পোড়ারমুখি
পোড়ারমুখি
হঠাৎ করেই শর্মিলার বিয়েটা হয়ে গেল। দেখা নেই শোনা নেই কথা নেই বার্তা নেই যাকে বলে ভোজবাজির মতই সব কিছু হয়ে গেল। শর্মিলার বাবা, মা ও দাদা ওর বিয়ে দেওয়া নিয়ে কতই না চেষ্টা করেছে, কিন্তু কিছুতেই আর হয়ে উঠছিল না। যতবারই কোন সম্বন্ধ আসত, কথাবার্তা কিছুটা এগোবার পরে তা ভেঙ্গে যেত নানা কারণে। হয় মেয়ে শ্যামলা, কিংবা দেনা-পাওনার দাবী না মেটাতে পারার জন্য, নতুবা মেয়ে গেঁয়ো, শহুরে পরিবেশে চলে না এইসব অজুহাতে। বিয়ে কিছুতেই না হওয়াতে এমন মরিয়া হয়ে যায় শর্মিলার বাবা, মা, দাদা যে একবার তো এক জমাদার পাত্রের সাথেই সম্বন্ধ ঠিক করে ফেলেছিল। কিন্তু শর্মিলা কান্নাকাটি করে তীব্র আপত্তি করায় সে যাত্রায় বিয়েটা ভেঙ্গে যায়। শর্মিলার বাবা ঘোর বৈষয়িক মানুষ, একটা ছোট কারখনায় কাজ করে। মেয়েকে কোনরকমে পার করেই তার বেসরকারি চাকুরে ছেলেকে বিয়ে দিয়ে কিছু যৌতুক আদায় করবে ঠিক করে রেখেছে। এখন মেয়েকে পার না করা অবধি তার স্বস্তি হচ্ছে না। শর্মিলা সবই দেখে, সবই বোঝে কিন্তু না বোঝার অভিনয় করে যায়। মনে মনে ঠিক করে যত শীঘ্র সম্ভব বাবা, মায়ের ঘাড় থেকে গলগ্ৰহ হিসাবে বিদায় নিতে পারে ততই সবার পক্ষে মঙ্গল। সে ভালই বোঝে বাবা, মা তাকে বোঝা হিসাবেই দেখে।
ওদের তিনটে বাড়ি পরেই তার বান্ধবী লতার বাড়ি। লতার বাবা বড় ব্যাবসায়ী, অর্থের প্রাচুর্য থাকলেও শর্মিলাকে লতা সত্যিই ভালবাসে। শর্মিলা মাঝেমাঝেই লতাদের বাড়িতে গল্প করতে যায়। লতার মাও মাঝেমধ্যেই শর্মিলাকে ভালমন্দ রান্না করে খাওয়ায়। শর্মিলা যখন বি.এ. পড়তে পড়তেই পড়াশোনা ছেড়ে দিতে বাধ্য হল বাড়ির খরচের চাপে, তখন লতা আর লতার মা বলেছিল, "তুই যদি পড়তে চাস তো পড়তে পারিস, গ্ৰ্যাজুয়েশান অবধি পড়ার খরচ আমরা দিয়ে দেব।" কিন্তু শর্মিলা চায়নি এই নিয়ে তার মা, দাদা বলতে পারে তোর জন্য আমাদের পাড়ায় কথা শুনতে হচ্ছে যে লতারা তোকে পড়াচ্ছে, আমরা পারছি না। ফলে শর্মিলার আর পড়াশোনা এগোয়নি। ফলে প্রবল ইচ্ছা থাকলেও শর্মিলাকে ক্লাস টুয়েলভ্ পাস করেই লেখাপড়ায় ইতি টানতে হল। এই নিয়ে সে যখন মন খারাপ করে বসেছিল, একদিন লতা এসে ওকে ডেকে বলল, "চল্ তোকে মা ডাকছে, জরুরি দরকার।" শর্মিলা গেল দেখা করতে। লতার মা শর্মিলাকে একটা স্মার্টফোন উপহার দিল। শর্মিলাতো কিছুতেই সেটা নেবে না বলে, "না কাকিমা, আমি এটা কিছুতেই নিতে পারব না।" লতার মা বলে "আমি তোর মার মত, তোর জন্মদিন উপলক্ষে এইটা তোকে কি দিতে পারিনা? এটা নে আর তোর নেটের খরচ নিয়ে ভাবতে হবে না।" শর্মিলা জানে লতার মা তাকে কতটা স্নেহ করে, ফলে সে আর না করতে পারেনি।
শর্মিলা ঐ ফোন নিয়ে হাতের কাজ সেরে প্রতিদিন ফেসবুক, হোয়াটস্আ্যপ নিয়ে খানিকটা ভাল সময় কাটায়। আর তো কেউ ওর সাথে সুন্দরভাবে কথা বলে না উল্টে বিয়ে হচ্ছেনা বলে খোঁটা দেয় ওর দাদা, মা। ফলে ঐ ফোনটাই শর্মিলার একমাত্র সঙ্গী, যাকে অবলম্বন করে সে সংসারের জাঁতাকলে পেষাই হওয়া থেকে কিছুটা মুক্তির স্বাদ পায়। ইদানীং সে ফেসবুকে কয়েকজন বন্ধুও জুটিয়েছে। দু একজন ছেলে বন্ধুও আছে তার মধ্যে। কথায় কথায় সে কথা লতাকেও জানায়। লতা ওকে সাবধান করে দেয় যে ফেসবুকের বন্ধু প্রায়ই প্রতারক হয়। কথাটা ক্রমেই শর্মিলার দাদার কানে গেল। ওর দাদা সেই কথাটা ওর মাকে বলল। তারপর দুজনে মিলে খুব বকাবকি করল আর নির্লজ্জ, গায়ে পড়া বলে অপমান করল। শর্মিলার বাবা অবশ্য আরও পেশাদারি মনোভাব পোষণ করে, বলে, "আহা ও যদি নিজের পাত্র নিজে যোগাড় করতে পারে তাহলে অসুবিধা কোথায়?" এইকথা শোনার পরে ওর মা থেমে গেলেও ওর দাদা ঝাঁঝিয়ে উঠে বলে, "ও কি আর কোন ভাল পাত্র যোগাড় করতে পারবে? দেখবে এমন এক পাত্র জোটাবে যাতে সবার নাক কাটা যাবে।" শর্মিলা এইসব শুনে মরমে মরে যায়, কিন্তু মনে মনে ফেসবুক বন্ধুর সম্বন্ধে আরও সতর্ক ও সাবধানী হয়ে যায়।
তবে শর্মিলা ক্রমে ক্রমে সাহস সঞ্চয় করে লতাদের বাড়ি যাবার নাম করে ফেসবুক বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে দেখা করতে যেতে লাগল। বারবার বিভিন্নরকমভাবে সে ফেসবুক বন্ধুকে বাজিয়ে দেখতে লাগল। শর্মিলা বেশ বুঝতে পারছিল যে তার নতুন বন্ধু রীতেশ বেশ বড়লোক ও ব্যাবসায়ী হিসাবে বেশ ব্যাস্তবাগীশ মানুষ। মাঝেমধ্যেই রীতেশ শর্মিলাকে রেষ্টুরেন্টে খাওয়ানো শুরু করল। শর্মিলা রীতেশকে জিজ্ঞাসা করে জেনে নিয়েছে যে সে বাবা মার একমাত্র সন্তান। আর ওর বাবার বিশাল ব্যাবসা আছে। রীতেশও জানতে চায় শর্মিলার বাড়িতে কে কে আছে। বাবা, দাদা কি করে ইত্যাদি। বিশদে জেনে নিয়ে মুচকি হেসে খাওয়ায় মন দেয়, মনে মনে ভাবে তার জহুরীর চোখ খাটি সোনা চিনতে ভুল করবে না। শর্মিলার অবশ্য সংশয় থাকে যে বড়লোক ব্যাবসায়ী ছেলে বা তার পরিবার কি তার মত নিম্মমধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েকে মেনে নেবে তো?
এর মধ্যে শর্মিলার বাবা একটা সম্বন্ধ যোগাড় করে আনল। ছেলের পান বিড়ির দোকান, দোকান নাকি ভালই চলে। আর তাই শর্মিলার মা, বাবা দুজনেই আর দেরি করতে চায় না। কিন্তু শর্মিলা স্বাভাবিক ভাবেই রাজি হয় না। তখন ওর মা বলে, "তোর কি সম্পর্ক আছে কাররু সাথে? থাকলে বলতে পারিস।" শর্মিলা রীতেশের শেখানো পদ্ধতিতে বলল, "আর কদিন অপেক্ষা কর, সব বলব।" শর্মিলা রীতেশকে বলে, "বাড়িতে জানাবে কবে?" রীতেশ শুধু বলে, "আর কদিন অপেক্ষা কর সব বলব, তবে একটু চমক দেব।" এদিকে সব শুনে শর্মিলার দাদা রেগে গিয়ে বলে, "দেখ কোন রিক্সাওয়ালা বা ফুচকাওয়ালাকে জুটিয়ে নিয়েছে হয়ত। এছাড়া আর কাকেই বা জোটাবে।" ইদানীং শর্মিলার দাদা যেন আরও উগ্ৰ হয়ে উঠেছে। উঠতে বসতে সর্বক্ষণ তাকে খোঁটা দিতে থাকে। শর্মিলা আড়ালে চোখের জল ফেলে, ভাবে শুধু শুধু কেন যে ওর সঙ্গে দুর্ব্যাবহার করে বুঝে উঠতে পারে না।
কয়েকদিন পরে হঠাৎ রীতেশ ফোন করে জরুরি তলব করল শর্মিলাকে, বলে, "আজ বিকালে ঠিক পাঁচটার সময় নাইটিঙ্গেল রেষ্টুরেন্টে চলে আসবে, জরুরী কাজ আছে।" শর্মিলা জিজ্ঞাসা করল, "কি জরুরি কাজ?" কিন্তু রীতেশ এড়িয়ে গেল বলল, "আসলেই দেখতে পাবে।" বাড়ির সব কাজ সামলে স্নান খাওয়া সেরে উঠতেই শর্মিলার প্রায় চারটে বেজে গেল। তাড়াহুড়ো করছিল দেখে ওর মা জিজ্ঞাসা করল, "কি রে হুড়োহুড়ি করছিস কেন, কোথাও যাবি নাকি?" শর্মিলা বলল, "হ্যাঁ লতার সঙ্গে আজ একটু বের হব, লতার কিছু কেনাকাটা করতে হবে।" মা বলল "তা তুই মরতে কি করতে যাবি? লতা ওর বাড়ির লোকের সঙ্গে গেলেই তো পারে!" শর্মিলা বলে, "না আজ আমাকেই যেতে বলেছে।" এই বলে একটা ভাল শাড়ি পরে একটু সেজেগুজে সে বেরিয়ে পড়ল।
সন্ধ্যাবেলায় বেজার মুখে কাজ থেকে ফিরল শর্মিলার দাদা। ওর মা জিজ্ঞাসা করল, "কি হল মুখ ভার কেন, শরীর খারাপ নাকি?" শর্মিলার দাদা কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলল, "মা আমার চাকরিটা আর নেই। ব্যাবসা মন্দার অজুহাতে আমাদের পাঁচজনকে উদ্বৃত্ত ঘোষণা করে ছাঁটাই করে দিয়েছে।" এইকথা শোনার পর থেকে শর্মিলার মার মুখ থেকে আর কোন রা সড়ছে না। পাশের ঘর থেকে শর্মিলার বাবা সব শুনে বলল, "সর্বনাশ হয়ে গেল, আমার তো আর মাত্র বছর খানেক চাকরি আছে তারপর সংসার চলবে কি করে? এদিকে শর্মিলার বিয়েটাও দেওয়া গেল না।" ব্যাস এইকথা শোনমাত্রই শর্মিলার মা চিৎকার করে বলতে শুরু করল, "আমার ছেলেটার চাকরিটা চলে গেল আর তিনি গেছেন লতার সঙ্গে কেনাকাটা করতে, ফুর্তি করতে। ধিঙ্গি আইবুড়ো মেয়ে কোন লজ্জা শরমের বালাই নেই!" শর্মিলার দাদাও বলতে শুরু করল, "বড় বেশি বাড় বেড়েছে ওর, আসুক আজকে আজ ওর একদিন কি আমার একদিন।" সবাই এমন চেঁচামেচি করতে শুরু করল যেন আজ শর্মিলার জন্যই এত দুর্দিন দেখতে হল।
এদিকে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়ে গেল শর্মিলা ফিরছে না দেখে ওর বাবা বলল, "দেখ তো লতার বাড়িতে একটা ফোন করে।" শর্মিলার মা লতাকে ফোন করলে লতা জানায়, "না কাকিমা আমি তো কেনাকাটা করতে যাইনি কোথাও।" সঙ্গে সঙ্গে শর্মিলার মা কান্নাকাটি শুরু করে দিয়ে বলল, "পোড়ারমুখি মেয়ে কি নষ্টামী করছে দেখ, ওগো আমাদের মুখ পোড়ালো গো, কি যে হবে?" ওর দাদা বলল, "আসুক না আজ, সব নষ্টামী আমি ছুটিয়ে দেব। কত ভাল ভাল সম্বন্ধ বাতিল করে দিয়ে এখন নষ্টামী করে বেড়ানো হচ্ছে।" ওর বাবা বলল, "পোড়ারমুখি নষ্টামী করুক আর যাই করুক যদি বিয়েটা করে নিত তাহলে আর কোন ল্যাঠা থাকত না।"
অবশেষে রাত এগারটা নাগাদ একটা গাড়ি এসে দাঁড়াল আর শর্মিলা ঝলমলে মুখে গাড়ি থেকে নামল। আর গাড়ির আওয়াজ শুনে ওর মা, বাবা, দাদা সবাই বাইরে এসে দাঁড়িয়েছিল। শর্মিলা গাড়ি থেকে নেমে রীতেশকে ডাকল, "এসো মা, বাবার সাথে দেখা করে যাও।" রীতেশ আর শর্মিলা এসে ওদের সামনে দাঁড়াল। রীতেশ বলল, "নমস্কার মাসিমা, আমরা আপনাদের সারপ্রাইজ দেব বলেই আগে বলিনি, ক্ষমা করবেন। আমরা আজ রেজিস্ট্রিটা করে নিয়েছি, আগামী মাসেই সামাজিকভাবে বিয়েটা সম্পন্ন করব। আপনারা আমাদের আশীর্বাদ করুন।
শর্মিলার বাবা আর মা যতটা যতটা অবাক হল তার থেকেও বেশি আনন্দে বাক্ রহিত হয়ে থাকল আর ওর দাদা এসে রীতেশের পায়ে পড়ে বলল, "স্যার আমার চাকরিটা!"