Maheshwar Maji

Abstract

3  

Maheshwar Maji

Abstract

অস্ত্র

অস্ত্র

4 mins
622


নামটা তার রাধা সর্দার।বছর পঁয়ত্রিশের মত বয়স।হাঁটুর উপর খাটো করে পরা শাড়ি।আঁচলের দিয়ে কোমরটা কষে বেঁধে রাখে।

পান,সুপুরি আর খয়েরের লাল রঙে জিভটা টকটক করে।শুধু বুকের বাঁধনটুকুর কথা নয়, শরীরের গড়নটাও বেশ টান,টান ।

গায়ের রঙ কাজল কালো।চোখে সুরমা টানে।


চৌদ্দ বছর বয়েসে বিয়ে হয়েছিল।স্বামী আজো বেঁচে আছে,তবু সিঁথিতে সিন্দুর তোলে না। আর শাখা,পলাও কবে ভেঙে ফেলেছে।হাতে এখন একটা তাগড়ায় সাইজের ধাতব বালা পরে থাকে।


বিয়ের আট,দশ বছর পরেও যখন তার কোলে কোন সন্তান এল না। তখন তার স্বামী তাকে ছেড়ে পালায়।অন্য বিয়ে করে নেয়।

রাধা তার আর খোঁজ করেনি।আর মনের দুঃখে কভু চোখের পলকও ভেজায়নি।সেদিন থেকেই রাধা সধবার সাজ পুকুর পাড়ে ছুঁড়ে ফেলে এসেছে।

তবে শ্বশুরের টুকরো ভিটেখানি ছেড়ে যায় নি।কেন যায়নি ?তার কারণ শুধুমাত্র সেই জানে।

যখন সে নতুন বিয়ে করে কুঁড়ে ঘরটায় পা রেখেছিল।তখন তার শ্বশুর বেঁচে ছিলেন।শ্বাশুড়ীর মুখ সে দেখতে পায়নি।তবে শ্বশুরটা তাকে নিজের মেয়ের মত স্নেহ করতেন।

রাধাও নতুন একখানা বাবা পেয়ে গেছিল।বড় শ্রদ্ধা করত মানুষটাকে।তার স্বামী তাকে নেশা করে উল্টো,পাল্টা কিছু বললে, বুড়ো শ্বশুর তখন রাধার পক্ষ নিয়ে ছেলেকে তেড়ে আসতেন।

একদিন সন্ধ্যাবেলায় তার শ্বশুর খড় চালার ভেতর থেকে প্রায় দুহাত লম্বা ধারাল একটা কাটারি দিয়ে বলেছিলেন,নিজকে আর ভিটেটাকে রক্ষে করার দায়িত্ব আজ থেকে আমি তোর হাতে তুলে দিলাম।শ্বশুরের মান রাখিস।

তার কিছুদিন পরেই তিনি পরলোকে যাত্রা করেন।

তখন রাধার স্বামী একদিন সুযোগ বুঝে তাকে মারধর করে ভিটে ছাড়া করার মতলব নিয়ে বলে উঠেছিল,ভাগ মাগী।আমার ঘর থেকে।বাঁজা পাঠি।

জবাবে সেদিনই রাধা প্রথম লম্বা কাটারিটা চালের কাঞ্চি থেকে বের করে ডানহাতের মুঠোয় ধরে ছিল।

রাধার সেই ভয়ঙ্কর চেহারা প্রত্যক্ষ করে তার স্বামী সেই যে দৌড় দিল।ফিরেছিল তিনদিন পর।তবে আর কোনদিন রাধার উপর খবরদারী খাটাতে যায়নি।

তারপর একদিন সেই কাপুরুষ, নিজেই বাড়ি থেকে চম্পট দেয়।চিরদিনের জন্য।দ্বিতীয় মেয়েছেলের খোঁজ পেয়ে।


