ভাইরাসের কড়চা #১৪ । খুদ করোনা
ভাইরাসের কড়চা #১৪ । খুদ করোনা


০৭এপ্রিল ২০২০
এদেশে আসার পর এদের খবরের কাগজ পড়তে শিখে আমার বেশ লাভ হয়েছে। এরা তবু অনেক ধরণের ও অনেকের কথা বলে - সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর লোকের কথা। কিন্তু টিভির বেশিরভাগ চ্যানেলে চোখ রাখলে দেখি উল্টোটা। একই জিনিস বার বার দেখাচ্ছে - খবরের চ্যানেলে সকাল, দুপুর, বিকেল, রাত্তির একই খবর, তার সাথে কোন বিষয়কে নিয়ে তরজা, বিভিন্ন দলের রাজনৈতিক কর্মীদের গলা ফাটানো ঝগড়া! অসহ্য; এর থেকে কাকেদের কা-কা অনেক ভালো! অবশ্য মিথ্যে বলবো না, কয়েকটা চ্যানেলে কিছু ক্লাসিক সিনেমা দেখাচ্ছে, যদিও গাদা গাদা বিজ্ঞাপনের মধ্যে থেকে সেগুলো ছেঁকে দেখতে হয়। ওটা মেনে নিতেই হবে। তা হোক, সময়টা তো কাটে! এবার আসল কথায় আসি। আজকের কাগজে একটা খবর দেখে ভুরুদুটো একটু কোঁচকালো বৈকি আমার। এ'রাজ্যের সরকার পরিস্থিতি সামাল দিতে গ্লোবাল আডভাইসরি বোর্ড তৈরি করেছে। তাতে নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ, ডব্লিউ এইচ ও র আঞ্চলিক অধিকর্তা, প্রবীণ চিকিৎসক, গবেষক ইত্যাদি হোমরাচোমরা লোকেরা জায়গা পেয়েছে। বুঝতেই পারছি, এবার একজনের বুদ্ধির জায়গায় আটজনের বুদ্ধির বিরুদ্ধে লড়তে হবে। এটাই হবে আসল দাবাখেলা! কিন্তু জেনে রাখুন - করোনা কে তাপ সে তুমহে একহি আদমি বচা শকতা হ্যায়, এক হি আদমি; খুদ করোনা...কী বুঝলেন ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারকরা?
আজকে টিভির দূরদর্শন চ্যানেলে মহাভারত দেখছিলাম। সব শ্যুটিং বন্ধ, নতুন কিছু দেখাচ্ছে না, পুরনোগুলোই আবার চালাচ্ছে।গত শনিবার থেকে রামায়ণ, মহাভারত শুরু করায় চ্যানেলের টি আর পি এখন ঊর্ধমুখী। কর্ণর কথা শোনাচ্ছিল আমার সতীর্থ ডেঙ্গু। মেনে নিচ্ছি যে কুন্তীর ছেলে কর্ণ ছিল এক অসাধারণ বীর, অর্জুনের থেকেও বড়। শুধু তাই না, দানবীর এক মহান ব্যক্তিত্ব। প্রশংসা করছি বটে কিন্তু ভুলেও ভাববেন না যে আমি ওর দৃষ্টান্তে অনুপ্রাণিত হয়ে আমার কবচ-কুন্ডল অন্য কারোর হাতে তুলে দেব। সে আমার জন্মদাত্রী এলেও না। জঙ্গ্ অভি জারী হ্যয়। যে কোনো মূল্যেই এই লড়াই আমাকে জিততেই হবে। অনেকেই ঘায়েল, মরেছেও বিস্তর, কিছু আবার সেরেও উঠছে। খবর পেয়েছি দিল্লিতে বিরাশি বছরের এক বৃদ্ধ সেরে উঠেছেন। এই ফাঁকে একটা ছোট্ট সিক্রেট দিয়ে রাখি। আমি যদি আপনার ঘাড়ে কখনো চেপে বসি, খালি একটা জিনিস মাথায় রাখবেন - ভয় পাবেন না, নিজেকে অন্যদের থেকে সরিয়ে রেখে যা যা করতে বলেছে, যেমনভাবে চলতে বলেছে সেইভাবেই থাকবেন। গব্বর সিং-এর সেই ডায়ালগটা মনে আছে তো - জো ডর্ গয়া, সমঝো মর্ গয়া!
আমার ধারণাই ছিল না যে এই শহরে এত লোক বাড়িতে থেকে অফিসের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে! না করেই বা উপায় কি! আমার দাপটে সবাই তো কোণঠাসা। আজ দুপুরে একজনের বাড়িতে হানা দিয়েছিলাম। সার্ভেইল্যান্স ট্যুর বলতে পারেন। ছেলেটা একটা এঞ্জিনিয়ারিং কনসালটেন্সি কোম্পানিতে কাজ করে। গিয়ে দেখি, কনফারেন্স কলে ব্যস্ত। কল চলছে পুরোদমে, পুরো টিমের মধ্যে – এগারোজন লোকের পুরো ফুটবল টিম। সরিৎ, মানে যার বাড়ি সে হল এদের টিমলিডার। চুপটি করে কান পাতলাম, কোনটা কার কথা জানিনা, আপনারাই বুঝে নেবার চেষ্টা করুন কোনটা একজনের কথার পিঠে অন্যজনের উত্তর:
- কি খবর সবার? নিজে আর ফ্যামিলির সবাই ভালো তো?
প্রচুর 'হুঁ', 'হ্যাঁ', 'এখনো অবধি সব ভালো' ইত্যাদি উত্তর শুনলাম। একজন চুপ করে ছিল।
- কিরে তমাল, শরীর ঠিক আছে তো?
উত্তরে দুটো বিশাল হ্যাঁচ্চো পড়লো। পিনড্রপ সাইলেন্স। নাক টেনে তমাল বলল,
- সরিৎ দা, অফিসটা খুললেই আমি একসপ্তাহ স্টে ইন অফিস!
- কেন রে? তুই তো সবার আগে শুক্রবার হলেই ওয়ার্ক ফ্রম হোম অ্যাপ্লাই করতিস!
- দাদা, কেন বুঝছো না, তখন ভাবনাচিন্তাটা কমপ্লিটলি অন্যরকম, ছিল - উইকেন্ড ট্রিপ, ডিনারে যাওয়া, মলে যাওয়া এসব প্ল্যান থাকতো, এখন সারা বাড়ি স্প্রেয়িং, ক্লিনিং করানোর প্ল্যান চলছে...নিডলেস টু সে, সবই আমাকে দিয়ে! আর নিতে পারছি না।
- আমার আবার বাসন মাজা, ওয়াশিং মেশিন চালানো, আরো কত কি! ওয়াশিং মেশিনে দিলে মেয়ের জামা নষ্ট হয়ে যাবে বলে সেগুলোকে আলাদা করে হাতে কাচতে হয়। আর জানিসই তো আমার দু'বছরের মেয়ে বউয়ের খাওয়ানোর ঠেলায় রোজ কমসে কম চারবার বমি করে...
- তোমার ওই ব্যাপার! আমার তো নিজেকে মনে হয় হোটেলের রুম সার্ভিস। বারবার ডাক পড়ে, একটা কাজ শেষ হলেই আরেকটা ধরিয়ে দেয়। আলাদীনের দত্যির মতো। সিগারেট ফুঁকে যে দম নেবো তারও ফুরসৎ নেই।
- বলো কি ভায়া? তোমার তো কোটা ছিল দিনে দু প্যাকেট! একটু পরে পরেই স্মোকিং জোনে যেতে!
- ছাড়্, ও সব এখন পাস্ট টেন্স! এখন দিনে রেশনের মতন দুটো, সকালে টয়লেটে আর রাতে শোয়ার আগে।
- এইজন্যই বলেছিলাম রান্নাটা শিখে নাও। তাহলে এইসব ঝামেলার কাজগুলো একটু হলেও তো কমতো।
- আমাদের নেতা সরিৎ দা সবচেয়ে ভালো আছে মনে হয়?
- সে আর বলতে; নেতার হাতে দুবেলা এখন ন্যাতা।
- এ হরপ্রীত, তেরা ক্যা হাল?
- সব্ ঠিক হ্যায় পাজি।
- তু তো বোলা থা তেরা বিবি বহোত হি সুশীল, ঘরেলু অওরত...
- সো তো হ্যয়। পর অভি হাল মেঁ কুছ বদলি বদলি সি নজর আ রহা হ্যয়। জো ভি বোলতা হুঁ, কহতি হ্যায় "খুদ করোনা"!
ধন্যবাদ - শ্রী অমরনাথ মুখোপাধ্যায়