অ্যাবরশন
অ্যাবরশন


প্রিয়ার বিয়ে,রুমা ও কার্তিকদা নিমন্ত্রণ করতে এসেছিল। দুজনেই খুব খুশি ওরা,মেয়ের কথা,ছেলের কথা,হবু জামাইয়ের কথা অনর্গল বলে গেল শ্রাবণের বৃষ্টিধদধারার মতো,থামতেই চায় না যেন। উচ্ছ্বাসটা চোখে পড়ার মত,চোখ মুখ থেকে খুশি যেন উথলে উথলে উঠছে। মেয়েকে কি দিচ্ছে,কি কি বাজার করল,কোথা থেকেই বা করল সব সব। মেয়ের বিয়ের ঠিক হল কিভাবে এমনকি শ্বশুরবাড়ির প্রতিটি মানুষের এমন বর্ণনা দিল যে আমি তাদের প্রত্যেককে চিনে ফেললাম। সব শুনে যা মনে হল প্রিয়ার শ্বশুরবাড়িটি খুব ভালই হচ্ছে। ও আমার মেয়ের বয়সী,আমার মনটাও একটু খচখচ করে উঠল,আমার মেয়েটার বিয়েটাও লাগলে হয়। রাজ,ওদের ছেলে,আমেরিকা থেকে কবে আসবে কবে যাবে সেসবও জানলাম। আমেরিকা থেকে দিদির বিয়ের সমস্ত কসমেটিকস সে নিয়ে আসবে। আমাদের তো আইবুড়ো ভাত থেকে বৌভাত অবধি রোজ দু'বেলা নিমন্ত্রণ,শুধু খাওয়া নয়,থাকতে হবে সারাদিনই।
কার্তিকদা আমার বরের স্কুলের বন্ধু সেই জলপাইগুড়ি থাকার সময় থেকে। পরে ওরা এবং আমার বরেরা দুজনরাই কলকাতার কাছাকাছি এই ছোট্ট মফস্বল শহরে বাড়ি করে চলে আসে। বেশি দূর নয় বাড়ি,তাই যোগাযোগটা ভালই আছে। একমাস পর পর আমাদের দুজনের বিয়ে হয়,যদিও রুমা বয়সে আমার থেকে দু'বছরের ছোট,তাও বন্ধুত্বটা ভালই আছে। বিয়ের পর থেকেই ও আমার সাথে ভালোমন্দ সব শেয়ার করে। শ্বশুরবাড়ির ওপর একটুও খুশি ছিল না ও,বড় ফ্যামিলি,শাশুড়ি, দিদিশাশুড়ি,জায়ের ছেলেমেয়ে,যদিও জা থাকে জলপাইগুড়িতেই। সেখানে বড় ব্যবসা,ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার জন্য পাঠিয়ে দিয়েছে এখানে। ছোট দেওর ডাক্তার,বউ নিয়ে কলকাতায় থাকে,মাঝেমধ্যে আসে ও। রুমা নিজেই সম্বন্ধ করে ওর বন্ধুর সঙ্গে দেওরের বিয়ে দিয়েছে। কাজেই এ বাড়িতে,এই সংসারে ও একজন বউ হওয়ায় ওর উপর কাজের চাপ প্রচুর,সারাদিন বেচারি বিশ্রাম পেত না। তার ওপর নিজে রবীন্দ্রভারতীতে মিউজিকে এম এ করছিল,কলেজ যাবার আগে ভোর থেকে সব গুছিয়ে আবার ফিরেই লেগে পড়তে হতো সংসারের কাজে। সেসব ফিরিস্তি আমায় অনেক শুনিয়েছে ও।
তবু চলছিল সব ঠিকঠাকই,হঠাৎই হল বিপত্তি। রুমা কনসিভ করল,কিন্তু সেই মুহুর্তে ও বাচ্চা নিতে মানসিকভাবে প্রস্তুত নয়। গান ওর প্রাণ,এম মিউজ কমপ্লিট না করে বাচ্চা নেবে না কিছুতে। পড়া শেষ করবে,নিজেরা দু'বছর এঞ্জয় করবে,তবে তো বাচ্চা নেবে! তাই সে কিছুতেই এ বাচ্চা রাখতে চায় না,অ্যাবর্ট করতে চায়। বাড়িতে সবাই ওর এই কথায় অসন্তুষ্ট। কার্তিকদা কত বোঝালো প্রথম সন্তান নষ্ট না করতে কিন্তু সে মেয়ে বুঝলে তো?কারো কোনো যুক্তিই সেদিন মানে নি রুমা। বাড়ির বড়রা বারবার বারণ করেছেন,রাগারাগি করেছেন তাতেও সে শোনেনি কারো কথা। শেষে সবার মতকে অগ্রাহ্য করে স্বামীকে বাধ্য করেছে ও নার্সিংহোমে নিয়ে গিয়ে গর্ভপাত করিয়ে আনার জন্য। বাড়ির সবাই ওর উপর বিরক্ত। সে তো গেল কিন্তু এরপর ওর শরীর খুব খারাপ হতে লাগল। একেই বরাবরের রোগা মেয়ে,সংসার সামলে ডেলি প্যাসেঞ্জারী করে পড়াটার ধকল আর নিতে পারল না ওর শরীর। কলেজ বন্ধ করতে হল শেষে।
মনটন খারাপ,সারাদিন শুধুই কাজ,একে খেতে দাও,ওকে খেতে দাও,ওকে জল দাও,এর অমুক,ওর তমুক,মনে ওর শান্তি নেই মোটে। এইসব রেখে কোথাও একটু বেড়াতে যাবার প্ল্যান করতেও পারে না ওরা। এই রকম চলতে চলতে রুমা আবার কনসিভ করল কিন্তু দুর্ভাগ্য, চার মাসের মাথায় ওর অ্যাবরশন হয়ে গেল। এখন কিন্তু ওরা বাচ্চা চাইছিল। এই অ্যাবরশনে ওর আবার শরীর খারাপ হয়ে গেল,হিমোগ্লোবিন কমে গেল,দুর্বল হয়ে পড়ল খুব কিন্তু সংসারের চাপটা সেই ওকেই সামলাতে হচ্ছিল তার মধ্যেও।
এইভাবেই চলছিল। একটু সুস্থ হলে ওরা বাচ্চা নিতে চাইছিল কিন্তু বারেবারে অ্যাবরশন হয়ে যেতে লাগল আর রুমার চেহারা দিনদিন ভেঙে যাচ্ছিল। খুব সুন্দরী না হলেও ছিপছিপে চেহারা,একমাথা চুল,আর চোখদুটো ভারী সুন্দর ওর। আর ছিল খুব হাসিখুশি। কিন্তু বারবার এভাবে বাচ্চা চেয়ে চেয়ে না পেয়ে মুখের হাসিটা চলে গিয়েছিল। শরীরের ভাঙ্গন চোখে পড়ত,মনমরা হয়েই থাকত সর্বদা। শাশুড়ি আবার একটু ইন্ধন দিতেন 'অভিশাপ লেগেছে' বলে। এরপর পঞ্চমবার যখন কনসিভ করে ডাক্তার বেডরেস্ট বলে দিয়েছিলেন। এবারে তেমনই রাখা হয়েছিল ওকে। তবু পঞ্চম মাসে হঠাৎ একদিন পেটব্যথা ও ব্লিডিং শুরু হলে নার্সিংহোমে অ্যাডমিট করা হয় ওকে কিন্তু ডাক্তারের সবরকম চেষ্টাই ব্যর্থ হয়। এবারও ওর অ্যাবরশন হয়ে যায়। সিস্টার নার্সিংহোমে ওর মাকে বলছিল, "জানেন মাসিমা,বাচ্চাটার হাত,পা সব সেপ নিয়ে নিয়েছিল" সেটা ও শুনতে পেয়ে যায় আর দেখবার জন্য জেদ ধরে। সিস্টার কিছুতেই দেখাবে না,ও ও কিছুতেই ছাড়বে না,দেখবেই। শেষে ওর জেদের জয় হল। সিস্টার ট্রেতে করে রক্তমাখা টুকরো টুকরো ছোট ছোট হাত-পা,আঙ্গুল,তাতে একটু নখও হয়েছে,নিয়ে যখন দেখাতে এল রুমাকে তারই অনুরোধে,সেদিকে এক নজর তাকিয়ে তীব্র আর্তনাদ করে ঝাঁপিয়ে পড়ল রুমা নার্সিংহোমের বেডে। উপুড় হয়ে ডুকরে ডুকরে কাঁদতে লাগল সে। মা ছিলেন তার সামনে,এমন দৃশ্য তিনিও সহ্য করতে পারেননি সেদিন। তবু চোখের জল সামলে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে তাকে সান্ত্বনা দিতে চেয়েছিলেন তিনি। এই নিয়ে পাঁচবার হল। রুমা আর্তনাদ করে ওঠে, "মা এ তারই অভিশাপ,তাকে আমি পৃথিবীর আলো দেখতে দিইনি,তার জন্মের পথে আমি বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছি,আর তাই তার অভিশাপে আজও আমার কোল ভরল না মা। এমন দৃশ্য যে আমি আর সইতে পারছি না মাগো। আগে রক্তপাত হয়েছে,গর্ভপাত হয়ে গেছে,কষ্ট পেয়েছি খুব,বারে বারে কোন মা সহ্য করতে পারে বল মা তুমি,কিন্তু আজ যা দেখলাম তা যে সহ্যের সব সীমা পেরিয়ে গেল গো মা। যে ছোট ছোট হাতে আমার গলা জড়িয়ে ধরার কথা,যে ছোট্ট ছোট্ট পায়ে টলমল করতে করতে আমার কাছে ছুটে আসার কথা,সেগুলো আজ ছিন্নভিন্ন মাগো। কেমন করে সইবো আমি? আমি খুনি মা,আমি খুনি,আমায় তোমরা পুলিশে দাও।"
আঘাতে আঘাতে রুমা আজ জর্জরিত,অনুতাপে তার হৃদয় হয়েছে খান খান কিন্তু সেদিন সে তা বুঝতে চায় নি,আর আজ আকুল হয়ে বাচ্চা চাইতে চাইতে বারবার পাঁচবার তার গর্ভপাত হয়ে গেল। এ যেন সেই 'অনাগত সন্তান',যাকে পৃথিবীর আলো দেখতে দেওয়া হয়নি,তারই অভিশাপ। রুমার আজ তাই মনে হয়। সেদিনের সেই দৃশ্য অনেকদিন ওকে বিভীষিকার মতো তারা করে বেরিয়েছে। এইসব বলার সময় আমার কাছে ও খুব কেঁদেছিল। আমিও সান্ত্বনা দেবার কোনো ভাষা খুঁজে পাই নি। নিজেই বলেছিল তখন, "আমার প্রথম সন্তানকে আমি খুন করেছি,আজ সেই খুনের অপরাধে আমার একের পর এক সন্তান আমায় ছেড়ে চলে যাচ্ছে। ওরা আমার কাছে বেড়ে ওঠার ভরসা পাচ্ছে না।" ওর কষ্টে সেদিন আমার বুকটা ফেটে যাচ্ছিল। ভীষণভাবে একটা বাচ্চা চাইছে যখন ও, অপরাধবোধে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে,তবু ওর কোল ভরছে না। ওর জন্য আমরাও কষ্ট পাই। অল্পবয়সে একটা ভুল,একটা হঠকারিতা করে ফেলেছে আর তার শাস্তি ও একের পর এক পেয়ে চলেছে। একে ওর মানসিক যন্ত্রণা,তায় শরীর যাচ্ছে ভেঙে,এর মধ্যে একদিন ওর শাশুড়ি আমায় বলেছিলেন, "কোন মা প্রথম সন্তান নষ্ট করতে চায়,বলতো?" আমি চুপ করে শুনেছিলাম সেদিন। কথাটা উনি ভুল কিছু বলেননি। আমিও যে একথা ভাবি নি তা নয়,তবু বন্ধু তো তাই ওর কষ্টে আমি সমব্যথী। ওর শাশুড়ির এ কথা আমি আজও বলিনি ওকে,যদিও উনি আর নেই,তবু আমি একথা ওকে বলব না কোনদিন।
এরপর রুমার আরও একটা অ্যাবরশন হবার পর সপ্তম সন্তান অবশেষে পৃথিবীর আলো দেখল। একটা ফুটফুটে মেয়ে হল ওর,আদর করে নাম রাখলো প্রিয়া,বড় প্রিয় কিনা। সেই প্রিয়ার বিয়ের নিমন্ত্রণ করতেই ওরা আজ এসেছিল। আমার তাই সেসব পুরনো দিনের কথা মনে পড়ে গেল। এ সেই প্রিয়া,কত অপেক্ষা করতে হয়েছে রুমাকে এর জন্য।তার দু'বছর পর ওদের অষ্টম সন্তান জন্মাল,এবারে ছেলে,নাম রাখল রাজা। বড় আনন্দের দিনগুলো কাটতে লাগলো ওদের,কথায় বলে অষ্টম গর্ভের সন্তান খুব ভালো হয়,সত্যিই জুয়েল ছেলে রাজা,স্কুলে কোনোদিন সেকেন্ড হয়নি সে। এরপর বড় হয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং করে এমবিএ করে বর্তমানে আমেরিকায় চাকরি করছে। ছেলেমেয়ে বড় হয়ে পড়াশোনা ও চাকরি সুবাদে সব কাছছাড়া। রুমা অবসাদে ভুগতে থাকে। সর্বদা আশঙ্কা পাছে ছেলে-মেয়ের কিছু বিপদ হয়,মনে হয় ওর কাছে থাকলে হয়তো কিছু হবে না,দূরে থাকে বলে ভয় পায় সর্বদা। মেয়ে বড় হয়েছে,বিয়ের জোগাড় হচ্ছে না,চিন্তায় ওর শরীর ভাঙতে লাগল,প্রায় বিছানা নিল, মাঝে মাঝে হসপিটালাইজড হতে হয়,এমন সময় প্রিয়ার বিয়ের যোগাযোগটা হওয়ায় রুমা যেন অর্ধেক সুস্থ হয়ে গেছে। হাসিখুশি, চনমনে,সেই বিয়ের পরে যেমনটা দেখেছি,খুব ভাল লাগল ওকে দেখে। মনে মনে বললাম, "খুশি থাক রুমা তুই, অতীতের কষ্ট যেন আর তোকে নাড়া না দেয়,বর্তমানের সুখটুকু নিয়ে তুই আনন্দে থাক"।