Sekhar Bandyopadhyay

Others

4.5  

Sekhar Bandyopadhyay

Others

জয়ী

জয়ী

3 mins
208


ছোট থেকেই তনু পাড়ায় খুব ডানপিটে আর পরোপকারী হিসাবে পরিচিত ছিল। গাছে ওঠা, সাঁতার কাটা, ফুটবল খেলা সবেতেই সে তার পাড়া নন্দরামপুরের ডাকসাইটে চ্যাম্পিয়ন ছিল। আবার প্রতিবেশীদের বিপদে আপদেও নির্দ্বিধায় ঝাঁপিয়ে পড়ত। কারুর বাড়িতে অসুস্থ রুগীকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে বা কারুর বাড়ির মৃতদেহের সৎকার করতে হবে সব ব্যাপারে সে ছিল নিরলস। সে পাড়ার ফুটবল দলেরও ক্যাপ্টেন ছিল, পাশের পাড়া মাণিকগঞ্জকে তার দল হেলায় হারাতো। কিন্তু প্রতিবছর নন্দরামপুর ও মাণিকগঞ্জের মধ্যে একটা মর্যাদাপূর্ণ সাঁতার প্রতিযোগিতার আসর বসে। দুই পাড়া থেকেই বাছাই করা দুজন করে সাঁতারু নিয়ে গঙ্গা পারাপার করার প্রতিযোগিতা। বিজয়ী দলকে দশহাজার টাকা নগদ ও একটা সুদৃশ্য ট্রফি দেওয়া হয় ফি বছর। দুজন সাঁতারুর একজন এইপার থেকে ঐপারে যাবে আর একজন সাঁতারু ঐপার থেকে এইপারে আসবে। যারা প্রথম ফিরে আসতে পারে তাদের জয়ী ঘোষণা করা হয়। গত দুবছর ধরে এই মর্যাদার লড়াইয়ে মাণিকগঞ্জ জিতে আসছে, আর এই নিয়ে নন্দরামপুরকে ওরা কম দুয়ো দেয়না। গতবছর তনু প্রাণপণ লড়াই করেও জিততে পারেনি দুটো কারণে। এক নম্বর হল ওর সতীর্থ এপার থেকে ওপারে যাওয়ার সময় এতটাই পিছিয়ে পড়েছিল যে পরে তনু আর কিছুতেই ঐ দূরত্ব মেটাতে পারেনি আর দ্বিতীয় কারণ হল মাণিকগঞ্জের উপল গোস্বামী নামে একজন সাঁতারুর উপস্থিতি। উপল সাঁতারে ওদের সমগ্ৰ জেলার চ্যাম্পিয়ন। নন্দরামপুরের লোকেরা এবার বসে ঠিক করল এই বছর তনুর সাথে বিপিন থাকবে, কারণ, গতবার তনুর পছন্দমত রাহুলকে নেওয়া হয়েছিল। আর ঐ রাহুলের জন্যই তারা হারে। বিপিন এদিকে এবছর ওদের জেলার দলেও ডাক পেয়েছিল। ফলে বিপিনকে নিয়েই তনুদের জোর অনুশীলন চলতে লাগল। উল্টোদিকে মাণিকগঞ্জের দুই সাঁতারু উপল আর নিখিলও অনুশীলনে মেতে থাকল। প্রতিদিনই দুপক্ষের গুটিকয়েক সমর্থক ওদের অনুশীলনে ভীড় জমাত। তারা নিজেদের সাঁতারুদের যতটা উৎসাহ যোগাত তার থেকে বেশি বিপক্ষকে টিটকারি দিতেই ব্যাস্ত থাকত। ফলে দুপাড়ার সমর্থকদের মধ্যে রেষারেষি, উত্তেজনা বেড়েই চলছিল। মাণিকগঞ্জের সমর্থকরাই বেশি টিটকারি দিত কারণ তারাই গত দুবছর ধরে ট্রফিটা জিতেছিল। আর অন্যদিকে নন্দরামপুরের সমর্থকেরাও বলছিল এবার তারাই জিতবে, তবে তাদের গলার জোর যেন কিছুটা কমই ছিল। যদিও এইসব রেষারেষি, টিটকারি তনুকে স্পর্শ করতে পারত না। সে প্রায় রোজই অনুশীলন শেষ করে ফেরার সময়ে উপলদের সাথে দু-চার কথা বলে তবে বিদায় নিত। যার জন্য তাকে দুপক্ষের সমর্থকদের থেকেই অনেক টিটকারি হজম করতে হয়েছে। 

              ক্রমেই এসে গেল সেই বহু প্রতীক্ষিত সাঁতার প্রতিযোগিতা। বিকাল চারটের মধ্যেই দুই পাড়া থেকেই ঝেঁটিয়ে লোক এসে গঙ্গার পাড়ে ভীড় জমাল। ছেলে, বুড়ো, মেয়ে, বৌ কেউই বাদ থাকল না। মাণিকগঞ্জের লোকেরা বলাবলি করতে লাগল এবারও তারাই ট্রফি জিতবে, তারা উচ্চস্বরে ধ্বনি দিতে লাগল। অন্যদিকে নন্দরামপুরের যুবক সমর্থকরাও পাল্টা ধ্বনি দিতে থাকল। ক্রমেই উত্তেজনার পারদ চড়তে থাকে। ঠিক পাঁচটার সময় প্রতিযোগিতা শুরু হল টানটান উত্তেজনার মধ্যে। দর্শকরা মে মাসের বিকালের পড়ন্ত রোদের উত্তাপের মধ্যে আরও উত্তেজনায় দরদর করে ঘামতে ঘামতেও চিৎকার করে উৎসাহ দিতে থাকে। প্রথমে এইপার থেকে শুরু করল বিপিন আর নিখিল। আর আগে থেকেই ঐপারে তনু আর উপল অপেক্ষমান ছিল। কিছুক্ষণ পরেই এইপারের দুই প্রতিযোগি ঐপারে পৌঁছল। এবারেও নিখিল, বিপিনের আগেই পৌঁছল। ফলে তনু পিছিয়ে থেকেই সাঁতার শুরু করল। তনু প্রবল বেগে সাঁতরে উপলকে প্রায় ধরে ফেলার উপক্রম করল কিছুক্ষণ পরেই। ক্রমেই তনু উপলকে ধরেও ফেলল। আর তা দেখে নন্দরামপুরের ছেলে মেয়েরা চিৎকার করে, করতালি দিয়ে উৎসাহ যুগিয়ে যাচ্ছিল, অন্যদিকে মাণিকগঞ্জের দর্শকরা একটু দমে গেছিল। একটু পরেই সবাই দেখল তনু উপলকে টপকে এগিয়ে গেল। কিন্তু কি আশ্চর্য! হঠাৎ দর্শকরা অবাক হয়ে দেখল উপল চিৎকার করে বাঁচাও, বাঁচাও বলছে, আর তনু সাঁতরে পিছনদিকে গিয়ে উপলকে একহাতে ধরে আর একহাতে সাঁতরে পাড়ের দিকে নিয়ে আসছিল। সব দর্শকরা চাপা গুঞ্জন শুরু করল। আর তনু কোলে করে উপলকে পাড়ে তুলে দিল আগে, তারপরে নিজেও উঠল। আর নিরপেক্ষ রেফারি উপলকে জয়ী ঘোষণা করল।

               সবাই যখন জিজ্ঞাসা করল কি ব্যাপার, ততক্ষণে খানিকটা সুস্থ হয়ে উপল বলল, "আমি যখন দুপায়ের পেশির টানে ডুবে যাচ্ছিলাম তখন তনু নিজের স্বার্থ ত্যাগ করে আমাকে বাঁচাল, ওকেই জয়ী ঘোষণা করা হোক, 

ওই আমাদের প্রকৃত জয়ী।"


Rate this content
Log in