Sekhar Bandyopadhyay

Romance Inspirational Others

4  

Sekhar Bandyopadhyay

Romance Inspirational Others

জোড়াপ্রাপ্তি

জোড়াপ্রাপ্তি

8 mins
278



সত্যি সত্যিই অতুল পরীক্ষা দিয়ে সরকারি চাকরিটা পেয়েই গেল। ওর বন্ধুবান্ধব, সহপাঠী বা আত্মীয়স্বজন কেউই বিশ্বাস করতে পারেনি খবরটা একবারে। আর পারবেই বা কি করে, ওকে দেখে বা ওর সঙ্গে কথা বলে এইরকম ধারণা হওয়াটা মোটেই অস্বাভাবিক নয়। এইতো গতবছরের কথা, অতুল ওর বন্ধুদের সঙ্গে খানিকটা দুরের গ্রামের মেলায় গেছিল। মেলায় ঘুরতে ঘুরতে চারদিকে রকমারি জিনিস দেখতে দেখতে যে যার মত আলাদা হয়ে যায়। অতুল ঘুরতে ঘুরতে একটা দোকানে  দাঁড়িয়ে পড়ে ও পছন্দ করে একটা খেলনা কেনে ওর ভাইঝির জন্য। কিনে যেই বেরোতে যাবে দোকান থেকে অমনি দেখে পাড়ার সরলা হাসিহাসি মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। সরলাকে দেখেই অতুল লজ্জা ও ভয়ে কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে স্ট্যাচুর মত দাঁড়িয়ে পড়ল। সে না পারছে কথা বলতে না পারছে পাশকাটিয়ে চলে যেতে। খানিকক্ষণ চুপচাপ দুজনে দাঁড়িয়ে থাকার পর সরলা যখন দেখল অতুল কোন কথা না বলে শুধু হাসিমুখে দাঁড়িয়েই আছে তখন সরলাই প্রথম কথা বলল, “ভালই হল অতুলদা চলুন একসাথে ফেরা যাবে, সন্ধ্যে হয়ে গেছে।“ সরলা ওদের পাড়ার ডাকসাইটে সুন্দরী ও তেমনি মেজাজি। অতুল এই প্রস্তাবে বেশ বিপাকে পড়ল, একদিকে তার বন্ধুরা যদি জানতে পারে যে ওদের ফেলে সে সরলাকে সঙ্গে নিয়ে মেলা থেকে ফিরেছে তাহলে বন্ধুরা ওকে ছেড়ে দেবেনা, আর একদিকে পাড়ার সব ছেলেদের হৃদয় হরণকারীর মিষ্টি আবদার। কিন্তু অতুলকে বেশী ভাববার সময় না দিয়ে সরলা বলল, “ কি হল অতুলদা কি ভাবছেন, আরও কিছু কিনবেন নাকি?” অতুল সামলে নিয়ে বলে উঠল “না আর কিছু কিনব না, কিন্তু আমি ভাবছি আপনি কি একাই মেলায় এসেছিলেন?” সরলা বলল, “না আমি আমার বান্ধবীদের সঙ্গেই এসেছিলাম, কিন্তু এখন আর কাউকে দেখতে পাচ্ছিনা।“ ওরা মেলা থেকে বেরোতেই  সরলা বলে উঠল, “অতুলদা খুব ক্ষিধে পেয়েছে, চলুন ফুচকা খাই।“ অগত্যা দুজনে ফুচকা খাওয়ার পর দুজনেই দাম দিতে গেলে অতুল সাহস সঞ্চয় করে বলে, “না আজকে  বরং আমিই  দামটা দিই, আপনি বরং পরে কোনদিন দিয়ে দেবেন।“ এই কথার পরে সরলা আর কথা বাড়ায়নি। অতুল দামটা মিটিয়ে দিল আর তারপরেই হঠাৎ দেখল সরলার চার বান্ধবী একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে। ওদের দেখেই সরলা হেঁসে বলে উঠল, “ ঐ তো আমার বান্ধবীরা ঐখানে দাঁড়িয়ে আছে আমার জন্যে, আপনাকে আর আমার জন্য কষ্ট করতে হবেনা, আমি  ওদের সঙ্গেই চলে যাব।“ অতুল অস্ফুটভাবে  বলে উঠল , “ হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক আছে ওদের সঙ্গেই চলে যান।“ সরলারা চলে যাওয়ার পরে অতুল একাই বাড়ি ফিরল। আসার সময় সে অনুভব করল, যতক্ষণ সরলা সঙ্গে ছিল কিরকম একটা মিষ্টি অনুভূতি হচ্ছিল। কেমন একটা হিরো হিরো অনুভূতিও যেন তার হচ্ছিল। যাইহোক বাড়ি ফিরে ভাইজিকে খেলনাটা দিতেই  সে খুব খুশী হল, কিন্তু তার বাবা তাকে বলল, “মেলা বেড়ানো হল? কাজকর্ম তো কিছু নেই শুধু আড্ডা আর ঘুরে বেড়ানো আর কতদিন চলবে?” এই কথায় তার মনের ফুরফুরে ভাবটা একেবারে চুপসে গেল। সে তো আর বেশী প্রতিবাদ করতে পারেনা, তাই চুপচাপ সবকথা হজম করল। দুদিন পরে অতুল ওর বন্ধুদের আড্ডায় গেলেই ওকে নিয়ে  হাঁসি, টিটকারি শুরু হয়ে গেল। প্রথমে হকচকিয়ে গেলেও পরে দু-একজন বন্ধুর থেকে জানতে পারল যে সেইদিন মেলায় সরলা ওর বান্ধবীদের সঙ্গে বাজী ধরেছিল যে সে অতুলের গাঁটের কড়ি দিয়ে কিছু খাবে আর যদি খেতে পারে তাহলে বাজী জেতার জন্য ওর সব বান্ধবীরা ওকে রেস্টুরেন্টে ডিনার খাওয়াবে। এই কথা শোনার পর অতুলের সরল মন ভেঙ্গে চৌচির হয়ে গেল। সে আশা করেছিল যে ওর বন্ধুরা ওকে ঘিরে ধরে জিজ্ঞাসা করবে, হ্যাঁরে সরলা তোকে কি বলল? ওর সঙ্গে তোর কি করে দেখা হল? কে প্রথম কথা বললি? ইত্যাদি, কিন্তু কোথায় কি? লজ্জায় দুঃখে অতুল মাটিতে মিশে গেল। কোনরকমে আড্ডা থেকে বেরিয়ে বাড়ির পথ ধরল। ফিরতে ফিরতে ভাবল তার সাথেই সবসময় এরকম কেন হয়! সে তো কারও অনিষ্ঠ করেনি। অনেক ভেবে সে  এই সিদ্ধান্তে উপনীত হল যে তাকে বন্ধুরা বা মেয়েরা বা বাড়ির লোকেরা কেউই সম্ভ্রমের চোখে দেখেনা কারণ সে কোনদিনই ছাত্র হিসাবে ভাল কিছু করে দেখাতে পারেনি আর এখনও সে একজন বেকার। এখন আর যেহেতু সে ছাত্র নয়, তাই কিছু করে দেখাতে হলে তাকে একটা ভাল চাকরি পেয়ে দেখাতে হবে। সে মনে মনে চাকরীর পরীক্ষাগুলো ভাল করে দেওয়ার জন্য কঠোর প্রস্তুতির প্রতিজ্ঞা করল। তাকে চাকরী পেয়ে দেখাতেই হবে। পরদিনই সে চাকরীর পরীক্ষার কয়েকটা বই জোগাড় করে ফেলল। আর শুরু করল নিবিড় অনুশীলন। ওর বাড়ির লোকেরা সবাই বেশ অবাক হয়ে দেখল অতুল শুধুমাত্র বাজার করা ছাড়া আর কখনই বাড়ির বাইরে বের হয় না। সবসময় বইমুখে নিয়ে বসে থাকে। বন্ধুবান্ধবরা ভাবল সরলার ঘটনাটায় লজ্জা পেয়ে হয়ত অতুল আর ঘর থেকে বেরোয় না, এবং এই নিয়ে আর এক প্রস্থ হাসির রোল ওঠে আড্ডায়। এদিকে ওর দাদা, বউদিও সরলার সঙ্গে অতুলের দেখা হওয়া ও তার পরিণতির কথা জানতে পারল ও তাই নিয়ে খাবার টেবিলে হাসি-মস্করা চলতে থাকল। কিন্তু কোনকিছুতেই অতুলকে তার লক্ষ থেকে বিচ্যুত করতে পারেনা। তার ধ্যানজ্ঞান এখন একটাই। এখন ওর মায়ের একটা কথাই সবসময় মনে পড়ে ও নিজের মনে মনেও সেই কথাটাই মন্ত্রের মত আওড়ায়—“পুরুষ মানুষ যদি অর্থ উপার্জন করতে না পারে সংসারে তার কোন মূল্যই নেই।“  এদিকে অতুলের বাবা-মা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে, “ অতুল সারাক্ষণ কি যে পড়ে বোঝা যায়না, বাড়ি থেকেও বেরোতে চায়না, কি যে হল?”  অতুলের মা বলে “ নিশ্চয়ই অতুল ঐ সরলার ঘটনাটায় একটা বড় ধাক্কা খেয়েছে, সেইজন্যেই হয়তো বাইরে বেরোয় না। এখন ঠাকুর ঠাকুর করে যদি একটা চাকরী পেয়ে যায় তাহলে ওরও মনটা ভাল হয়ে যায় আর আমরাও শান্তি পাই।“  

                                      এদিকে সরলার বিএ ফাইনাল পরীক্ষার পর থেকেই ওর মা ওর জন্য সম্বন্ধ দেখতে উঠে পড়ে লাগল। সরলার বাবাকে বলল, “মেয়েতো গ্রাজুয়েশন করে ফেলল, আর বসিয়ে  রাখা ঠিক না, তুমি বরং ওর জন্য পাত্র খোঁজা শুরু কর।“  সরলার বাবা বলল, “দাঁড়াও সবে তো ফাইনাল পরীক্ষাটা দিল এখনও তো গ্রাজুয়েট হয়নি, আগে ভালভাবে পাশ করুক তবে তো ভাল পাত্র জোগাড় করা যাবে। এখনই ব্যাস্ত হয়ে উঠ না। বরং ও কয়েকদিনের জন্য ওর পিসির বাড়ি রাঁচি থেকে ঘুরে আসুক।“  এই কথায় সরলার মা খুবই খুশী হল কারণ, সরলার পিসি মাসতিনেক  আগেই বলে রেখেছিল যে সে সরলার জন্য একটা ভাল পাত্র দেখে রেখেছে। সরলাকে ওর মা রাঁচি ঘুরে আসার কথা বলায় ও খুশিই হল। ঠিক হল সরলা আর তার মা দুজনেই সপ্তাহ খানেকের জন্য পিসির কাছে যাবে। পিসির বাড়ি গিয়ে দু-তিন দিন ভাল ভাল খাওয়া দাওয়া আর ঘুরে বেড়ানোর পর ওর পিসি খাওয়ার টেবিলে কথাটা তুলল, “আমার কিন্তু সরলার জন্য একটা খুব ভাল পাত্র দেখা আছে, আমি পরশুই সরলাকে পাত্রপক্ষকে দেখানোর কথা বলে রেখেছি।“ কথাটা শোনার পর সরলা কেমন একটা অভিসন্ধির গন্ধ পেল। সে জানাল যে এখন বিয়ে করতে চায় না। কিন্তু ওর মা, পিসি আর পিসেমশাইর চাপাচাপিতে বাধ্য হয়ে রাজী হল। আজই বিকালে পাত্রপক্ষ ওকে দেখতে আসবে। সকালের জলখাবার খেতে খেতে সরলা ওর পিসিকে জিজ্ঞাসা করল, “ছেলে কি করে?” ওর পিসি বলল, “ওরা বিশাল ব্যাবসায়ী পরিবার। ছেলে তার বাবার একমাত্র সন্তান এবং স্বভাব চরিত্র ভাল আর পড়াশুনা শেষ করে এখন সম্পূর্ণভাবে ব্যবসায়ে জড়িত, ফলে সব দিক থেকেই তোর পক্ষে ভাল।“ সরলার পিসেমশাই হেঁসে বলল, “শোন, তুই একবার দেখলেই সব ভুলে যাবি, ছেলে যে সাক্ষাৎ রাজপুত্র।“ সরলা মৃদু প্রতিবাদ করে ওঠে, “আমার রাজপুত্রর কোন দরকার নেই। আমি আরও পড়তে চাই।“ 

                                                                          যাইহোক বিকালে পাত্রপক্ষ দেখতে আসল। কিছুক্ষণ একথা সেকথার পর ছেলের বাবা, মা বলল, “আমরা বরং অন্য কোথাও গিয়ে বসি, ওরা ততক্ষণ দুজনে কথাবার্তা বলে নিক।“ এই কথায় সবাই ঘর থেকে চলে গেল। পাত্র সরলাকে নামধাম ও সে কি পড়াশুনা করে ইত্যাদি আরও কিছু সাধারণ কথা জানতে চাইল। সরলাও এক এক করে সব প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিল, কিন্তু বাধ সাধল তখনই যখন পাত্র সরলাকে প্রশ্ন করল, “আচ্ছা তখন থেকে আমিইতো শুধু প্রশ্ন করে যাচ্ছি, আপনি তো কোন প্রশ্নই করছেন না?” আপনার কি কিছুই বলার নেই? আপনার এই বিয়েতে কোন আপত্তি নেই তো? থাকলে বলতে পারেন কোন অসুবিধা নেই।“ সরলা দেখল এই সুযোগ, সে সরাসরি বলল, “আমার এখন বিয়ে করার কোন ইচ্ছা নেই। আমি আরও পড়তে চাই, তারপর চাকরী বাকরি যোগাড় করে বিয়ের কথা ভাববো।“ এরপরে আর বিশেষ কথাবার্তা হয় না ওদের মধ্যে। পাত্রপক্ষ এরপরে শুভেচ্ছা বিনিময় করে চলে গেলে, সরলার মা আর পিসি জানতে চাইল যে ওদের মধ্যে কি কথাবার্তা হল, কিন্তু সরলা আসল কথাটা বেমালুম চেপে গেল, বলল খুব সাধারণ গতানুগতিক কথাবার্তাই হয়েছে।“ পাত্রপক্ষ ফিরে গিয়ে আর কোন যোগাযোগ  না করায় সরলার মা ও পিসি বেশ হতাশই হল, ক্রমে ওদের ফেরার সময়ও হয়ে এল আর সরলারা বাড়ি ফিরে আসল।

                                                                     এদিকে একদিন অতুলের বাবার শরীরটা একটু খারাপ হওয়ায় অতুল সন্ধ্যবেলায় ওষুধ আনতে গিয়ে দেখল সরলাও ওষুধ নিতে এসেছে। সরলাকে দেখে না দেখার ভান করে ওষুধটা নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময়েই সরলা পিছন থেকে ডাকল, “আরে অতুলদা না, দাঁড়ান আমিও বাড়ি ফিরব, আমারও ওষুধ নেওয়া হয়ে গেছে।“ অগত্যা অতুলকে দাঁড়াতেই হল। দুজনেই একসঙ্গে বেরিয়ে হাঁটতে শুরু করল। অতুল সেই পুরনো স্মৃতির সঙ্কোচে কোন কথাই বলতে পারছে না, সরলাই জিজ্ঞাসা করল, “কার শরীর খারাপ করল অতুলদা?” অতুল বলল, “বাবার।“ সরলা বলল, “কেন মেশমশাইএর কি হয়েছে?” অতুল বলল, “না, সেরকম কিছু না, একটু সর্দি-জ্বর আরকি।“ কিছুক্ষণ চুপচাপ চলার পর সরলা বলল, “আচ্ছা অতুলদা আপনি কি আমার উপর এখনও রাগ করে আছেন?” অতুল বলল, “না না রাগ করতে যাব কেন?” সরলা বলল, “যাক বাবা, বাঁচলাম। আমি ভাবছিলাম সেইদিনের ঘটনার পর আপনি এখনও রেগে আছেন। আচ্ছা অতুলদা, আপনি কোন চাকরীর পরীক্ষা দিচ্ছেন না?” অতুল চমকে উঠে বলল, “হ্যাঁ দিচ্ছি তো, কিন্তু হঠাৎ এইকথা কেন?” সরলা একটু লজ্জা পেলেও সামলে নিয়ে বলল, “না, মানে আমারও বি এ ফাইনাল পরীক্ষা হয়ে গেল তো, আমিও এবার চাকরীর পরীক্ষাগুলো দেব ভাবছি, তাই আরকি জানতে চাইছি কিভাবে প্রস্তুতি নেওয়া যায়।“ 

                                          যাইহোক, কিছুদিন পরেই অতুলের পরীক্ষা এসে গেল। খুব টেনশন নিয়ে পরীক্ষাটা দিল সে। যেহেতু নিজের উপর তার আস্থা কম, সে পরীক্ষাটা দিয়ে ঠিক সন্তুষ্ট হতে পারল না। মাস তিনেক বাদে পরীক্ষার ফল বের হওয়ার দিন টেনশনে কাঁপতে কাঁপতে কাউকে কিছু না বলেই সে দেখতে চলে গেল। গিয়ে তো সে অবাক, দেখল যে সে সিলেক্টেড।  অতুলের তো প্রথমে বিশ্বাসই হচ্ছিল না, সে আবার ভাল করে দেখল, না সে ঠিকই দেখেছে। সে তাড়াতাড়ি বাড়ি এসে মাকে খবরটা দিল। 

                                  এদিকে ছোট মফঃস্বল এলাকায় যা হয়, আগুনের মত খবরটা ছড়িয়ে পড়ল।  সরলাও খবরটা পেয়ে থেকেই উশখুশ করতে থাকল। একদিন অফিস থেকে ফেরার পথে অতুলকে ধরে বলল, “আচ্ছা অতুলদা, আপনি কি কিছুই বোঝেন না? আমাকে আর কত খুলে বলতে হবে?” হঠাৎ এই কথা শুনে অতুল বিস্ময়ে আর আনন্দে হতবাক হয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল।        


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance