Pronab Das

Horror

2  

Pronab Das

Horror

বাগানবাড়ীর ভয়।

বাগানবাড়ীর ভয়।

6 mins
636


     আমাদের গ্রামের নাম বীরনগর। অঞ্জনা নদীর তীরে ছবির মত সুন্দর। আদর্শ গ্রাম বলতে যা বোঝায় ঠিক সেই রকম। গ্রামের লোক সংখ্যা খুব বেশি নয়। বেশিরভাগই জেলে নয়তো চাষী। গ্রামের মাটি নদীর পলিতে বেশ উর্বর, তাই চাষ-আবাদ খুব ভাল হয়। বাবার মুখে শুনেছি কয়েক পূর্বপুরুষ ধরে আমরা এখানে বসবাস করছি। একসময় এই গ্রামে নীল চাষ হত। ইংরেজ আমলের দু একটা ভাঙা নীল কুঠি, চার্চ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। একসময় এই নীলকর সাহেবদের অত্যাচার আমাদের পরিবারের ওপরও পড়েছিল । আমাদের প্রধান জীবিকা চাষবাস। গ্রামের শেষপ্রান্তে আমাদের বাড়ি। নদীর কাছাকাছি আমাদের কয়েক বিঘা জমি আছে। সেখানেই চাষবাস হয়। নদীর চর বরাবর দাক্ষিণ দিকে জমিদার হারু ঘোষের পরিত্যক্ত প্রকান্ড দালান বাড়ি। বিঘার পর বিঘা গাছপালা আর ফলের বাগান। সবই অনাদরে অসহায়ের মত একপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে। সূর্য অস্ত গেলে ভয়ে ওদিকে কেউ মারায় না। বিকেলের পরে ভুল করে কোন চোর, ডাকাত, ভবঘুরে বা কোন গবাদী পশু যদি হারু ঘোষের সীমানায় প্রবেশ করে, পরদিন তার ক্ষত বিক্ষত প্রাণ হীন দেহ তাঁর সীমানার বাইরে পরে থাকতে দেখা যাবে। এমন ঘটনা আগে আকছার ঘটত। এখন কিছুটা কমেছে। গ্রামের মঙ্গলের হেতু মোড়ল - মাতব্বররা জাগ-যজ্ঞ, পূজা-অর্চনা করে মন্ত্রপুত বড় শাল খুঁটির সাথে কাঁটা তারের বেড়া বেঁধে দিয়েছে। অশুভ শক্তি যাতে বাইরে বেরিয়ে এসে অত্যাচার না করতে পারে।এসব সত্ত্বেও আপাত শান্ত এই গ্রামের গ্রামবাসী আষাঢ় মাসে ভয়ানক আতঙ্কে কাটায়। এই সময় ওই দুষ্টআত্মার ক্ষমতা খুব বেড়ে যায়। ওই মাসে কখনও কখনও বেড়া ডিঙিয়ে ওই দুরাত্মা লোকালয়ে এসে ক্ষতিসাধন করে। মানুষ তো বটেই গবাদিপশুও রেয়াত পায়না অভিশপ্ত ভয়ংকর আত্মার হাত থেকে। 

 

       এক সময়ে এই গ্রামের এক জমিদার ছিলেন মনোহর চৌধুরী। প্রজাবৎসল দয়ালু মনের মানুষ ছিলেন তিনি। হারু ঘোষের পিতা বীরবল্লভ ঘোষ ছিল জমিদার মনোহর চৌধুরীর খাস লেঠেল। বীরবল্লভ ঘোষ লেঠেলের দায়িত্বের এর সাথে সাথে জমিদারের বিশাল খাটালের দায়িত্ব সুচারু ভাবে সামলাত।

 

       সময়টা তখন ইংরেজ আমলের। জব চার্নকের সুতানুটি গোবিন্দপুর ও কলকাতা ও এর সন্নিকটে যে আটত্রিশ গ্রামে কোম্পানির হয়ে ব্যাবসা করার অনুমতি পেয়েছিল এই গ্রাম তার মধ্যে একটি। যদিও জমিদারের সাথে ইংরেজদের সম্পর্ক খুব একটা মধুর ছিল না। একপ্রকার চাপে পরে তাদের সাথে সম্পর্ক রেখে কোনমতে জমিদারির কাজ কর্ম চালিয়ে যাচ্ছিল। বিদেশের বাজারে নীলের অত্যাধিক চাহিদার জন্য বেশ কিছু ইংরেজ ও ফরাসী সাহেব কোম্পানীর চাকুরী ছেড়ে ব্যক্তিগত ভাবে বিনা রাজস্বে নীল চাষ ও ব্যবসা করত। খাজনা তো দিতোই না। এ নিয়ে জমিদার মনোহর চৌধুরীর সাথে সাহেবদের প্রায় রোজই অশান্তি হত। এমন কোন মাস ছিল না যে মাসে জমিদারের লেঠেলের সাথে নীলকর সাহেবের কর্মচারীদের সাথে হাতাহাতি, লাঠা লাঠি হয়নি। বীরবল্লভ ঘোষের দুর্ধর্ষ লেঠেলের জন্য নীলকর সাহেবদের বিভিন্ন রকমের অসুবিধার সম্মুখীন হতে হচ্ছিল। লেঠেল বীরবল্লভ ঘোষকে কোন মতে বাগে আনতে না পেরে সুকৌশলে তাকে হত্যা করে। হারু বীরবল্লভ এর স্থলাভিষিক্ত হয়। সাহেবরা তলে তলে হারুর সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে। প্রথম দিকে সে বেঁকে বসলেও জমিদারীত্বের প্রলোভন দেখিয়ে তাঁরা হারু কে এক প্রকার কিনে ফেলে। বীরবল্লভ এর মৃত্যুতে অসুস্থ জমিদার মনোহর চৌধুরী দিশাহীন হয়ে পরে ও কয়েক মাসের মধ্যে সিঁড়ি থেকে পড়ে মারা যান। কানাঘুষায় শোনা যায় জমিদারের মৃত্যুতে লেঠেল হারুর প্রত্যক্ষ হাত রয়েছে। নীলকর সাহেবদের মদতে হারু জমিদার মনোহর চৌধুরীর সব কিছু দখল করে, নিজেকে বীরনগর গ্রামের নতুন জমিদার হিসেবে ঘোষণা করে। যারা জমিদারের বিশ্বাসভাজন ছিল তাদের কয়েক জনকে সে হত্যা করে ও কিছু মানুষ কে গ্রাম থেকে বিতাড়িত করে। হারুকে জমিদার স্বীকৃতি দিয়ে নীলকর সাহেবরা আরও অত্যাচারী হয়ে ওঠে। ক্রমে মনোহরের বাগান বাড়ি নীলকর সাহেবদের ফুর্তির জায়গা হয়ে ওঠে। রাতের আঁধারে গ্রামের মহিলাদের জোর করে তুলে নিয়ে যাওয়া হত জমিদার বাড়িতে নয় বাগান বাড়িতে। এমনকি দিনে দুপুরে গ্রামের মহিলাদের কোনরূপ সুরক্ষা ছিল না। এরই মধ্যে গ্রামে এক ভয়ানক ঘটনা ঘটে যায়। গ্রামের জাগ্রত, ডাকাত কালিমন্দিরের পুরোহিত রণচন্ডী বারুজ্যে মহাশয়ের চতুর্দশী বয়সী মেয়ে দেবীকে কে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। গ্রামের সবাই সর্বত্র তন্ন তন্ন করে খুঁজতে লাগল। এমন কি হারু নিজেও গ্রামের মান্যগন্য পুরোহিত বারুজ্যে মশাই কে অভয় দিয়ে এসেছ। কিন্তু তিন দিনপর গ্রামের লোকেরা যখন দেবীর বিবস্ত্র মৃতদেহ জমিদার বাড়ির কাছে অঞ্জনার একটি ঘাটে ভাসতে দেখে, তখন কারোরই আর বুঝতে বাকি থাকে না যে দেবীর মৃত্যুতে কার হাত থাকতে পারে। মুহ্যমান পুরোহিত মশাই কন্যার শোকে, দুঃখে, রাগে এক প্রকার পাগল হয়ে গ্রাম ছেড়ে কোথায় যেন চলে যায়।  

 

         এই ঘটনার বেশ কয়েক দিন পর যে অতিপ্রাকৃতিক ঘটনাটি জমিদার বাড়ি ও তৎসংলগ্ন বাগান বাড়িতে ঘটে যায়, তার জন্য গ্রামের মানুষ জন বিন্দু মাত্র প্রস্তুত ছিল না। হঠাৎ ই প্রচার হয় যে হারু ঘোষের বাড়ি ও তৎ সংলগ্ন এলাকায় এক অশরীরীর উৎপাত ঘটেছে। রাতের দিকে এক নারী মূর্তি বাড়ির এদিক সেদিক ঘুরতে দেখা গেছে। পাহারাদারের কয়েক জন ওই নারী মূর্তির সম্মুখীন হয়ে অজানা এক আতংকে প্রাণ বাঁচাতে কাজ ছেড়ে পালায়। তারা ঠিক কি দেখেছে সেটা কারও কাছে বিশেষ স্পষ্ট ছিল না। হারুর কানে যে এসব পৌঁছায়নি তা নয়, এগুলিকে স্রেফ গুজব বলে উড়িয়ে দেয়। সে নিজে একজন বলশালী সুপুরুষ। নিয়ম করে দুবেলা ডন বৈঠক ও মুগুর ভাজে। সামান্য এক অশরীরীর ভয়ে হারু ঘোষ ভয় পেয়ে যাবে ?.........হারু স্বাগতোক্তি করে মুচকি হাসে।

 

      আষাঢ়ের এক বর্ষামুখর রাত। হারুর বাগান বাড়িতে মজলিস বসেছে। বাইরে থেকে বিশিষ্ট গাইয়ে ও নৃত্যশিল্পীরা এসেছে। এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সাথে সাথে কয়েক জন নীলকর সাহেবও সেখানে উপস্থিত। দু জন সুন্দরী রমণী চাদির পাত্রে সূরা পরিবেশনে ব্যাস্ত। অনেক রাত পর্যন্ত চলল নাচ গান। সাথে চলল দেদার রঙিন পানীয়। হারু আকণ্ঠ সূরা পান করে নর্তকী দের সাথে উন্মত্ত আচরনে মেতে ওঠে। অতিকায় ঝাড়বাতির নীচে সুরেলা ধ্রুপদী সংগীতের মূর্ছনা, ঘুঙুরের শব্দ, দামী সূরা ও তামাকের ধোঁয়ায় বুঁদ হয়ে উপস্থিত সবাই একটা অদ্ভুত নেশার পরিবেশে অবদ্ধ হয়ে পরে। মধ্য রাত পর্যন্ত চলে আমোদ প্রমোদ, হৈ হুল্লোড় - এরপর একে একে অতিথিরা মজলিস ছাড়ে। হারু কয়েক জন ব্যক্তিগত মাতাল পেয়াদার সাথে ওখানেই থেকে যায়। সূরার গ্লাস শেষ হতেই হারু বিরক্তিসূচক কণ্ঠে রমনীদের সূরার জন্য হাক দেয়। কিঞ্চিৎ অপেক্ষার পর সূরা না পেয়ে উন্মত্ত হারু চিৎকার করতে থাকে।পরমুহূর্তেই নিস্তব্ধ নিশুতি রাতের নিস্তব্ধতা চিরে ছম.... ছম..... ঘুঙুরের শব্দ করে এক রমণী চাদির ট্রে তে সূরার বোতল নিয়ে তাঁর দিকে এগিয়ে আসে। হারু গালিচাতে আধ শোওয়া অবস্থায় খালি পেয়ালা বাড়িয়ে দেয় ওই রমণীর দিকে। ঢুলু ঢুলু চোখে ধীরে ধীরে হারু রমণীর পানে মুখ তোলে, মুহূর্তেই হারুর হাত থেকে সূরার পেয়ালা ছিটকে পড়ে। ভয়ে চিৎকার করে বলে,... "কে,......কে তুমি?.... রণচন্ডী বারুজ্যের মেয়ে না তুমি?...এ অসম্ভব!!!...এ অসম্ভব!!!....."

 

         রমণী খিল খিল করে অট্টহাস্য করে হারুর দিকে তার দিকে রক্ত মাংসহীন হাত দুটি প্রসারিত করতে থাকে। প্রায় নিভে যাওয়া ঝাড়বাতির আধারী আলোতে হারু দেবীর চোখে প্রতিশোধের আগুন দেখতে পায়। হারু ভয়ে কাঁপতে থাকে। দেবীর কাছে প্রাণভিক্ষা চায়। মুহূর্তের মধ্যে সে হারুর বক্ষ চিরে হৃদপিণ্ড বের করে আনে। ঝাড়বাতি সম্পূর্ণ নিভে যায়।

 

         সকালে জমিদার বাড়ির লোকজন বাগান বাড়িতে উপস্থিত হলে সমগ্র বাড়িতে রক্তের দাগ ও টুকরো টুকরো দেহাংশ এদিক ওদিক দেখতে পায়। কে যেন পরম ঘৃণায় ও আক্রোশে হারুর দেহাংশ খুবলে খুবলে চতুর্দিকে অমনভাবে ছড়িয়েছে। সংজ্ঞাহীন অবস্থায় পেয়াদা ও ভৃত্য রমনীদের উদ্ধার করে রাতের ঘটনার কথা জানতে চাইলে তারা কোনও কিছুই ঠিক ভাবে বলতে পারেনি।

 

          অপঘাতে মৃত হারুর মৃতদেহের সম্পূর্ণ দেহাংশ খুঁজে পাওয়া যায়নি। শোনা যায় ওই ঘটনায় হারুর হিংস্র আত্মা মুক্তি পায়নি। তার দূরাত্মা এখনও ওই বাগান বাড়ি ও জমিদার বাড়িতে ঘুরে বেড়ায়। সুযোগ পেলেই ক্ষতি করার চেষ্টা করে। কয়েক জন ইংরেজ সাহেব, নীলকর সাহেব সাহস করে ওই বাড়ি দখল করার চেষ্টা করে। দু একদিন রাত্রিবাস করার পর তাদের মৃতদেহ ওই বাড়ি থেকে উদ্ধার হয়। এ কাজে কেউই সফল হয়নি। 

 

         ইতিহাসের পাতায় হয়তো এদের কাহিনী পাওয়া যাবে না। কিন্তু অঞ্জনার তীরে বীরনগর গ্রামের মাটিতে কান পাতলে আজও তাদের করুন আর্তনাদ আপনি শুনতে পাবেন।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Horror