আত্মার মুক্তি
আত্মার মুক্তি
-----শোন শুভ' আমাকে বেশ ভূত ভূত ভাব আসবে এমন একটা বাড়ির সন্ধান দিতে পারবি?কলকাতায় বসে প্রেম কাব্য লেখা যায়,ভূতের ভয়ানক ছবি ফুটছে না বুঝলি,অনেক চেষ্টা করছি, হচ্ছে না কিছুতেই৷বল তো ভাই এমন বাড়ির সন্ধান তোর জানা আছে কি?
-----দাঁড়া ভাবতে দে.......শোন দীপু আমাদের ডায়মন্ড হারবারের দিকে একটা পুরোনো বাড়ি আছে৷তোকে চাবি দেব একটা শর্তে, আমাদের বাড়ির কেউ যেন না জানতে পারে বাড়িটা খোলা হচ্ছে,আগে সবাই মিলে থাকতো ওই বাড়িটাই,তারপর বাবা ওকালতি পড়ে হাইকোর্টে প্র্যাকটিস করতে লাগলেন। তখন বাবা আর দাদু মিলে এই বাড়িটা বানিয়ে কলকাতাবাসি হয়ে যান৷তার চার বছর পর অজু কাকু গিয়ে থাকতে শুরু করেন,শুনেছি ওখানে তন্ত্রসাধনা করতেন,আবার কিসব এস্ট্রলজি নিয়েও গবেষনা করতেন৷তারপর যে কি হলো! একদিন নিজেই আমাদের বাড়ি চলে এলেন,আর ও মুখো হতে দেখিনি৷অজু কাকুই বলেছিলেন, ও বাড়ি অভিশপ্ত,কেউ যেন না যায়,গেলেই সে মারা যাবে৷কাকু নাকি ওর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের শক্তি দ্বারা জেনেছিলেন এটা৷ভয়ে কেউ আর কোনদিনও খোলে নি বাড়িটা৷ সেই থেকে বাড়িটা দীর্ঘ দিন ধরে বন্ধ, প্রায় ৪০ বছর তো হবেই৷আলো পাখা কিচ্ছু পাবে না গুরু,আর ভূত পাবে কিনা তারও নিশ্চয়তা নেই৷২০১৭ তে তুই ভূত নিয়ে লিখতে যাচ্ছিস?পাবলিক এত বোকা লাগে তোর?ভেবে দেখ অভিশপ্ত বাড়ি চলবে কিনা?
----ধুর! অভিশপ্ত না ছাই,এসব বলে কিচ্ছু হয়না৷মনের ভুল সব৷আর বলিস না,এক পরিচালকের আবদার এবার আমাকে ভূতের গল্পের প্লট লিখতে হবে৷টেলিফিল্ম বানাবে৷আমি ভাই লেখা দেব টাকা নেব। পাবলিকের চিন্তা পরিচালক আর প্রডিউসারের৷আর অজয় কাকু আবার তন্ত্র জানতো নাকি?এস্ট্রলজার ছিল জানতাম৷দেখাই যাক, ঘটে যদি কোনো প্লট আসে৷ চাবিটা কাল দিতে পারবি?তুই যাবি তো সঙ্গে?
----না গুরু, তোমার মতো সুখের জীবন আমার নেই, দশটা পাঁচটা ডিউটি করে খাই৷পরশু আবার অডিটের কাজে দুর্গাপুর যেতে হবে......কাল অফিস যাওয়ার পথে চাবি দিয়ে যাবো,আজ উঠি রে৷
পরদিন সকাল সকাল গাড়িটা নিয়ে শুভ'র আসার অপেক্ষা না করেই, সাথে একটা স্টোভ, প্রয়োজনীয় কিছু খাবার ৪ দিনের মতো বেঁধে নিয়ে শুভর বাড়ি রওনা দিলাম৷শুভ'র থেকে চাবি টা নিয়ে সোজা ওদের ডায়মন্ড হারবারের বাড়ি গিয়ে হাজির! বাড়িটা অনেক ভেতর দিকে। বাড়ির ২ মাইলের মধ্যে না আছে কোন বাজার না বসতি৷আশে পাশের সব বাড়ি গুলো তালা মারা৷সবাই হয়ত শুভদের মতো অশুভ পথের পথিক হয়ে ভেগে গেছে বাড়ি ঘর ফেলে৷ গাছপালায় ঢেকে গেছে পুরো বাড়িটা,ধারগুলো ভেঙ্গে পরছে,আর ক'বছর পর পুরো বাড়িটাই ভেঙ্গে যাবে৷দরজার কাছ থেকে গাছ গুলো হাত দিয়ে অনেক কষ্টে সরিয়ে তালা খুলে ভেতরে ঢুকলাম৷ভেতরটা খুব অপরিষ্কার ধূলো জমা, মাকড়সার জালে ভর্তি৷ ঢুকেই কাশি শুরু হয়ে গেল৷বিশাল বাড়ি,এই বাড়ি আজকের দিনে কেউ এভাবে ফেলে রাখে৷চাবি দিয়ে নিচের সব কটা ঘর খোলার চেষ্টা করলাম, একটাও খুলল না৷তালা গুলোতে জং ধরে চাবি গুলো কাজ হচ্ছে না৷দোতলার ঘর গুলোও খুললো না৷তিন তলার একেবারে শেষ প্রান্তের কোণার ঘরটা শেষ মেশ খুললো৷ নিশ্চিন্ত হলাম কোনো ঘর তো খুললো! তবে এখানে এসেও যে প্লট পাবো বলে মনে হচ্ছে না৷নিরিবিলি তে কদিন কাটিয়ে যাই......শহরের কোলাহল মুক্ত পরিবেশে নির্জন দ্বীপের গল্প লিখে ফিরতে পারবো এটা নিশ্চিত৷ভৌতিক গল্প আর হবে না মনে হচ্ছে৷ আর কি?চালে ডালে ফুটিয়ে খেতে বসে গেলাম৷
সবে দুপুর তিনটে,
ধুস্!না আসলেই ভালো হতো৷ পেটপুজো শেষ এবার ঘুমের দেশে যায়৷৷
গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন দীপুর মনে হল কে যেন কানের সামনে বলে উঠলো................
"উঠুন গল্প লিখতে হবে তো"........
ধরমরিয়ে তাকিয়ে দীপু বলে উঠলো,
-----হ্যাঁ উঠছি৷....... বাপরে! কি ঘুটঘুটে অন্ধকার........কে আমাকে ডাকলো মনে হলো?ধুর! গল্পের প্লট খুঁজতে গিয়ে মাথাটাই গেছে৷ মোমবাতিটা বের করি,এত অন্ধকার ব্যাগটা কোথায় খুঁজবো?পায়ে কি ঠেকলো?ব্যাগটা এখানে কি করে এলো?ওটা তো ঢুকেই দরজার পাশের খোপ গুলোতে রেখেছিলাম, হয়ত আমিই রেখেছি খাটের পায়ার কাছে৷মোমবাতিটা একচান্সেই পেয়ে যাবো ভাবিনি৷মোমবাতি জ্বালিয়ে ঘড়িতে দেখলাম রাত দশটা বাজে৷বাবা এতক্ষন ঘুমালাম! জীবনে এই প্রথমবার মনে হয় এতক্ষন ঘুমালাম৷যে কাজে এসেছি সেটা নিয়ে বসি এবার৷খাতা পেন নিয়ে ৪ টে মোমবাতি জ্বালিয়ে লিখতে বসে গেলাম।
ভৌতিক গল্প এযুগে অচল মনে হলেও, ভূত নামটাই অতি মডার্ণ ছেলে মেয়েদেরও শরীরে একটু হলেও ভয়ের শিহরণ জাগিয়ে তোলে৷এটা অস্বীকার করার উপায় নেই৷আসুন না তেমনই একটি গল্প আজ দেখা যাক.........
না! হচ্ছে না৷এসব আজগুবি লেখা আমার কর্ম না!
"এই নিন চা"—
মুখের সামনে হঠাৎ কাপ প্লেট ধরা একটা হাত দেখে চমকে উঠে তাকিয়ে দেখলাম, একটি মেয়ে ঘাগড়া পরা,মুখটা আবছা দেখা যাচ্ছে,ভালোই দেখতে৷হাতে চা এর কাপ প্লেট৷চা টা দেখে খুশিতে একপ্রকার কেড়ে নিয়ে বললাম,
----বাঁচালেন! মাথা খুলছিল না এতক্ষণ,বসুন৷
মেয়েটিও আমার সামনে খাটে বসে বলল—"কি,গল্পের প্লট চাই"?
আমি বললাম—"আপনি জানলেন কি করে"?
মেয়েটি বলল—"আম খান,আমের গাছের মালিক কে জেনে কি করবেন"?
আমি "সরি, সরি" বলে উৎসাহ তুঙ্গে তুলে বললাম— "বলুন শুনি"৷
মেয়েটি বলল, "যতটা লিখেছেন তারপর থেকে লিখে যান—বহু পূর্বের কথা চৈত্রের মাঝামাঝি কাঠফাটা রোদ্দুরে নদী নালা শুকিয়ে যাচ্ছে,গ্রামে আগত হলো দুজন দৈব পুরুষের৷একজনের নাম ভৈরব তান্ত্রিক অন্য জন ওনার শিষ্য৷বৈশাখের শুরুতে জাগযজ্ঞ করে বৃষ্টি আনলো৷সবাই সেই দৈব পুরুষদের বশবর্তী হয়ে গেল"৷
"এই দাঁড়ান দাঁড়ান!এসব কি আজগুবি বলছেন?আমার ভূতের গল্প লাগবে৷জাস্ট হরর থ্রিলিং৷থ্রিলিং বোঝেন? গায়ে কাঁটা দেওয়া রোমহর্ষক অনূভূতি পাবে পাবলিক এমন গল্প বলুন৷গ্রামে ভূত টুত দেখেন নি? সত্যিকারের ঘটনা কিছু যদি জানেন বলুন না"৷
"লিখতে থাকুন শেষ হলে বুঝবেন,থ্রিলিং রিয়েলিটি সব মালমশলা পাবেন"৷
"আরিব্বাস ইংরেজি জানেন দেখছি৷আচ্ছা বলতে থাকুন".........
"সে গ্রামের একটি ছেলে, নাম বিষ্ণু৷ শহরের কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র৷সে কলেজের ছুটিতে গ্রামে এল। সে সব শুনে বুঝে গেল দৈব পুরুষ টুরুষ কিচ্ছু না! সব লোক ঠকানো ঢপবাজি৷সে গ্রামের লোকদের বোঝালো এটা প্রকৃতির নিয়ম, মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে যা হওয়ার হচ্ছে৷ঠিক তার পরদিনই সারা গ্রামে ফসল,গাছপালা সব দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো,দৈব পুরুষ জানালো দেবতা রুষ্ট হয়েছেন এই পাপী ছেলের জন্য৷ এরপর থেকে একের পর এক অদ্ভুত কার্যকলাপ চলতে থাকে গ্রামে৷ছেলেটি একের পর এক বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে কারন ব্যক্ত করার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে গেল আর ব্যর্থ হলো৷দৈবপুরুষ অশিক্ষিত মানুষদের মনে জায়গা করে নিল৷নিজের দলের লোকদের গ্রামে ঢুকিয়ে অলৌকিক কার্যকলাপ শুরু করে দিল৷কখনও বা সাপে কাটা রোগী বাঁচিয়ে,কখনও বা নিঃসন্তান রমণীর বাচ্চা হচ্ছে দেখিয়ে৷দিনের পর দিন চলতে থাকে এসব৷বিষ্ণুর প্রেমিকা ছিল রাধা,সেও তখন গ্রামের স্কুলে দশম শ্রেনীতে পড়ে। বিষ্ণুর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা রাধা সহ গুটি কয়েক সদ্য পড়াশোনা করা ছেলে মেয়ে বুঝতো,এসব ভন্ডামি! তারা গ্রামের মানুষদের বোঝাতে পাঁচ জনের একটা দল বানালো৷দলের হেড হলো বিষ্ণু৷বিষ্ণু বাহিনী সবার বাড়ি গিয়ে গিয়ে এসব ভুল তথ্যের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিতে কিছু লোকের চেতনা জাগতে লাগলো৷বিষ্ণু হেড হওয়াতে ভৈরব আর তার শিষ্যের কাছে চক্ষুশূল হয়ে উঠলো৷হঠাৎ বিষ্ণুর মার একটি চোখ থেকে রক্তপাত শুরু হতে থাকলো একদিন৷এমতাবস্থায় গ্রামে রোজই কারো না কারো হাঁস,মুরগী,ছাগল অমাবস্যা তিথির পরই মৃত অবস্থায় পাওয়া যেতে লাগলো৷ভৈরব রটিয়ে দিল সব বিষ্ণুর মা খেয়ে নিচ্ছে,ওদেরই রক্ত চোখ দিয়ে পড়ছে৷ডাইনি অপবাদ দেওয়া হলো!রক্ত পাত হচ্ছিল কারন গ্লুকোমা রোগের উপসর্গ ছিল বিষ্ণুর মায়ের চোখে৷তার ওপর ছানি পড়েছিল চিকিৎসার অভাবে সেটি পেকে ফেটে যাওয়াতে রক্তক্ষরণ হয়ে চোখটিই প্রায় নষ্ট হতে বসেছে৷শহর ছাড়া এর চিকিৎসা করা যাবে না৷ শহরে নিয়ে গেলেই ঠিক হয়ে যাবে সেই ব্যাখ্যাও বিষ্ণু দিল৷কিন্তু ততদিনে মূর্খ গ্রামবাসিকে সহজে আবার হাতের মুঠোয় করে নিল দুই তান্ত্রিক৷গ্রামের লোকদের বোঝানো হলো, ডাইনিকে বাঁচাতে এগুলো বিষ্ণুর কারসাজি,ওকে না মারলে গ্রামের পশু আজ মরছে কাল মানুষ মরবে৷
সালিশি সভায় ঠিক হলো........এর পর যদি কিছু অঘটন হয় তার শাস্তি ভোগ করতে হবে বিষ্ণুর মাকে৷তার পরদিনই হরি সামন্তর পাঁচ বছরের ছেলের চোখ ওপড়ানো দেহটা বিষ্ণুদের বাগান থকে পাওয়া গেল৷নিরীহ বিষ্ণুর মাকে সবাই মিলে নির্মম ভাবে পিটিয়ে মেরে ফেলে বিষ্ণুকে একা করে দিল৷
তারপর বিষ্ণুর দলের একজন করে মারা যেতে লাগলো৷ওই দলে বিষ্ণুকে নিয়ে ৪টি ছেলে আর একটি মেয়ে ছিল৷তিনটি ছেলেই প্রতি অমাবস্যাই গায়েব হয়ে যেতে লাগলো৷কেউ খোঁজ পেত
না তাদের৷সবার বাড়িতেই একটি করে চিঠি চলে যেত—'ভৈরব বাবার জয়,উনি আমাদের এতদিনে ঠিকঠাক কাজের ব্যবস্থা করে দিলেন,আমরা ওখানেই চললাম'৷বাড়ির লোকও খুশি ছেলে কাজ পেয়েছে,আর ভৈরব তান্ত্রিক সকলের ভরসার পাত্র তো ছিলোই"৷
"আরে দাঁড়ান দাঁড়ান,এখানে ভূত কোথায়?এতো ডিটেকটিভ গল্প হচ্ছে৷কি সব হাবিজাবি বলে সময় নষ্ট করছেন আমার৷ধুর! দু পেগ না খেলে হবে না৷একটু বসুন,কি খাবেন নাকি?আহা সোমরসের মজাই আলাদা"৷
"না ধন্যবাদ,আমি এসব খাইনা৷বাকিটা শুনুন......বিষ্ণুর আর ওর প্রেমিকার কি হলো জানবেন না"?
মেয়েটির চোখ দুটো দিয়ে কেমন যেন আগুনের ঝলক দেখলাম,দু পেগেই ভূতের আভাস পাচ্ছি মনে হচ্ছে,চার পেগ মেরে দিলে স্বয়ং ভূত এসেই গল্প লিখে যাবে—"বলুন শুনি৷রাত সবে ৩ টে,রাতের খিদে টাও কেমন যেন আপনার আনা চা টি খেয়ে মরে গেল৷বাকি রাতটা খিচুড়ী গল্পেই কাটুক৷ সকাল হলেই ভাগবো বুঝলেন৷যে উদ্দেশ্য নিয়ে এলাম পূরণ হলো না..........
একি মাথায় হাত দিচ্ছেন কেন? আ..আ...আ.... কষ্ট হচ্ছে একি!কে এটা,উফ্ কি বীভৎস,চোখ ওপড়ানো,সরুন এখনই৷কে আপনি? ভয় দেখাতে এসেছেন মেক-আপ করে".....
বেশ ভারিক্কি অথচ নেকো সুরে বলল—"আমি বিষ্ণু",সাথে আধ পোড়া একটি ছেলে,বলল—"আমি রহিম"৷আর একটির গলা অর্ধেক কাটা ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে,বলল—"আমি নৃপেন"৷আর একটি ছেলের হাত পা ছাড়া দেহটা এসে দাঁড়ালো,সাথে সারা শরীরে ক্ষতচিহ্ন,বলল—"আমি শেখর"৷ সাথে অজস্র মুরগী,ছাগল,পাখির ছটফট করা কাটা দেহ৷মেয়েটি এগিয়ে এসে বলল— "এরাই বিষ্ণু বাহিনী"৷
"কিন্তু এরা তো সবাই মৃত"৷
মেয়েটি হা হা করে হেসে বলল—"এরা সবাই মৃত......দেখুন কি ভাবে মরেছে"—
ঘরটিতে নিমেষের মধ্যে জ্বলে উঠলো যজ্ঞ কুন্ড,এক তান্ত্রিক,তার সামনে সারা গায়ে পেরেক গাঁথা সিঁদুর মাখানো একটি পুতুল পুজো করছে৷
"আরে এই লোকটাতো অজু কাকু!আর একটি লোক....... একি! কি নির্মম ভাবে ছেলেটির গলা কাটছে,অর্ধেক কেটে ফিনকি দিয়ে পরা রক্ত বাটিতে ধরে তান্ত্রিকটা খেল আর অজুকাকু কে দিল,অজু কাকু বমি করছে তো৷
অজু কাকু খেওনা........ওটা মানুষের রক্ত".....
দীপু আরো দেখল তান্ত্রিক বলছে— "খা বেটা খা,আর চারজন কে মেরে রক্ত খেলেই আমরা সিদ্ধি লাভ করবো৷আজ যে গুলো লোককে ভন্ডামি করে বুঝিয়ে বোকা বানাচ্ছি, সেগুলো সত্যি করার শক্তি পেয়ে যাবো.....সাবাস বেটা এবার দেখ সিদ্ধি আমরা পাবোই"৷
"ওয়াক; অজু কাকু খেলে কেন"?
মেয়েটি এগিয়ে এসে বলল—"ওনারা আপনার কথা শুনতে পাবে না,এসব অতীতে যা হয়েছে দেখছেন,এই হল ভৈরব তান্ত্রিক আর তার শিষ্য আপনার অজয় কাকু"........
এরপর একের পর এক হত্যা দৃশ্য ফুটে উঠছে, পুরো মুখ কাপড়ে বাঁধা একটি মেয়েকে কুৎসিত ভাবে ওই তান্ত্রিক শারীরিক অত্যাচার চালানোর পর, অজু কাকুকে সিদ্ধিলাভের চতুর্থ ধাপে এগোতে বলল,অজু কাকুও নির্দ্বিধায় মেয়েটিকে ভোগ করলো,বিষ্ণুর চোখের সামনে বিবস্ত্র মেয়েটির ওপর মদ ফেলে আগুন ধরিয়ে দিল তান্ত্রিক৷বিষ্ণুর প্রাণ ফাটা চিৎকার,
"সব দেখে ফেলেছি তোদের আর নিস্তার নেই"৷
বলার সাথে সাথে অজু কাকু ভৈরবের কথামতো বিষ্ণুর চোখ দুটো গরম লোহার শিক দিয়ে উপরে ফেলে দিলো। তান্ত্রিকের কথা মতো একটা অমাবস্যায় একটি বলি গ্রহন বলে বিষ্ণুকে প্রাণে বাঁচিয়ে রাখলো৷চার দিনের মাথায় বিষ্ণু মারা গেল৷দেখা যাচ্ছে তান্ত্রিক বলছে.....
"সাধনায় ব্যাঘাত, সিদ্ধি লাভ করতে আর একজন চাই,অমাবস্যার দিনই যোগার করতে হবে"৷
আবার অমাবস্যা তিথি চলে এল,অজু কাকু সবে বের হয়েছে ঘরের বাইরে, রাতের অন্ধকারে একজন ছেলে ধরে নিয়ে আসতে৷সেই দিন পাঁচ জনের অতৃপ্ত আত্মারা জেগে উঠলো! ভৈরবকে ছিঁড়ে দু'টুকরো করে জানলা দিয়ে বাড়ির পেছনের বাগানে ফেলে দিল৷ভৈরবের এই পরিণতি ঘরের বাইরে থেকে দেখে অজু কাকু ঘরে না ঢুকে পালাতে লাগলো,তারপর দূরে মিলিয়ে গেল৷আমি মেয়ে টিকে বললাম—
"অজু কাকু কে আত্মারা ছেড়ে দিল কেন"?
মেয়েটি বলল— "আত্মাদের ক্ষমতা শুধু বাড়ির এই ঘরটির মধ্যে ৪০ বছর অন্তর একটা অমাবস্যা তিথিতে ওদের শক্তি বাইরে প্রয়োগ করতে পারবে৷পরেরদিন ভৈরবের দেহ গ্রামবাসীরা পুলিশ ডেকে তাদের হাতে তুলে দিল৷তারপর থেকে প্রতি অমাবস্যায় এরা পৈশাচিক ক্ষমতা লাভ করে ও শক্তিশালী হয়ে যায়৷ ভালো মন্দ সব মানুষকেই এরা এক চোখে তখন দেখে৷প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে যায়৷ কাল অমাবস্যা, দুপুর ২টোর আগে এই গ্রাম ছেড়ে চলে যাবেন৷অমাবস্যার মধ্যে এই খাতাটা আপনার অজয় কাকুর হাতে দেবেন"৷
আমার ভয়ে সারা শরীর হিম হয়ে গেছে৷তাও আপনা থেকেই বলে ফেললাম,
----গল্পের শেষটা কি লিখবো?
মেয়েটি বলল,
----এরপর যেটা হবে নিজেই লিখে দেবেন আমার সাহায্য লাগবে না৷অমাবস্যা কেটে গেলে পুলিশ দিয়ে সব কঙ্কাল গুলো উদ্ধার করাবেন,আর ওদের কঙ্কাল গুলো ওদের বাড়ির লোকদের হাতে, আর বিষ্ণু আর রাধার কঙ্কাল রাধার দাদার হাতে তুলে দিতে বলবেন৷কাল রাধার বাড়ি গিয়ে সব বলবেন৷আপনার গাড়ি ঠিক রাধার বাড়ির সামনে গিয়েই দাঁড়াবে৷আপনাকে খুঁজতে হবে না৷ ওরা আজও একমাত্র বোনের ফেরার অপেক্ষায় বসে৷
আমার কৌতূহল বেড়ে গেল৷একা একটা মেয়েকে সাহস করে ভূতের বাড়িতে দেখে নিজের ভয়টা কন্ট্রোল করে বলেই ফেললাম মেয়েটিকে,
----কিন্তু আপনি এই ভূতের বাড়িতে কেন? ভয় করছে না আপনার?আপনিও কি তন্ত্র মন্ত্র জানেন?
মেয়েটি জোরে জোরে হেসে নিল, সাথে বাকি অশরীরিরা৷আমি আর স্থির নেই! কোন অচেতন শক্তি আমাকে ঠেলে ফেলে দিল......
জ্ঞান ফিরলো সকালে!গভীর রাতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম না অজ্ঞান হয়েছিলাম মনে নেই৷রাতের কাহিনীর শিহরণ সারা শরীরে ভয়ঙ্কর ভাবে তখনও বিদ্যমান৷ গাড়ি নিয়ে আগে ছুট্৷ একটা বাড়ির কাছে গাড়িটা গিয়ে থামলো,বাইরে থেকে রাধার নাম ধরে ডাকতে একজন ষাটোর্ধ্ব লৌক বেরিয়ে বললেন, তিনি রাধার দাদা৷বলে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেল আমাকে৷রাধার বৌদির সাথেও পরিচয় হল৷তাদের সব বললাম রাতের ঘটনা৷ওরা শুনে থ বনে দুজনেই কান্নায় ভেঙে পড়লো৷আমার রাধার ওই পোড়া দৃশ্যের ছবিটা চোখে ভাসছে,আসল মেয়েটিকে দেখবো বলে ছবি চাইলাম৷দেখে আমার আত্মারাম খাঁচা ছাড়া,বললাম,
----এই মেয়েটি রাধা?এই তো গল্প গুলো বলছিল! সিনেমার মতো সব দেখতেও পেলাম৷ তার মানে সারা রাত একটা ভূতের সাথে ছিলাম৷পালাতে পারলে এবার বাঁচি! আমি প্রাণপনে ছুটে গাড়ি নিয়ে শুভদের বাড়ি,রাধার কথামত খাতাটি অজু কাকুর হাতে দিয়ে "পড়বেন", বলে চলে এলাম৷তখন বিকেল ৫টা৷বাড়ি গিয়ে স্নান করে, ভালো করে গঙ্গাজল গায়ে ছিটিয়ে, ঠাকুর ঘরে গিয়ে অনেকক্ষণ প্রণাম করলাম৷বাড়ির কাউকে কিছু বললাম না৷তাড়াতাড়ি খেয়ে, রাত ১০ টার মধ্যে শুয়ে লম্বা ঘুম দিলাম।
সকাল ৭টায় ফোনের আওয়াজে সেই ঘুম ভাঙলো। শুভ'র ফোন! বুঝলাম চাবির জন্য সাত সকালে ফোন করেছে। ফোনটা ধরেই বললাম,
----কাল তোর বাড়ি গেছিলাম তুই ছিলিস না৷আজ খুব ক্লান্ত আমি, তুই একসময় এসে চাবি নিয়ে যাস৷শুভ বলল,
----একটা খারাপ খবর আছে! অজু কাকু কাল রাতে সুইসাইড করেছে৷নিজেই নিজের চোখ উপড়ে,ওড়নায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন৷আর কাল তুই এসেছিলিস শুনেছি, তোর লেখার খাতাটা অজু কাকুর ঘরেই ফেলে গেছিস৷নিয়ে যাস৷
বুঝলাম এটাই হওয়ার ছিল৷আমি শুনেই বেড়িয়ে পড়লাম শুভর বাড়ি। গিয়ে দেখলাম বীভৎস ভাবে লোহার শিকে দুটো চোখ গাঁথা,গলায় রাধার পরনের ঘাগড়ার ওড়না,সেদিন যেটা পরেছিল৷ডায়মন্ড হারবারের বাড়িতে ঘটা সব ঘটনা শুভকে খুলে বললাম। পরেরদিন পুলিশ গিয়ে পুরো বাড়ি সার্চ করে, কঙ্কাল গুলো উদ্ধার করে, ফরেনসিক পরীক্ষা করে দেহ গুলো সবার পরিবারের হাতে তুলে দিল,সেই সাথে অজু কাকুর দেহও৷ পোস্টমর্টেমে এবং সব কিছুতে অজু কাকুর হাতের ছাপ পাওয়াতে আত্মহত্যা প্রতিষ্ঠিত হলো মৃত্যুটা৷৷
সেদিন রাতে শুয়ে আছি,মনে হলো যেন রাধা আর বিষ্ণু দুজন দুজনের হাত ধরে এসে বলছে—"আপনার জন্য আমরা আজ ৪০বছর পরে মুক্তি পেলাম"৷৷
আমিও গল্পের শেষটা লিখে ফেললাম........এর পর যা যা ঘটলো,অজু কাকুর অশরীরির হাতে মৃত্যু রহস্য,সবশেষে আত্মা যুগলের মুক্তি লাভ সবই লিখলাম৷ততদিনে সারা দেশে মিডিয়ার মাধ্যমে পুরো খবর ছেয়ে গেছে৷লেখক দীপাঞ্জন বসু থেকে এখন আমি বেশী পরিচিত হয়ে গেছি ভূত পরিদর্শক দীপাঞ্জন বসু হিসেবে৷প্রডিউসরের আবদার মতো লেখকের চরিত্রের অভিনয়টিও আমাকেই করতে হবে৷যা যা ঘটেছে, অবিকল তাই দেখানো হবে৷ রিয়েল ভূতের দর্শন হওয়ার যে রোমহর্ষকতা আমার ঘটেছে! সেটার অনুভূতি দর্শক কতটা পাবে জানি না,তবে রাধার কথামত রিয়েলিটি পুরোটাই পাবে এনিয়ে কোনো দ্বি-মতের অবকাশ নেই৷
( সমাপ্ত)