেন"
আমি হতভম্ব হয়ে কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে বললাম "আপনি কি করে জানলেন? হাত গুনতে জানেন নাকি?"
এবার মোক্ষদা দিদি একটু খিলখিল করে হেসে বললেন
"আমি সব দেখতে পাই, তোমরা যা পারো না তাও"
বাবা ঠিক এই সময়ে আমাকে ডাকলেন বাথরুমে যাওয়ার জন্য। আর কথা হল না বটে কিন্তু আমার মনে মোক্ষদা দিদির ওই কথাটা তোলপাড় করতে আরম্ভ করলো। এটা সত্যি যে বাবার অবস্থা ক্রমশ খারাপ এর দিকে যাচ্ছিল। ডাক্তারের চেষ্টার ত্রুটি ছিল না বটে কিন্তু বাবা শেষে আর চিকিৎসায় খুব বেশি সাড়া দিচ্ছিলেন না। আমিও মোক্ষদা দিদির কথাটা বাবাকে আর কিছু বলিনি। এমনকি বাবা এই মোক্ষদা নামটিও জানতেন না কারণ বাবার ঘরে মোক্ষদা দিদি খুব একটা যেতেন না রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে বাড়ি চলে যেতেন।
বাবা আর খুব বেশিদিন আমাদের মাঝে থাকলেন না। আমি বাবার দেহ নিয়ে একটা গাড়ি ভাড়া করে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। পথে ওই ভবানী বাবুর দোকানটি পড়ল। আমি গাড়ি থামিয়ে ওনার দোকান থেকে কয়েক বোতল জল কিনতে গিয়ে ওনাকে মোক্ষদা দিদির কথাটা বললাম
ভবানী বাবু চমকে উঠে বললেন
"কি বলছ মোক্ষদা দিদি আজ থেকে কুড়ি বছর আগে মারা গেছেন, আমি ওকে চিনতাম, অনেক দূর থেকে এসে এখানে রান্নার কাজ করতো"
আমি খুব অবাক হয়ে বললাম "সে কি করে হয় ভূত কখনো রান্না করতে পারে"?
ভবানীবাবু উত্তরে বলেছিলেন হয়তো তোমাদের কেউ ছিলেন তাই তোমাদের বিপদে সে ছুটে এসেছে"
বাবার শেষকৃত্য হয়ে যাওয়ার পর মাকে যখন ঘটনাটি বললাম মা চমকে উঠে আমাকে বললেন"মোক্ষদা ছিল আমার ননদ, অনেক বছর আগেই কলকাতায় শ্বশুরবাড়িতে এক দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিল, শশুর বাড়ী ভালো ছিল না, ভালো করে খেতে দিত না কিন্তু বাপের বাড়িতে কোনো সাহায্য চাইতে কোনোদিন আসে নি, বাড়িতে রান্নার কাজ করে সংসার চালাতো। হঠাৎ আগুনে পুড়ে শেষ হয়ে গেলো মোক্ষদা"
আমার ভবানীবাবুর কথাটা মনে পড়ল উনি ঠিক বলেছিলেন দাদার কষ্ট দেখতে না পেরে উনি ছুটে এসেছিলেন। কোনদিন এই মোক্ষদা পিসিকে জীবন্ত দেখার সুযোগ না হলেও ওনার প্রতি আমার শ্রদ্ধা বহুগুণে বেড়ে গিয়েছিল।

