STORYMIRROR

Sekhar Bandyopadhyay

Drama Crime

3  

Sekhar Bandyopadhyay

Drama Crime

ট্যাক্সিওয়ালা

ট্যাক্সিওয়ালা

5 mins
235


প্রতিদিনের মতোই ঠিক সকাল সাতটায় ট্যাক্সিটা গ্যারেজ থেকে বার করল শম্ভু, করেই খুব যত্ম করে ধোয়া-মোছা করে এয়ারপোর্টের ট্যাক্সিস্ট‍্যান্ডে গিয়ে দাঁড়াল। প্রতিদিনই সে কোনো জনবহুল জায়গা যেমন হাওড়া স্টেশন, শিয়ালদা স্টেশন, ফেয়ারলীপ্লেস লঞ্চঘাট, এয়ারপোর্ট ইত্যাদিকেই বেছে নেয়। সকাল সাতটা থেকে দুপুর দেড়টা পর্যন্ত সে ভাড়া খাটে তারপর দুঘন্টা বিশ্রাম নেয়, আবার সাড়ে তিনটে থেকে রাত এগারোটা পর্যন্ত ট্যাক্সি চালিয়ে তারপরে মালিকের গ্যারেজে জমা করে টাকা পয়সার হিসাব মিটিয়ে তবে বাড়ি ফেরে। শম্ভুর বাড়িতে মা ছাড়া আর কেউ নেই, বাবা আগেই গত হয়েছে। ওর বাবা একটা ছোট্ট কারখানায় কাজ করত। লেখাপড়ায় শম্ভু খুব ভালো না হলেও মন্দ ছিল না। কিন্তু বাবার মৃত্যুর পর পড়াশুনো ছেড়ে চাকরির খোঁজে পথে নামতে বাধ্য হয়। বহু চেষ্টা করেও কোনো চাকরি না পেয়ে হতাশ হয়ে যাচ্ছিল সে। একদিন চাকরির সন্ধান সেরে বাড়ি ফিরে শুনল ওদের পাড়ারই রামদুলালকাকা বাড়ি এসে ওর মাকে বলে গেছে, "শম্ভু যদি চায় তো আমার ট্যাক্সিটা ও চালাতে পারে, কারণ আগের বিহারী ড্রাইভার কাজ ছেড়ে দিয়ে দেশে চলে গেছে। মল্লিকদার ছেলের জন্য আমি দৈনিক কম টাকাতেই চালাতে দেব।" হঠাৎ এই সুযোগ পেয়ে শম্ভু যেন হাতে স্বর্গ পেল। সে দুদিন পরেই কাজে লাগল। ব্যাস সেই থেকেই সে হয়ে গেল ট্যাক্সিওয়ালা।


          প্রতিদিনই নতুন নতুন ধরনের যাত্রী বহন করতে হয়, কত বিচিত্র অভিজ্ঞতা তার ঝুলিতে জমা হয়। একদিন তার ট্যাক্সিতে এক ভদ্রলোক উঠল হাওড়া স্টেশন থেকে বালিগঞ্জে যাবে। গন্ত‍ব‍্যে পৌঁছে সেই ভদ্রলোক ভাড়া মিটিয়ে চলে যাওয়ার পর পিছনের সীটে সে দেখল একটা প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগ পড়ে আছে। শম্ভু ক্যারিব্যাগটা খুলে দেখল ভেলোর হাসপাতালের মেডিক্যাল রিপোর্ট। নিশ্চয়ই ভদ্রলোক ভেলোরে চিকিৎসা করিয়ে ফিরছিল, তাই সে খুঁজতে খুঁজতে ঐ ভদ্রলোকের বাড়ি গিয়ে প‍্যাকেটটা ফেরৎ দিল। আর সেই ভদ্রলোক কোনরকমে একটা ধন্যবাদ জানিয়েই প্রায় মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিল। শম্ভু শুধু একটু ভদ্রতা, আপ্যায়ন আশা করেছিল। কিন্তু সে হতাশই হল। ফিরে আসতে আসতে সে ভাবছিল না গেলেই হত, আমারই বা কি দরকার ছিল ওটা ফেরৎ দিতে যাওয়ার। কিন্তু পরক্ষণেই তার শিক্ষিত রুচিশীল বিবেক তাকে বলে সে তো কোনো কিছুর আশা করে ফেরৎ দিতে যায়নি। তাই সে সব ভুলে আবার গুনগুন করে গান করতে করতে এগিয়ে চলে। আবার একবার সে এক যাত্রীর টাকা ভর্তি ব্যাগ ফেরৎ দিতে যায়। লোকটাকে খুঁজে পেয়ে সেটা ফেরৎ দিতেই সেই লোকটা ওকে জড়িয়ে ধরে ধন্যবাদ জানিয়ে বলে, "এই টাকাটা আমার সারা জীবনের সঞ্চয়, এটা ফেরৎ না পেলে আমাকে গাছতলায় থাকতে হত, তুমি এখান থেকে কিছু টাকা নিয়ে নাও।" সে তো কিছুতেই টাকা নেবে না, কিন্তু সেই যাত্রী তাকে চা-মিষ্টি খাইয়ে হাজার টাকা জোর করে পকেটে গুঁজে দেয়।


     আজকে সে সকাল সকাল এয়ারপোর্টে এসে বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষায় থাকলেও কোনো যাত্রী পাচ্ছিল না। ট্যাক্সিতে বসে থেকে থেকে শম্ভু ঘুমে ঢুলতে শুরু করল। ঘুম ভাঙল এক মহিলা কন্ঠস্বরে, "দাদা ঠাকুরপুকুর যাব।" ঠিক তক্ষুণি আরও দুজন লোক এসে বলল, "আমরাও জোকা যাব পার্কসার্কাস হয়ে।" শম্ভু অবাক হয়ে যায়, এতক্ষণ কোনও ভাড়া হচ্ছিল না আর এখন একসঙ্গে দু-দুটো! কিন্তু আবার ভাবলো যে ঐ মহিলা রাজি হলে তবেই জোড়া প্যাসেঞ্জার পাওয়া যাবে। শম্ভু মহিলাকে জিজ্ঞেস করল, "ম্যাডাম ওনারাও একই রাস্তা দিয়েই যাবে, ওনাদেরও সাথে নিলে কোনো আপত্তি নেই তো?" মহিলা যাত্রী বলল, "কিন্তু আমি তো আগে এসেছি।" তখন ঐ লোকদুটো বলল, "দেখুন দিদি স্ট‍্যান্ডে আর কোনও ট্যাক্সিই নেই, আমাদের খুব তাড়া আছে আর আপনিও প্রায় একই জায়গায় যাবেন, প্লিজ না করবেন না।" মহিলা আর শম্ভু দুজনেই ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল সত্যিই একটাও ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে নেই। অগত্যা মহিলা নিমরাজি হল। ট্যাক্সি ক্রমে ভিআইপি রোড পার করে উল্টোডাঙা থেকে বাইপাস ধরল। সাইন্সসিটির একটু আগে একটা ধাবার কাছে, পিছনের একটা লোক হঠাৎ, "এখানে একটু দাঁড়াও ভাই, দাঁড়াও ভাই" বলে এমন ঝুলোঝুলি করতে শুরু করল যে বাধ্য হয়ে শম্ভু ট্যাক্সিটা দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞেস করল, "কি ব্যাপার?"


দূরের ঐ ধাবাটা দেখিয়ে লোকটা বলল, "দিদি প্লিজ একটু হেল্প করুন আমাদের। ঐ ধাবাটার ক্যাশ কাউন্টারে গিয়ে বলুন মিঃ ভার্মার মেডিসিনটা দিন, এটা বললেই ওরা জিজ্ঞেস করবে কোন মিঃ ভার্মা, তখন শুধু বলবেন রাঁচির ভার্মা সাব। তাহলেই ওরা মেডিসিনটা দেবে।" এইকথা শুনে মহিলা বলল, "আপনার মেডিসিন আমি আনতে যাব কেন?" ঐ লোকটা বলল, "দেখুন ভার্মাসাবের অবস্থার অবনতি হচ্ছ, ওনাকে একভাবে ইনহেলার দিতে হচ্ছে দেখছেন তো।" মহিলা আর শম্ভু দুজনেই দেখল অন্য লোকটা কিরকম তীব্র শ্বাসকষ্টে খাবি খাচ্ছে। তখন শম্ভু বলল, "আচ্ছা ম্যাডামকে যেতে হবে না আমিই যাচ্ছি মেডিসিনটা আনতে।" এইকথা শুনেই লোকটা বলল, "না না ড্রাইভার তোমাকে ওরা দেবেনা। ওরা ভার্মাসাবের পিএ ভেবে ম্যাডামকে দিয়ে দেবে। সেইভাবেই ভার্মাসাবের বলা আছে। আর দেরি করবেন না ম‍্যাডাম, প্লিজ তাড়াতাড়ি যান।"


ঐ মহিলা চাপে পড়ে ইতস্ততঃ করছে দেখে শম্ভু বলল, "দাঁড়ান আমি একবার রিকোয়েস্ট করেই দেখি।" পিছনের লোকটা বারেবারে বারণ করল, কিন্তু শম্ভু বারণ না শুনেই দৌড়ে গিয়ে সব বলল, কিন্তু তাকে কেউ পাত্তাই দিলনা, উল্টে প্রায় তাড়িয়ে দিল। সে ফিরে এসে বলল, "না ওরা দিল না।" লোকটা বলল, "আমি জানতাম দেবেনা, ম্যাডাম প্লিজ তাড়াতাড়ি যান ভার্মাসাবের খুব বিপদ। দেরি করলে একটা কিছু হয়ে যেতে পারে।" তখন বাধ্য হয়ে গজগজ্ করতে করতে মহিলা গেল আর কি আশ্চর্য! হাতে একটা প্যাকেট নিয়ে ফিরল। সেই প্যাকেটটা প্রায় ছোঁ মেরে লোকটা নিয়ে নিল আর একটা ইনহেলার বার করে টানাতেই মিনিট দুয়েকের মধ্যে ভার্মাসাব সুস্থ হয়ে উঠল। 

             শম্ভু তাড়া দিয়ে বলল, "তাহলে এবার চলা যাক।" লোকটা বলল, "হ্যাঁ, এবার চলো, আগে একটু গড়িয়ায় চলো।" শম্ভু অবাক হয়ে বলল, "সেকি! আপনারা তো জোকা যাবেন পার্কসার্কাস হয়ে?" মিঃ ভার্মা সুস্থ হয়ে উঠে বলল, "হ্যাঁ বলেছিলাম কিন্তু গড়িয়াতে একটা কাজ করেই চলে যাব।" "আমি আগে পার্কসার্কাস যাব, ওখান থেকে গড়িয়া যাব" এইকথা বলে শম্ভু গাড়ি ঘুরিয়ে চালাতে শুরু করল। গাড়ি ঘোরাতে দেখেই পিছনের দুই যাত্রীই চিৎকার করে বলল, "আরে ড্রাইভার তুমি কথা শুনছ না বদমাইশি করার চেষ্টা করবেনা একদম, গাড়ি থামাও।" শম্ভু হেঁসে বলল, "আরে স্যার আমার ঠিক পাঁচমিনিটের কাজ আছে, যাব আর আসব।" এই বলে ট্যাক্সির গতি বাড়াল। আর প্রচন্ড রেগে গিয়ে হঠাৎ শম্ভুর মাথায় পিস্তলের বাঁট দিয়ে সজোরে আঘাত করল ভার্মা। প্রচণ্ড আর্তনাদ করেও গাড়ির গতি একটুও না কমিয়ে সোজা কসবা থানায় ঢুকিয়ে দিল। আর সঙ্গে সঙ্গে জনাদশেক সশস্ত্র পুলিশ ঘিরে ফেলল ট্যাক্সিটাকে। থানার ওসি এসেই অর্ডার করল তিন যাত্রীকেই গ্ৰেপ্তার করার। আর শম্ভুর সঙ্গে হাত মিলিয়ে বলল, "তোমার সাহসিকতার জন্যই এই ড্রাগ পাচারকারীরা আজ বহুদিনের চেষ্টায় ধরা পড়ল।" শম্ভু লাজুক হেঁসে বলল, "না স্যার আমি আপনার নির্দেশটুকু পালন করেছি মাত্র।"

         


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama