অবিশ্বাস
অবিশ্বাস
ছোটবেলা থেকেই আমি ভূতে বিশ্বাস করি না। আর এই নিয়ে আমার বন্ধুরা আমার পিছনে কম লাগেনি। তারা বলত, "ঐ কথা অনেকেই বলে, কিন্তু আসল সময়ে তথাকথিত ভূতে অবিশ্বাসীরা সবাই রণে ভঙ্গ দেয় নানান অজুহাতে।" আমি বরাবরই এই জাতীয় অভিযোগের যোগ্য উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করে এসেছি সফলভাবে। সেই যখন ক্লাস টেনে পড়ি তখন একবার আমাদের বন্ধুদের মধ্যে বাজি ধরা হয় যে, যে একদম একা অমাবস্যার মাঝরাতে শ্মশানের মধ্যের শিরিষ গাছের ডালে তাদেরই দেওয়া একটা লাল শালু বেঁধে আসতে পারলে তাকে সবাই মিলে ভূড়িভোজ করাবে আর সবাই তাকে সত্যিকারের সাহসী বলে মেনে নেবে। আমাদের ছোটবেলায় গ্রামের শ্মশানে রাতের বেলায় শিয়াল কুকুরের মড়ার খুলি নিয়ে কামড়া কামড়িতে বাস্তবিকই এক বিভৎস দৃশ্যের অবতারণা করত। দুর্বল চিত্তের লোকের পক্ষে সেইসব হাড় হিম করা পরিস্থিতিতে সুস্থ স্বাভাবিক থাকতে পারা মোটেই সহজ কাজ ছিল না। তবুও আমি বন্ধুদের কথামতই রাত ঠিক একটার সময় অমাবস্যার নিকষ কালো অন্ধকারে একা একা শ্মশানে গিয়ে পৌঁছলাম। পৌঁছে অন্ধকারে শিরিষ গাছটাকে আর কিছুতেই খুঁজে পাই না। যতবারই এগিয়ে যাচ্ছিলাম ততবারই কোনো শবদাহের পরে ফেলে রেখে যাওয়া, নিবে যাওয়া চুল্লির কাছে চলে যাচ্ছিলাম। আর কয়েকটা শিয়াল যেন আমাকে বিদ্রুপ করে হাসতে হাসতে পাশ দিয়ে দৌড়ে চলে যাচ্ছিল। মাঝেমাঝেই একটা প্যাঁচা কর্কশভাবে ডাকতে ডাকতে ঠিক আমার মাথার উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছিল। ভাবতে শুরু করেছিলাম কেন শুধু শুধু এই বাজিটা ধরতে গেলাম। হঠাৎ দেখলাম একটা মড়ার খুলি গড়িয়ে গড়িয়ে আমার পাশ দিয়ে চলে গেল। পালাতে গিয়ে দেখি ভয়ে আমার পাদুটো পাথরের মতো ভারী হয়ে গেছে, আমি হাঁটতেও পারছি না। কোনরকমে একটা গাছে হেলান দিয়ে ধপ করে বসে পড়লাম। প্রায় ঘন্টা তিনেক ঐ বিভীষিকার মধ্যে একটা ঘোরের মধ্যে কাটানোর পর ভয়ে ও ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। পরে আস্তে আস্তে আকাশ পরিস্কার হয়ে এলে ঘুম ভেঙে দেখি আমি সেই শিরিষ গাছটার নীচেই বসে আছি। তাড়াতাড়ি করে উঠে শিরিষ গাছের একটা ডালে লাল কাপড় বেঁধে ফিরে এসেছিলাম। না তবে কোনো প্রেতাত্মা বা অশরীরীর দর্শন আমি পাইনি, আর পরের দিন বেলা হলে বন্ধুরা ঐ লাল কাপড়টা খুলে এনে আমার সাহসের তারিফ করেছিল। যদিও বাকি সব ঘটনা আমি আর কাউকেই বলিনি। এরকম আরও অনেক ঘটনাই ঘটেছে আমার জীবনে। আর একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনার কথা বলি। সেটাও অনেক কাল আগের কথা, তখন আমি ক্লাস টুয়েলভে পড়ি। টিউশন পড়ে ফিরছি, ফিরতে বেশ রাতই হয়েছে, প্রায় রাত এগারটা বাজে। বর্ষাকাল, টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে মাঝে মাঝেই একটা করে দমকা হাওয়া দিচ্ছিল। আমি বাস থেকে নেমে দীর্ঘপথ হাঁটতে শুরু করলাম। একে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া তার উপর বেশ রাত হয়ে যাওয়ায় রাস্তাঘাট অন্যান্য দিনের তুলনায় একেবারেই ফাঁকা ছিল। তবে একটাই ভরসা ছিল যে রাস্তার আলোগুলো অন্তত জ্বলছিল। কিন্তু কপাল মন্দ, ঠিক তখনই লোডশেডিং হয়ে গিয়ে চারদিকে যেন কেউ হঠাৎ করে আলকাতরা লেপে দিল, একফুট দূরের জিনিসও আর দেখা যাচ্ছেনা, আমার কাছে টর্চও ছিলনা ফলে নিকষ কালো অন্ধকারের মধ্যেই একদম একাই হেঁটে চলেছি। আমি খেয়াল করলাম আশ্চর্যজনকভাবেই রাস্তায় সেইসময় একটাও কুকুর নেই। দমকা হাওয়ায় মাঝে মাঝেই ছাতাটা এলোপাথাড়ি উড়তে উড়তে একসময় উল্টেই গেল। ফলস্বরূপ আমাকে ভিজে ভিজেই যেতে হচ্ছিল। হঠাৎ তার মধ্যেই কেউ যেন পিছন থেকে ডেকে বলল, "শুনছেন? আপনি কোন দিকে যাবেন?" ঐ অন্ধকার দুর্যোগপূর্ণ শুনশান রাতে নারীকন্ঠের ডাক শুনে সত্যি কথা বলতে আমার মতো ঘোর ভূত অবিশ্বাসীরও বুকের রক্ত হিম হয়ে গেছিল, ফলে আমি যেন শুনতেই পাইনি এইভাবে হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলাম। কিন্তু আবার সেই কাতর নারীকন্ঠের আর্তি, "একটু দাঁড়ান না, একসাথে যাব, বড্ড ভয় করছে।" আমি মনে মনে অতীতের সাহসীকতার কথা ভেবে মনকে শক্ত করে পিছন ফিরে তাকিয়ে অন্ধকারে কাউকে দেখতে না পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম, "আপনি কোথায়? দেখতে পাচ্ছি না তো?" সঙ্গে সঙ্গে উত্তর এল, "আর কয়েক পা এগিয়ে আসুন না, তাহলেই আমাকে দেখতে পাবেন।" আমি বেশ কয়েক পা এগিয়ে আবার জিজ্ঞেস করলাম, "কোথায় আপনি? কাউকেই তো দেখছি না।" আবার সেই কাতর কন্ঠ বলে উঠল, "আর কয়েক পা আসুন না।" অর্থাৎ আমাকে আরও খানিকটা যেতে হবে! আমার একবার মনে হল, ঠাকুমার মুখে নিশির ডাকের গল্প শুনেছিলাম, এটা সেরকম কিছু নয়তো!?
আমি কয়েক মূহর্ত কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে ভাবছি আর এগোনটা কি ঠিক হবে? ঠিক তখনই আবার সেই করুণ আর্তি, "আর একটু এগিয়ে আসুন তাহলেই আমাকে দেখতে পাবেন।" এইকথাটা শুনেই হঠাৎ আমার মনে হল তার মানে ঐ মহিলা আমাকে দেখতে পাচ্ছেন কিন্তু আমি তাকে দেখতে পাচ্ছি না। তাই আমি বললাম, "আপনি যখন আমাকে দেখতেই পাচ্ছেন তখন আপনিই একটু এগিয়ে আসছেন না কেন? আমি আর এগোব না আপনি আসতে হলে আসুন।" এইকথা শুনেই সেই নারীকন্ঠ হঠাৎ সুর পাল্টে হাঁসতে হাঁসতে বলল, "দাঁড়িয়ে পড়লেন কেন ভয় পেলেন নাকি?" আমি স্পষ্ট অনুভব করলাম আমার শিরদাঁড়া বেয়ে যেন একটা ঠান্ডা স্রোত নেমে এল। হ্যাঁ আমি প্রচন্ড ভয় পেয়ে আবার পিছন ফিরে হন হন করে অন্ধকারের মধ্যেই হাঁটতে শুরু করলাম। পথ যেন আর শেষই হয় না। অথচ বাসস্টপ থেকে আমার বাড়ি খুব বেশি হলে মিনিট কুড়ি লাগে। আর যতটা পথ আমি হেঁটেছি প্রায় ততটা পথই সেই অদৃশ্য নারীকন্ঠ আমার পিছন পিছন এসেছে, আর নানারকমভাবে আমাকে দিকভ্রান্ত করার চেষ্টা করে গেছে। কিন্তু আমি আর একবারও পিছনে ফিরে তাকাই নি। বাড়ির গেটের কাছে এসে দেখলাম জানলা দিয়ে হারিকেনের আলো দেখা যাচ্ছে। দেখে প্রাণে জল এসেছিল। হ্যাঁ আমি প্রচন্ড ভয় পেয়েছিলাম ঠিকই, একটা ভয়ংকর ভৌতিক অনুভূতিও হয়েছিল। কিন্তু ভূত দর্শন হয়নি।
এর বেশ কয়েক মাস পরে, তখন আমি কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি, একদিন আমাদের ক্লাবের সান্ধ্যকালীন আড্ডা বেশ জমে উঠেছে তখন হঠাৎ সুবল হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বলল, "তোরা কেউ আজকের কাগজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খবরটা দেখেছিস?" সবাই অবাক হয়ে এর ওর মুখের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাচ্ছি দেখে সুবল বলে ওঠে, "জানতাম, তোরা কেউ খবরটা দেখিস নি।" এইরকম নাটকীয়ভাবে কথা বললে অন্য কেউ পার পেত না এটা হলফ করে বলতে পারি, তবে সুবল বলেই সবাই খবরটা জানার জন্য উৎসুক হয়ে উঠল। কারণ সুবল বরাবরই আমাদের আড্ডায় চটকদার খবর পরিবেশন করে থাকত, ফলে রণেন জিজ্ঞেস করল, "তা গুরুত্বপূর্ণ খবরটা কি শুনি!" তখন সুবল বলল, "নৈহাটির কাছে একটা বাড়ি আছে সেই বাড়িতে নাকি একরাত কাটালেই ভূত দর্শন হবেই, একেবারে গ্যারান্টি।" এইকথা শুনেই সবাই নড়েচড়ে বসল কারণ আমাদের ক্লাবের বেশিরভাগ সদস্যই ভূতের অস্তিত্বে ঘোর অবিশ্বাসী। রণেন জিজ্ঞেস করল, " তা সেই বাড়িটা, কোনো ভাঙাচোড়া পোড়োবাড়ি নিশ্চয়ই?" সুবল মুচকি হেঁসে বলল, "মোটেই না, বরং বেশ সাজানো গোছানো আধুনিক বাড়ি।" প্রবাল বলল, "তা সেই সাজানো গোছানো বাড়ির মালিক কি এখন বিক্রি করার জন্য খদ্দের খুঁজছে বলে কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েছে?" সুবল বলল, "বাড়ির মালিক বিক্রি করার আগে একবার শেষ চেষ্টা করছে।" আমি বললাম, "শেষ চেষ্টা করছে, মানেটা কি?" সুবল বলল, "যদি কেউ এককভাবে বা দলবদ্ধভাবে ঐ বাড়িতে একটা রাত কাটিয়ে অক্ষতভাবে ফিরে আসতে পারে তাহলেই নাকি প্রমাণ হয়ে যাবে যে সেই বাড়িটা মোটেই ভুতুড়ে বাড়ি নয়, আর তখন বাড়ির বাজার দরটাও অনেক বেড়ে যাবে।
তবে যদিও আজ পর্যন্ত কেউ তা পারেনি।" রাজু জিজ্ঞেস করল, "আমরা শুধু শুধু এই ভূতের বোঝা বইতে যাব কেন?" সুবল জানাল, "মোটেই শুধু শুধু নয়, সফল হলেই এক লক্ষ টাকা নগদ পুরস্কার।" আজ থেকে বছর তিরিশ আগে একলক্ষ টাকা মানে বিশাল পরিমাণ টাকা, রণেন তখনই রাজী হয়ে কে কে ঐ বাড়িতে রাত কাটাবে ঠিক করে ফেলল। যথারীতি আমাকেই সেই দলের পান্ডা ঠিক করা হল। আমি ছাড়া সেই দলে আর ছিল রণেন, সুবল ও পল্টু। ঠিক করা হল একটা শনিবার দেখে ঐ বাড়িতে রাত্রিযাপন করা হবে, কারণ তার পরের দিন রবিবার হওয়ায় সবার কলেজ ছুটি থাকবে আর বিশ্রাম নেওয়া যাবে।
পরের শনিবার দুপুরে রেডি হয়ে আছি ঠিক সেইসময় পল্টু ফোন করে জানাল যে ওর বাড়িতে হঠাৎ কিছু আত্মীয় এসে পড়ায় ওর পক্ষে আর যাওয়া সম্ভব হবেনা। আমি মনে মনে হেঁসে ভাবলাম এইরকম একটা হওয়ারই ছিল, পল্টু্র সাহসের বহর জানাই ছিল। যাইহোক, আমরা তিনজন লোকাল ট্রেনে উঠে বিকেলের মধ্যেই গন্তব্যে পৌঁছে গেলাম। দেখলাম, একজন দারোয়ান এসে গেটের আর বাইরের দরজার তালা খুলে দিয়েই সে বিদায় নিল। বাড়িটার চারপাশে বেশ খানিকটা ফাঁকা জমি আর বাড়িটাও বেশ পেল্লাই সাইজের। তিন তলা ছাই ছাই রঙের বাড়িটা দেখে বোঝার উপায় নেই যে এটা একটা ভুতুড়ে বাড়ি। আমরা তিনজন ভিতরে প্রবেশ করলাম। ভিতরে আসবাবপত্র সবই আছে। আমি বললাম, "চল্ একটু ঘুরে দেখে নি বাড়িটা।" এই প্রস্তাবে দেখলাম বন্ধুরা খুব একটা উৎসাহ দেখাল না, আমি বুঝলাম ওরা ভয় পেতে শুরু করেছে। ওরা একটা পরিস্কার দেখে ঘরে বসে পড়ল। অগত্যা আমি একাই পুরো বাড়িটা ঘুরে দেখলাম।
অসংখ্য ঘর বাড়িটায়, তবে বেশীর ভাগ ঘরেই লাইট, ফ্যান চলে না। দোতালার একটা ঘরে দেখলাম একটা পিয়ানো রাখা আছে, আর একটা দেওয়াল ঘড়িও আছে যদিও সেটা বন্ধ হয়েই আছে। এই ঘরটাকে দেখে আমার কেন যেন মনে হল যে অন্যান্য ঘরের থেকে এইখানে যেন বেশ কিছুটা প্রাণের ছোঁয়া আছে। একা একাই প্রায় পুরো বাড়িটা ঘোরা হয়ে গেলে ফিরে এসে রণেনের আনা টিফিন ক্যারিয়ার থেকে খাবার খেয়ে নিলাম। আর তারপর সবাই বসে একটু গল্প-গুজব করলাম। হঠাৎ দেখলাম লাইট, ফ্যান সব বন্ধ হয়ে গেল। ঘরটার ভিতরে গাঢ় অন্ধকার দানা বেঁধেছে। আমি পকেট থেকে টর্চ বের করে জ্বালিয়ে দেখি ঘরের সবকটা বন্ধ জানালা কে খুলে দিয়েছে।
ঘরের ঠিক বাইরেই করিডরে কে যেন জুতো পড়ে গটগট করে হেঁটে যাচ্ছে। তারপরেই কিছুক্ষণের অস্বস্তিকর নিস্তব্ধতা। সেই নিস্তব্ধতা ভাঙলো একটা দেওয়াল ঘড়ির ঘন্টায়, ঠিক বারোটা বাজল। অথচ আমার স্পষ্ট মনে আছে যে একমাত্র দেওয়াল ঘড়িটা বন্ধই দেখেছিলাম। আর তারপরেই শুরু হল পিয়ানোর বাজনা। কে পিয়ানো বাজাচ্ছে দেখার ঔৎসুক্যে আমি ওদের দুবার ডাকলাম কিন্তু কোনো সাড়া না পেয়ে আমি উঠে দাঁড়িয়ে টর্চটা জ্বালিয়ে দেখি রণেন আর সুবল দুজনেই অজ্ঞান হয়ে মেঝেতেই পড়ে আছে। আমি দুর্নিবার আকর্ষণে এগিয়ে গেলাম ঐ বাজনা লক্ষ করে, ঐ ঘরের দরজা দিয়ে প্রবেশ করতেই এক জোড়া ভয়ংকর জ্বলজ্বলে নীল চোখ আমার দিকে তাকিয়ে আমায় ডাকল। আমিও যন্ত্র চালিতর মতো তার দিকে এগিয়ে গেলাম, ব্যাস তারপরে আর কিছু মনে নেই। পরদিন সকালে আমার বন্ধুদের গিয়ে বললাম সেই পিয়ানো বাদকের গল্প, কিন্তু একি! ওরা তো আমাকে দেখতেও পাচ্ছে না আর আমার কথাও শুনতে পাচ্ছে না।