রাধা সেই থেকে কাটারিটা সবসময় কোমরে গুঁজেই ঘুরে বেড়ায়।

ওই কাটারি দিয়ে সে জঙ্গলে ঘুরে,ঘুরে শুকনো কাঠ কেটে গাঁয়ে,গাঁয়ে বেঁচে ফেরে।আর আত্মরক্ষাও করে।জঙ্গলের হিংস্র জানোয়ার হোক আর মানুষের লোলুপ দৃষ্টি।তার অস্ত্রের ঝলকানিতে সব লেজ গুটিয়ে গর্তে ঢুকে যায় ।


একদিন সন্ধ্যাবেলায় সে উনুনে শুকনো পাতা পুরে ভাত ফোটাচ্ছিল।এমন সময় ভাঙা টিনের দরজাটা ঝনঝন করে উঠল।

রাধা ফাটা গলায় চেঁচিয়ে উঠে,কেরে?

দরজার ওপার থেকে জবাব আসে,


---আমরা থানা থেকে এসেছি।দরজাটা খোল।

রাধা প্রথমটাই ভেবেছিল,কেউ তার সাথে তামাশা জুড়েছে।তাই ধমক দিতেই দরজা খুলল। দেখল দু,তিনজন পুলিশ সত্যি সত্যিই আলো হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছেন।

একজন পুলিশ কড়া গলায় বলে উঠলেন,তোর নামে থানায় অভিযোগ আছে।

রাধা এক মুহূর্ত অবাক হল। কথাটার আগাগোড়া কিছুই বুঝতে পারছে না। এদিকে গাঁয়ে হঠাৎ পুলিশ দেখে, মানুষের ইতিউতি বাড়তে লাগল।

রাধা একটু ঘাবড়ে গেল।তাই থেমে,থেমে বলে উঠল,অ-ভি-যো-গ!

পুলিশটি উত্তরে ধমক দিলেন,

----রাতদিন হাতে মস্তবড় অস্ত্র নিয়ে ঘুরে বেড়াস।এটা তোর শোভনীয় না। তাছাড়া এটা বেআইনি।কোনদিন বড়সড় অপরাধ করে বসলে তখন দায়ী তো আমরা হব।তাই ওটা তোকে আমাদের হাতে এখুনি তুলে দিতে হবে।নাহলে তোকে এ্যরেস্ট করে থানায় তুলে নিয়ে যেতে বাধ্য হব।

কথাটা শুনে রাধা প্রথমে ঠোঁট চওড়া করল।তারপর প্রচন্ড জোরে হাসতে লাগল।

হাসির চোটে সারা শরীরটা দুলছে। আলো,আঁধারির মধ্যেও যেন তার চোখের তারাদুটো স্পষ্ট বোঝা গেল।একটা নির্ভীক ভ্রূকূটি ঠিকরে পড়ছে!!

অন্য একজন পুলিশ তাকে থামিয়ে আবার জোর গলায় বলে উঠলেন,সেটআপ!..নিজের হাতে তুলে না দিলে আমরা কিন্তু জোর দেখাতে জানি।সে ক্ষমতা আমাদের আছে।

রাধা হাসি থামিয়ে স্পষ্ট ভাষায় বলে উঠল,অস্ত্র শুধু আমার হাতেয় সকলে দেখতে পেলেন কেন?..আর কী কোন নারী আমার মতো অস্ত্র নিয়ে থাকে না?...আমারটা জমা করার আগে যান ওদেরগুলো জমা করুন।তারপর না হয় আমি নিজে গিয়ে জমা করে আসব।

পুলিশের একজন বলে উঠলেন, হয়াট!...কী বলতে চাইছিস তুই?..তোর মত অস্ত্র ধরে থাকা নারী এই তল্লাটে একটাও নেয়।না হলে তাদের বীরুদ্ধেও অভিযোগ জমা পড়ত।

রাধা দৃঢ় গলায় বলে উঠল,মা দূর্গার হাতে কতগুলো অস্ত্র কখনো গুনেছেন?...আর মাকালী।ও তো রক্তাক্ত মুন্ডু নিয়ে খড়্গ হাতে সহাস্যে দাড়িয়ে থাকে।আজ কত যুগ পেরিয়ে গেল।আপনারা কেন এসব মেনে নেন দারোগাবাবু?...কেন তাদের হাত থেকে অস্ত্রগুলো খুলে ফেলা হয় না?

একজন পুলিশ জোর গলায় বলে উঠলেন,একদম ঘোরাবার চেষ্টা করবি না বলছি।কোথায় দেব, দেবী!! আর তুই সামান্য একজন নিচু জাতের নারী!কার সাথে কাকে তুলনা করছিস অ্যা?

অন্য আর একজন পুলিশ যোগ দিয়ে বলে উঠলেন,ওসকল অস্ত্রগুলো মিথ্যে ।তোর মত জ্যান্ত অস্ত্র নয়।

---বাঃ...খুব ভাল।একজন দেবী মিথ্যে অস্ত্র ধরে বিশ্ববাসীকে বিপদের হাত থেকে রক্ষা করার মিথ্যে ছলনা করে চলেছেন!!আর মানুষ তাকে ফুল,বেলপাতা দিয়ে তুষ্ট করার আপ্রাণ চেষ্টাও করে যাচ্ছে!মিথ্যে কৃপা লাভের আশায়।আর একজন জ্যান্ত নারী যখন আত্মরক্ষার খাতিরে অস্ত্র ধারণ করে।তখন সেটা ঘোরতর অপরাধ?..তাইতো দারোগাবাবু?

একজন পুলিশ বলে উঠল,ও এমনি,এমনি মানবে না স্যার ।আমাদের জোর করে কেড়ে নিতে হবে?

রাধা সাথে,সাথে প্রতিবাদ করে উঠল,

---একদম চেষ্টা করবেন না সাহেব। কারণ ওটা দিয়ে আমি শব্জি কাটি।

---বটি এতবড় হয় নাকি?আর বটি নিয়ে বাইরে কেন ঘোরা?

---মাপের কথায় আসতে হলে প্রথমে পৃথিবীর সমস্ত পুরুষগুলোকে উলঙ্গ করুন।তারপর বুঝবেন পার্থক্য থাকে কিনা?...পুরুষরা একটা অস্ত্র জন্মের সাথে নিয়েই ঘুরছে।তাই দিয়ে নারীকে সবসময় শোষণ আর শাষণ করার ভয় দেখায়।আর কোন নারী তার প্রতিবাদে হাতে অস্ত্র ধরলেই তখন ঘোরতর অপরাধ?আপনারা আজ পর্যন্ত কতগুলো মেয়ের লজ্জা বাঁচাতে পেরেছেন হিসেব করে বলুন তো?পারেননি।সম্মান চলে যাওয়ার পর বিচারের চেষ্টা করেছেন মাত্র। তাতে আদৌ কোন সুফল পাওয়া যায়?...যায় না। আমি বলছি প্রত্যেক নারীকে আমার মত ঘরের বটি সাইজের একটা করে অস্ত্র রাখার বৈধতা দিন।দেখবেন কোন মেয়েকে আর পুরুষদন্ডের ভয়ে সিটিয়ে থাকতে হবে না। আমার মত তারা সদর্পে ঘুরে বেড়াতে পারবে বনে,জঙ্গলে সর্বত্র।

রাধার কথা শুনে ভিড়ের মাঝ থেকে গুঞ্জন শুরু হল।কিন্তু প্রথম হাততালিটা নব্বই বছরের একজন বুড়িমার হাত দিয়ে শুরু হল।শেষ হল পুলিশ তিনজনের দিয়ে।

একজন পুলিশ বলে উঠলেন, তুই সত্যি বলেছিস রাধা।আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় অস্ত্রধারী দেবীকে পুজো করার বিধান থাকলেও,বাস্তবের নারীকে আমরা হাতে চুড়ি পরিয়ে নিরস্ত্র করে দিয়। সব্জি কুটো করতে বটি ধরালেও, আত্মরক্ষার জন্য কেবলমাত্র ওড়না অথবা পর্দা তুলে দিয়েছি। এসকল নিয়ম না পাল্টালে বর্তমান সমাজে নারীরা কিছুকেই নিজেকে শয়তানী পুরুষদের হাত থেকে বাঁচাতে পারবে‌না।


তারপর পুলিশ জিপটা হেট লাইটের তীব্র আলো ফেলে খেঁজুর বনের অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।  


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract