Rima Goswami

Tragedy Crime Thriller

3  

Rima Goswami

Tragedy Crime Thriller

বধূ যখন বেশ্যা পর্ব 3

বধূ যখন বেশ্যা পর্ব 3

14 mins
830


মার্কণ্ডেয় ছেলেটা হয়ত বাপের যোগ্য উত্তরসূরি হতে পারতো কিন্তু মা সতীর প্রশ্রয় তাকে মাথা সোজা করে দাঁড়াতেই দিলো না । মদ , সিগারেট তো আছেই উপরন্তু গাঁজা আর কোকেনের নেশাও ধরিয়ে ফেলেছে ছেলেটা । সেবার প্রায় আধা পাগল অবস্থায় মার্কণ্ডেয়কে রিহ্যাবে দিয়ে ছিল মথুরা বাবু । সেখান থেকেই পরিচয় মাহির সাথে । মাহিই একপর্যায়ে সুস্থ করে মার্কণ্ডেয়কে । তার পর আলাপ থেকে প্রেম পর্যন্ত গড়াতে দেরি হয়নি ব্যাপারটা । মথুরা বাবুর ইচ্ছা ছিলো না ছেলের অবাঙালি মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দেবার । মেয়ে গরিব হোক বা বড়লোক সে বাঙালি হবে এটাই ইচ্ছা ছিল তবু মেনে নিতে হয় কারণ এক তো মা ছেলের জেদ , দুই মেয়েটার উপকারটা ডিনাই করা যায় না । সেই মাহি আজকাল একটা প্রস্টিটিউট কেয়ার এনজিও র হয়ে কাজ করতে গিয়ে আবিষ্কার করে হবু শশুর মশাইকে । উর্যা নামক মেয়েটাকে কেমন যেন সন্দেহ হয় মাহির ! মেয়েটা আর পাঁচজনের মতো সেজে থাকার চেষ্টা করে বটে তবে আর পাঁচ জনের সাথে একটা পার্থক্য তো আছেই ওর ! উর্যার বাচ্চাটাকে দেখতে খুব মিষ্টি । মথুরা বাবুকে মাহি ভীষণ সন্মান করতো মনে মনে তবে নিজের মেয়ের বয়সী উর্যার ঘরে ওই যাতায়াত দেখে সব সমীকরণ কেমন যেন ওলট পালট হয়ে গেছে পলকে । মার্কণ্ডেয়কে কি ভাবে যে তখন ভালোলাগে মাহির সে এখন নিজেও বুঝতে পারেনা । মার্কণ্ডেয় হলো একটা বড়লোক বাবার বিগড়ানো জেদি ছেলে । চাইলে মাহি বেরিয়ে আসতে পারে সম্পর্ক থেকে বাধা দেবার কেউ নেই তবুও কেমন মায়া পড়ে গেছে ছেলেটার উপরে । আর সব বাজে ছেলেকে যদি মেয়েরা ছুড়ে ফেলে তা হলে সেই ছেলে গুলোকে সঠিক রাস্তাই বা কে দেখাবে ? মাহির পাপাজি আর বিজি খুব খুশি কারণ মার্কণ্ডেয় স্বর্ণ ব্যবসায়ীর একমাত্র ছেলে । রাগের মাথায় এনগেজমেন্ট এর জাস্ট আগে আগে ঝামেলা করে এখন কেমন অস্বস্তিতে পরে গেছে মাহি । মার্কণ্ডেয় কে না বললেই ভালো হতো কথাটা মনে হয় । এসব ভাবতে ভাবতে মাহি ভাবে একবার উর্যার সঙ্গে মিট করা যাক ওই বেটার বলতে পারবে । উর্যাকে গিয়ে ধরলো মাহি । মথুরা বাবু মাহির পরিচিত এটা না বলে এমনই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ওনাকে নিয়ে কৌতূহল দেখাতে লাগলো মাহি । উর্যা জানালো মথুরা বাবুর মত মানুষ খুব কম দেখা যায় । উনি যে ভাবে উর্যাকে সাহায্য করেন সেটা অবিশ্বাস্য । অনেকেই টাকার বিনিময়ে শরীর কিনতে আসে তাদের সাথে মথুরা বাবুর তুলনা চলে না । সব কিছু শুনে বেশ অনুতাপ হয় মাহির । না মানুষটার নিজস্ব ব্যক্তিগত চাহিদা থাকতেই পারে । মার্কণ্ডেয়র মা মহিলা বেশ আত্মসুখী বোঝাই যায় । শারীরিক চাহিদা থাকতেই পারে কারো , সেটা ঘরের মধ্যে না মিটলে দীর্ঘ দিন এক চাহিদা নিয়ে কি করে মানুষ বাঁচতে পারে ? আসল কথা হলো মথুরা বাবু কিন্তু চাইলেই দামি এসকর্ট ভাড়া করে দিন প্রতিদিন মেয়ে পাল্টে ফেলতে পারতেন । সেটা কিন্তু উনি করেননি , উল্টে যে রিক্ত স্থান ওনার স্ত্রীর উদাসীনতার কারণে তৈরি হয়েছিল সেটা উনি উর্যাকে দিয়েছেন । উপরন্তু ওকে যে ভাবে সাহায্য করেন সেটাও রেয়ার দেখা যায় । মাহি মার্কণ্ডেয়র সাথে প্যাচ আপ করবে বলে ওকে ফোন করে । দু একটা রিংয়ের পরই ফোনটা ধরে মার্কণ্ডেয় । মাহির কলটা পেয়ে যেন আকাশের চাঁদ পায় ও । ওরা বিগ বাজারের ফুড চেনে মিট করবে ডিসাইড করে আধা ঘন্টা পরে । মাহি ফুড জোনে ঢুকে দেখে মার্কণ্ডেয় বসে আছে অলরেডি । ব্ল্যাক শার্ট আর ব্লু ডেনিম প্যান্টে ভীষণ হ্যান্ডসাম লাগছে ওকে । ভিতরে একটা সিরসিরানি বয়ে যায় মাহির । দুজনের মধ্যে অনেকটা গাল গল্প হয় । তার পর মার্কণ্ডেয় জানতে চায় মাহির এই প্যাচ আপের কারণটা কি ? মাহি সবটা বলে ওকে , উর্যার ব্যাপারটাও বলে । সব কিছু শুনে মার্কণ্ডেয়র নিমেষে তিতকুটে লাগে কোল্ডকফির চুমুক । এবার রাগের মাথায় ফাক অফ ইউ ব্লাডি হোর বলে বেরিয়ে যায় মার্কণ্ডেয় । মাহি অবাক হয়ে যায় সুদর্শন উচ্চশিক্ষিত হয়েও কিভাবে মেয়েদের প্রতি এরূপ কদর্য মনোভাব পোষণ করে মার্কণ্ডেয় ? এই নিয়ে নিজের সাথেই নিজের অসম বোঝাপড়ায় লিপ্ত হয়ে যায় মাহি ।

এক সুদর্শন সুমুখের আড়ালে সুস্পষ্ট দেখতে কদর্য এক ব্যক্তিত্ব যেন ! এ যেন নিজের প্রেমিকের আসল আর নিখুঁত প্রতিরূপ । যার মধ্যে মিনিমাম আবেগ টুকুও নেই । মার্কণ্ডেয় হয়ত সেই মানুষ গুলোর দলে পরে যারা আবেগ-অনুভূতির নামে একটা সম্পর্ককে প্রায় ব্যবসার পর্যায়ে নামিয়ে আনে , আড্ডা ঠাট্টা তামাশার রসালো বিষয়বস্তু বানিয়ে ছাড়ে । নাহ , আর না ,এর বিহীত অবশ্যই দরকার । মাহি বেরিয়ে আসে ফুড জোন থেকে ওর গন্তব্য মথুরা বাবুর অফিস ।

বাইরে বের হতে গিয়ে দাঁড়িয়ে গেল মাহি । মার্কণ্ডেয় এখনো আছে এখানে তবে কোন বন্ধুর সাথে কথা বলছে । বন্ধুটি মার্কণ্ডেয়কে বলছে , কি মাল পটিয়েছিস ভাই ! এত পুরো বম্ব ! এতো ডাসা মাল পটালি কি করে ! তা বিয়ে থা করবি ? নাকি খেয়ে দেয়ে ছুড়ে ফেলে দিবি ভাই ?

