শিপ্রা চক্রবর্তী

Abstract Tragedy Others

3  

শিপ্রা চক্রবর্তী

Abstract Tragedy Others

অন্নপূর্নার হেঁসেল

অন্নপূর্নার হেঁসেল

3 mins
244



অন্নপূর্না দেবীর কাছে রান্নাঘরটাই তার দুনিয়া। কারন সেই ষোলো বছর বয়সে বিয়ে করে স্বামীর হাত ধরে নববধুর সাজে পা.... রেখে ছিলেন এই সান‍্যাল বাড়িতে। আর জীবনের শেষ বয়সে এসেও সেই রান্নাঘরের চার দেওেয়ালের মধ‍্যেই আটকে থেকে গেলেন!!! বের হতে পারলেননা আর এই জীবন থাকতে তিনি মনে হয় বেরোতেও পারবেন না। 


অন্নপূর্না দেবীর একান্নবর্তী পরিবারে বিয়ে হয়েছিল, অার অন্নপূর্না দেবী ছিলেন বাড়ির ছোট বৌ। অষ্টমঙ্গলা পার হতে না হতেই ঢুকতে হয়েছিল রান্নাঘরে। রান্নাঘরে প্রথম ঢুকে অন্নপূর্না দেবী বেশ অবাক হয়ে ছিলেন কারন পর... পর.... সারি দেওয়া বড় বড় কাঠের উনান, তার ওপর বসানো বড় বড় হাড়ি, কড়াই এ.... যেন ভোজ বাড়ির রান্না চলছে। 


আসলে অন্নপূর্না দেবী ছোট থেকে পশ্চিমের দেশে মানুষ হয়েছেন, কারন অন্নপূর্না দেবীর বাবা কর্মসূত্রে ওখানেই পাড়ি দিয়ে ছিলেন । আর বাড়িতে লোক বলতে বাবা, মা, দাদা। তাই প্রথম দিন এত রান্নার আয়োজন দেখে অবাক হয়ে ছিলেন!!! অন্নপূর্না দেবী যখন এই বাড়িতে বৌ হয়ে আসেন তখন ওনার শাশুড়ি মার অনেকটাই বয়স তিনি রান্নাঘরে জাননা তবে স্বামী এবং ছেলেদের নিজের হাতে খাবার পরিবেশন করেন। সকাল সকাল কর্তাদের অফিস, তারপর ছেলেদের স্কুল, মুনিষ-পাট, রাখাল, মালি, কাজের লোক নয় নয় করে প্রায় জনা তিরিশ লোকের পঞ্চব‍্যঞ্জন সমেত খাবারের ব‍্যাবস্থা করতে বড় বৌ, মেজ বৌ, সেজো বৌ যেন হিমশিম খেয়ে যেত, তার ওপর মুড়িভাজা, থেকে শুরু করে মিষ্টি বানানো সবাই ঘরে করা হত, আর আত্মীয় স্বজন আসা যাওয়া তো.... লেগেই থাকত, তাই অন্নপূর্না দেবীও লেগে পড়েছিলেন ওনাদের সাথে রান্নাঘরের কাজে। তবে বাড়ির মেয়েরাও বসে থাকতোনা তারাও হাতে হাতে কাজের সাহায্য করে দিত। 


তবে অন্নপূর্না দেবী রান্নাবান্না সেই রকম কিছুই জানতেননা, কারন তিনি একটু অন‍্য রকম ভাবে মানুষ হয়ে ছিলেন, মা রান্নার কাজ সামলাতেন আর অন্নপূর্না দেবী সারাদিন বইএ মুখ গুজে থাকতেন। আর এই অক্ষর জ্ঞান অন্নপূর্না দেবী বাবার কাছ থেকে শিখে ছিলেন। তখনকার দিনে মেয়েদের পড়াশোনা নিয়ে অত কারোর মাথা ব‍্যাথা ছিলনা!!! মেয়েদের আসল শিক্ষার বিচার হত রান্নাবান্না, হাতের কাজের ওপর। রান্নাবান্নায় দক্ষতা না... থাকলেও অন্নপূর্না দেবীর হাতের কাজে দক্ষ ছিলেন। খুব সুন্দর সোয়েটার, আসন, নকসী কাঁথা বুনতে পারতেন। তবে রান্নাবান্না বাদে লেখা পড়া জানতেন বলে ওনাকেও অনেক কথা শুনতে হয়েছে জা, ননদ, শ্বাশুড়ি, পাড়া-প্রতিবেশির কাছ থেকে। সেই ভোর থেকে রাত পর্যন্ত অন্নপূর্না দেবীর রান্নাঘরেই কেটে যেত। সারাদিনের ক্লান্তির শেষে দুচোখে যেন ঘুম নেমে আসত, বই পড়ার সখ কোথায় যেন চাপা পড়ে গেছিল সংসারের চাপে। ঐ টালির চাল দেওয়া রান্নাঘরটাই ছিল অন্নপূর্না দেবীর আসল দুনিয়া, আর ওর বাইরে দুনিয়ায় সেইভাবে কোনদিন দেখা হয়ে ওঠেনি।


এইভাবে সময় পার হতে লাগল, অন্নপূর্না দেবী দুই ছেলে, তিন মেয়ের মা হলেন। তারপর আস্তে আস্তে শ্বাশুড়ি মা হলেন, এবং অবশেষে ঠাকুমা হলেন। অন্নপূর্না দেবীর শ্বশুর, শ্বাশুড়ি ইহলোকের মায়া ত‍্যাগ করে পরলোক গমন করছেন অনেক কাল আগেই, মেয়েরা বাপের বাড়ি ছেড়ে শ্বশুরবাড়ি গেছে, আর অন‍্যদিকে বাড়িতে টুকটুকে সব রাঙা বৌ এসেছে ছেলেদের হাত ধরে। বড় এবং মেজজা ততদিনে রান্নাঘরের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছেন এখন সব দায়িত্ব সেজো আর অন্নপূর্না দেবীর ওপরে। 


আস্তে আস্তে যুগের পরিবর্তন হল মেয়েদের শিক্ষা ব‍্যবস্থা চালু হলো তখন অন্নপূর্না দেবীর বয়স আশির কাছাকাছি, আর তিনি তখন বিধবা তার জা, ভাসুর স্বামী সবাই ইহলোকের মায়া ত‍্যাগ করেছেন। অন্নপূর্না দেবী চোখে ভালো মত দেখতে পান না, তবুও সকালের দিকে কিছুটা সময় রান্নাঘরে কাটান আসলে এই রান্নাঘর যে.... তার দুনিয়া, তাই এই জীবন থাকতে রান্নাঘরের মায়া অন্নপূর্না দেবী আর ত‍্যাগ করতে পারবেননা!!! তবে দুপুরের দিকে নাতি,নাতনির কাছে বসে গল্প শোনান তার দীর্ঘ এই আশি বছর পার করে আসা জীবনের, আর মনে মনে সেই ফেলে আসা ছোটো বেলাকার সুন্দর স্মৃতি মনে করতে থাকেন। আর নিজের অজান্তেই ঠৌঁটের কোনে হাসি ফুটে ওঠে। তবে অন্নপূর্না দেবীর মনে কোথাও একটা অফশোস রয়ে গেছে রান্নাঘরের চার দেওয়ালে আটকা পড়ে তার পড়ার সখটা আর এই জীবনে পূর্ণতা পেলনা। তবে অন্নপূর্না দেবী জীবনের চৌষট্টিটা বছর রান্নাঘরের চার দেওয়ালের মধ‍্যেই কাটিয়ে দিলেন, এবং সেই রান্নাঘরেই একদিন তিনি তার জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ত‍্যাগ করলেন। আসলে অন্নপূর্না দেবীর সংসারের জালে জড়িয়ে পড়া জীবন রান্নাঘরেই শুরু হয়েছিল আর রান্নাঘরেই শেষ হলো। 




Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract