ভুতের খপ্পরে দাদু
ভুতের খপ্পরে দাদু
বাইরে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি পড়ছে। এ বৃষ্টি আবার যে সে বৃষ্টি নয়, কি যেন একটা সাইক্লোন এসেছে বাংলাদেশে তার জেরে আমাদের এখানেও বৃষ্টি। বেশ ঠান্ডা ঠাণ্ডাও লাগছে। তাতাই মহা আনন্দে মাকে গিয়ে বলেছিল আজ রাতে খিচুড়ি করতে। মা তখন পিচাইকে গরম জামা কাপড় পরাতে ব্যস্ত ছিলেন তাই কড়া গলায় তাতাইয়ের প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছেন। মা মনে করিয়ে দিলেন এই পরশু দিনই ফুচকা খেয়ে সন্ধ্যাবেলায় পেটের যন্ত্রনায় ছটফট করছিল তাতাই। আজ আবার তাতে খিচুড়ি খেলে রক্ষে থাকবে না। রাতের জম্পেশ ডিনারের প্রস্তাবটা এমন সরাসরি নাকচ হয়ে যেতে মনে বড় ব্যাথা পেয়েছে তাতাই। মা মুখে যাই বলুক, তাতাই জানে মা বাবা ঠাম্মি দাদু সবাই এখন সারাদিন শুধু পিচাই আর পিচাই করতে থাকেন, তাতাইয়ের কথা কেউ ভাবে না। তাই রাগে গাল ফুলিয়ে পাশের ঘরে চলে এলো তাতাই। বৃষ্টির জন্য সব জানালা লাগানো ছিল। অনেক কসরৎ করে একটা জানালা খুলে তার গোড়ায় বসে বৃষ্টি দেখতে লাগল তাতাই। বৃষ্টির ঝাঁট এসে যে ওর জামাকাপড় ভিজিয়ে দিতে থাকলো সেদিকে ভ্রূক্ষেপই করল না। তাতাই দেখতে পেল বৃষ্টির ফোঁটাগুলো টুপটাপ করে পড়ছে শিউলি গাছের পাতায়, বৃষ্টির চাপে ফুলগুলো নিশ্চয় থেতলে যাবে! কথাটা মনে হতেই মনটা আরও খারাপ হয়ে গেল তাতাইয়ের। আচমকা একটা দমকা বাতাস দিল বাইরে, সে বাতাসের এতো তেজ যে তাতাই ভেতর অবধি কেঁপে উঠল আর সেই সঙ্গে পেছনের তাক থেকে কি যেন একটা ধপ করে পড়ে গেল নীচে। আওয়াজ পেয়ে ছুটে এলেন ঠাম্মি, "কি হল কি হল?"
ঘরে এসে প্রথমে সুইচ টিপে আলোটা জ্বালালেন তিনি, আর আলো জ্বলার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর নজর পড়ল তাতাইয়ের দিকে।
---- সর্বনাশ!এ কি কান্ড তোর?
আঁতকে উঠলেন ঠাম্মি। তাতাইও কম যায়না, সে গম্ভীর মুখে বললে,
---- আমাকে এখন একলা ছেড়ে দাও।
পুঁচকে মেয়ের এমন কথাশুনে একটা ঢোঁক গিললেন ঠাম্মি,
---- তা একা থাক না তুই কিন্তু জানালা খুলে ভিজছিস কেন?
---- আমার মন মেজাজ ভালো নেই।
আগের মতোই গম্ভীর গলায় জবাব দিল তাতাই।
---- তবে রে পাকা বুড়ি। ঠান্ডা লেগে গেলে তখন কি হবে?
এই বলে ঠাম্মি এগিয়ে গিয়ে জানালাটা সবার আগে বন্ধ করলেন। তারপর একটা টাওয়েল নিয়ে তাতাইয়ের গা হাত মোছাতে মোছাতে জিজ্ঞেস করলেন,
----তা আমার দিদিভাইয়ের মন মেজাজ খারাপ হল কেন?
---- কি আর বলি, ও তুমি বুঝবে না।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল তাতাই
ঠাম্মি ওর গালটা টিপে দিয়ে বললেন শুনিই না একটু।
---- মাকে বললাম ডিনারে খিচুড়ি করতে। মা শুনলোই না….! তুমিই বলো ঠাম্মি বৃষ্টির দিনে খিচুড়ি ছাড়া কি মজা আসে?
----তা ঠিক, তবে কি জানো দিদিভাই বৃষ্টির দিনে উপভোগ করার আরও অনেক উপায় আছে।
---- আর কি?
ব্যাজার মুখে বলল তাতাই।
---- উমমম এই যেমন ধরো ভুতের গল্প শোনা।
---- ভুতের গল্প?
---- হুমম। এই বৃষ্টি ভেজা দিনে ঘরের আলো নিভিয়ে ভুতের গল্প শোনার মজাই আলাদা।
---- তাই নাকি?
---- একদম।
---- তাহলে ঠাম্মি আমাকে একটা ভুতের গল্প বলো এক্ষুণি।
----এখন?
---- হুঁ। এক্ষুণি… প্লিজ প্লিজ ঠাম্মি।
---- কিন্তু আমার যে অনেক কাজ পড়ে আছে।
---- আমি কোনো কথা শুনবো না, আমাকে এক্ষুণি গল্প বলতে হবে। আমার সোনা ঠাম্মি প্লিজ।
---- আচ্ছা বাবা বলছি বলছি।
★★★★★
আলোটা নিভিয়ে ঠাম্মি বসলেন খাটে। তাতাই বসলো তাঁর গা ঘেঁষে। হাবভাবে যতই নিজেকে বড় দেখানোর চেষ্টা করুক কিন্তু আদপে তো সে ছোটই। ভুতের গল্প শুনতে তাই তার বেশ ভয় লাগে। কে জানে ঠাম্মি কত ভয়ানক ভুতের গল্প বলেন আজ! তবুও মুখটাকে সাহসী সাহসী করে তাতাই বলল ,
---- কি হল ঠাম্মি, বলো।
---- বলছি বাবা বলছি।
তাহলে শোনো, সে অনেকদিন আগের কথা। তখন তোমার দাদু এইটুকু পুঁচকে ছেলে।
----- কত পুঁচকে ঠাম্মি?
---- এই তোমার থেকে একটু বড়।
---- ওওও… তারপর?
---- দাদু তখন আমাদের গ্রামের বাড়িতে থাকেন। সেই বাড়িতে একদিন বেড়াতে এলেন তোমার দাদুর মাসিমণি।
---- দাদুরও মাসিমণি আছে???
---- আছেই তো। তা সেই মাসিমণির একটি তুনু বেটুন ছিল। তার নাম কি জানো?
---- কি??
---- চিনি। তোমার দাদুর চিনি বোনু।
---- সে কি চিনির মত মিষ্টি?
---- সে আর বলতে! খুব মিষ্টি ছানা সে।
p>
---- সে কতটুকু ছানা ঠাম্মি?
----এই তো এইটুকুনিস। তোমার ভাইয়ের মত।
---- ওওও তারপর তারপর?
----তা তোমার দাদুর বাড়িতে তো তার মাসিমণি আর বনু এসে আছে। বোনূর সঙ্গে খেলে খুব মজায় দিন কাটছে তোমার দাদুর। খুব খুশি সে। কিন্তু এরই মাঝে ঘটে গেল এক মারাত্মক ঘটনা।
---- কি ঘটনা গো ঠাম্মি?
---- একদিন সকালে উঠে সবাই দেখল চিনি নেই।
---- কোথায় গেছে?
----কে জানে! ওইটুকু ছানা তো হাঁটতে পারেনা তাহলে যাবে কোথায়!!! চারিদিকে খোঁজ খোঁজ পড়ে গেল। মা আর মাসিমণি তো কেঁদে কুল পাননা। ছোট্ট চিনি গেল কোথায়!
এদিকে তোমার দাদুও বড়দের সঙ্গে খোঁজে বেরোলেন।
---- তারপর তারপর?
---- গ্রামে একটা বড় খেলার মাঠ ছিল। সেই মাঠের এক ধারে একটা বহুদিনের পুরোনো বটগাছ ছিল। সেই বট গাছে থাকত একটি টিয়া পাখি। তোমার দাদু রোজ যেহেতু সেই মাঠে খেলতে যেতেন তাই সেই টিয়া পাখির সঙ্গে তোমার দাদুর খুব বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল।
তা সেদিন ভোর বেলায় তোমার দাদুকে অমন উদ্ভ্রান্তের মত ছোটাছুটি করতে দেখে টিয়া উড়ে এলো, "ও বন্ধু, কি হয়েছে তোমার?"
"আর বোলো না বন্ধু। আজ ভোরে ঘুম থেকে উঠে দেখছি আমার বোনু বাড়িতে নেই।"
"সেকি!!! কোথায় গেল?"
"তা তো জানিনা, তাকেই তো খুঁজছি তাই।"
"আচ্ছা আচ্ছা। তা তোমার বোনু কেমন দেখতে বলো দিকি!"
"আমার বোনু!" দাদু অনেক ভেবে বললেন, "আমার বোনু দেখতে এক্কেবারে পুতুলের মত। মিটিমিটি চোখে তাকায় খালি, আর ওকে সুড়সুড়ি দিলে গোলাপের মত হাসে।"
"ওহ আচ্ছা আচ্ছা।" কি যেন একটা ভেবে নিয়ে টিয়া বলল, "তোমার কাজে লাগবে কিনা জানিনা তাও তোমাকে একটা কথা বলে রাখি।"
"কি কথা গো?"
"উম্ম… আজ সকালে আমি মামদোকে একটা পুতুলের মত কি যেন নিয়ে ছুটতে দেখেছি।"
"বলো কি!"
"হ্যাঁ গো।"
"তুমি কি জানো মামদো কোথায় থাকে?"
"জানি।"
----- ওই দাদুর বুনুকে কি মামদো ধরে নিয়ে গেছিল?
----- আহা তুমি শোনোই না গল্পটা। গল্পের মাঝে এতো প্রশ্ন করতে নেই।
---- আচ্ছা আচ্ছা বলো তবে।
---- হুমম। তা তারপর টিয়ার নির্দেশ মত দাদু ছুটল তাল বাগানের দিকে। কেননা ঐখানেই নাকি মামদোর বাসা। তাল বাগানে ঢুকে দাদু হাঁক পাড়ল,
"মামদো দাদা… বলি ও মামদো দাদা…" বেশ কিছুক্ষণ ডাকাডাকির পর সাড়া দিলো মামদো। মামদোকে দেখেই চোখ বড়বড় করে দাদু জিজ্ঞেস করল,
"আমার বোনকে কেন এনেছো?"
মামদো কিন্তু দাদুকে ঠিক চিনতে পেরেছে। সে বলল, "তোমার বোন! আমি তো আনিনি, আমি তো শুধু চিনি এনেছি তোমাদের বাড়ি থেকে।"
"কি বললে চিনি?"
"হ্যাঁ, আমার এক বন্ধু বলেছে চিনি খেতে নাকি ভারী সুস্বাদু।"
মামদোর কথা শুনে দাদু তো হেসেই কুপোকাত, " মামদো দাদা তুমি কি বোকা গো? ওটা খাওয়ার চিনি নয় গো, ওটা আমার বোন চিনি।"
"মানে!"
"ওটা খাবার নয়, একটা পুঁচকে মানুষ। ওকে ফেরৎ দাও।"
"না না আমি চিনি খাবো।"
"আরে বাবা এই চিনিকে খাওয়া যায়না গো মামদো দাদা। আমি মাকে বলবো তোমার জন্য একটু খাওয়ার চিনি দিতে।"
"সত্যি বলছো?" মামদোর গলায় অবিশ্বাস।
"একদম । প্রমিস করছি।"
---- তারপর মামদো দাদুর বুনুকে দিল?
---- হ্যাঁ।
---- তারপর দাদু কি করল?
---- কি আবার করবে? বোনুকে নিয়ে ফিরে এলো।
---- তারপর?
---- তারপর কি?
---- মামদোকে চিনি খাওয়াবে না?
---- ওহ। হ্যাঁ হ্যাঁ তাও খাওয়ালো দুপুর বেলা।
---- আচ্ছা আচ্ছা। দুপুরে শুধু চিনি খাওয়ালো! একটু মাংস ভাত…
---- তাও খাইয়েছিল।
---- আচ্ছা আচ্ছা। ভাতের পর পান দিয়েছিল?
---- হ্যাঁ, তাও দিয়েছিল।
---- ঠাম্মি
---- কি?
---- ভুতে পান খায়?
---- আমার জানা নেই।
---- এই যে বললে মামদো খেয়েছিল।
---- তাহলে খায়।
---- ঠাম্মি
---- কি?
---- তুমি আমাকে মিছি কথা বললে না?
---- মিছি কথা! না মানে…
---- আমি তো শুরুর থেকেই জানতাম তুমি মিছি কথা বলছো। তাও তোমার গল্প বলতে এতো ইচ্ছে করছে বলে কিছু বলিনি।
--- হে ভগবান!
মাথায় হাত ছাপড়ালেন ঠাম্মি। আজকালকার বাচ্চাগুলো….!!!!