মার্কণ্ডেয় দুটো বাজে গালাগালি ছুড়ে দিলো ছেলেটার দিকে । যতই হোক সে ভালোবাসে মাহিকে । ওদের তাকিয়ে নিজের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে মাহির । চুপচাপ ও বেরিয়ে যায় ওখান থেকে ।

উর্যার আর গুনগুনের জীবনটা থেমে গেছে এক জীর্ন চড়াতে এসে । যেখানে স্রোতের আশা নেই , ঢেউ নেই কোন চলমান গতি নেই । মথুরা বাবুকে গুনগুনের ভর্তির জন্য উর্যা জানালে উনি খুশি হয়ে জানান যে উনি শীঘ্রই গুনগুনকে ভর্তি করে দেবেন এক কনভেন্টে । সেই সঙ্গে ওর উচ্চশিক্ষার সকল প্রকার ব্যবস্থা ও করে রেখে দেবেন অগ্রিম । শুনে আস্বস্ত হয়েছিল উর্যা , যাক মেয়ের জন্য তো আর কোন চিন্তা রইল না । তার জন্য আজীবন জেলের বিনিময়ে রইল না হয় এই যৌনপল্লীর অন্ধ কূপ । এই কূপ হয়ত অন্ধকার , পঙ্কিলতা পূর্ন , অবৈধ তবুও যে নরকের কীটকে উর্যা মেরেছে তার জন্য জেলের কারাগার মেনে নিতে পারবে না শাস্তি স্বরূপ । সে তার যোগ্য শাস্তি পেয়েছিল তার জন্য উর্যাকে আইন কোন শাস্তি দিতে পারেনা । অথচ হয়ত এখান থেকে বাইরে গেলেই ও ধরা পড়ে যাবে । তাই মথুরা বাবুর হাজার বার করে অনুরোধ জানানো সত্ত্বেও ওনার সাথে এখান থেকে বেরিয়ে যেতে পারেনি উর্যা । অথচ মথুরা বাবু ওকে নিজের কলকাতার ভিলাতে রাখতে চেয়েছিলেন । এই গলি ঘুপচি দরমার বস্তি যেখানে সোজা হয়ে দাঁড়ানো পর্যন্ত যায়না অথচ উর্যা বাধ্য এখানে থাকতে । এদিকে আবার নতুন এক আসুরিক বৃত্তি উঁকি দিচ্ছে এলাকায় বিজলী মাসি যতদিন পর্যন্ত বেঁচে ছিলো এখানকার নিয়ম কানুন আলাদা ছিলো । কোন বেশ্যা আর তার সন্তান নিজে চাইলে তবেই এই ব্যবসাতে নিজেকে জড়াত বেশ্যার কন্যাটি । এখন বিজলী মাসি না থাকায় তার সিংহাসনে যে অধিকার পেয়েছে তার নাম রত্না , সে আগের সব নিয়মের পরিবর্তন ঘটিয়ে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করতে মরিয়া । এই কাদারোড বস্তিকে রাতারাতি দুগুন বাড়াতে এখানকার মেয়েদের নাবালিকা বাচ্চা মেয়েদের ব্যবসাতে নামাতে উদ্ধত সে । এই সেদিন কাঁচুলির তেরো বছরের মেয়েটাকে জোর করে টেনে নিয়ে এলো রত্না মাসি এই নরকে । এখানকার রীতি অনুযায়ী কোন কুমারী মেয়ের প্রথম খদ্দের ধরার দিনকে পালন করা হয় ধুমধাম করে । এই অনুষ্ঠানকে বলা হয় নথ তোরনি আচার । নিলামের মতো মোটা অংকের অর্থর বিনিময়ে কোন এক পুরুষ কিনে নেয় কুমারী মেয়েটির প্রথম রাত আর তার সতীত্ব । বিছানায় রক্তাক্ত হয় এক শৈশব , রত্নার অর্থের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় দ্রুত ।

রত্না মাসি এলাকার দশ এগারো বছরের মেয়েদের এখন থেকেই তালিম দিতে নিজের কাছে নিয়ে যাচ্ছে রোজ । ওদের হয়ত এক দুবছরের মধ্যেই নামিয়ে দেবে ব্যবসায় । একফাঁকে উর্যাকেও বলে গেছে মাসি , সে গুনগুনকে খিচুড়ির স্কুলে পড়াচ্ছে সে ভালো কথা কিন্তু এটা যেন না ভাবে যে এই বেশ্যাপট্টি থেকে বার করে অন্যত্র কোথাও চালান করবে । তার ফল খুব একটা ভালো হবে না । উর্যা বোঝে এটা একটা প্রচ্ছন্ন হুমকি ছাড়া আর কিছুই না । মাসির শকুনের নজর এই তিন বছরের মেয়েটার দিকেও । তবে কি মাসি কিছু কানাঘুষা শুনলো মথুরা বাবুর আর উর্যার কথা ? মাসি কি জানতে পেরে গেল যে উর্যা গুনগুনকে বোর্ডিং পাঠাতে চাইছে ? কিন্তু উর্যা তো বাধ্য নয় তার মেয়েকে এ পেশায় আনতে ? কেন আনবে সে ? না যে ভাবেই হোক গুনগুনকে এখান থেকে দূরে সরিয়ে দিতেই হবে ওকে । পরিস্থিতি উর্যার সাথে যা করার করেছে সেটা আর দ্বিতীরবার গুনগুনকে সইতে দেবে না ওর মা ।

জানালার বাইরে চোখের সামনে ভেসে থাকা উজ্জ্বল চাঁদের অবয়বটা ঘন কালো মেঘে ঢাকা পড়ছে ক্রমশ , যেমনটা প্রস্ফুটিত ব্যক্তিত্ব চাপা পড়ে কদর্যতার আড়ালে , প্রবঞ্চনার পরতে , উর্যার ভিতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে ।বাইরে এলাকার দালাল কাম রত্না মাসির পোষা গুন্ডা পলাশ আর নান্টুর গলা ... শুনছিস নতুন চিড়িয়ার নেশা কেটে গেলে আমাদেরকেও টেস্ট করতে দিবি কিন্তু ভাই ..

রাত সাড়ে বারোটা বাজছে পরনের পোশাক ছেড়ে রংচটা নাইটিটা পরতে পরতে সবটুকুই কর্ণগোচর হলো উর্যার , বাইরে থেকে ভেসে আসা কথাগুলো শুনে রাগে ঘৃণায় চোয়ালটা শক্ত হয়ে গেলেও ধৈর্য ধরে শুনতে লাগল চুপচাপ । ওরা ওই গতকাল নতুন একটি চোদ্দ পনেরো বছরের মেয়ে এসেছে তার কথাই বলছে নিজেদের মধ্যে । পলাশ ছেলেটার এটাই চালাকি , ও ভদ্র ঘরের ছেলে সেজে ভালো ভালো মেয়েদের জড়িয়ে ফেলে নিজের জালে । কখনো কাজ দেবার অছিলায় আবার কখন বিয়ে বা প্রেমের নামে হতভাগী গুলোকে এখানে এনে ফেলে । বিনিময়ে পলাশ মোটা টাকা পায় রত্নার কাছে । জানালার ওপ্রান্তে তখনও হাস্যচ্ছলে নিজের কীর্তি জাহির করে চলেছে নিজেকে পলাশ । নান্টু বলছে পলাশকে ...ওই মেয়েটা যদি বেশি বাড়াবাড়ি করলে কুচিয়ে ফেলে দেবো শালীকে , এতবার সতিপনা করার কি কোন দরকার আছে ! যতই হোক ধৈর্য বলেও তো কোনো জিনিস আছে নাকি ! " সেদিন রাতে নিয়ে এলি মালটাকে ধরে তারপর নথ তোরনি অনুষ্ঠান কমপ্লিট এর পরেও শালী বুঝতে পারছে না যে পলাশ তুই ওর সোয়ামী না দালাল ? যা শালা !

অফুরন্ত রসালো বার্তালাপে ঠাসা কথোপকথন কিছুক্ষণ পর থেমে যেতেই বদ্ধ জানলা খুলে একমনে বাইরের আকাশ দেখতে লাগলো উর্যা । পূর্ণিমার থৈ থৈ জ্যোৎস্নায় আলোকিত সমগ্র বিশ্ব চরাচর । নিজেকে বাঁচাতে একদিন উর্যা বেশ্যা হয়ে ছিলো আর ওই নতুন মেয়েটাকেও বাঁচতে হলে বেশ্যা হয়েই বাঁচতে হবে । বছরখানেক আগে ঊর্যাও তো স্বামী নামক এমনই এক প্রতারকের সান্নিধ্যে এসে সর্বস্ব হারাতে বসেছিল । ঋষির ওই বিশ্বাস ভাঙ্গার নিদারুণ কষ্টটা উর্যাকে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে , তা বলাই বাহুল্য , দিনদিন দেখা যাচ্ছিলো আপাতদৃষ্টিতে সম্পর্কটা দুতরফা হলেও আবেগনামার বিচারে যে একতরফাই বলা চলে । উর্যার ভালোবাসা অভিমান কখনো ধর্তব্যের মধ্যেই আনেনি ঋষি । বারবার উর্যা হাজার অত্যাচার সহ্য করে ও নিজের দিক থেকে সম্পর্ক বাঁচানোর চেষ্টার কসুর করেনি , কিন্তু ঋষিকে মেরে ফেলার আগে , শেষের দিকে একাকীত্ব নিঃসঙ্গতাকে আঁকড়েই বাঁচতে হয়েছিল ওকে ।

এই যে নাম না জানা মেয়েটা নিঃশর্ত বিশ্বাসের প্রতিদান স্বরূপ নিজের কুমারিত্ব বিলিয়ে দিয়েছে পলাশ নামক ঠগীর নিমিত্তে ।

যদিও ' কুমারী ' শব্দটা আজকাল বড্ড ক্লিশে , তারপরেও ওই মেয়েটার জন্য কি আর রইলো জীবনে ? নারী নাকি শক্তির উৎস ! শক্তির সিম্বল দূর্গা পুজো নাকি বেশ্যা ঘরের মাটি ছাড়া সম্পন্ন হয়না ? জানা নেই কে বা কারা এই নিয়ম কানুন চালু করেছিল তবে এই বেশ্যার ঘরের মাটিকে স্থান দিয়ে কি এটা তারা বোঝাতে চেয়েছেন যে বেশ্যাও শক্তি ? সেও শক্ত হাতে দমন করতে পারে ?

উর্যা তো আজীবন রক্ষণশীল পরিবারের বড় হয়েছে তারপর একটা শান্ত ভীরু মেয়ে তার হাতে অস্ত্র তুলে নিতে পিছপা হয়নি যখন প্রশ্ন এসেছে নিজের সন্তানের জীবনের । মাতৃত্ব নারীর মজ্জাগত আবেগ যা উপড়ে ফেলা বাস্তবে অতটাও সহজ নয় । সেটা পলাশ , নান্টু বা রত্না মাসীদের মতো ক্লিশে প্রাণীদের বোঝাতে গেলে শক্ত হাতে রাস ধরতেই হবে ।

উর্যা নিজের জীবন দিয়ে বুঝেছে কখনো কখনো মূল্যবোধকে বিসর্জন দিয়ে বেছে নিতে হয় সেই রাস্তাটাই যেখান থেকে কখনো আর ফেরা যায় না অথচ সে রাস্তা ধরে এগোতে না পারলে পিছনোও যাবে না। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে দ্রোণাচার্য যুদ্ধক্ষেত্রের ত্রয়োদশ দিনে চক্রব্যূহ রচনা করেছিলন। সেখানে অর্জুনপুত্র কিশোর অভিমুন্য অসীম বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করে শেষ পর্যন্ত সপ্ত বীরযোদ্ধার হাতে পাশবিকভাবে পরাস্ত হয় আসলে তাকে হত্যা করা হয়েছিল । হয়ত এই যে বাচ্চা মেয়েদের দিয়ে জোর করে সেক্স রাকেট রত্না মাসি চালাচ্ছে তাকে দমন করতে গেলে

অভিমুন্যর মতো উর্যাকেও এরা মেরে ফেলতে চেষ্টা করবে বাস্তব সমাজ জীবনে ও তো আদতে এরকম অসংখ্য সমাজ চক্রব্যূহ রচিত করে ! কখনো সবার লক্ষ্যে কখনো বা সবার অলক্ষে । চক্রব্যূহ ভেদ করার জন্য একত্রিত করতে হবে শক্তি । একটি সাধারণ মধ্যবিত্ত বাড়ির সাধারণ মেয়ের জীবনে কালের নিয়মে চক্রব্যূহের মধ্যে পড়ে তছনছ করে ফেলে নিজের জীবন । আবার সেই হয়ত বা পারে সবকিছুকে অতিক্রম করে পিশাচ দের থেকে নিস্তার পাওয়ার রাস্তা থাকে না অতিক্রম করার উপায় ? উথাল পাথাল চিন্তা করতে করতে দু চোখে ঘুম নেমে আসে তার ।

ঘুমের মধ্যে উর্যা দেখতে পাচ্ছে অতীত , তার শৈশব ... বাবা আর ঠাকুমা ... স্কুল ... ঋষির সাথে বিয়ে ...

কে যেন একটা অচেনা এগিয়ে আসছে ওর দিকে ! এটাতো মা ? মাকে উর্যা ছবিতেই দেখেছে ... সামনে থেকে দেখার জন্য তো ঈশ্বর তার মাকে পৃথিবীর বুকে রাখেননি । মা এসে বসেছে উর্যার পাশে .. মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করছে মা । উর্যার ভিতর দলা পাকা কষ্ট গুলো বুক ঠিলে উঠে আসছে । মা নিমেষে পরিবর্তন হয়ে গেল দেবী দুর্গার রূপে । সামনে বসে আছে জগৎজ্যোতি মা অদ্যাশক্তি । দেবীর হাতে ত্রিশূল, খড়্গ, চক্র, বাণ, শক্তি, ঢাল, ধনুক, ঘণ্টা, পরশু ও নাগপাশ । তিনি উর্যাকে বললেন ...

“একৈবাহং জগত্যত্র দ্বিতীয়া কা মামপরা। পশ্যৈতা দুষ্ট মধ্যেব বিশন্ত্যো মদ্বিভূতয়ঃ।।”-একা আমিই এ জগতে বিরাজিত। আমি ছাড়া দ্বিতীয় কে আছে? রে দুষ্ট, এই সকল দেবী আমারই বিভূতি। দ্যাখ্, এরা আমার দেহে বিলীন হচ্ছে।

উর্যা দেখে পৃথিবীর সব কিছুই দেবীর নিমিত্তে । তীব্র আলোর ছটা এসে দুচোখ ধাঁধিয়ে দেয় তার । ধড়মড় করে উঠে বসে উর্যা । সকাল হয়ে গেছে সে স্বপ্ন দেখছিল এতক্ষন । ঘামে ভিজে একাকার হয়ে গেছে সে , গলা শুকিয়ে কাঠ । বিছানা ছেড়ে নেমে আসে উর্যা , কুঁজো থেকে এক গ্লাস জল গড়িয়ে খায় । কেন ? এত বছর পর এভাবে নিজের মাকে বা মা থেকে দেবীতে ওই রূপান্তর কেন দেখলো সে ? ঈশ্বর কি কোন বার্তা দিতে চাইছে ওকে ? ওসব ভাববে পরে গুনগুনকে ঘুম থেকে উঠিয়ে কল তলার দিকে এগিয়ে যায় উর্যা । মেয়েটাকে স্কুলে দিয়ে আসতে হবে । আর মাত্র কটা দিন তার পর তো গুনগুন বোর্ডিং স্কুলে চলে যাবে । যে ভাবেই হোক রত্নার ছোবল থেকে মেয়েকে বাঁচাবে সে ।

একটা পরিত্রাহী চিৎকার শোনা যাচ্ছে কারো ? গুনগুনকে কলতলায় দাঁড় করিয়ে রেখে আওয়াজটার দিকে এগিয়ে যায় উর্যা । তার পর যেটা দেখে তার হার হিম হয়ে যায় ! ওই পলাশের নিয়ে আসা নতুন মেয়েটা দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুনে । সামনে দাঁড়িয়ে হাসছে রত্না মাসি আর পলাশ । বাকি সকলে নীরব দর্শক , উর্যা চিৎকার করে ওঠে , কেউ কম্বল এনে চাপা দাও ! আগুন নেভাও !

ওর গলা পেয়ে ঘুরে দাঁড়ায় রত্না মাসি ..শ্বাপদের মতোই পাশবিকতায় জ্বলজ্বল করছিল ওর চোখ দুটো । এরা ইচ্ছা করে নিজেরাই তো আগুন ধরিয়ে দেয় নি ? উর্যা ছুটে গিয়ে পাশেই থাকে নীলিমা , ওর কাছ থেকে একটা ছেড়া কম্বল নিয়ে পাগলের মত চিৎকার করতে করতে ছুটতে থাকা মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরে । আগুন নিভে কিন্তু অনেক দেরি হয়ে গেছে ততক্ষণে । মেয়েটা নাইনটি পার্সেন্ট বার্ন হয়ে গেছে । কাতরাতে কাতরাতে কোন মতে বললো , দিদি একটু জল ? উর্যা ইশারা করে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা নীলিমাকেই । ও ছুটে জল নিয়ে আসে । মেয়েটা এক ঢোক জল খায় । তারপর কাতরাতে কাতরাতে বলে , আমাকে কেন ওরা এভাবে মারলো ? কেন আমাকে এত কষ্ট দিলো দিদি ? আমার আগুন যখন তুমি নেভালে , আমার বদলাও কি তুমি নেবে ? আমার সারা শরীর জ্বলে যাচ্ছে গো ? জ্বলে যাচ্ছে । এটুকু পর্যন্ত বলেই মেয়েটি শেষ হয়ে গেল উর্যার কোলে । তখনো রত্না মাসি আর তার ছেলেরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছিলো । এবার মেয়েটা মরেছে দেখে একে একে সরে গেল । উর্যা ওকে বাঁচাতে গিয়ে নিজেও অল্প বিস্তর জখম হয়েইছে আগুনের লেলিহান শিখায় । এই কাল মেয়েটাকে বসে বসে কাঁদতে দেখেছিল উর্যা আর আজ সেই মেয়েই পুড়ে কালো আঙ্গার হয়ে উর্যার কোলেই পরে আছে । মরতে মরতে মেয়েটা কি বলে গেল ? এত বড় দায়িত্ব কোন বিশ্বাস থেকে সে দিয়ে গেল ? কাল রাতের স্বপ্ন আর আজ এই নিষ্ঠুর বাস্তব কি ইঙ্গিত দিচ্ছে উর্যাকে ? তবে কি আবার ঘুরে দাঁড়ানোর সময় এসেছে ? কিন্তু গুনগুন , ওর কি হবে ? চিন্তায় ছেদ পড়লো পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে গেছে । উর্যা মেয়েটার মৃত শরীরটা নামিয়ে উঠে পড়ে দ্রুত । পালিয়ে আসে সে মেয়েকে নিয়ে নিজের ঘরে , পুলিশের সামনে আসতে এখনো তার দ্বিধা বোধ হয় । মনে হয় এই যেন ধরা পড়ে যাচ্ছে । গুনগুনকে কোলে নিয়ে ঘরে ঢুকতেই মেয়েটা বমি করে ভাসিয়ে দেয় চারদিক । উর্যা মেয়েকে জল খাইয়ে একটু ধাতস্থ করে জিজ্ঞাসা করে তার কি শরীর খারাপ লাগছে ? গুনগুন জানায় মায়ের কোল থেকে পোড়া গন্ধ আসছে । পুলিশ এসে মেয়েটার বডি নিয়ে যায় আর রত্না মাসি ওদের জানায় , মেয়েটা আত্মহত্যা করেছে । এসব কেসের কোন তল্লাশি হয়না । বডিটা ওরা কালেক্ট করে নিয়ে গিয়ে মর্গে পাঠিয়ে দেবে আর সিম্পল সুইসাইড কেস নোট করে কেস ক্লোজ করে দেবে । তার জন্য একটা এমাউন্ট অবশ্য মাসি খাওয়াবে ওদের । এদিন বিকালে মথুরা বাবু এলেন তবে গুনগুনকে নিয়ে আলাপ আলোচনা করতে । উর্যা আর কোন মতেই মেয়েকে এখানে রাখতে সাহস পাচ্ছে না । তাই ইমার্জেন্সি কোটায় গুনগুনকে ভর্তি করতে মথুরা বাবু কাগজপত্র নিয়ে এসেছেন । সব লেখালিখি করে বাবার নামের কলমটা ফাঁকা রয়ে গেল দেখে মথুরা বাবু জিজ্ঞাসা করলেন গুনগুনের অভিভাবকের নাম কি দেওয়া হবে ? উর্যা মথুরা বাবুর হাত দুটো ধরে অনুরোধ করে গুনগুনের অভিভাবকের স্থানটা নিজের নাম দিয়ে পূরণ করতে । মথুরা বাবু জানায় তিনি তো আছেন সবসময়ই তবুও গুনগুন ওর মায়ের পরিচয়ে কেন বড় হবে না ? উর্যা সব খুলে না বললেও মথুরা বাবুকে জানায় এটা সম্ভব নয় ।

তার পর কথা প্রসঙ্গে সকালের ঘটনার কথা ওঠে । সব শুনে মথুরা বাবু বলেন , কেন বাকি মেয়েরা কিছু বলতে পারলো না রত্নাকে ?

উর্যা ফিকে হেসে বলে ওরা এরকম ছিলনা আগে ,জীবনের আঘাত গুলো ওদের এরকম করে দিয়েছে । বিজলি মাসির না থাকাটা আর রত্নার আসাটা যেন আমাদের হাতে শিকল বেঁধে দিয়েছে । একটা সংকীর্ণ গন্ডির মধ্যে বাঁধা থাকতে থাকতে ভীষণ রকম একককেন্দ্রিক,ভীষণ একসেরে হয়ে গেছে সকলে শুধু নিজেদের টুকু ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারেনা, অন্যের কষ্ট দুঃখ গুলো আর চোখেই পড়েনা । চোখে পড়লেই বা লাভ কি ? যে প্রতিবাদ করবে তাকেই তো মরতে হবে সকালের মেয়েটার মতো । হঠাৎ মথুরা বাবু বলে উঠলেন , আচ্ছা উর্যা বলতো জীবন মানে কি ? উর্যা ম্লান হেসে বলে , কি আবার খাও , মাখো আর বাঁচো । মথুরা বাবু বললেন , জীবন মানে হলো খেলা আর কোন যে সে খেলা নয় এ হলো ফুটবল খেলা । বারবার রেফারি হলুদ কার্ড দেখাবে তবু খেলো । ফাউল করা বা সাইডে যাওয়া আবার ল্যাং খেয়ে পড়ে যাওয়া । এভাবে মৃত্যু অবধি খেলা খেলতেই হবে ।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy