বার্থডে গিফ্ট
বার্থডে গিফ্ট


— বাপি আমি মামন (সৌমির ডাকনাম) বলছি।
— বল সোনা এতো সকালে তোর ফোন। তুই ঠিক আছিস তো মা?
—ওহ্ বাপি তুমি তো জানো আমার মামণি থাকতে আমার কোনোকিছু হবে না। আই অ্যাম ফাইন। আমি শুধু তোমাকে একটা কথা বলার জন্য কল করেছি। তুমি এবার আমার বার্থডের গিফ্টটা প্লিজ কিনে আনবে না।
—কেন রে?আমি তো জানি তুই কি ভালোবাসিস।
—প্লিজ, প্লিজ আমার রিকোয়েস্টটা রাখো। আমি এবার তোমার থেকে একটা স্পেশাল গিফ্ট নেবো।
—প্রতিবারের মতো এবারও সৌগত মেয়ের বায়নার কাছে পরাজিত হয়ে বলল 'ওকে ডিয়ার, তাই হবে। আর এবার আমি একটু বেশিই ছুটি নিয়ে আসছি।’
—থ্যাংকস বাপি। বাই বাই। মামণি ডাকছে।
ফোনটা রেখে দেওয়ার পর সৌগত মনে মনে ভাবতে লাগলো সৌমি হওয়ার সময় সে আর রূপা এই আগত সন্তানকে নিয়ে কত স্বপ্নই না দেখেছিল। কিন্তু সৌমি হওয়ার সাতদিন পরে যখন একটা ইন্টারনাল হ্যামারেজের জন্য রূপার খুব বেশি ব্লিডিং-এর ফলে রূপা তাকে ছেড়ে চলে গেল তখন সৌগতর সব স্বপ্ন ভেঙে তছনছ হয়ে গেল, দিশেহারা হয়ে পড়ল সে এইভেবে যে কি করে ঐ ছোট্ট সাতদিনের শিশুকে সে মানুষ করবে।
সৌগতর বাবা-মা তার বিয়ের আগেই গত হয়েছেন। আর রূপার থাকার মধ্যে আছে তার মা আর নিপা—রূপার ছোটো বোন। কিন্ত নিপারও তো বিয়ে হবে কয়েক বছরের মধ্যে তখন কি রূপার মার পক্ষে একা সৌমিকে মানুষ করা সম্ভব হবে!
কিছুদিনের মধ্যে রূপার শ্রাদ্ধানুষ্ঠান মিটে গেলো। এবার তো নিপা ও তার মা নিজেদের বাড়ি চলে যাবে কিন্তু সদ্যোজাত মাহারা শিশুটিকে সৌগতর কিছুতেই অন্যের হাতে তুলে দিতে মন চাইলোনা। যদিও সবাই বলেছিল যে তার উচিত আর একটা বিয়ে করা। কিন্তু যে সন্তানকে নিয়ে তারা এতো স্বপ্ন দেখেছিলো তাকে সৎ মার হাতে তুলে দেবে? কিছুতেই না। আর সেও কি আর কাউকে তার জীবনে রূপার জায়গা দিতে পারবে? কখনোই পারবে না।
এইসব চিন্তাগুলো যখন তার মনের মধ্যে অস্থিরতা তৈরি করছিল তখনই প্রতিমাদেবী মানে রূপার মা রাতে সৌগতকে খেতে দেওয়ার সময় বললেন,
—তোমাকে একটা কথা বলার ছিল বাবা।
—হ্যাঁ বলুন না মা।
—মানে তুমি কিছু মনে করবে নাতো?
—মনে করবো কেন? এতো সংকোচের কিছু নেই। আপনি আমাকে সবসময় নিজের ছেলের মতোই স্নেহ করেছেন আর আমিও আপনাকে নিজের মায়ের মতোই মনে করেছি। আজকে আপনার মেয়ে না থাকার জন্য কি সব সর্ম্পক শেষ হয়ে যাবে? আপনার যা বলার আপনি নিঃসঙ্কোচে বলতে পারেন।
প্রতিমাদেবী একটু আশ্বস্ত হয়ে বললেন,
—দ্যাখো বাবা নিপা বলছিল ও কিছুতেই রূপার এই শেষ চিহ্নটাকে অন্যের হাতে তুলে দিতে পারবে না। তুমি তো জানোই ওদের দুই বোন পিঠোপিঠি হওয়াতে ওরা দুই বন্ধুর মতো ছিল। আর আমিও ভেবে দেখলাম নিপার বিয়ে হতে তো এখনো কয়েকবছর বাকি আছে। আর তখন বাচ্চাটাও একটু বড়ো হয়ে যাবে। তখনকার অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করা যাবে। তাই এখন বাচ্চাটাকে আমরা আমাদের সাথে নিয়ে যেতে চাই। আর তুমি তো অফিসের কাজে বেশিরভাগ সময়ই শহরের বাইরেই থাকো। তবে অবশ্যই যদি তুমি রাজী থাকো তবেই।
এতোক্ষণ সৌগত সব চুপ করে শুনছিল। এবার সে বলল,
—মা এর থেকে ভালো কথা তো আর কিছুই হতে পারেনা। তবে মা আমি বলছিলাম যে মামনকে আপনাদের সাথে না নিয়ে গিয়ে আপনারাই যদি এইবাড়িতে এসে থাকেন তবে বেশি ভালো হয় কারণ শহরের দিকে থাকলে বাচ্চাটার ক্ষেত্রে সুবিধা হবে। আর আপনাদের বাড়িটা বিক্রী করে পুরো টাকাটাই নিপার নামে ব্যাঙ্কে জমা করে দিন ওর বিয়ের সময় কাজে লেগে যাবে। বাবা মারা যাওয়ার পর যেটুকু সঞ্চয় ছিল তা তো দুই মেয়েকে মানুষ করতেই শেষ হয়ে গিয়েছে।
প্রতিমাদেবী সব শোনার পর বললেন,
— তুমি যেটা বলবে সেটাই হবে। তুমি ছাড়া আমাদের আর কে আছে বলো? মেয়েটা তো অসময়ে আমাদের ফাঁকি দিয়ে-----
এই বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়লেন প্রতিমাদেবী।
শেষ পর্যন্ত সৌগতর কথা মতোই কাজ হয়েছিল। আর তারপর দেখতে দেখতে সাত বছর পার হয়ে গিয়েছে। সামনের সপ্তাহে সৌমির সাত পূর্ণ করে আট বছরে পা দেবে।
এই সাত বছরে নিপা আর সৌমির একে অপরকে ঘিরে একটা আলাদা জগৎ গড়ে উঠেছে। ইতিমধ্যে যতবার নিপার বিয়ের কথা উঠেছে ততবারই সে নানা অজুহাতে তা এড়িয়ে গিয়েছে। বলেছে,
—মা তুমি আর সৌগতদা সবসময় একই কথা বলোনা। কতবড় হয়েছে মামন? একটা সাতবছরের বাচ্চাকে ছেড়ে আমি স্বার্থপরের মতো বিয়ে করে নেবো। আর বিয়ে করে তো সেই সংসার আর সন্তানই মানুষ করবো। তোমাদের কি মনে হয় আমি মামনকে জন্ম দিইনি বলে কি আমি ওকে নিজের সন্তানের থেকে কিছু কম ভালোবাসি। আর যদি কোনোদিন আমার নিজের সন্তান হয়ও তবুও তাকে আমি মামনের থেকে বেশি ভালোবাসতে পারবোনা এটা জেনে রাখো।
—কিন্তু তোমার তো নিজস্ব একটা জীবন আছে, চাওয়া-পাওয়া আছে নিপা।
—প্লিজ সৌগত দা আপনার কি মনে হয় আমি অসুখী আছি? দিদি চলে যাওয়ার পর আমি যখন ছোট্ট মামনকে মানুষ করার দায়িত্ব নিয়েছিলাম তখন থেকেই ওকে ঘিরে আমার জগৎ গড়ে উঠেছে আর সেখান আমি খুব সুখে আছি। জানি আমি মামনের জীবনে কখনোই হয়তো দিদির জায়গা নিতে পারবো না আর সেটা আমি চাইওনা। আমি শুধু চাই দিদি ওকে নিয়ে যা যা স্বপ্ন দেখেছিল সেগুলো পূরণ করতে।
—কিন্তু যখন আমি থাকবোনা নিপা তখন তোকে কে দেখবে বল?
—মা তুমি যখন থাকবেনা তখন আমার মামন সোনা আমায় দেখবে। কিরে দেখবি তো মামন?
মামনও খুব খুশি হয়ে নিপার গালে একটা হামি খেয়ে, গলা জড়িয়ে বলল,
—নিশ্চয়ই দেখবো মামণি। তুমি আমাকে ছেড়ে মামমামের মতো কক্ষণো চলে যাবে না।
ব্যাস আর কি। সব আলোচনার সমাপ্তি ঘটলো।
জন্মদিনের দুদিন আগে সৌগত বাড়ি এলো। প্রতিবছরই খুব আড়ম্বর করে মেয়ের জন্মদিন পালন করে থাকে সে।
বাবাকে দেখেই একগাল হেসে মামন দৌড়ে এসে তার বাবার গলা জড়িয়ে ধরলো। সৌগতও অনেকদিন পর মেয়েকে পেয়ে খুব খুশি। নিপা এতক্ষণে ড্রয়িংরুমে এসে পর্দার আড়াল থেকে বাবা আর মেয়ের আদর আহ্লাদ দেখছিল। সে বুঝতেই পারেনি যে মামন কখন তার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। তার স্তম্ভিত ফিরল যখন মামন তার হাত ধরে টেনে এনে সৌগতর সামনে দাঁড় করালো।
—একি নিপা তোমার চোখে জল কেন?
নিপা বুঝতে পারেনি নিজের অজান্তেই কখন তার চোখে জল চলে এসেছে। সে তাড়াতাড়ি চোখ মুছে বলল ও কিছু না।
—ডোন্ট্ টেল লাই মামণি। বাপি জানো মামণি মাঝে মাঝেই এরকম কাঁদে যখনই দিম্মা মামণির বিয়ের কথা বলে তখনই কাঁদে। আর সেদিন তো দিম্মার কোন ফ্রেন্ড এসেছিল সে বলছিল তার ছেলের সাথে মামণির বিয়ে দেবে। সেদিন থেকে মামণি আরো ক্রাই করছে।
এই বলেই মামন কাঁদতে শুরু করলো আর সৌগতর গলা জড়িয়ে বলতে লাগলো,
—বাপি ওরা কেন বোঝে না আমি মামণিকে ছাড়া থাকতে পারবোনা আর মামণিও আমাকে ছেড়ে যেতে চায় না। তাইতো আমি ঠিক করলাম এইবছর আমার বার্থডেতে আমি তোমার কাছে মামণিকেই গিফ্ট চাইবো। বাপি প্লিজ ডু সামথিং। মামণিকে কোথাও যেতে দিওনা। প্লিজ, প্লিজ----
সৌগত নিপার মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মেয়ের চোখের জল মোছাতে মোছাতে বলল,
—তুই যা চাইবি তাই হবে মামন। তোর মামণিকে কেউ তোর থেকে আলাদা করতে পারবেনা। এবার তুই খুশি তো?
—ঠিক তো বাপি?পাক্কা প্রমিস?
—ইয়েস মাই ডিয়ার।
এতক্ষণে মামন খুশি হয়ে বাপি আর মামণিকে দুটো হামি দিয়ে বলল,
—যাই আমি দিম্মাকে বলে আসি।
এই বলে সে দৌঁড়ে চলে গেলো।
সৌগত নিপার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল,
—জানিনা তোমার মনে কি আছে? তবে তোমাকে রূপার জায়গা দিতে না পারলেও আমি এতোদিনে বুঝে গিয়েছি যে রূপার পর যদি কেউ মামনের মায়ের জায়গা নিতে পারে সে শুধু তুমি। এতদিন তুমি আমার মেয়ের দেখাশোনার দায়িত্ব নিয়েছিলে আর যদি তোমার আর মায়ের আপত্তি না থাকে তাহলে আমি সারাজীবনের জন্য তোমার দায়িত্ব নিতে চাই।
পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে দিদা আর নাতনি দুজনেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।