অভিশপ্ত চিলেকোঠা
অভিশপ্ত চিলেকোঠা
বনি, রকি, রনি, টুবাই চার বন্ধু সবে সবে উচ্চমাধ্যমিক পাস করছে। এখন কিছুদিনের জন্য বিশ্রাম পড়াশোনা থেকে, তাই ওরা ঠিক করেছে কদিনের জন্য একটা ছোট্টো করে অ্যাডভেঞ্চার ট্যুর করবে রহস্যে-রোমাঞ্চে ভরা। অবশেষে আলোচনা করে ঠিক করল, টুবাইএর মাসির বাড়ি যাবে, ওনাদের নাকি জঙ্গলের মাঝে একটা পুরনো জমিদার বাড়ি আছে, রাজকীয় কায়দায় থাকা খাওয়া, তারসাথে রাজবাড়ীর সব পুরানো কত সত গল্প। আর তাছাড়া টুবাই এর বর্নণা শুনে ওরা যেটুকু বুঝেছে, তাতে গ্রামটাও খুব সুন্দর।
সবাই মিলে হই.... হই করতে করতে ব্যাগপত্র নিয়ে বেড়িয়ে পড়ল, গন্তব্য ঝাউতলা গ্রাম। সারা রাস্তা আনন্দ করতে করতে যখন ঝাউতলা গ্রামে পৌঁছাল তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল। ঝাউ গাছের ফাঁকে সূর্য তখন ক্ষীন ভাবে উঁকি দিচ্ছে। সাড়ি সাড়ি গাছের মাঝে রাস্তার ওপর দিয়ে ছুটে চলেছে ওদের গাড়ি। কিছুক্ষনের মধ্যেই গাড়ি এসে থামল জমিদার বাড়ির ফটকের সামনে। সবাই যেন ওদের আসার অপেক্ষাতেই ছিল।
সবার সাথে প্রাথমিক পরিচয় পর্ব সেরে ওরা টুবাইএর সাথে ভীতরে ঢুকল। ওদের জন্য মস্ত বড় একটা ঘর দেওয়া হয়েছে দোতলায়, চারজন একসাথে থাকবে বলে। ঘরটা পুরনো দিনের আসবাব পত্র দিয়ে খুব সুন্দর করে সাজানো গোছানো। ঘরের সৌন্দর্য এক মুহুর্তেই সবার নজর কাড়বে। সারা সন্ধ্যে জমিদার বাড়ি ঘুরে দেখতে লাগল ওরা, কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় জমিদার বাড়ির দক্ষিন দিকের কিছু ঘরের পাশাপাশি চিলেকোঠার ঘরটাও তালা বন্ধ হয়ে পড়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে এদিকে বিশেষ কেউ আসা যাওয়া করেনা।
---তবে কৌতূহল মেটাতে রকি জিজ্ঞাসা করেই ফেললো ঘর বন্ধ থাকার রহস্য....?
---টুবাই এর মাসি বললেন ওদিকে বিশেষ যাতায়াত হয়না তো তাই বন্ধ!!!! তবে তোমরা রাত বিরেতে হুটহাট কোথাও একা বেড়িয়ে পড়না বুঝলে, বেড়োনোর দরকার হলে বিশু সর্দার কে ডাকবে, ও সারারাত জেগে পাহাড়া দেয়।
ওরা বাধ্য ছেলের মত মাথা নাড়ল। সারা দিনের জার্নি শেষে ক্লান্ত শরীরে শোয়ার সাথে সাথে ঘুমের দেশে যেন তলিয়ে গেল ওরা। হঠাৎ একটা কান্নার আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে গেল রনির, জানলার পর্দা ভেদ করে ঘরে তখন চাঁদের রূপোলি আলোর ছড়াছড়ি, বাইরে ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক রাতের গভীর নিস্তব্ধতাকে আরও যেন বাড়িয়ে দিচ্ছে। রনি ওর পাশে শুয়ে থাকা টুবাইকে ডাকতে শুরু করল
---------এই টুবাই.... টুবাই.... ওঠ!!! কে.... যেন কাঁদছে মনে হচ্ছে।
কিন্তু টুবাই যেন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ওর কান অবধি রনির কথা পৌঁছাচ্ছেনা। রনি খাট থেকে নেমে এক পা... এক পা.... করে এগিয়ে গেল জানলার কাছে, পর্দা সরিয়ে দেখতে লাগল রাতের মায়াবী পরিবেশ। আর তখন সেই কান্নার আওয়াজটাও আর আসছেনা, রনি দুঢোক জল খেয়ে আবার শুয়ে পড়ল। কিন্তু ঘুম আর চোখে যেন ধরা দিচ্ছেনা। রনি আবার শুনতে পেল......
---কে.... যেন কাঁদছে, আর বলছে ছাইড়াদেন কর্তা, ছাইড়াদেন ! এত্তো বড়ো সর্বনাশ করবেননে.... আমার মা মড়া মাইয়াটার।
রনি ধরফড় করে বিছানা থেকে উঠে বসে একসাথে গায়ে ঠেলা দিয়ে বনি, রকি, টুবাইকে ডাকতে শুরু করল। ওরা হঠাৎ ঘটা এই রকম ঘটনায় ভয়ের চোটে ধরপড় করে উঠে বসল।
---------রনি কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, বাইরে কারা যেন কাঁদছে, কথা বলছে।
ওরা চুপচাপ কান পেতে শোনার চেষ্টা করল, কিন্তু কিছুই শুনতে পেলনা। ওরা আবার যে যার মত শুয়ে পড়ল। আর রনিকে বলল স্বপ্ন দেখেছিস হয়তো শুয়ে পড়। রনিও চুপচাপ শুয়ে পড়ল। কিন্তু কিছুক্ষন পর ওদের কানে ভেসে আসল এক যন্ত্রণায় ভরা তীব্র... আর্তনাদ। ওরা ধড়পড় করে উঠে একে অপরের মুখ চাওয়া চায়ি করতে লাগল।
--------রনি বলে উঠল আমি বলেছিলাম এবার বিশ্বাস হলোতো। ওরা বলল চলতো বাইরে বেড়িয়ে দেখি। চারবন্ধু একে অপরের হাতধরে এগিয়ে যেতে লাগল দরজার দিকে। দরজাটা খোলার সাথে সাথে কথাগুলো যেন আরও স্পষ্ট শুনতে পেল........
-----------একজন লোক করুন সুরে বলছে ছাইড়াদেন কর্তা.... আমার মা.... মড়া মাইয়াটার এত্তো বড় সর্বনাশ করবেননে.... আমাকে কটাদিন সময় দেন, আমি সব খাজনা মিটাইয়া দিমু, দয়া করে আমার মাইয়াটারে ছাইড়াদেন।
----------মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে বলছে, ছাইড়া দিন কর্তা, ছাইড়া দিন.... আপনার পায়ে পড়ি।
---------আর একজন দাম্ভিক স্বরে হাসছে, আর বলছে, ছাড়লে কি..... করে হবে, ছাড়া তো... যাবেনা, এত বছরের হিসাব, সুদে আসলে মেটাতে হবে।
আওয়াজ গুলোকে উদ্দেশ্য করে ওরা এগিয়ে চলেছে দক্ষিনের চিলেকোঠার দিকে। মস্ত ঝুলবারান্দার সাদা পর্দাগুলো হাওয়ার তালে তালে দুলছে, আর কালো কালো ছায়ামূর্তি ফুটে উঠছে পর্দার গায়ে গায়ে, চাঁদের আলোয় সেগুলো স্পষ্ট রূপ নিচ্ছে। চিত্রপটের মত ভেসে উঠছে ছবি, একজন সুঠাম চেহারার অধিকারি ধূতি পাঞ্চাবি পড়ে ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন লোক হাতে লাঠি নিয়ে সামনে সামনে যাচ্ছে, আর তার পিছনে একজন মস্ত চেহারার লোক একটা বছর সতেরোর যুবতি মেয়েকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে, আর একজন বৃদ্ধ লোক শুকিয়ে কাঠ হওয়া চেহারা, গামছায় চোখের জল মুছতে মুছতে অনুরোধ করতে করতে যাচ্ছে, কিন্তু সেই অনুরোধ সামনের দাম্ভিক অহংকারি মানুষটার কান অবধি পৌঁছাচ্ছেনা। ছায়ামূর্তি গুলো যেন চিলেকোঠার ঘরের সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেল। আর তার সাথে জোড়ে শব্দ করে দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল, এবং ভাসতে লাগল যন্ত্রণায় ভরা তীব্র... করুন আর্তনাদ।
*****************************************
ওরা চার বন্ধু যেন ঘোরের মধ্যে এগিয়ে চলেছে চিলেকোঠার ঘরের দিক। ওদের ঘোর কাটল একটা গলার আওয়াজে.......
-----------কি করছেন এইখানে...... শহরের দাদাবাবুরা?
ওরা পিছন ঘুরে দেখল বিশু সর্দার মস্ত লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে আছে।
----------রনি কাঁপা কাঁপা গলায় বলে উঠল, এইতো কারা যেন কাঁদছিল, চিৎকার করছিল তুমি শুনতে পাচ্ছনা। কিন্তু বলার পরক্ষনেই উপলব্ধি করল, সেই রকম আর কোন আওয়াজ নেই। ওরা আবার একে অপরের মুখের দিকে চেয়ে রইল। কি.....বলবে কিছুই বুঝতে পারছেনা?
------------বিশু সর্দার দৃঢ় কন্ঠে বলল, ওরা রোজই এই রকম করে, আপনাদের এইভাবে এইখানে আসা ঠিক হয়নি!!আমি সময় মত না..... আসলে কি..... বিপদটাইনা হতো! যান ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ুন সকাল হতে এখনও অনেক সময় বাকি।
---------টুবাই বলে উঠল বিপদ মানে...? কিসের বিপদ....?
-----------বিশু সর্দার বলল, অত শত আমি জানি না....!!! কালকে না.... হয় কর্তা বাবুর কাছে জেনে নেবেন...!!! আর আমাকে না..... ডেকে কোথাও বেরবেন না.... যান ঘরে।
ওরা চারবন্ধু চিলেকোঠার তালাবন্ধ ঘরের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে চলে আসল ওদের নির্দিষ্ট ঘরে। বাকি রাতটুকু সেই ভাবে নিদ্রাদেবী আর আসলোনা ওদের চোখ জুড়ে।
ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথে টুবাই এর মাসি আর মেসো হাজির হল ওদের ঘরে। ওরা তখনও কালকে রাত্রের ঘটে যাওয়া ঘটনার কথাই ভাবছে।
-------মাসি মেসো কে... দেখে টুবাই রাত্রের সমস্ত ঘটনা বলে, জিজ্ঞাসা করল কি..... হয়েছিল ঐ চিলেকোঠার ঘরে?
-----------টুবাইএর মেসো খাটে বসে দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বলে উঠলেন, এ.... এক অভিশপ্ত ঘটনা আমার ঠাকুরদার আমলের। আমার ঠাকুরদা একজন রাগি, বদমেজাজি, দাম্ভিক এবং চরিত্রহীন কাপুরুষ ছিলেন। জমিদারির কাজের থেকে তিনি সুরা পান এবং নারীতে আসক্ত থাকতে বেশি ভালোবাসতেন, সেই বছর খরা হওয়ার গ্রামে চাষবাস ভালো হয়নি, তাই সবাই যথা সময়ে খাজনা দিতে পাড়েনি। গ্রামের নিমাই হালদার পর... পর.... তিন বছর খাজনা দিতে পাড়েনি, তাই ঠাকুরদা ওনার বিশ্বস্থ লেঠেল সর্দার জগাকে দিয়ে নিমাই হালদারের মেয়েকে তুলে এনে ছিলেন, এবং চিলেকোঠার ঘরে ওর আব্রু হরণ করেন, নিমাই হালদারের কোন অনুণয় অনুরোধ কিছুই শোনেননি। মেয়েটি ঐ ঘরেই গলায় কাপর জড়িয়ে আত্মহত্যা করে। তারপর জমিদার বাড়িতে নেমে আসে কালোছায়া একের পর এক সবাই মরতে থাকে। অনেক পূজো, যাগ...যজ্ঞ করে ঘরটাকে বন্ধ করে রাখা হয়েছে। এখনও রাত্রি নামলে সেই অভিশপ্ত ঘটনা দৃশ্যমান হয় জমিদার বাড়ির প্রত্যেক আনাচে কানাচে।
টুবাই, বনি, রনি, রকি সমস্ত ঘটনা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেল।
-------টুবাই এর মাসি বলে উঠল, আমার কালকে তোদের সবকথা বলে দেওয়া উচিত ছিল, আসলে সবে এসেছিস তাই আর বলিনি!!! যাক সব ঠিক আছে এটাই...রক্ষে!!
সত্যি কত অভিশপ্ত অতিতের কাহিনী লুকিয়ে আছে এই রকম পুরনো জমিদার বাড়ি, রাজবাড়ির আনাচে কানাচে। রাতের নিস্তব্ধতা, এবং মায়াবী পরিবেশের সাথে তারা নিজেদের কাহিনি ফুটিয়ে তোলে।

