Priyanka Chatterjee

Fantasy

5.0  

Priyanka Chatterjee

Fantasy

অনেক দূরের তুমি

অনেক দূরের তুমি

5 mins
502


বছর দশেকের ছেলেটি ফ্যালফেলে চোখে তাকিয়ে থাকে, কষ বেয়ে লালা গড়ায়, অকারণেই হাসে। রুমিকে বাসে তোলার সময় রোজের এই দৃশ্য দেখতে অভ্যেস হয়ে গেছে ববিতার। ছেলেটির নাম নীল, রুমির বন্ধু মিলির দাদা, মিলিকে বাসে তুলতে আসে আয়ার সাথে। মাস দশেক হল এই পাড়ায় এসেছে ববিতা। ঘণিষ্ঠতা বাড়ায়নি।

ডিভোর্সের পর একা থাকাটা অভ্যাসে পরিণত করেছে এখন। প্রথম প্রথম রুমির খুব কষ্ট হত, ববিতা বুঝতে পারত, গলার কাছে কান্নাটা ভীষণ জমাট বেঁধে যেত তার। তবু চোখ দিয়ে জলটা বেরোয় না তার। সময়তো থেমে থাকে না । দিন থেকে রাত, রাত থেকে ভোর, আবারো একটা দিনের শুরু হয়। মনের ভেতরের ক্ষত থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে রক্ত পড়ে। বাঁদিকের বুকটায় তীব্র যন্ত্রণা করে। দিনের কাজ সেরে অফিস, সেখানের বসের চোরা চাউনিকে অগ্রাহ্য করে কাজ করে যাওয়া, ঘরে ফিরে মেয়ের স্কুলের কাজ, মেয়েকে ঘুম পাড়ান, কখন যে রাত গভীর হয়ে যায় বোঝা যায় না।ববিতার শূণ্যদৃষ্টি খুঁজে বেড়ায় এই বাঁচার অর্থ, গুমরে আসা কান্নাটাকে গিলে নিয়ে শুয়ে পড়ে বিছানায়।

 ঋষভের সাথে সম্পর্কটা ভাঙতে চায়নি, কিন্তু উপায় ছিল না। বছর দশ আগে ববিতার বাবা,মার চোখটা লোভে চকচক করেছিল ঋষভকে দেখে। সে বলতে পারেনি নীলকে ভালোবাসার কথা।নীল বসাক, কী সুপুরুষ চেহারা। সে বলেনি তাকে, যে, সে তাকে ভালোবাসে। সবটাই চোখেচোখে। যখন বলল তখন বড্ড দেরী হয়ে গেছে। কেমন যেন ঘেঁটে গেছিল সব, সব কিছুই, এমনকি তার সত্তাও। মিথ্যেকে সত্যি ভাবাটাই কি অভ্যেস?তার নাম কি মানিয়ে নেওয়া?

 ঋষভকে তাদের পছন্দ হয়েছিল নাকি তার উঁচু পোস্ট, তার অর্থ এগুলোই ছিল তাদের পছন্দের কারণে। তাই জোর করেই লাল বেনারসি ও সোনার গয়নায় সাজিয়ে বসিয়ে দিয়েছিল বিয়ের পিঁড়িতে। প্রথম দু তিন বছর ভাল কাটলেও সমস্যা শুরু হল তারপর। ঋষভের মনের মত হতে শুরু করলেও , এটা যে অন্তহীন পথ সেটা ববিতা নিজেও জানত না, নাকি জানার চেষ্টাও করে নি, কে জানে? আগের সব ভুলে সাজিয়ে নিত, নিজেকে। পার্টিতে উড়ত মদের ফোয়ারা, কার স্ত্রী কার স্বামীর বক্ষলগ্না হয়ে ঘুরছে, নেশায় খেয়াল নেই কারো। উগ্র আধুনিক সাজে, গাড় লিপস্টিকে রাঙানো ঠোঁটের লিপস্টিক লাগে কাঁচের গ্লাসে। কিন্তু যেদিন ঋষভ নেশার ওষুধ মেশায় কোলড্রিঙ্কসে আর , নেশা কাটার পর ববিতা দেখে, সে অর্ধনগ্ন হয়ে ঋষভের বসের আলিঙ্গনে আবদ্ধ, বসের সারা শরীরে তার লাল লিপস্টিকের চিহ্ন, ভীষণ ঘেন্না লেগেছিল ভীষণ। কোনোমতে উঠে ঋষভকে খুঁজতে গিয়ে দেখে, ঋষভ অফিসের ঊর্দ্ধতন সহকর্মীর সাথে আপত্তিকর অবস্থায় আছে। ঘরে গিয়ে সেদিন সিদ্ধান্ত নেয় সে ডিভোর্স নেবে। অনেক লড়াই করে সে বেরিয়ে এসেছে সেই নরক থেকে। আজো মনে পড়লে তার বড় কষ্ট হয়। বাবা মা ও মারা গেছেন। আজ সত্যি ববিতার বড় একা লাগে।


---রুউউ, রুউউ.........., একা যেওনা।

--একা কোথায়? নীলদাদা ছিল।

ভয় ও কিছুটা বিরক্তি মেশানো গলায় ফিসফিস করে ববিতা বললেন,

---ওর সাথে একা যাবে না। 

আমিতো আসছি।

---কেন ? নীলদাদা অন্যরকম তাই!

---তুমি খুব বেশী কথা বল রু।

ববিতা কি করে বোঝাবে ঐ একরত্তি প্রাণেই যে তার প্রাণভোমরা রয়েছে। হয়ত ছেলেটির অ্যাবনর্ম্যাল ব্যবহার যেন তাকে আকর্ষণ করে চুম্বকের মত, কিন্তু ভয় লাগে, অজানা ভয়।


সেদিন ববিতার দেরী হয়ে যায় অফিস থেকে ফিরতে, পৌঁছে দেখে, রাস্তার উল্টো ফুটে তখন স্কুলবাস নামিয়ে দিয়েছে রুমিকে। 

 

রুমি মাকে দেখেই দৌড় দেয়, সেইসময় উল্টো দিক থেকে একটা বড় মোটর সাইকেল ছুটে আসে...

ববিতার পাগুলো আটকে গেছে, আতঙ্কে চোখ বন্ধ করে। একটা গেল গেল রব...

 চোখ খোলে ববিতা , নীল আর রুমি পড়ে আছে রাস্তায়, ভিড় করে আছে । কেউ বলে

---ভাগ্যিস ছেলেটা ঠেলে দিয়েছিল, নইলে..  

 ছেলেটা তখনো ফ্যালফেলে চোখে তাকিয়ে আছে, আর কষ বেয়ে লালা ঝরছে।

বড় যত্নে ছেলেটার লালা মুছিয়ে দিতেই শোনে

--সরি পাপা আই এম লেট।

মুখটা ঘোরাতেই বড় অবাক হয়েছিল ববিতা, তার উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে আছে মিঃ বসাক। দুজনেই অবাক চোখে দুজনের দিকে তাকিয়ে থাকে।আজ প্রায় এক যুগ পরে দেখা। নির্নিমেষ নয়ণে তাকিয়ে থাকার পরে ববিতা তার দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। এক অস্বাভাবিক নিস্তব্ধতা। দুজনেই পাশে পাশে হাঁটছে। নীরবতা ভেঙে মিঃ বসাক প্রথম বললেন 

--কেমন আছ ববি?

বুকের ভেতরটা মুচড়ে গেল , অথচ মুখে কৃত্রিম হাসি এনে বলল, 

--ভালো।

সেদিন হাজারো প্রশ্ন বুকে ঢেউ তুললেও গলা দিয়ে স্বর বের হয় নি। বেশ কদিন পরে আবার দেখা। ববিতাই জিজ্ঞেস করল

--আপনি আসেন নি?

--আয়া আসে।আজ আয়া আসে নি, তাই আমি!

--পতিদেব কোথায়?

ক্ষীন স্বরে ববিতা বলল

--ডিভোর্স হয়ে গেছে।

আবারো নিস্তব্ধতা। তবুও একসাথে চলার এক অদম্য ইচ্ছে যেন গ্রাস করেছে তাকে, তাই রিক্সা না করে পাশে পাশে হাঁটতে থাকে।উল্টো দিকের মানুষটাও রিক1সা না করে হাঁটছে পাশে পাশে। ববিতা নিজের হৃৎস্পন্দন শুনতে পাচ্ছে। ববিতাই বলল

--বিয়ে করলেন কবে?

মিঃ বসাক হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লেন, তারপর ববিতার দিকে চেয়ে বলেন, 

--আমি বিয়ে করিনি ববি। তোমার বিয়ের পরে তখন প্রচন্ড যন্ত্রণায় দিন কাটছে, তাই তখন প্রায় ঘুরতাম।বছর চার আগে ট্রেনে যাচ্ছিলাম হরিদ্বার। এক ভিখারী একটি অপ্রকৃতিস্থ বাচ্চাকে কোলে নিয়ে ভিক্ষা করছিল। হঠাৎ পড়ে গেল পড়ে গেল আওয়াজ, আমিও যাই ওখানে ,দেখি বাচ্চাটা বসে কাঁদছে, আর মা টা পড়ে গেছে । ঐ বাচ্চাটিকে কোলে তুলে নি। মিলি ওর বোন। ওদের বস্তিতে গিয়ে অনেক আইনি পথ পেরিয়ে দত্তক নিলাম। 

ববিতা আড়চোখে দেখল বাচ্চাগুলো হাতধরে হাঁটছে সামনে। মিঃ বসাকের স্বরে ঘাড় ঘোরাল। তিনি বলছেন

--সত্যি বলতে, এদের নিয়ে আমি ভাল আছি। এটুকু বুঝলাম, আমি মিথ্যে কষ্ট পাচ্ছি, আমার থেকে হাজারগুন বেশী কষ্টে আরো কত মানুষ আছে।


ববিতা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। ঐটুকু ছেলে জীবনপণ করে তার মেয়েকে বাঁচিয়েছে। প্রকৃত শিক্ষার আলোয় সে আলোকিত। সে তার শিক্ষক মিঃ বসাককে মন দিয়ছিল, সব মনে আছে তার। কলেজ যেদিন বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে ইংরেজীর নব্য আগত প্রফেসর মিঃ বসাক তার হাত ধরে বলেছিল 

--যুঁই তোমায় ছাড়া সব কিছু খাপছাড়া। তুমি আসলেই চারিদিকে পাই যুঁই এর সুবাস। ভালোবাসি তোমায়। 

সেদিন হাত ছাড়িয়ে ববিতা চলে এসেছিল । বলতে পারেনি, তার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে, বলতে পারে নি,সেও ভালোবাসে, কিন্তু এখন সব কিছুই ভিত্তিহীন। তার বাবা মা মেনে নেবে না। তাই উদ্গত কান্নাটা চাপা দেবার জন্য ওড়না চাপা দিয়ে ছুটেছিল ঐ বৃষ্টির মাঝে। 


আর কেউ না জানুক , সে জানে, তার মন জানে। চোখ দিয়ে তার নেমেছে বৃষ্টির ধারা, সবকিছু তাতে ধোঁয়া, ধোঁয়া হয়ে যাচ্ছে।ভীষণ ইচ্ছে করছে তার বলতে, 

---আমি আপনাকে আগেও ভালোবাসতাম এখনো বাসি।

না, ববিতার গলা দিয়ে আওয়াজ বেরুচ্ছে না, শুধু চাপা কান্না গুমরোচ্ছে।


মিঃ বসাক একবার তাকালেন ববিতার দিকে। সেই এক রকম যুঁই ফুলের গন্ধ তিনি , বুক ভরে শ্বাস নিলেন । আজো ববিতাকে তিনি বড্ড ভালোবাসেন। দুজনে পাশাপাশি হেঁটে চলেছে, মাঝে যেন যোজন মাইলের দূরত্ব। একটা শক্ত কাঁচের দেওয়াল যেন দুজনের মাঝে, দেখতে পাওয়া গেলেও , স্পর্শ করা যায় না, অনুভব করা যায় না, মনটাকে স্পর্শ করা যায় না। 

হঠাৎ বাচ্চা ছেলেটি দৌড়ে এসে ববিতাকে জড়িয়ে ধরে তার চোখের জল মুছিয়ে অস্পষ্ট ললা জয়ানো উচ্চারণে বলে

--দুউউ, দুউউ , 

ববিতা ওকে জড়িয়ে কেঁদে চলে। না আজ আর বৃষ্টি হয় নি। সব বৃষ্টি শুকিয়ে গেছে। 


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Fantasy