Sekhar Bandyopadhyay

Inspirational Others

4.2  

Sekhar Bandyopadhyay

Inspirational Others

ভীতু রাতুল

ভীতু রাতুল

6 mins
197



ঠিক রাত আটটা চল্লিশে কৃষ্ণনগর লোকালটা শিয়ালদা থেকে ছাড়ল। এই সময়ের লোকাল ট্রেনটায় সারা সপ্তাহে রোজ প্রচণ্ড ভীড় হলেও আজ বড়দিনের ছুটি থাকায় ট্রেনের কামরাটা তুলনামূলকভাবে ফাঁকাই ছিল। তার হয়ত আর একটা কারণ হতে পারে যে শীতটাও বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে, আর তাই হয়তো সবাই একটু তাড়াতাড়িই বাড়ি ফিরে গেছে। রাতুল ট্রেনে উঠেই একদম ভিতর দিকে গিয়ে একটা ফাঁকা সিটে বসল কারণ, ঠান্ডা হাওয়াটা ভিতরদিকে একটু কমই লাগে। শিয়ালদা ছেড়ে বেরিয়ে ধীরে ধীরে গতি বাড়াল ট্রেনটা। অভ্যাস মত রাতুল একটা ম্যাগাজিন বার করে পড়তে শুরু করল। ওর উল্টোদিকে বসা কয়েকজন মাঝবয়সী যাত্রী তাস খেলার আয়োজন করছিল। কিছুক্ষণ খেলার পরে একজন বলে উঠল, "না খেলা জমছে না। আর একজনকে চাই তাহলে ব্রীজ খেলা যাবে।" তখন একজন রাতুলকে ডেকে বলল, "দাদা শুনছেন? আমাদের একজন পার্টনার কম পড়ছে, একহাত চলবে নাকি?" রাতুল ম্যাগাজিন থেকে মুখ সরিয়ে হাসিমুখে জবাব দেয়, "না ধন্যবাদ, আমি তাস খেলা পছন্দ করি না। আপনারা বরং অন্য কাউকে দেখুন।" ওদের মধ্যে একজন বলল, "সে কি আপনি তাস খেলা পছন্দ করেন না, নাকি তাস খেলতে জানেন না?" রাতুল বলল, "ধরুন দুটোই।" ওদের আর একজন বলল, "আরে বাবা দেখছিস না কিরকম লালটুস চেহারা, তাস খেললে তো খারাপ ছেলে হয়ে যাবে, মা বকবে।" বলেই ওরা নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি শুরু করে দিল। রাতুলের খুব রাগও হচ্ছিল আবার লজ্জাও লাগছিল কিন্তু যেহেতু সে ঝগড়াঝাটি একদমই পছন্দ করেনা তাই সব শুনেও কোনও উত্তর না দিয়ে আবার ম্যাগাজিনটা পড়তে শুরু করল।


              কিছুক্ষণ বাদে ট্রেনটা একটা স্টেশনে থামল। রাতুল কাঁচের জানালা দিয়ে দেখল বেলঘড়িয়া স্টেশন। কামরায় ইতিমধ্যে আরও কিছু লোকজন উঠেছে, আর ওর উল্টোদিকে বসা লোকদেরও তাসের পার্টনার জুটে গেছে, আর তাই ওরা খেলায় মত্ত হয়ে গেছে। বেশ কিছু যাত্রী আপাদমস্তক চাদর জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। রাতুল আবার ম্যাগাজিনের পাতায় চোখ রাখল। কিছুক্ষণ পড়ার পরে তার মনোসংযোগ করতে অসুবিধা হচ্ছিল কিছু যাত্রীর উচ্চস্বরে কথাবার্তা বলার জন্য। সে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল কামরার ডানদিকের কোণায় বসা তিনটে ছেলে খুব জোরে জোরে কথা বলছে আর হাসি মস্করা করছে। ফলে সে ম্যাগাজিনটা ব্যাগে ঢুকিয়ে জানলা দিয়ে দেখার চেষ্টা করল ট্রেনটা কোথায় আসল। ব্যারাকপুর থেকে একটা বড় পরিবার কামরায় উঠল। তাদের মধ্যে জনা চারেক মেয়ে ও মহিলা ছিল। তাদের বেশভূষা, কথা বার্তায় বোঝা যাচ্ছিল যে তারা কোন বিয়েবাড়িতে নেমন্তন্ন খেয়ে ফিরছিল। পরিবারটা ফাঁকা পেয়ে ঐ তিনটে ছেলের পাশে গিয়েই বসল। কিছুক্ষণ পরেই একটা ছেলে বারবার একজন মহিলার গায়ে পড়তে থাকে। দু-তিনবার দেখার পরেই ঐ মহিলা চিৎকার করে প্রতিবাদ করে ওঠে। ঐ মহিলার চিৎকার শুনে কামরার সবার নজর ঐদিকেই গিয়ে পড়ল। ঐ পরিবারের মধ্যে একজনই মাত্র পুরুষ ছিল, তিনি আবার বয়সে প্রৌঢ়। কিন্তু সেই প্রৌঢ়মানুষটাই রুখে দাঁড়াল । ফলে কথা কাটাকাটি শুরু হয়ে গেল। সেই প্রৌঢ় ভদ্রলোকটা চিৎকার করে বলল, "তোমরা এইরকম বেয়াদবি করছ কেন? মহিলাদের সঙ্গে অসভ্যতা করছ তখন থেকে। সরে গিয়ে ভদ্রভাবে বস নইলে ফল ভাল হবে না।" এই কথায় তিনটে ছেলে আরও উত্তেজিত হয়ে বলল, "কাকু আপনি চুপ করে থাকুন আপনার বয়স হয়ে গেছে, শুধুশুধু কেন ঝামেলা করছেন? আমরা কারুর গায়ে পড়িনি। বরঞ্চ আমাদের গায়েই ঐ বৌদি এসে পড়ছিল বারেবারে।" এইকথা শোনার পর বেশ কয়েকজন যাত্রী বলে ওঠে, "ওদের সঙ্গে ভদ্র কথায় কাজ হবে না, উত্তম মধ্যম দিলেই কাজ হবে।" ঐ ছেলেগুলো যেন মনের মতো কাজ খুঁজে পেল এতক্ষণে বলল, "তাই নাকি, তাহলে দেখি কেমন উত্তম মধ্যম দিতে পারেন।" এই বলে তারা জামার আস্তিন গোটাতে শুরু করল। দেখতে দেখতেই কামরার বেশিরভাগ যাত্রীই একযোগে ওদের বিরুদ্ধে মারমুখী হয়ে উঠল আর আশ্চর্যজনকভাবে আরও দুটো ছেলে যারা এতক্ষণ পর্যন্ত চুপচাপ বসে ছিল ঐ ছেলেগুলোর ঠিক উল্টোদিকে, ঐ তিনটে ছেলের হয়েই আসন্ন হাতাহাতিতে অংশগ্রহণ করবে বলে দাঁড়িয়ে পড়ল। খাণিকক্ষণ বাকযুদ্ধ চলার পরে কোন সমাধানের সূত্র তো বেরলই না উল্টে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হতে হতে সত্যি সত্যিই ট্রেনের কামরায় খন্ডযুদ্ধ বেঁধে গেল। ঐ পরিবারের মধ্যে থাকা মেয়ে মহিলারা সভয়ে কামরার এক কোণে জড় হয়ে বসে ঐ হাতাহাতি ও কুরুচিকর মন্তব্যের নীরব সাক্ষী হচ্ছিল। হঠাৎ একজন তরুণী বলে উঠল, "দিদি দেখেছিস ঐদিকে বসা ছেলেটা কোন প্রতিবাদ না করে কেমন চুপচাপ বসেই আছে স্বার্থপরের মতো।" তার দিদি আরও একধাপ এগিয়ে গিয়ে বলল, "আরে দেখছিস না কিরকম ভয়ে সিটিয়ে ক্যাবলার মতো বসে আছে। ও আবার প্রতিবাদ করবে কি রে? ও তো নিজেই পালাতে পারলে বাঁচে, যতসব কাপুরুষ কোথাকার।" 


         রাতুল এতক্ষণ সযত্নে এই ঝগড়া, হাতাহাতি এড়িয়েই চলছিল। সত্যিই তো সে ঝগড়াঝাটি, মারামারি একদমই পছন্দ করে না। সে যে বরাবরই একটু নিরীহ শান্তস্বভাবের। কলেজে পড়ার সময় একবার কয়েকজন সহপাঠী ছাত্রীদের সামনেই তাকে খুব অপদস্থ করছিল, কিন্তু তবুও সে কোন প্রতিবাদ না করে সেখান থেকে উঠে চলে যাচ্ছিল। ঠিক সেইসময় একজন তাকে পিছন থেকে ল্যাঙ মেরে ফেলে দিয়েছিল, আর তা দেখে সব ছাত্রীরা যখন ভীষণ হাসাহাসি করেছিল তখন অপমানের জ্বালায় রাতুল থাকতে না পেরে ঐ ছেলেটাকে একটা সপাটে চড় মারে। অবশ্য তার ফলস্বরূপ তাকে ঐ সহপাঠীরা বেদম প্রহার করে সর্বসমক্ষে। তখন থেকেই সে ঠিক করে নিয়েছিল যে মারামারি তার জন্য নয়, বিপদ থেকে উদ্ধার হতে হবে বুদ্ধি খাটিয়ে। ফলে এখানেও রাতুল সবকিছু দেখেও না দেখার ভান করে বসেছিল কাঁচের জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে। তাই প্রমিলাকন্ঠের তীব্র খোঁচাটাও সম্পূর্ণরূপে শুনেও অবলীলাক্রমে হজম করে যাচ্ছিল। কিন্তু তার শিক্ষিত রুচিশীল মনস্কতায় এইরকম অন্যায়ও বরদাস্ত হচ্ছিল না। কিন্তু সবাই দেখল সে একমনে মোবাইল ঘাঁটতেই ব্যাস্ত। 


            যাইহোক, একটু পরেই ট্রেনটা গ্যালপিং হয়ে গেল ফলে আর কোন লোকজনও ওঠানামা করল না। আর তারপরই ঐ পাঁচজন ছেলের হাতেই নানান অস্ত্র দেখা গেল। তার মধ্যে একজনের হাতে দেখা গেল একটা পিস্তল আর বাকিদের হাতে ধারালো ছুরি। আর যার ফলে এতক্ষণ ধরে যে হাতাহাতিতে সাধারণ যাত্রীরাই সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুযোগ নিচ্ছিল তারা চমকে গিয়ে পিছিয়ে তো গেলই উল্টে কয়েকজন সুর বদলে বলতে শুরু করল নিশ্চয়ই ঐ মেয়েগুলোর কোন উস্কানি ছিল তা না হলে একহাতে কি তালি বাজে কখনও। কিন্তু তারপরই ঐ পাঁচজন স্বরূপ ধারণ করে সবাইকে চমকে দিয়ে বলে উঠল, "আমাদের হাতে সময় কম, যার কাছে যা আছে টাকাকড়ি, গয়না, মোবাইল, ঘড়ি চুপচাপ তাড়াতাড়ি দিয়ে দিন। বেশিবার কিন্তু আমরা এককথা বলব না।" সাধারণ যাত্রীরা যারা মারামারি, হাতাহাতি করছিল এতক্ষণ তারাই সবার আগে এক এক করে টাকা-পয়সা, মোবাইল, ঘড়ি খুলে দিয়ে দিল। মেয়েরাও কান্নাকাটি করতে করতে বিয়েবাড়ির জন্য পড়ে আসা সব গয়না দিতে শুরু করল। একজন মেয়ে একটু মৃদু প্রতিবাদ করায় তাকে ছুরির খোঁচা খেতে হল। ক্রমেই দেখতে দেখতে সবার কাছ থেকে সবকিছু কেড়েকুড়ে সব নেওয়ার পর হঠাৎ একটা ডাকাত খেয়াল করল যে রাতুল খোলা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে একমনে ফোন করে চলেছে। তখনই সে নির্দেশ দিল, "ঐ ন্যাকা শশীটা কিছুই দেয়নি এখনো, ওর কাছ থেকে তাড়াতাড়ি সব নিয়ে নে, পরের স্টেশন আসার মুখেই লাফ মারতে হবে, রেডি থাক সবাই।" তখনই ডাকাতের সর্দারের কথামত রাতুলের হাত মুচড়ে ফোন, টাকা-পয়সা, ঘড়ি সব খুলে নেওয়া হল। রাতুল গোবেচারার মতো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল।


               পরের স্টেশন আসার আগেই হঠাৎ কেউ কিছু বোঝার আগেই রাতুল ট্রেনের চেন টেনে দিল। আর ট্রেনটাও ক্যাঁচ করে ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে পড়ল। ঘটনার আকস্মিকতায় সাময়িকভাবে ডাকাতগুলো হকচকিয়ে গেল, কিন্তু একটু পরেই তাদের সব রাগ গিয়ে পড়ল ঐ রাতুলের উপর। ওরা তখন রাতুলকে ঘিরে ধরে বেদম মারতে শুরু করল। কিন্তু কি আশ্চর্য! বেধড়ক মার সহ্য করেও রাতুলের মুখে একটা স্মিত হাঁসি দেখা গেল। যা দেখে বাকি যাত্রীরা বলাবলি করতে লাগল, "বেচারা ন্যালাক্ষেপা ছেলেটাকে দেখলে মায়াই হয়!" 


              কিন্তু এর মধ্যেই হঠাৎ ঝপাঝপ পনের কুড়িজন সশস্ত্র পুলিশ কামরায় লাফ দিয়ে উঠে পড়ল। আর তড়িৎগতিতে সবকটা ডাকাতকে বামাল গ্ৰেপ্তার করল। অতঃপর সব যাত্রীদের মধ্যে একটা খুশির রোল উঠল আর সবাই যে যার খোওয়া যাওয়া টাকা, গয়না, মোবাইল, ঘড়ি উদ্ধার করতে ব্যাস্ত হয়ে পুলিশের কাছে দাবি জানাল আর পুলিশের তৎপরতার প্রশস্তি শুরু করল। কিন্তু পুলিশ অফিসার হাত তুলে সবাইকে থামিয়ে দিয়ে বলল, "আচ্ছা, আপনাদের মধ্যে রাতুলবাবু কে আছেন? একটু এগিয়ে আসুন।" তখন সবাই অবাক হয়ে দেখল সেই ক্যাবলাকান্ত ছেলেটা সলজ্জ ভঙ্গিতে এগিয়ে গেল। পুলিশ অফিসার বলল, "শুনুন সবাই, ধন্যবাদ আমাদের নয়, ধন্যবাদ রাতুলবাবুকে দিন। রাতুলবাবুই অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তা ও সাহসের সাথে আমাদের পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে সব খবরাখবর দিয়ে এই কুখ্যাত ট্রেন ডাকাতদের ধরতে সাহায্য করেছেন। আমরা দীর্ঘদিন ধরে এই দলটাকে ধরার চেষ্টায় ছিলাম। কিন্তু রাতুলবাবুর মতো সাহায্য কেউই আমাদের করেনি আগে।" 

             এদিকে রাতুল তো প্রশংসার বহর শুনে লজ্জায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। হঠাৎ ঐ মহিলাদের মধ্যে থাকা একজন মেয়ে উঠে দাঁড়িয়ে রাতুলের প্রশংসা করে হাততালি দিতে শুরু করল, আর তা দেখে কামরার সবাই একসঙ্গে হাততালি দিতে থাকল।

 

 


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational