বাস্তবের রূপকথা
বাস্তবের রূপকথা
স্বপ্নের মত একটা বাড়ি।বিশাল বড় গেট।গেট দিয়ে ঢুকেই আটফুটের সিমেন্ট বাঁধানো একটা পাকা রাস্তা।রাস্তার দু'পাশে সবুজ লন।ডানদিকে একটা গ্যারেজ।প্রায়ই স্বপ্নে দেখে পারমিতা।বাড়িটা পরিচিত নয়।ছেলেবেলা থেকে ঠাকুমার কাছে রাজা,বাদশা,মন্ত্রী,সেপাই গল্প শুনতে শুনতে নিজেকে মনেমনে রাজকন্যা কল্পনা করে কোন ভাবের ঠিকানায় একটি রাজপ্রাসাদে বাস করতে করতে ঘুমাতে যেতো।কিন্তু কোনদিনও তার স্বপ্নে কোন রাজপ্রাসাদ আসেনি।এসেছে বাংলো প্যাটানের ছবির মত এই বাড়ি।পারমিতার খুব কাছের বন্ধু ঠাকুমা। ঠাকুমার সাথে সে সব কথা শেয়ার করে।ঠাকুমাকে এই স্বপ্নের কথা বললে তিনি বলেন,
--দেখবি দিদি ঠিক এইরকম একটা বাড়ির রাজকুমার এসে তোকে বধূবেশে তোর স্বপ্নে দেখা বাড়িটায় দামী গাড়ি করে নিয়ে যাবে।
একদিন কলেজ থেকে ফিরতে একটু রাতই হয়ে গেলো।কারন কলেজ ছুটির পর কিছু নোটস এর প্রয়োজনে পারমিতা দেবর্তিদের বাড়িতে গেছিলো।দেবোর্তি অনেকটা পথই তাকে এগিয়ে দিয়ে গেছিলো।বড় রাস্তায় বাসের জন্য দাঁড়িয়ে থেকে অনেকটা সময়ই চলে যায়।হঠাৎ এক বয়স্ক/বয়স্কা ভদ্রলোক ভদ্রমহিলা পারমিতাকে বলে একটা ট্যাক্সি ধরে দিতে তারা শ্যামবাজার চার মাথার মোড়ে নামবেন।পারমিতা অনেক চেষ্টা করে একটি ট্যাক্সি পায়।পারমিতার বাড়ির রাস্তাও একই।শুধু চার মাথার মোড় থেকে একটা অটো ধরতে হবে।ভদ্রলোক ভদ্রমহিলার পীড়াপীড়িতে সেও ট্যাক্সিতে উঠে বসে।ট্যাক্সিটা চার মাথার মোড় থেকে সামান্য এগিয়ে একটা বড় গেটওয়ালা বাড়ির সামনে থামে।পারমিতা চমকে যায় এই সেই বাড়ি --যে বাড়ি বহুবার সে স্বপ্নে দেখেছে।কিন্তু এতো রাতে অপরিচিত মানুষের বাড়ির ভিতরে ঢুকতে সে সাহস পেলোনা।তবে তাঁদের আশ্বাস দিয়ে আসলো খুব শীগ্রই সে আসবে।
পরদিন কলেজ যাবেনা ঠিক করলো।সকাল দশটা নাগাদই ওই বাড়ির উর্দেশ্যে সে রওনা দিলো।গেটে আজ সিকিউরিটি ।কিন্তু কাল রাতে যখন গাড়ি থেকে নেমেছিলো তখন তো গেটে কেউ ছিলোনা।এগিয়ে গিয়ে সিকিউরিটিকে গেট খুলতে বললো।পারমিতা খুব আশ্চর্য হল সিকিউরিটি তাকে কোন প্রশ্ন না করেই গেট খুলে দিলো।এতদিন সে যে বাড়িটাকে শুধু স্বপ্নে দেখেছে আজ সে সেটা চাক্ষুষ দেখছে।আনন্দ যেমন হচ্ছে মনের মধ্যে একটা ভয় ও আতংক কাজ করছে।বাড়ির সদর দরজা হাট করে খোলা।আস্তে আস্তে দোতলায় উঠে গেলো।বারবার সে মাসিমা,মেশোমশাই বলে ডাকতে লাগলো।কিন্তু কারও কোন সারাশব্দ পেলোনা।প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেলো।গলদঘর্ম হয়ে যখন ছুটে পালাবে ভাবছে তখন পিছন থেকে কেউ যেন বলে উঠলো,
---কাকে চায়?কোথা থেকে এসেছেন?
---আসলে কাল রাতে মাসিমা,মেসোমশাই আমাকে আসতে বলেছিলেন।
সুন্দর,সুপুরুষ ছেলেটি কথাগুলো শুনে চুপ করে গিয়ে পারমিতার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো।পারমিতাও যেন এতক্ষণে সম্বিত ফিরে পেয়ে ছেলেটির মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলো,'এই কি তবে ঠাকুমার বলা রাজকুমার?'
--হ্যাঁ কি যেন বলছিলেন,মাসিমা,মেসোমশাই এর কথা?উনারা তো এখানে থাকেননা,প্রয়োজনে আসেন।কালই উনারা ফিরে গেছেন।
প্রশ্ন অনেক ঘুরপাক খাচ্ছে পারমিতার মাথার মধ্যে কিন্তু কোনটাই করতে পারছেনা তার কারন এতো বড় বাড়িতে শুধুমাত্র এই একটিমাত্র মানুষের বাস শুনেই অজানা ভয়ে দিশেহারা হয়ে বেরিয়ে আসতে পারলেই বাঁচে।
---আচ্ছা তাহলে আমি আবার পরে আসবো।
---ঠিক আছে।
পারমিতা বেরোতে যাবে হঠাৎ তার কানে এলো ভদ্রলোক বললেন যে তোমাকে তো আসতেই হবে।পিছন ফিরে জানতে চাইলো,'কিছু বললেন?' 'কই নাতো।'
কোনোক্রমে সেদিন পারমিতা বাড়িতে পৌঁছালো।কাউকেই কিছু বললোনা।সারারাত ঠাকুমাকে জড়িয়ে ধরেই ঘুমোলো।
পরীক্ষা শেষ।পারমিতা মামাবাড়িতে ঘুরতে গেলো।সেদিনের পর থেকে সে আর ওই স্বপ্নটা দেখেনি যদিও এটা নিয়ে তার কোন মাথাব্যথা নেই।বেশ কিছুদিন মামা বাড়িতে হৈ হৈ করে কেটে গেলো।কিন্তু তাকে লুকিয়ে মামাবাড়ির সকলে যে ফোনে তার সম্মন্ধেই আলোচনা করছে এটা সে বুঝতে পারছে।কানাঘুষা চলছে।পারমিতাকে দেখলেই সব চুপ!জানতে চাইলে সকলে বলে,'ও অন্যকথা তোকে পরে বলবো।'
বাড়িতে ফিরে এসে জানতে পারলো তার বিয়ে ঠিক হয়েছে আগামীমাসে।ছেলে বিশাল ব্যবসায়ী, মস্তবড় বাড়ি,দূর্দান্ত দেখতে।সব কিছু শুনে সে তার ঠাকুমাকে বললো,'এটা-উঠ ছুড়ি তোর বিয়ে-তাই হচ্ছে না কি?আমার কোন মতামত নেই, আমার কোন পছন্দ নেই?আর তোমার যা ছেলে -কিছু বলতে গেলে আমায় কচুকাটা করে ফেলবে।'
--আমার ছেলের উপর ভরসা রাখ, তোর জন্য সে রাজপুত্র জোগাড় করেছে রে!তাকে দেখলে নিজেই হা হয়ে যাবি।
কিছুই করার নেই।হাত পা বাঁধা।ছাদনাতলায় শুভদৃষ্টির সময়ে সে যাকে দেখলো সত্যিই সে হা হয়েই গেলো।মাথাটা ঝিমঝিম করতে লাগলো।পিঁড়িতে বসার পর তার বরটি একটু ঝুঁকে তাকে জানালো,'যেসব প্রশ্নগুলো মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে একটু সময় দাও সব উত্তর আমি দিয়ে দেবো।'
পারমিতা ড্যাবড্যাব করে তার রাজপুত্র বরটির দিকে তাকিয়ে থাকলো।
শিল্পপতি অসিত মুখার্জী তার পাঁচ বছরের ছেলে ও বৌকে নিয়ে প্রতিবছরই ঘুরতে বেরোন।তখন ব্যবসার কাজ দেখেন বাবা নিজ হাতে।বংশপরম্পরা বিশাল পারিবারিক ব্যবসা।বহুবার তিনি দার্জিলিং গেছেন কিন্তু দার্জিলিঙের ওই সবুজ বনানী আর পাহাড় যেন তাকে বারবার ডাকে।তিনি এই ডাককে কিছুতেই উপেক্ষা করতে পারেননা।তাই এক দুবছর অন্তরই তিনি সেখানে ছুটে যান।আর এই যাওয়াটাই তার জীবনের কাল হোল।বিশাল এ্যাকসিডেন্ট!একটি গাড়ি আর একটি গাড়িকে পাশ কাটাতে গিয়ে সোজা গাড়িটি চলে গেলো কয়েক হাজার ফুট নীচুতে।কিছু একটা ঘটতে চলেছে বুঝতে পেরে মুহূর্তে গাড়ির দরজা খুলে ছেলে অনিন্দ্যকে রাস্তার উপরেই ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেন।অসিতবাবুর দেহ উদ্ধার হলেও তার স্ত্রীর নলিনীকে আর খুঁজে পাওয়া যায়না।অনিন্দ্যর প্রচুর আঘাত লাগে।বাঁচার আশা ছিলো ক্ষীণ।একমাস হাসপাতাল থাকতে হয়।নানানভাবে অনুসন্ধানের পর অনিন্দ্য যখন পুরোপুরি সুস্থ্য হয় তখন তার দাদু,ঠাকুমা তাকে খুঁজে পান।দাদু তাকে ছোটবেলা থেকেই ব্যবসা সংক্রান্ত খুঁটিনাটি বুঝাতে থাকেন।অতি অল্প বয়সেই সে সব ব্যপারে পারদর্শী হয়ে ওঠে।তারা প্রায়ই অনিন্দ্যকে বলতেন,'তোমাকে বিয়ে দিয়ে সংসারী করে তবে আমাদের ছুটি।এর আগে যে মরেও শান্তি পাবোনা।'কিন্তু বিধাতা তাদের কাউকেই সে সুযোগ দিলেননা।মাত্র ছ'মাসের ব্যবধানে দু'জনই তাদের আদরের বাইশ বছরের অনিন্দ্যকে রেখে চিরতরে চলে গেলেন।পাড়াপ্রতিবেশীর সাথে খুব একটা মেলামেশা না থাকলেও অনিন্দ্যর কানে বহুবার এসছে যে তারা দুজনকেই নাকি একসাথে রাতবিরেতে দেখতে পায়।সে নিজেও এর প্রমান যে পায়নি তাও নয়।চিরতরে চলে গিয়েও অনিন্দ্যকে সংসারী করতে তারা ছিলেন বদ্ধপরিকর।অনিন্দ্যর জন্য যোগ্য পাত্রী খুঁজে তার বিয়ের ব্যবস্থা করেই তারা তাদের নিজেদের মুক্তি নিজেরাই করে নিয়েছেন।
ফুলশয্যার রাতে এই বিশাল কাহিনী শুনে পারমিতা আরও সরে গিয়ে একেবারে অনিন্দ্যর গা ঘেসে বসে।মুখ শুকিয়ে পুরো আমসি।অনিন্দ্য বুঝতে পেরে হেসে পরে বললো,'ভয় পেয়োনা গো।দাদু,ঠাকুমাকে আর কোনদিনও দেখা যাবেনা।আমি তাদের এতো আদরের নাতী,চিরতরে চলে গিয়েও আমাকে সংসারী করার জন্য এতদিন ঘুরে বেড়িয়েছেন।আজ আমি সংসারী।আর তাদের কোন ভয় নেই। আমার মা,বাবার কাছে কোন জবাবদিহি আর করতে হবেনা।