The Stamp Paper Scam, Real Story by Jayant Tinaikar, on Telgi's takedown & unveiling the scam of ₹30,000 Cr. READ NOW
The Stamp Paper Scam, Real Story by Jayant Tinaikar, on Telgi's takedown & unveiling the scam of ₹30,000 Cr. READ NOW

arijit bhattacharya

Horror

2.5  

arijit bhattacharya

Horror

অভিশপ্ত গড়

অভিশপ্ত গড়

22 mins
949


শরতের বিকাল। পড়ন্ত মায়াবী রোদ। অজিত তার দীর্ঘদিনের গার্লফ্রেণ্ড প্রিয়াঙ্কাকে নিয়ে এসেছে ছত্তিশগড়ের শাল সেগুন পিয়াল অধ্যুষিত ঘন অরণ্যে, দীর্ঘদিন আগে যা দণ্ডকারণ্য নামে পরিচিত ছিল রামায়ণ মহাভারত আর পুরাণের পাতায় পাতায়,সেই ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় অরণ্যের বুকে কোলকাতা শহরের কোলাহল আর কৃত্রিমতা থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে থেকে প্রেমের কিছু অন্তরঙ্গ মুহূর্ত কাটানোর। টিনএজ থেকেই অরণ্য বিশেষ করে ছোটনাগপুর অঞ্চল আর পশ্চিমঘাট চুম্বকের মতো এক অমোঘ মায়াবী আকর্ষণ দিয়ে টানে অজিতকে। এক দিকে ছোটনাগপুর অঞ্চলের শাল, সেগুন,মহুয়া আর পলাশ অধ্যুষিত পর্ণমোচী অরণ্য ,আরেকদিকে পশ্চিমঘাটের বৃষ্টিবহুল অঞ্চলের হিংস্র শ্বাপদ আর নানাবিধ ভয়সংকুল চিরহরিৎ।উটি তার ঘোরা আছে, তাই আগে থেকেই প্রিয়াঙ্কার সাথে আলোচনা করে ঠিক করেছিল যে, এবার তার গন্তব্য ছোটনাগপুরই হতে চলেছে । প্রিয়াঙ্কাও জঙ্গল খুব ভালোবাসে।বুদ্ধদেব গুহ র গল্পের সে যেমন দারুণ ভক্ত,তেমন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আরণ্যকও তার খুব প্রিয়। তাই তো সে অজিতের প্রস্তাবে প্রথমেই একবাক্যেই হ্যাঁ বলেছে।

বহু প্রাচীন জায়গা এই ছত্তিশগড়। পূর্বে এর নাম ছিল মহাকোশল। এখানে রাজত্ব করতেন আটবিক রাজ্যের অধিপতি মহাপরাক্রমশালী মহেন্দ্র,যাকে সম্মুখ সমরে পরাজিত করেন গুপ্ত যুগের শ্রেষ্ঠ সম্রাট 'ভারতের নেপোলিয়ন ' সমুদ্রগুপ্ত।

যাই হোক,সেই মহাজনপদ 'মহাকোশল' কিভাবে বিবর্তিত হয়ে ছত্তিশগড়ে পরিণত হল,তা এক দীর্ঘ আলোচনার বিষয়।

এরপর শুরু হয় চেদী বংশের রাজাদের শাসন। মহাভারতে তো উল্লেখ রয়েছেই শ্রীকৃষ্ণের পরম শত্রু চেদীরাজ শিশুপালের কথা। এইখানেই নাকি পাণ্ডবরা তাদের বনবাসের একটি বছর অতিবাহিত করেছেন। পুরাণের কথা যদি বাদ দেওয়া যায়, তবে চেদী বংশ সম্পর্কে প্রমাণসাপেক্ষ ইতিহাস পাওয়া যায় মূলত দশম ও একাদশ শতকে।জানা যায় গাঙ্গেয় দেব এবং তার সুপুত্র কর্ণদেবের কথা যাদের সময়ে এই রাজ্যের উত্তরসীমা রাজস্থান অবধি বিস্তৃত ছিল। ইতিহাসবেত্তারা বলেন, এই চেদী বংশের রাজাদের জন্য অঞ্চলটির নাম হয়েছে 'চেদিসগড়',এবং সেটি উচ্চারণের সাথে সাথে বিবর্তিত হয়ে পরিণত হয়েছে ছত্তিশগড়ে। আবার ,কেউ কেউ বলেন অন্য এক কথা। চেদী বংশের রাজাদের মোট ছত্রিশ খানা দুর্গ বা গড় ছিল। তাদের মধ্যে লাফাগড়, চৈতরগড়,নওয়াগড়, রতনপুর,বিজয়পুর,রায়পুর,দুর্গ এখনও বিদ্যমান রয়েছে সদম্ভে এবং ইতিহাসপ্রেমী পর্যটকদের এক চৌম্বকীয় বলে যুগের পর যুগ ধরে আকর্ষণ করে চলেছে এবং বাকি গড়গুলি মহাকালের মায়াও কিছু জরাগ্রস্ত, আবার কিছু নামহীন গড় গহন বনানীর মধ্যে,সভ্য সমাজ দ্বারা এখনোও অনাবিস্কৃত। আদিবাসী সমাজে শোনা যায় তাদের নিয়ে কতো লোককথা, কতো আদিভৌতিক রহস্যময় উপকথা । তাদের মধ্যে কিছু গড় নাকি কোনো অজানা মায়াবী মন্ত্রবলে অভিশপ্ত। ভুলক্রমে তার ধারেকাছে গেলে বা গড়ের মধ্যে ভুলক্রমে ঢুকে পড়লে তো বিপদ অবশ্যম্ভাবী বটেই,দূর থেকে সেগুলিকে দেখে ফেললেও নাকি নিজের জীবনে নেমে আসতে পারে চরম বিপদ।

শাল সেগুনের বনে অধ্যুষিত পাহাড়ের কোলে অবস্থিত খারসিয়া তেহসিলের বরগড় গ্রাম। এখানের কাছেই গ্রাম থেকে গোটা ছয়েক মাইল দূরে জঙ্গলের মধ্যে মন মাতাল করা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মাঝে প্রিয়াঙ্কাকে নিয়ে কয়েক দিন প্রেমের জোয়ারে ভেসে যাবার জন্য এসেছে অজিত।শালিমার থেকে শালিমার গোণ্ডা সুপারফাস্ট স্পেশালে রায়গড়,সেখান থেকে ছত্তিশগড় ট্যুরিজমের বাস। অজিত আগের দিন কাছেই বরগড় গ্রামে ঘুরতে গিয়েছিল। আদিবাসী গ্রাম,গোণ্ড সম্প্রদায়ের মানুষের বাস মূলত ।আগের দিন মোড়ল বলছিল অদ্ভূত এক কথা।

অজিতরা যে ফরেস্ট গেস্ট হাউসে উঠেছে, তার কাছেই নাকি একটা বহু পুরনো গড় আছে। গড়টা নাকি দিনের সূর্যের আলোয় চোখে পড়ে না, এমনি অদ্ভূত।গড়টা নাকি অভিশপ্ত! স্বয়ং শয়তানের অনুচর নাকি সেটি নাকি পাহারা দেয়। ঐ অভিশপ্ত গড়ের ধারেকাছে কেউ যদি আসে , বা যদি গড়টিকে খালি চোখে দেখেও ফেলে,তারপর তার জীবনে বিপদ অনিবার্য। মনে মনে হাসল অজিত, যতোসব গাঁজাখুরি উপকথা।

দক্ষিণমুখী ঘর। সারা হোটেলে দক্ষিণমুখী ঘর এই একটাই আছে। খোলা জানলার সামনে বসে দূরের ধূসর পাহাড়শ্রেণী আর গহন অরণ্যানীর সৌন্দর্য সুধা পান করছিল অজিত। আর তখনি তাকে পেছন থেকে এসে হঠাৎই জড়িয়ে ধরল প্রিয়াঙ্কা। পড়ন্ত বিকালের এই নরম আলোয় প্রেমিকাকে বড়ো ভালোবাসতে ইচ্ছা করল অজিতের। অজিতের ঠোঁট স্পর্শ করল প্রিয়াঙ্কার রসালো দুই ওষ্ঠ এবং অধর।হাত দিয়ে ছুঁল তার কোমল দেহবল্লরী। চাহিদার টানেই আরো ঘনিষ্ঠ আর অন্তরঙ্গ হয়ে গেল দুই কপোত কপোতী। কেউ বাধা দেবার নেই এখন তাদের এই প্রেমের আদিম খেলায়।তীব্র আলিঙ্গনে মত্ত হয়ে উঠল নিরাবরণ দুই যুবক যুবতী।

অস্তাচলে চলে গেছেন দিবাকর। কিন্তু একি! ঘরটা আচমকাই এতো ঠাণ্ডা লাগছে কেন। সবে তো সেপ্টেম্বর মাস।চারিপাশ কেমন যেন ধোঁয়াটে কুয়াশায় ভরে গেছে। গোধূলির মৃদু আলো আঁধারিতে জানলা দিয়ে যা দেখল, চমকে উঠল অজিত। যেন শূন্য থেকে উদয় হয়ে তার সামনে পাহাড়ের বুকে এসে দাঁড়িয়েছে আগাগোড়া কালো পাথরের তৈরি সেই অভিশপ্ত গড়।


উফ,কতোদিন পর আবার একটা লম্বা ট্যুর। সোজা কোলকাতার জনকোলাহল এড়িয়ে শারদীয়ার জাঁকজমক ছেড়ে হাজার মাইল দূরে ছত্তিশগড়ের এক অরণ্যময় প্রাচীন রহস্যময় জায়গা। শারদীয়াকে কোন বাঙালি না ভালোবাসে বা সে কোলকাতায় না থাকলে শারদীয়াকে না মিস্ করে। কিন্তু, ছোটবেলা থেকেই ইতিহাস আমাকে যেমন টানে দুর্নিবার আকর্ষণে,তেমন আদিবাসী জনগোষ্ঠীদের জীবনযাপনও আমায় যথেষ্ট আকর্ষণ করে। আর শুনেছি রায়গড় শহর থেকে খানিক দূরে এই অঞ্চলে ভারতের সবথেকে বৃহত্তম উপজাতি গোণ্ড বাস করে। তাদের ভাষা, তাদের খাদ্যাভ্যাস, তাদের জীবনযাপন, তাদের ধর্মীয় রীতিনীতি আমাকে দুর্নিবার আকর্ষণে টানে।তাই তো,ভাস্কর যখন অফিসের একঘেয়েমি আর কাজের চাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য মাইন্ড রিফ্রেশমেন্ট করার এই ট্যুরের কথা বলেছিল,তখন এককথাতেই রাজি হয়ে গিয়েছিলাম। এছাড়া, আরেকটা কারণওছিল। ভাস্করই কোথা থেকে ইনফর্মেশন জোগাড় করেছিল,কাছাকাছি চেদী বংশের রাজাদের নাকি একটা গড় রয়েছে। গড়টা এতই অদ্ভূত যে,একমাত্র খুব সকালে অথবা গোধূলিতেই ওটাকে দেখা যায়। আর ঐ গড়টা নাকি অভিশপ্ত!আদিবাসীরা তো বলে,ওখানে অপদেবতা আছে । আজ অবধি গড়টাকে যেই দেখেছে,তার জীবনেই বিপদের কালোমেঘ জমাট বেঁধেছে। ভাস্কর তো বলছিল এসব একেবারেই ভুলভাল কথা। কিন্তু,ভাস্করের মুখে গড়টা সম্পর্কে শোনামাত্রই আমার মনেও কেমন কৌতুহলের শিহরণ জেগে উঠেছে।

হাওড়া মুম্বাই সুপারফাস্ট মেল ভায়া নাগপুরে রায়গড়। ট্রেনে যেতে যেতেই পরিচয় হল প্রমিত পালের সঙ্গে। প্রমিত পাল ব্যবসায়ী মানুষ। বয়স হয়েছে,এখন রায়গড়েই থাকেন।প্রমিতবাবুও দেখলেন দুর্গটার কাহিনী সম্পর্কে অবগত। তিনি জানেন যে, দুর্গটা দশম বা একাদশ শতকে চেদী বংশের আমলে তৈরি হলেও পূর্বে সমৃদ্ধই ছিল। তারপর মৃগয়া করতে গিয়ে ঐ বংশের এক তরুণ যুবরাজ কোনো এক তান্ত্রিকের দ্বারা অভিশপ্ত হন। ঠিক কোন কারণে তিনি অভিশপ্ত হয়েছিলেন জানা নেই,কিন্তু অভিশপ্ত হয়ে তিনি পরিণত হয়েছিলেন এমন এক সত্ত্বায় যে প্রতি পূর্ণিমার রাতে নরখাদক শয়তানে পরিণত হবে।রক্তের নেশায় নিজের স্বজাতিকেই হত্যা করতে পিছপা হবে না সে। যাই হোক, ভগ্নচিত্তে দুর্গে ফিরে এলেন যুবরাজ। সেদিন শুক্লপক্ষের প্রথমা। দু সপ্তাহ পুরো নির্ঝঞ্ঝাট কেটে গেল।অভিশাপটিকে হেসে মন থেকে উড়িয়ে দিলেন যুবরাজ,যাই হোক এতে তাঁর মন অনেক হাল্কা হল।

কিন্তু,তারপরেই জ্যোৎস্নারাতে ঘটল সেই ভয়ংকর দুর্ঘটনা।শরীর আর মনে প্রচণ্ড রক্তের তৃষ্ণা অনুভব করলেন যুবরাজ। দেহ আর মনে ঘটতে লাগল পরিবর্তন ।রাতের নিস্তব্ধতাকে খানখান করে চূর্ণ করে শোনা গেল ক্ষুধার্ত দানবের গর্জন।মাত্র এক রাতের মধ্যেই দুর্গ পরিণত হল মৃত্যুপুরীতে।


কিন্তু মিটল না সেই প্রেতের রক্ততৃষ্ণা।হাজার বছর কেটে গেছে।আজও যখন পূর্ণিমার মায়াবী জ্যোৎস্নায় যখন রহস্যময় রোম্যান্টিক লাগে বিশ্বচরাচরকে , তখন পাহাড়ের কোলে ঐ ভগ্নপ্রায় মায়াবী গড়টি হাতছানি দিয়ে ডাকে পথিককে। সেই আকর্ষণ অমোঘ,এর হাতছানি উপেক্ষা করা খুব কঠিন।কিন্তু,আগন্তুক যদি ভুলক্রমেও সেই অশুভ দুর্গের ধারেকাছে যায়,তাহলে যুবরাজের সেই নারকীয় প্রেতের হাতে শিকার হতে হয় সেই হতভাগ্যকে। তখন তার পরিণতি একটাই,সেটা হল মৃত্যু।

থামলেন প্রমিতবাবু। যাই হোক,বাস থেকে নেমে এখন আমি আর ভাস্কর যখন বিকালের পড়ন্ত আলোয় উঁচু নীচু পাথুরে পথে ফরেস্ট গেস্ট হাউসের কাছে আসছিলাম,তখনও যথেষ্ট ভয় লাগছিল ঐ কথাগুলি মনে করে। ভয় কেন একটু কৌতুহলও হচ্ছিল।

আজ মহাষষ্ঠী। প্রচণ্ড মিস করছিলাম আমাদের সাধের কল্লোলিনী তিলোত্তমা কোলকাতাকে। সারা কোলকাতা আজ রাত থেকেই শারদীয়ার আনন্দের ঢেউয়ে মেতে উঠবে।আমি যে কেন মরতে গিয়ে ভাস্করের এই পাগলের মতো প্রস্তাবে রাজি হয়ে বসলাম। নাহলে ,এখন কোলকাতাকে ছেড়ে মরতে কেউ ছোটনাগপুরের এই জনমানবশূন্য অঞ্চলে আসে। বইছে শরতের বিকালের ফুরফুরে হাওয়া। আমার মনের খারাপ লাগা নিমেষে কেটে গেল প্রকৃতির অনাবিল সৌন্দর্যের দিকে তাকিয়ে।

যত দূরেই তাকাই না কেন সবুজে সবুজ। শাল,মহুয়া,শিমূল আর পিয়ালের অরণ্য।কতো প্রাচীন জায়গা এই ছোটনাগপুরের মালভূমি!বর্তমানে ক্ষয়ীভূত হলেও ক্রেটাসিয়াস যুগের আগ্নেয় লাভা দিয়ে গঠিত মালভূমি এককালে পাহাড় এবং গহন অরণ্যের জন্য এককালে যথেষ্ট দুর্গমই ছিল। রামায়ণের সময়ে তো এটাই ছিল 'দণ্ডকারণ্য'।

যাই হোক,অরণ্যের যতো গভীরেই যাই না কেন,প্রকৃতিসুন্দরী পলকে পলকে উন্মুক্ত করবে তার অবর্ণনীয় সৌন্দর্য। দিগন্তে ধূসর পাহাড়ের সারি।একটানে সুরে ডেকেই চলেছে পাহাড়ি ময়না। আশ্চর্যের ব্যাপার,দেখা গেল না পাখিটাকে। হয়তো জঙ্গলের গভীরে কোথাও ডাকছে!আপাতত ঠিক আছে, কোজাগরী লক্ষ্মীপূজা পর্যন্ত তো থাকবই।

পশ্চিমের পাহাড়ের কোলে অস্তাচলে চলেছেন দিবাকর। গোধূলির নরম আলো।কিন্তু দক্ষিণ পশ্চিম কোণে নগ্ন পাহাড়ের গায়ে আগাগোড়া কালো কষ্টিপাথর দিয়ে তৈরি ওটা কি!দুর্গ না,হ্যাঁ তাই তো মনে হল। তাহলে কি ওটাই রায়গড়ের অভিশপ্ত গড়!ভাস্করকে দেখাতে যাব দুর্গটা কিন্তু পরক্ষণেই চেয়ে দেখলাম দুর্গটা আর নেই ঐ জায়গায়। যেন কোনো অজানা চিত্রশিল্পী সমগ্র ল্যান্ডস্কেপের ক্যানভাস থেকে যেন কোনো এক অদৃশ্য মন্ত্রবলে দুর্গটাকে মুছে দিয়েছে।অবাক হয়ে গেলাম আমি। চারিদিকে শুধু পাহাড় আর জঙ্গল,প্রকৃতির আদিমতার সাক্ষী। আর বিরাজমান এক অদ্ভূত নিস্তব্ধতা, যেন ভয়ঙ্কর কোনো কিছুর পূর্বাভাস।

যাই হোক,হতবাক হয়ে গেলাম। আমাকে দেখে 

ভাস্কর বলে উঠল,"কি রে,তোর আবার কি হল। হাঁ করে চেয়েই আছিস ঐ দক্ষিণ-পশ্চিম পাহাড়ের দিকে।" তখনই উত্তর দিতে পারলাম না ভাস্করের কথার। মন্ত্রমুগ্ধের মতো চেয়েই থাকলাম সেই রহস্যময় প্রস্তরময় নগের দিকে,যার কোলে ক্ষণিকের জন্য আবির্ভূত হয়ে শূন্যে মিলিয়ে গেছিল সেই রহস্যময় কালো পাথরের দুর্গটা।হয়তো আমাদের কাছেই সে এত সহজে ধরা দিতে চাইছে না।প্রমিতবাবুর কথা অনুসারে এখানেই ঘুরে বেড়ায় যুবরাজের অশুভ প্রেতাত্মা।

আমাকে মৌন দেখে ভাস্করও বলে উঠল,"শোন গাইড রাম সিং ও বলছিল,পাথরের দেশে পাহাড় অনেক মায়া দেখায়। অরিজিৎ রে,এই ইন্দ্রজালেও সহজে ভ্রমিত হোস না।"উত্তর দিতে পারলাম না ভাস্করের কথার। কি দেখলাম আমি -সেই অভিশপ্ত দুর্গ না পাহাড়ের ইন্দ্রজাল!


ভাস্কর আগে থাকতেই ওপরতলার তিনটে ঘর বুক করে রেখেছিল। তার মধ্যে একটা ঘরে দক্ষিণমুখী এক ব্যালকনি রয়েছে, সেখান থেকে তাকালে শাল সেগুনের জঙ্গলকে ভেদ করে দূরে প্রকৃতির বুকের ওপর শায়িত থাকা টিলাগুলি সুস্পষ্ট দেখা যায়। ছোটখাটো হলে কি হবে,গেস্ট হাউসটা বেশ সাজানো গোছানো সুন্দর।এখনও চারিদিক পুরোপুরি অন্ধকার হয় নি। প্রকৃতির বুকে নেমে আসছে সন্ধ্যা। সন্ধ্যার সেই ম্লান আলোয় আমি বাইরের দিকে তাকালাম।অন্ধকারে গাঢ় নীলবর্ণ ধারণ করা গহন অরণ্য আর দূরে কালো পাহাড়ের সারি ছাড়া চোখে বিশেষ কিছুই পড়ল না। কিন্তু ষষ্ঠেন্দ্রিয় কোনো ভয়ঙ্কর কিছুর পূর্বাভাস দিয়ে উঠল। ঐ দিক থেকেই তো কোনো এক অজানা মন্ত্রবলে পাহাড়ের বুকে আবির্ভূত হয়েছিল সেই অভিশপ্ত কালো গড়টি। ক্ষণিকের জন্য দর্শন দিয়েই অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল পাহাড়ের বুকে।

যাই হোক,দক্ষিণমুখো এই ঘরটায় ঢুকেই মনের মধ্যে এক অদ্ভূত অতীন্দ্রিয় অনুভূতি দানা বাঁধতে লাগল। এই ঘরের তাপমাত্রা আশ্চর্যজনক ভাবে কম। যাই হোক, গেস্টহাউসের কেয়ারটেকারও বাঙালি,নাম বাবুলাল ঘোষ। যথেষ্ট সদালাপী মানুষ। এতদূরে বিদেশ বিভুঁই তে এসে একজন বাঙালির সাথে যোগাযোগ করতে পেরে মনে মনে খুশিই হলাম। বাবুদা মানুষও ভালো,সবসময়ই মুখে হাসি লেখে আছে।আমরা এ ঘরটা নিয়েছি সেটা নাকি বাবুদার মনঃপূত হয়নি,অন্তত বাবুদার মুখভঙ্গি দেখে তাই বোঝা গেল। আর একটা কথা তো আছেই না,মুখমণ্ডল মানুষের মনের আয়না। যাই হোক,বাবুদাকে বললাম আমরা এখানে আদিবাসীদের পরব দেখতে আর আদিবাসীদের লোকসংস্কৃতি নিয়ে জানতে এসেছি। আমার হাতে ছত্তিশগড়ের গোণ্ড উপজাতিকে নিয়ে লেখা একটি বইও ছিল। যাই হোক,কথাটা বাবুদার কাছে যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠল। কিন্তু,ঐ পাহাড়ের বুকে অভিশপ্ত গড়টার কথা আমরা বেমালুম চেপে গেলাম। বাবুদা বারেবারে সাবধান করে দিল যে,অন্ধকার নেমে আসার পর কোনোমতেই আমরা যেন গেস্ট হাউসের বাইরে না বেরোই। এমনকি পরিচিত গলার ডাক শুনতে পারলেও নয়। ভাস্কর কৌতুহলমিশ্রিত গলায় বলল,"কেন গো? এদিকে চোর ডাকাতের খুব একটা উপদ্রব আছে বলে তো শুনি নি।" বাবুদা বলল,"চোর ডাকাত না থাক। হিংস্র জন্তু জানোয়ার যেমন নেকড়ে,শিয়াল,ভল্লুক আর বুনো মোষ তো আছেই,তাছাড়া এই অঞ্চলের আরেকটা বিশেষত্ব হল এখানে মহাবিষধর শঙ্খচূড়ের অধিষ্ঠান ।" 'শঙ্খচূড়' নামটিতেই চমকে উঠলাম আমি। ভাস্কর চেঁচিয়ে উঠল,"ওহ্ মাই গড। ইউ মিন কিং কোবরা!"বলা বাহুল্য,ভারতভূমের সবথেকে বিষধর চারটে সাপের অন্যতম এই শঙ্খচূড়। আকৃতিতে অনেকটা কেউটে বা গোখরোর মতো,কিন্তু আকারে অনেক বড়ো। মাথার ফণার পেছনে বিষ্ণুর পাঞ্চজন্য শঙ্খের প্রতিবিম্ব। তাই তো অতি পবিত্র এই সাপ। একবার দংশন করলে মানুষ কেন,হাতিরও মৃত্যু অনিবার্য ।" কিছুক্ষণ পর ঢোক গিলে ভাস্কর বলল,"আরও কি কিছু আছে!" বাবুদা গম্ভীর স্বরে বলল,"কতো পুরনো এই জায়গা। আছে তো অনেক কিছুই। তবে তাদের নাম করতে নেই। অতি ভয়ঙ্কর তারা।"এই বলে বাবুদা চলে গেলেন। মনে হল বিষয়টা সকৌশলে এড়িয়ে গেলেন তিনি।এরপর গণ্ডগোলটা শুরু হল সেই রাত থেকে। রাত তখন দুটো। মনে হল কেউ যেন দেওয়াল বেয়ে আমাদের গেস্ট হাউসে ওঠার চেষ্টা করছে। অনেকটা মাঝেমাঝে গিরগিটির মতো শব্দ করছে। কিন্তু গিরগিটি সে যতই বড়ো হোক না কেন,তার চলাফেরা এত বিকট হয় না। ঘরের তাপমাত্রা আশ্চর্যজনক ভাবে কমে গেছে। দেওয়াল ঘষটানোর আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল ভাস্করের। ভাস্করকে আমি বিছানা ছেড়ে উঠতে না করতে যেতাম,কিন্তু ভাস্কর শুনল না। আমার হাত ধরে টেনে দক্ষিণমুখী জানলার কাছে আনল যেখান দিয়ে দেওয়াল ঘষটানোর শব্দ আসছিল। ভাস্কর পিলে চমকে দিয়ে চেঁচিয়ে উঠল,"who is this?"আর জ্বেলে ধরল উজ্জ্বল রেডিয়াম টর্চ। এক অদ্ভূত জন্তু যার অপার্থিব ব্যাঙের মতো ডাকে(কিন্তু ব্যাঙ অতো জোরে আওয়াজ করতে পারে না,আর ওর আওয়াজে রক্তও জল হয়ে যায় না) খানখান হয়ে গেল রাতের নিস্তব্ধতা । আর টর্চের প্রখর আলোয় যে দৃশ্য দেখলাম,কেঁপে উঠলাম আমি। হা ভগবান,এও কি সম্ভব!


ভাস্করের টর্চের আলোয় ক্ষণিকের জন্য জীবটাকে যা দেখলাম ,তাতে জীবটাকে আর যাই হোক মানুষ বলা চলে না। দু পেয়ে আর মানুষের মতো গড়ন হলে কি হবে আকার আকৃতি আর চোখমুখ অনেকটা ব্যাং আর সরীসৃপের মাঝামাঝি। যেন কোনো প্রাগৈতিহাসিক জীব সদ্য সদ্য বিবর্তনের পাতা থেকে উঠে এসে আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ লাল,তাতে আদিম হিংস্রতা প্রতিফলিত। জন্তুটি বেশ দেওয়াল বেয়ে বেয়ে উঠছিল,হয়তো টার্গেট ছিল আমাদের ঘরটি ই । কিন্তু, ভাস্করের টর্চের আলোয় জন্তুটি টাল সামলাতে না পেরে নিচে গিয়ে পড়ল,আর তারপর করে উঠল সেই গগনবিদারক বিকট চিৎকার। তারপর মুহূর্তের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল। ভাস্কর বলে উঠল,"জিৎ,এটা কি ছিল!" সহসা কোনো উত্তর দিতে পারলাম না। উত্তর দেওয়ার মতো অবস্থাতেই ছিলাম না। প্রথমত,বিকেলে পাহাড়ের বুকে সেই অজ্ঞাত দুর্গটা। ভাস্কর আর রাম সিং কেউই দেখল না ।কিছু মুহূর্তের জন্য শুধু আমাকেই দর্শন দিয়ে আবার শূন্যে মিলিয়ে গেছিল। আর দ্বিতীয় ব্যাপার হল,গভীর রাতের এই মহান আগন্তুক,যার হিংস্র চোখ আর গলার বিকট চিৎকার বলে দিচ্ছে -সে আর যাই হোক,ইহলোকের কোনো মানুষ হতে পারে না। এই অসামান্য জীবটি যেন সাক্ষাৎ নরক থেকে উঠে এসেছিল আমাদের নিধন করতে!

দরজায় শুনতে পেলাম ধাক্কার আওয়াজ । প্রথমে প্রতীত হল সেই অদ্ভুত জীবটি। কিন্তু ভাস্করের কাছ থেকে সাহস পেয়ে দরজা টা খুললাম। হন্তদন্ত হয়ে ঘর্মাক্ত কলেবরে ঘরে প্রবেশ করলেন বাবুদা। বললেন,"আপনারা কিছু শুনেছেন?"ভাস্কর হেসে বলল,"আরে শুনব না। ঐ বিকট চিৎকার স্বয়ং কুম্ভকর্ণেরও ঘুম ভাঙার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু আমরা তো মশাই রক্ত -মাংসে তৈরি নিরীহ মানুষ। আমাদের ঘুম ভাঙবে না বলুন!আর আমি যদি সঠিক হই তাহলে ঐ বিকট চিল চিৎকারে আমাদের মতো আপনারও ঘুম ভেঙে গিয়েছে।" ভাস্করের দিকে কিছুক্ষণ স্থির চোখে তাকিয়ে থাকলেন বাবুদা। মনে হল,চোখের ভাষা পড়তে চেষ্টা করছেন। কিছুক্ষণ পরে বললেন,"আমার রাতের ঘুম এমনিই পাতলা। এমনিই কম ঘুমোই। আর আজকে যা হল। যাই হোক,শনিবার ছিল। খুব অশুভ দিন। "

"ওটা যা ভয়ঙ্কর ছিল।" আমি জন্তুটার ব্যাপারে বলতে যাব ,ভাস্কর এই সময় আমার হাত চেপে ধরল। নিষেধ করল বাবুদাকে না বলতে। কারণটা বুঝলাম না। তাহলে কি ভাস্করের মাথাতে কিছু চলছে!ভাস্কর কি বাবুদাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছে না!তাই বা কিকরে হয়। বাবুদার মুখ দেখে সৎ আর মিশুকে ছাড়া তো অন্য কিছু বলে মনে হয় না। চাপা গলায় বাবুলালদা বললেন,"আর কিছু দেখলেন!"ভাস্কর হেসে বলল,"কি দেখব বলুন তো। অন্ধকারে বাইরে বিকট চিল চিৎকারে ঘুম ভেঙে গেল। জানলা বন্ধ রেখেছিলাম। জানলা খুলে দেখলাম বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার,গভীর অরণ্যানী আর দিগন্তে কালো ধূসর পাহাড়তলি।আর কিছুই দেখলাম না!" বুঝতে পারলাম,ভাস্কর ব্যাপারটা বেমালুম চেপে যাচ্ছে। বাবুদা অপ্রতিভ হয়ে বলল,"যাই হোক,চিৎকারে গেস্ট হাউসে যারা আছে,সবারই মোটামুটি ঘুম ভেঙে গেছে।"তারপর কিছুক্ষণ পরে বাবুদা বলল আমাদের অবাক করে,"বুঝতে পারছি না,তাহলে ওপর থেকে টর্চের আলোটা ফেলল কে!"বলেই কেমন যেন সন্দেহজনক ভঙ্গিতে তাড়াহুড়ো করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।আমার চোখে পড়ল অদ্ভুত এক দৃশ্য ।বাবুদার পাঞ্জাবীর পিছন দিকে ধুলো আর পাতা লেগে আছে।


সেদিন রাতে আমার আর ঘুম আসল না। ভাস্কর দেখলাম রীতিমতো নাক ডেকে ঘুমোতে শুরু করেছে। আশ্চর্য এই বিপদ আর ভয়ের সময়ও ঘুমোতে পারে ছেলেটা। যাই হোক,আমার মনে আসতে লাগল নানা উৎকট চিন্তা। শেষরাতে চোখ লেগে এল। তলিয়ে পড়লাম অতল নিদ্রায়। স্বপ্নে দেখলাম,সেই বিকট জন্তুটা পাহাড়তলির শালবনের মধ্যে আমায় আর ভাস্করকে তাড়া করেছে।

যাই হোক,উষার ব্রাহ্মমুহূর্তে বনমোরগের ডাকে ঘুম ভেঙে গেল আমার।জানলা খুলে দেখলাম পুবাকাশে রঙের খেলা। পূর্ব দিগন্তে দিবাকর উদিত হচ্ছেন। দক্ষিণমুখী জানলার সামনে দাঁড়ালাম। রাতের অন্ধকার কিছুটা বাকি আছে!কি সাংঘাতিক, এখান দিয়েই তো কাল জানোয়ারটা দেওয়াল বেয়ে উঠে আসছিল। আকাশ ধীরে ধীরে ফর্সা হচ্ছে।এইসময় আরে দক্ষিণ পশ্চিম কোণে পাহাড়ের গায়ে ওটা কি! সেই কালো পাথরের ভাঙা অভিশপ্ত দুর্গটা কোনো এক অজানা মন্ত্রবলে আমার চোখের সামনে দ্বিতীয়বার প্রতীত হয়েছে। নির্নিমেষ চক্ষে চেয়ে থাকলাম পাহাড়ের বুকে সেই জমাট বাঁধা চাপ চাপ রহস্যের দিকে। ওটা যেন আমায় হাতছানি দিয়ে ডাকছে!বড়ো অমোঘ সেই টান। এই টান উপেক্ষা করা খুব কঠিন।


পাহাড়ের কোলে সেই অভিশপ্ত গড়টা আমার চোখের সামনে বেশ খানিকক্ষণ ভেসে ছিল। চুম্বকের মতো টানছিল আমায়। তাই নির্নিমেষ নয়নে তাকিয়ে ছিলাম ঐ গড়টার দিকে। গড়টা যেন পাহাড়ের বুকে একরাশ রহস্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। উদাস হয়ে তাকিয়ে ছিলাম,হঠাৎ দেখলাম গড়টা আর নেই। সম্বিৎ ফিরল আমার। বাইরে বেশ রোদ। ঘড়িতে দেখলাম সাড়ে ছটা বাজে,তার মানে টানা দেড়ঘন্টা আমি এই গড়টার সামনে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কিন্তু,আমার যেন মনে হল জাস্ট কিছু মুহূর্ত । তার মানে কি অশুভ ঐ গড়ের মায়া আমার ওপর প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করছে! যাই হোক,আর মনের মধ্যে খারাপ চিন্তাকে প্রশ্রয় দেব না,বাথরুমে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হলাম।বাথরুমটা বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। আজ একে মহাসপ্তমী,তায় রবিবার। শারদীয়ার খুশির আনন্দে আজ নাচছে কল্লোলিনী তিলোত্তমা । বাংলার আকাশে বাতাসে আজ খুশির ছোঁয়া।নদীর ধারে কাশ বনে ঢেউ তুলে খেলে বেড়াচ্ছে হাওয়া। শোনাচ্ছে মায়ের আগমনীর বার্তা। যাই হোক,বাংলা থেকে আমরা আছি এখন হাজার মাইল দূরে অনুর্বর জঙ্গল আর পাথরের দেশে।মনটা খারাপ হয়ে গেল।

বিছানায় অঘোরে ঘুমিয়ে আছে ভাস্কর। ওর তো উঠতে আজ নটা,দশটা হবেই। ও যা লেট লতিফ! যাই হোক,ওকে ডিস্টার্ব না করে বাইরে বেরিয়ে আসলাম।

অপরূপ সুন্দর নিসর্গ প্রকৃতি। কিন্তু একটা কথা মনের মধ্যে গাঁথা ছিল যে,প্রকৃতিসুন্দরী যতো মোহময়ী দৃষ্টিতে হাতছানি দিক না কেন,আগের সন্ধ্যাবেলা বাবুদা তো বলেছে,এই জঙ্গল বাঘ,নেকড়ে,ভল্লুক আর বিষাক্ত শঙ্খচূড়ের অধিষ্ঠান । যদি একবার তাঁদের কারোর সামনে পড়ি তাহলে আমাকে ওপরে পাঠাতে ওরা তিলমাত্র বিলম্ব করবে না। শুধু তো পার্থিব বিভীষিকা নয়,কাল রাতের সেই অপার্থিব অতিলৌকিক আক্রমণকারীকে আমার এখনো মনে আছে। সেই বিভীষিকা ভোলার নয়।

আচ্ছা,এই জঙ্গল কি মায়াবী। যত দূরেই যাই না কেন,সব আগের মতো একই রকম আছে। একই রকম গাছপালা, একই রকম গভীরতা,হুবহু সব একই রকম। গাছগুলো মার্কগুলো করলে তো ভালো হত। এখন আর কি করা যাবে!বেশ বুঝতে পারছি এই গভীর জঙ্গলের কুহেলিকাময় পথে পথ হারিয়েছি। আমি এখন পথভ্রষ্ট!কোনোকিছুই মাথায় আসছে না। যদি কোনো পথচারী পাওয়া যেত।ভাস্করের কাছে শুনেছি যে,সামনে কিছু দূরেই গোণ্ড আদিবাসীদের গ্রাম আছে।আদিবাসীদের ভাষা ঠিকঠাক জানি না ঠিক আছে,কিন্তু ওখানে গেলেও তো আশ্রয় পাওয়া যাবে। কিন্তু,এই ঘন জঙ্গলে তো পথ খুঁজে পাওয়াই কঠিন।শাল আর সেগুনগাছগুলি এখানে এত ঘনসন্নিবিষ্ট যে সূর্যের আলোও ঠিকঠাক প্রবেশ করতে পারে না । দ্বিপ্রহরেও এক অদ্ভুত আলো আঁধারি।চারদিক কেমন ধোঁয়া ধোঁয়া,একটা অতিলৌকিক ব্যাপার লক্ষ্য করলাম,এই গহন অরণ্যে প্রবেশ করা মাত্রই চারপাশের উষ্ণতা যেন আশ্চর্যজনক ভাবে কমে গেছে ।জঙ্গলটাও কেমন যেন আশ্চর্যজনক ভাবে নিস্তব্ধ,এই নিঃঝুমতা যেন ভয়াল ভয়ঙ্কর কোনো কিছুর পূর্বাভাস । এতটা জঙ্গলের ভিতরে ঢুকলাম,মোটামুটি চারঘন্টা হেঁটেছি একটানা।কিন্তু,এখনোও কোনো পাখি( পাহাড়ি ময়না,ফ্ল্যামিংগো,Indian Spot Billed Duck, Rain Quail,বনমোরগ কিছুই চোখে পড়েনি।জংলী পাখির কূজন যা এই ঘন অরণ্যে শোনা খুব স্বাভাবিক তাও শুনতে পাইনি। আচ্ছা,কালকে রাতের সেই বীভৎস আগন্তুক এই জঙ্গলে লুকিয়ে নেই তো। শিকারকে আক্রমণ করার জন্য গভীর জঙ্গলে ওঁত পেতে বসে অপেক্ষা করছে সেই চরম মুহূর্তের জন্য।ভাবতেই মনটা কেমন ছ্যাঁত করে উঠল। একটা কথাতে আমি নিশ্চিত,যদি সূর্যের আলো পড়ার আগে আমি গেস্ট হাউস না পৌঁছাতে পারি, তাহলে এই জঙ্গলে আমার অন্ত সুনিশ্চিত। হেঁটে হেঁটে খুব হাঁপিয়ে গেছিলাম,সামনে দেখলাম এক বিরল নৈসর্গিক দৃশ্য ।খরস্রোতা পাহাড়ি নদী উঁচু টিলার থেকে নিচে পড়ে এক সুন্দর পাহাড়ি ঝরণার সৃষ্টি করেছে। এই ঝরণা উপর থেকে নিচে প্রচণ্ড বেগে পড়ে সৃষ্টি করছে ঝিল বা জলাশয়।এখানে জঙ্গল বেশ পাতলা। অতিলৌকিক শীতল ভাবটাও কেমন যেন উধাও।

জলাশয়ের জলের ঝাপটা চোখে মুখে দিয়ে একটু স্বস্তি অনুভব করলাম। মাথাটা কাজ করতে লাগল!ঠাণ্ডা জলে পা ডুবিয়ে জলার পারে বসলাম,আহা কি অপূর্ব অনুভূতি! প্রাণ জুড়িয়ে গেল।কিন্তু,এখান থেকে গেস্ট হাউসে না ফিরতে পারলে তো বেঁচে থাকাই অসম্ভব।

কতক্ষণ সামনে হাঁটছিলাম জানি না। কিন্তু সামনে দেখলাম পড়ন্ত সূর্যের মায়াবী আলোয় কিছু দূরে হঠাৎই মাটি থেকে খাড়া উঠে গেছে এক নগ্ন পাথুরে টিলা যাকে আমরা বলি মোনাডনক,আর তার গায়ে বেশ ভালোভাবে প্রতীতমান সেই কালো পাথরের দুর্গ যেন আমার দিকে তাকিয়ে ক্রূর ভঙ্গিতে দন্তবিকাশ করছে।কিন্তু দুর্গ থেকে ওটা কে নেমে আসছে!কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারলাম বাবুলাল।কিন্তু বিদ্যুল্লেখার মতো প্রশ্ন খেলে গেল মনে,"বাবুদা এখানে কেন!তবে কি!"যাই হোক,এখন উল্টোপাল্টা ভাবলে চলবে না। বাবুদা যেন কোনো আঁচ না পায় এরকম ভাবে চুপিসাড়ে ফলো করে যখন গেস্ট হাউসে পৌঁছলাম,তখন সন্ধ্যা সাতটা বাজে। কিন্তু,মনের মধ্যে বইতে লাগল,একের পর এক প্রশ্নের ঝড়।


ক্লান্ত বিধ্বস্ত দেহে যখন গেস্ট হাউসে পৌঁছলাম,তখন হাত ঘড়িতে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা বাজে। দেখলাম যে ভাস্কর অনেক আগেই হন্তদন্ত হয়ে অপেক্ষা করছে। আমাকে দেখে বলল ,"ও তুই এসে গেছিস তাহলে। তোকে কোথায় কোথায় খুঁজেছি বল তো। আমি তো প্রথমে ভাবলাম,আদিবাসী গ্রামের দিকে গেছিস। যেটা এই জঙ্গলের পূর্ব দিকে। তারপর দারোয়ান লক্ষ্মণ গুপ্তা ,যাকে আমি খুব বিশ্বাসী লোক বলে মনে করি,বলল যে তুই গেছিস দক্ষিণ পশ্চিম দিকে যে দিকটাকে খুব মারাত্মক আর অশুভ বলে মনে করে,এখানকার আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ। যাই হোক,আমি তো ভাবতেই পারি নি তোকে আবার দেখতে পাব। থ্যাঙ্ক গড।"এই বলে কান্নায় ভেঙে পড়ে আমায় জড়িয়ে ধরল ভাস্কর। সত্যি কথা,ভাস্করকে এর আগে এতোটা মানসিকভাবে দুর্বল হতে দেখিনি। যাই হোক,কিছুক্ষণ পরে ও একটু আবেগের দিক থেকে থিতু হলে আমি বললাম,"আচ্ছা ,বাবুদা এখনো ফিরেছে!"আমার কথায় অবাক হয়ে ভাস্কর বলল যে,"সে কি !উনি তো এতক্ষণ এখানেই ছিলেন।তোকে খোঁজ করছিলেন। তারপর স্থানীয় পুলিশেও খবর দিয়েছেন। অ্যাকচুয়ালি, উনি কেয়ারটেকার তো,আমাদের কথা চিন্তা করা ওনার পক্ষে খুব খুব স্বাভাবিক । " অবাক হয়ে গেলাম আমি। সেই সঙ্গে প্রশ্ন জাগল মনে ,তাহলে জঙ্গলের মধ্যে কি দেখলাম! পাহাড়ের মায়া নাকি গড়ের ইন্দ্রজাল!সেই রাতে কিছু ঘটল না।

গণ্ডগোলটা ঘটল পরের দিন সকালে। যখন সকালে ভাস্কর আমাকে ডেকে বলল,"শোন ভাই,এটা আগের দিন রাতেই খুঁজে পেয়েছি। কিন্তু, তখন তুই ছিলি না। তাই ,এটা তোকে দেখানোর সৌভাগ্য হয়নি আমার।এটাতেই আছে বুঝলি তো,ঐ গড়ের ইতিবৃত্ত।এখানেই লেখা আছে শেখ নাসিরউদ্দিন কর্তৃক এই অভিশপ্ত গড়ের ইতিবৃত্ত। একজন ইসলাম পর্যটক,তিনি সুদূর তুর্কিস্তান থেকে এখানে এসেছিলেন চেদী বংশের ইতিহাস সম্পর্কে তথ্য জোগাড় করতে।আর এই বইয়েই লেখা আছে যুবরাজ বিক্রম সিং এবং তার করুণ অভিশাপময় জীবনের কথা। "

ভাস্কর যা বলল আমায় তা আমি ভাস্করের জবানীতেই তুলে ধরলাম।তখন 1080 সাল। গাঙ্গেয়দেবের শাসনে চেদীদের রমরমা। মৃলত আরবদের সিন্ধু জয়ের (712 খ্রিঃ) পরপর থেকেই মুসলিমরা বিভিন্ন কারণে ভারতে আসতে শুরু করলেও এই ভারতে মুসলিমদের আগমন বেড়ে যায় দশম ও একাদশ শতকে,যখন ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে তুর্কি আক্রমণ ঘটে। যাই হোক,সেইসময় সুফিবাদী মুসলিম যারা যুদ্ধবিগ্রহের ধার ধারত না,খালি একেশ্বরবাদ আর শান্তির বাণী প্রচার করত তারাও ভারতে আসতে শুরু করে। নাসিরউদ্দিন ছিলেন তখন বিখ্যাত সুফীসাধক খাজা মইনুদ্দিন চিস্তির ধর্মে ও আদর্শে বিশ্বাসী।তিনি যেমন অপূর্ব সঙ্গীতরচনা করতে পারতেন,তেমনি সাহিত্যরচনাতেও তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত।তার রুদ্ধশ্বাস তুর্কি ভাষায় লেখা থেকে জানা যায় যুবরাজ বিক্রম সিংহের কথা। তুর্কি ভাষা জানি বলেই কিছুটা উদ্ধার করতে পেরেছি। এখন সেটাই তোকে শোনাচ্ছি।

বিক্রমের মতো ছেলে পাওয়াটাই ভার। দায়িত্ব আর কর্তব্যে কোনো অবহেলা করে না। সবাইকে ভালোবাসে,সবার সাথে মেশে,প্রজাদের স্নেহ করে,জাত বা ধর্মের কোনো বিভেদ করে না। কিন্তু,চিরদিন নিয়তি কারোর সমান যায় না। বিক্রমদেব সিং এরও ভাগ্যের আকাশে নেমে এল ঘন কালো মেঘ। একদিন তিনি গভীর জঙ্গলে মৃগয়া করতে গেছিলেন। ভুল করে তিনি একজন তান্ত্রিক ও তাঁর সঙ্গিনীর দিকে(দুজন যখন তন্ত্রবিদ্যায় মগ্ন ছিল অদ্ভুত জানোয়ারের রূপ ধারণ করে) তীর চালিয়ে দেন। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় ঐ তান্ত্রিকা যোগিনীর। এখানে মনে রাখা দরকার তান্ত্রিক ও তান্ত্রিকা দুজনেই ছিলেন পিশাচসিদ্ধ। সুতরাং,সঙ্গিনীর করুণ মৃত্যুতে ক্রোধাগ্নি জ্বলে ওঠে তান্ত্রিকের ।তিনি অভিশাপ দেন,যে এরপর যুবরাজ বিক্রমদেব সিং এর জীবন অভিশপ্ত হয়ে যাবে। তিনি নররাক্ষসে পরিণত হবেন।তাঁর অদম্য রক্তপিপাসা মেটাতে গিয়ে মৃত্যু হবে তার বংশের সবার।


ভীষণ ভয় পেয়ে গেলেন যুবরাজ। তিনি এসে সব নাসিরকে বললেন।দুজনে মিলে ঠিক করল যে দরগায় যাবে!কিন্তু কে শোনে কার কথা! যদিও অভিশাপে পূর্ণিমারাতের কথা বলা হয়েছিল,যুবরাজ ভাবলেন যে,এই কয়েকদিনে তো কিছুই হল না। তাহলে বুঝি তান্ত্রিকের অভিশাপ মিথ্যা! ফুৎকারে হেসে উড়িয়ে দিলেন তান্ত্রিকের অভিশাপকে।

ডায়েরী না বলে পুরনো খসড়া বা manuscript বলাই ভালো।একনিমেষে পড়ে চলেছে ভাস্কর। এবার লক্ষ্য করলাম যে ভাস্করের গলাও কাঁপছে। কাঁপা কাঁপা গলায় সে বলল,"বুঝলি তো অরিজিৎ, প্রায় শেষের দিকে চলে এসেছি।এখানেই নাসির বলছে, তারপর এল সেই অশুভ পূর্ণিমার রাত।চোখের সামনেই নাসির দেখল তার বন্ধুর হিংস্র রক্তপিশাচে রূপান্তর। পরিবার,স্বজাতি আর কুল বলে কিছুই রইল না বাকি।আমার মনে হয় রক্তপিশাচের শেষ শিকার হল নাসির। এই দেখ নাসির বলছে-"না আর লিখতে পারছি না। ঐ তো দূরে আমার দিকে এগিয়ে আসছে খউপনাক (দুঃস্বপ্নপূর্ণ) দরিন্দা(পিশাচ)।এককালে আমার জিগরি দোস্ত ছিল,কিন্তু এখন ও চায় শুধুই রক্ত।"

এরপরে সব হলদে হয়ে যাওয়া বিবর্ণ পাতা,

আর কিছু নেই রে! -স্বগতোক্তি ভাস্করের। আমি বললাম,"কিন্তু ব্যাপারটা হল এই যে,এই শতাব্দীপ্রাচীন পাণ্ডুলিপিটা এই গেস্ট হাউসে এল কি করে!যতদূর শুনেছি এই গেস্ট হাউসটা তো বেশি পুরানো নয়!"


ভাস্করদার সাথে কথা বলছিলাম,এই সময় ঘরে প্রচণ্ড চেঁচামেচি শোনা গেল। জোর গলায় বাবুলালদা চেঁচাচ্ছেন আর অশ্রাব্য গালাগাল করছেন চাকরকে ,"আমার ঐ জরুরি জিনিসটা কোথায় গেল?"জরুরি জিনিসটা কি আমাদের আর সেটা বুঝতে বাকি ছিল না আমাদের। সেটা ছিল ঐ পুরনো manuscript। যাই হোক,এমনিই বাবুদার কাজকর্ম ছিল সন্দেহজনক। এখন বাবুদার ওপর সন্দেহ আমার আরও বেড়ে গেল। নিশ্চয়ই বাবুলালদার সাথে কিছু রহস্য জড়িয়ে রয়েছে। আবার এর মধ্যে ঐ ঐতিহাসিক পুঁথি,দুর্গের ইতিহাস সম্পর্কে যার গুরুত্ব মোটেই তুচ্ছ নয়। যাই হোক,ভাস্কর তো আগে থেকেই মুখিয়ে ছিল,পরের দিন পূর্ণিমা আর কোজাগরী লক্ষ্মীপূজা । আর লোককথার মতে সেদিনই জেগে উঠবে যুবরাজের সেই অভিশপ্ত প্রেতাত্মা। অদম্য রক্তের তৃষ্ণায় খুঁজে বেড়াবে তার শিকারকে।

যাই হোক,আমাদের মনে হয়েছিল রহস্যের যবনিকাপাত ঐ অভিশপ্ত গড়েই সম্ভব।সকালে রওনা দিয়ে আমরা যখন দুর্গে পৌঁছলাম তখন দুপুর দুটো। দূর থেকে দুর্গটা যতোটা ছোট বলে মনে হয়েছিল,মোটেই ততটা ছোট নয়। দুর্গের ভেতরটা আশ্চর্যজনক ভাবে ঠাণ্ডা আর ঘরগুলি অন্ধকার। একতলার প্যাঁচালো সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে গেলাম।আমি ডাকলাম,"ভাস্কর আর কতো দূর ।"কিন্তু একি ভাস্কর কোথায় গেল!তাহলে কি আমরা দুজনে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছি!ভয়ের এক শিহরণ জাগানো অনুভূতি আমার সারা শরীরে খেলে গেল। ভাস্কর নেই,এখন আমি একা! আদিবাসীরা বলছিল,যুবরাজের নারকীয় প্রেতাত্মার মায়াবী অনুচররাও এই দুর্গে বাস করে। সেদিন রাতে এদের মধ্যে একজনই আমাদের গেস্ট হাউসে হামলা করে।যাই হোক,মনে হল কেউ যেন আমার ঘাড়ের কাছে গরম শ্বাস ফেলল।বুক আতঙ্কে ধুকপুক করতে লাগল আমার। এই সময় কি হল বুঝতে পারলাম না।সিঁড়িটা পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে ওপরদিকে উঠতে গিয়ে এক জায়গাতে শেষ হয়ে গেছে। তারপর আর কিছুই নেই!আমি না বুঝতে পেরে সোজা গিয়ে পড়লাম নিচের একটা ঘরে।

ভাগ্যিস নরম কিছুর (পালঙ্কের) ওপর পড়লাম। এই ঘরে পড়তেই এক মন মাতাল করা সুগন্ধ ভেসে আসল। হাজার বছর কেটে গিয়েছে,কিন্তু দুর্গের এই কক্ষে সময় যেন থেমে গিয়েছে। চারিদিকে সোনা দানা,আতরের সুগন্ধ ।প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে কোথাও কোনো ক্ষয় নেই,কোথাও কোনো লয় নেই। ঐ তো জ্বলছে মোমবাতি।মোমবাতির মৃদু আলোয় দেখলাম পালঙ্কের ওপর শুয়ে আছেন রাজপোষাক পরা এক সুন্দর তরুণ। পরণে রাজবেশ,কপালে রক্ততিলক,মাথায় লম্বা ঘন কালো কোঁকড়ানো চুল,টানা জুলপি,চোখে সুরমা। বুঝতে পারলাম,ইনি নিশ্চয়ই যুবরাজ বিক্রমদেব সিংহ। আহা,হাজার বছর কেটে গেছে ,কিন্তু দেহে এতটুকু পচন ধরে নি।

চামড়ায় এতটুকু ভাঁজ পড়ে নি।যেন ঘুমিয়ে আছেন এক্ষুণি জেগে উঠবেন। মন্ত্রমুগ্ধের মতো দেখতে থাকলাম যুবরাজকে। হঠাৎই সম্বিৎ ফিরল আমার। বেলা পড়ে আসছে। শুনতে পেলাম কে যেন খসখস খসখস করে এগিয়ে আসছে!এ নিশ্চয়ই ভাস্কর নয়। অনুভব করলাম ফোঁস করে কোনো জন্তু শ্বাস ফেলল।এ সময়ই সম্বিৎ ফিরল আমার।দেখলাম যে,যুবরাজের ঠোঁটের আগায় রক্ত। হ্যাঁ আমি একশো শতাংশ নিশ্চিত হয়ে বলতে পারি যে,এই রক্ত মানুষের তাজা রক্ত।ঘরের মধ্যে অপার্থিব কোনো কিছুর উপস্থিতি অনুভব করলাম আমি।

না,এখানে আর এক সেকেণ্ডও নয়।বেরোতেই হবে এই মৃত্যুফাঁদ থেকে।না হলে এই ঘর আমাকেও গ্রাস করবে আর আমিও এখানে সময়ের ফাঁদে বন্দি হয়ে যাব। দরজাটা দেখলাম ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কোনোরকমে আমি বাইরে বেরিয়ে দিনের আলোয় স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলাম। নিচে দেখি ভাস্কর,দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপছে। ভাস্করের কপালের শিরা ফুলে উঠেছে,কপাল থেকে ঘাম ঝরছে, দূরে খাদের দিকে অস্ফুটে দেখিয়ে বলে উঠল,"বাবুদা!"

"আরে বাবুদা এখানে কোথায় আসবে!কোথা থেকেই বা আসবে।তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে নাকি!"


পাহাড় থেকে নেমে স্বাভাবিক হল ভাস্কর। তখন পশ্চিম দিগন্তকে রাঙিয়ে দিবাকর অস্তাচলে চলেছেন।আকাশে নানা রঙের খেলা!নিচে নেমে স্বাভাবিক হল ভাস্কর। খোলা হাওয়ায় বুক ভরে শ্বাস নিয়ে বলল, "অরিজিৎ,এখানে আর এক মুহূর্তও নয়।কাল সকালেই ফিরছি কোলকাতা।"ফিরে চললাম আমরা ফরেস্ট গেস্ট হাউসে। কিন্তু,কে জানত এই অভিশপ্ত মায়াবী রাতেও সেখানে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে এক রক্ত জল করা সংবাদ।


আমরা যখন ফরেস্ট গেস্ট হাউসে এসে উপস্থিত হলাম ,দেখলাম বাইরে লোকজন জমে গেছে। আদিবাসীরাও এসেছে। নিকটস্থ ভবানী মন্দিরের পুরোহিত এসেছে। পুরোহিতের কাছে যা শুনলাম তার সারমর্ম হল,সেদিন রাতে আমরা যে দুপেয়ে মানব সরীসৃপকে দেখেছিলাম সে বাবুলালই। বাবুলাল আগে সাধারণই একজন মানুষ ছিল,কিন্তু কোনোভাবে শয়তান বা অশুভ শক্তির উপাসনা শুরু করে। এরপর কোনোভাবে দুর্গ সম্পর্কে ঐ পুরনো পুঁথিটি বাবুলালের কাছে চলে আসে। এরপর বাবুলাল কোনো এক পূর্ণিমারাতে যুবরাজের প্রেতের কাছে দাসত্ব গ্রহণ করে। প্রত্যেক পূর্ণিমারাতে বাবুলালের কাজ ছিল যুবরাজের ঐ অভিশপ্ত নারকীয় প্রেতকে রক্তের জোগান দেওয়া।বলা বাহুল্য,এর ফলে বাবুলাল এক অতীন্দ্রিয় শক্তির অধিকারী হয়ে ওঠে। তার মন আর শরীর দুটোই বিকৃত হয়ে ওঠে। বলা বাহুল্য,অন্য সময় বাবুলাল সাধারণ রূপে থাকলেও যখন গভীর রাতে বিশেষ করে পূর্ণিমার রাতে বিশ্বচরাচর মায়াবী জ্যোৎস্নায় ভরে যেত,তখন বাবুলাল নিজের বাইরের খোলস ছেড়ে আসল রূপ ধরত।

আজ সন্ধ্যাবেলা বাবুলাল রক্তের তীব্র নেশায় লক্ষ্মণকে অ্যাটাক করে।কিন্তু লক্ষ্মণও ছাড়ার পাত্র নয়। সেও লোহার শিক এঁফোড় ওঁফোড় বসিয়ে দেয় ঐ দানবের শরীরে।ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় লক্ষ্মণ ও ঐ দানবের। কিছুক্ষণ পর দানবটা পরিণত হয় বাবুলালের চেহারায়।

বাবুলালের ক্ষতবিক্ষত হিংস্র মুখের দিকে তাকিয়ে সত্যিই ভয় পেলাম। মনে পড়ল সেদিন আলো আঁধারিতে ঐ গড় থেকে বাবুদাকে বেরোতে দেখেছিলাম। অমায়িক নম্র ভদ্র মানুষটাকে শয়তানের পূজারী বা হিংস্র দানব রূপে কল্পনা করতেও কষ্ট হচ্ছিল।

কাছেই শ্মশান। বাবুলালের শবকে কাঠের চিতায় দিয়ে পুরোহিত দেখলাম চারিদিকে পবিত্র জল ছেটালেন। তারপর দুর্বোধ্য সংস্কৃত মন্ত্র আওড়াতে লাগলেন।যারা প্রত্যক্ষদর্শী এই ঘটনার তারা দেখলাম কোনোওমতে পারলৌকিক ক্রিয়া শেষ হলে বাঁচে।সাবধানতার অন্ত নেই,যদি না শয়তান আবার জেগে ওঠে!দাহ কাজ সম্পন্ন হলে পুরোহিত বাবুলালের আত্মার শান্তির উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করলেন। শ্মশান থেকে যখন ফিরে এলাম তখন কারো মুখেই কোনো কথা নেই। সবার মুখই থমথমে। ভাস্করও কেমন যেন গুম মেরে রয়েছে!শেষমেষ গেস্ট হাউসের কাছে পৌঁছে পুরোহিত আমাদের বললেন,"লোভ বেড়ে গেছিল ওর। আর অতিরিক্ত লোভই পতনের মূল। তবে ওর মধ্যে শয়তানী সত্তা বা evil spirit প্রচুর পরিমাণে ছিল।

যেই মুহূর্তে বাবুলালকে দাহ করা হচ্ছিল তখন কেউ গড়ের যুবরাজের কক্ষে উপস্থিত থাকলে দেখতে পারত এক অতিলৌকিক ঘটনা। মুহূর্তে অক্ষিদ্বয় উন্মীলিত হল যুবরাজের,ঠোঁটের আগায় খেলে উঠল ক্রূর হাসি। এবার সে পাবে নতুন এক অনুচর,যে আগের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী, মানুষের রক্ত আহরণে যে আগের চেয়ে অনেক সুদক্ষ। গড়ের আকাশে নেমে এল বিপদের ঘনঘটা।রক্তের পিপাসায় জেগে উঠেছে বিক্রমদেব সিং এর প্রেতাত্মা।

আমার মনপ্রাণ কেঁপে উঠল। কুলদেবতার উদ্দেশ্যে প্রণাম জানালাম। আজকে আমাদের ওপর দিয়ে যে অশুভশক্তির ঝড় বয়ে গেল,মাথার ওপর ঈশ্বরের করুণার হাত না থাকলে বেঁচে ফেরা সম্ভব ছিল না। সত্যিই ঈশ্বর পরম করুণাময়!

সব রাতেরই পরে ভোর হয়। এই অভিশপ্ত পূর্ণিমার রাতও শেষ হল।পরের দিন ট্রেনে করে আমরা কোলকাতা ফিরে আসলাম।


Rate this content
Log in

More bengali story from arijit bhattacharya

Similar bengali story from Horror