অন্তরতম:-
অন্তরতম:-
(১)
মাঠে মাঠে সাদা কাশবনের আভরণ,আকাশ ঘিরেছে সাদা-নীল রঙ মেশানো পেঁজা তুলো মেঘের ভেলায়।সুন্দরী প্রকৃতির ছোঁয়ায় পৃথিবীর বপেঁচাল আনন্দের জোয়ার,আসছে পুজো।বাতাস সুবাসিত মন মাতাল করা হাসনুহানার গন্ধে।প্রকৃতি মেতেছে প্রেমজোয়ারে, প্রথম মল্লিকার কলি ফুটছে কত কিশোর-কিশোরীর মনে।হারমোনিয়ামের রিডে বেজে উঠছে "প্রেমের জোয়ারে,ভাসাবে দোঁহারে", কিশোর-কিশোরী গেয়ে উঠলো যৌথ গলায়।চলছে নাটকের মহড়া।নামের সাথে বয়সেও ওরা কিশোর-কিশোরী।কিশোর উচ্চমাধ্যমিক আর কিশোরী ক্লাস টেন।কিশোরের হাত দিয়ে থুতনির ছোঁয়াতে কিশোরীর ফর্সা গাল দুটো লাল হয়ে উঠলো।কিশোরের চোখ নামানোর ফাঁকে কিশোরী দুচোখ ভরে দেখছে কিশোরের মুখ।লুকোচুরির মাঝে একে অপরের দৃষ্টি বিনিময় চলছে।দুদিন বাদেই পাড়ার প্রতিমা উদ্বোধনের অনুষ্ঠান।গ্রামের পুজোর আড়ম্বর শহরের পুজোর চেয়ে অনেক কম হলেও আনন্দতে কোন ভাঁটা নেই এখানে।বিপত্তি ঘটলো অনুষ্ঠানের আগের দিন।প্যান্ডেল বাঁধার তত্ত্বাবধানের সময় বেকায়দায় পা মচকে গেল কিশোরের।লেংচে তো আর অভিনয় করা যায় না।অগত্যা অন্য অভিনেতাকে তৈরী করা হলো,প্রম্পট আর গানের দায়িত্বটা পালন করছে কিশোর চেয়ারে বসে।সেই ভরসায় এগোচ্ছে নাটক।এলো সেই গানের দৃশ্য, কিশোরীর থুতনিতে অন্য ছেলের হাত, তাও ওরই পাড়ার ছেলে, এ কি সহ্য করা যায়?দাঁতে দাঁত চেপে চলছে প্রম্পট,নাটক শেষে থমথমে মুখে কিশোর কারো সাথে কোন কথা না বলে বাড়ি চলে গেলো।পেছন পেছন কিশোরী ছুটছে "ও কিশোর দা আস্তে চলো,আমার সাথে চলো,হনহনিয়ে কেন হাঁটছো? ও কিশোর দা....." হাঁপাচ্ছে কিশোরী কিশোরের হাত দুটো ধরে।
"ছাড় আমার হাত,যার হাত থুতনিতে নিয়ে সোহাগ খাচ্ছিলিস তার হাত ধর"।
"আমি কি ইচ্ছে করে করেছি এটা!তুমিই তো পায়ে লেগে....."
"আবার মুখে মুখে কথা" বলে কিশোরীর চুল দুটো যতটা জোরে পারলো টানলো কিশোর।
"আঃ লাগছে তো।"
"লাগুক,আমারও লেগেছে এখানে" বলে নিজের বুকে কিশোরীর হাতটা ঠেকিয়ে কিশোরীকে জড়িয়ে জাপটে ধরলো বুকে।
"কিশোর দা তুমি সত্যি চলে যাবে শহরে আমাকে ছেড়ে?"
"যেতে যে হবে,পড়াশোনা না করলে তোকে খাওয়াব কি"?
(২)
"কি করছিস ভর দুপুরবেলা পুকুর ঘাটে বসে বসে?"
"খাবে? তেঁতুল মাখা?"
"একি রে তুই তো ঝাল খেতে পারিস না,এতো লঙ্কা দিয়ে মেখেছিস?"
"তুমি যে ভালোবাসো কিশোরদা তাই তো মেখে আনলাম।"
"কি হয়েছে তোর?চোখ ছল ছল করছে কেন?"
"কিছু না।"
"কিছু না বললেই হবে?বলবি না আমাকে?"কিশোরীর গাল দুটো ধরে জিজ্ঞাসা করলো কিশোর।
"কাল তো তোমার জয়েন্টের রেজাল্ট কিশোরদা?"
"হ্যাঁ,মনে হয় সরকারীতে ডাক্তারী পড়ার চান্সটা পেয়ে যাবো বুঝলি!"
"জানি তো,কলকাতায় পড়তে গিয়ে আর যে আমাকে মনে রাখবে না তাও জানি।"
"ধুর পাগলী,মনে আবার রাখবো না কেন?মনে তাকে করতে হয় যে মনের বাইরে থাকে, তুই তো আমার বুকের ভেতরে আছিস,তুই যে আমার সব, তোকে কি আলাদা করে মনে করতে হয়? না মনে করার প্রয়োজন পড়ে?দেখতে দেখতে দেখবি চার বছর পেরিয়ে গেছে।তুইও পাশ করে যাবি,তুই আবার কলেজে গিয়ে আমাকে ভুলে যাস না,নতুন বয়ফ্রেন্ড জুটিয়ে ফেলিস না তোর কিশোরদাকে ভুলে।"
"নিজেই তো বললে মনে তাকে করতে হয় যে মনের ভেতর থাকে না,তাকে মনে করতে হয় না যে মনের ভেতরেই থাকে,তুমিও যে আমার মন জুড়ে থাকো কিশোরদা,কি করে ভুলবো?আলাদা করেই বা কি করে মনে করবো?"
কিশোরের বুকে মাথা গুঁজে কিশোরী অঝোর ধারায় কাঁদছে। কিছুটা খুশিতে, কিছুটা বিচ্ছেদের যন্ত্রণাতে।কিশোর মেডিক্যালে চান্স পেয়ে গেছে। এই বছরটা দুজনের কাছেই যেমন খুশির,তেমনি দুঃখের।কিশোরী মাধ্যমিক পাশ করেছে ভালো ভাবে, কিশোরও উচ্চমাধ্যমিক পাশ আর জয়েন্টে আশানুরূপ ফল করে মেডিক্যালে চান্স পাওয়া সব ভালোর মাঝে দুজনের বিচ্ছেদটা সব ভালো খবরকে ম্লান করে দিচ্ছে। কিশোর চলে যাওয়ার দিন কিশোরী ওকে অনেক যত্ন করে নিজের হাতে তেঁতুল মেখে খাওয়ালো।চোখের জল আজ আর বাধ মানছে না কিশোরীর।
"ধুর পাগলী,কাঁদছিস কেন?আমি তো ছুটি পেলেই চলে আসবো তোর কাছে।এখানে আমার বাড়ি,মা-বাবা,বাড়ির লোকজন সবাই তো থাকলো।আমাকে তো আসতেই হবে।"
"ঠিক এসো কিন্তু কিশোরদা।না হলে তোমার কিশোরী কেঁদে কেঁদেই মা....." কিশোরীর কথাটা শেষ করতে না দিয়েই কিশোর ওর মুখটা হাত দিয়ে চেপে ধরে "কখনো এমন কথা বলবি না,আর যেন না শুনি" বলে জড়িয়ে ধরলো।
কিশোরীর চোখের সামনে দিয়ে ট্রেনটা হুইসেল বাজিয়ে চলে যাচ্ছে।যতদূর চোখ যায় দেখছে ওর কিশোরদাদাকে।টপ টপ করে গাল বেয়ে পড়ছে নোনাজলের ধারা।ট্রেনটা আর চোখে পড়ছে না কিশোরীর। কিশোরের পরিবারের কজন দাঁড়িয়ে ছিলেন, তাঁরাও বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন স্টেশন চত্ত্বর থেকে। কিশোরী সকলের অলক্ষ্যে চোখের জলটা মুছে সকল বন্ধুদের সাথে নিজের বাড়ি ফিরে এলো। পাঁচমাসের মাথায় কিশোর ছুটিতে এলো, তাও দুদিনের জন্য। এরপর কিশোরের বাবা কলকাতা বদলি হলেন, পরিবার সহ গ্রামের দিকে আসা ধীরে ধীরে কমে যেতে লাগলো। একটা সময় আসা পুরোই বন্ধ হয়ে গেলো তাদের। তখন সবে শহরাঞ্চলে মোবাইল ফোন আসছে, গ্রামাঞ্চলে তখনো সেইভাবে বিস্তার ঘটেনি।শহরাঞ্চলেও অভিজাত পরিবার ছাড়া মোবাইল ব্যবহার করার সামর্থ্য কারো ছিলো না। দু-তিন বছর চিঠির মাধ্যমে যোগাযোগ স্হাপন করেছিলো দুজনে।তবে কিশোরী যত চিঠি লিখতো কিশোরের কাছ থেকে জবাব খুব বেশী আসতো না। নিজের লেখা পড়া বিদেশে স্কলারশিপ পেয়ে পড়তে যাওয়ার চেষ্টাতে কিশোরের জগৎটা কিশোরীর থেকে পড়াশোনার জগতে বেশী মনোযোগী হয়ে ওঠে।কিশোরের সাথে রাজীব বলে আর একটি ছেলেও শহরে ডাক্তারীতে চান্স পেয়ে পড়তে যায়।ও ছুটি পেলেই গ্রামে আসে।অভিমানী কিশোরী ওর থেকে কিশোরের খোঁজ নিতে থাকে।চিঠির পরিমান ধীরে ধীরে শূন্যতে এসে ঠেকলো।তার কারণ কিশোর স্কলারশিপ পেয়ে বিদেশে চলে গেলো ডাক্তারীতে এফ.আর.সি.এস. ডিগ্রী আনতে সাথে ওর পরিবারও। রাজীবও একই সাথে গেলো। তবে একবার মাত্র রাজীব এসেছিলো ভারতে নিজের গ্রামে, ওর বাবার মৃত্যুর খবর পেয়ে, তখন ওর থেকে কিশোরী জেনেছিলো ওর কিশোরদা ভালো আছে।মন দিয়ে পড়াশোনা করছে।অনেক সুনাম ইতিমধ্যে হয়ে গেছে।রাজীব ওর মাকে নিয়ে চলে গিয়েছিলো বিদেশে।তারপর রাজীবও আর আসেনি কোনদিন গ্রামে, কিশোরের খোঁজও মেলেনি।কিশোরী গ্রামেই উচ্চমাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষিকা হয়েছে।ফোনের চল গ্রামেও হয়ে গেছে। কিশোরীর হাতে কি-প্যাড ফোন। অনেক নম্বরের ভীর থাকলেও ফোনটা একটা নম্বরের জন্য পরিপূর্ণ হয়ে উঠছে না। সেটা ওর কিশোরদার নম্বর। কত সম্বন্ধ ইতিমধ্যে ও নাকচ করেছে।কত প্রেমের হাতছানিও। স্কুল জীবন থেকে শিক্ষিকা জীবনে প্রবেশের দীর্ঘপথে অনেক কিছু উপেক্ষা করেছে।শুধু একজনের অপেক্ষায়।এ অপেক্ষা ওর মনের দৃঢ় বিশ্বাসের। ওর কিশোরদা আসবেই ওকে নিজের করে নিতে।
(৩)
প্রতিবছর পুজো আসে।নিজের মতো করে সবাই আনন্দ করে।সেই পুজোর অনুষ্ঠানটা আজো কিশোরীদের গ্রামে একইভাবে হয়ে আসছে। আয়োজক এখন কিশোরী সহ আরো কিছু ছেলে মেয়ে। চলছে রিহার্সাল ক্লাব ঘরটাতে।পাড়ার ছোট ছোট মেয়েদের গান তোলাচ্ছে কিশোরী। এমন সময় ওদেরই মধ্যে একজন বাচ্চাছেলে খবর দিলো একটা বড় দামী গাড়ি গ্রামে ঢুকছে। ভেতরে কে আছে বোঝা যাচ্ছে না। কালো কাঁচের গাড়ি। ছেলেটির বলার বেশ কিছুক্ষন পর গাড়িটা এসে থামলো ক্লাবঘরের সামনে। সবাই বেশ কৌতুহলে বেরিয়ে এলো দেখতে কার গাড়ি! কে এসেছেন এই গ্রামে এতো দামী গাড়ি চড়ে? সবার চোখে কৌতুহল। একমাত্র কিশোরী টেবিলের হারমোনিয়ামে গানের সুর বাজিয়ে গানে মগ্ন 'প্রেমের জোয়ারে,ভাসাবে দোঁহারে...."
চোখের কোনে জল।অনেকদিন পর এই গানটা হঠাৎই ওর গলা থেকে নিজের অজান্তেই বেরোচ্ছে।হাততালির আওয়াজে চোখ খুলে চেনা মুখ চোখের সামনে দেখে চমকে উঠলো কিশোরী।নির্বিকারে তুই বলে সে সম্বোধন করছে। চেহারার আদল এক থাকলেও গাম্ভীর্য এসেছে শরীরে।হবেই তো বিদেশের নাম করা ডাক্তার সে এখন।মেম বৌ পাশে করে এসেছে। কিশোরী নিছক গ্রামের এক কোনে পড়ে থাকা স্কুল শিক্ষিকা ছাড়া আর কিছু না আজ তার কাছে। কিশোরী চোখের জলকে মনের ভেতর ঘুরপাক খাওয়াচ্ছে, কিছুতেই বাইরে সে আসতে দেবে না।যত বালিশ তার ভিজবে বাড়ি গিয়ে।
"কেমন আছিস?"
"ভালো,আপনি?"
"আমিও ভালো আছি? তা তুই তো এখন স্কুলে পড়াশ শুনেছি।"
"ওই আর কি,চলি" বলে কাঁধে ব্যাগটা নিয়ে বেরোতে যেতে গিয়ে শাড়িতে টান পড়তে চোখ বন্ধ করে কিশোরী ভাবছে,আর কেন আঁচল ধরে টানছো কিশোরদা? পাশে মেম বৌ কি তোমার এতটাই উদার? যে কিনা পূর্ব প্রেমিকাকেও সানন্দে গ্রহন করবে? বিদেশের স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক এতোটাই কি উদারতাপূর্ন হয়? আবার যেতে গিয়ে টান পড়তে ছাড়ো বলে পেছন ফিরে দেখছে শাড়িটা টেবিলের পেরেকে আটকে গেছে। কিশোর তার মেম ব
ৌকে অন্যান্যদের সাথে পরিচয় করাতে ব্যস্ত।অসহায়ের মতো নিজের মনে একটা হাসি দিয়ে নিজেকে এই যন্ত্রণার থেকে দূরে সরাতে তাড়াতাড়ি করে পা চালিয়ে বাড়ি মুখো হয়ে আছড়ে পড়লো বিছানাতে। শূন্য বিছানাটা যেন ওকে আরো বেশী করে শূন্যতা অনুভব করাচ্ছে।এতো কথা.এতো গান,এতো প্রতীক্ষা সব আজ মিথ্যে কিশোরীর কাছে।
(৪)
স্কুলে এসেও কিশোরীর শান্তি নেই। কিশোরের এক সময়ের সহপাঠিদের কেউ কেউ ওর কলিগ। কিশোর আর ওর মেম বৌকে আজ প্রধান আলোচ্য বিষয় বস্তু করেছে।এই আলোচনা থেকেই জানতে পারলো কিশোরী মেম বৌটার নাম কিটি। কৃষানুর সাথে তো কিটি কেই মানায়।কিশোরদার বাড়ির গুরু জনেরা ভবিষ্যত কল্পনা করেই হয়তো ভালো নামটা কৃষানু রেখেছিলেন। কিটির সাথে তাই নাম টা মিলে গেল।কিশোরী চোখদুটো মুছে মনে মনে বলল "ভালো থাকুক ওরা দুজন, টিকে থাকুক ওদের প্রেম।"
এমন সময় কিশোরীর দরজার কড়া নাড়লো কেউ।কে বলাতেও উত্তর না মেলাতে বাধ্য হয়ে দরজাটা খুলে বেরিয়ে দেখে কিশোর এসেছে। মনটা হা হুতাশ করে বলছে "কেন এলে কিশোরদা? কেন এলে?এই তো বেশ ছিলাম স্বপ্নের ঘোরে তোমার আসার প্রতীক্ষাতে। তুমি আর আমার নেই , এই সত্যিটা জানাতে নাই বা আসতে!"
"কিরে আমাকে একলা ফেলে এইভাবে চলে এলি? এতোদিন পর দেখা, কোন কথা জিজ্ঞাসা করলি না? অনেক বড় হয়ে গেছিস বল?"
"বড় আর কোথায় হতে পারলাম আমি? গন্ড গ্রামের কিশোরী একই আছে। ছা পোষা যেমন ছিলো ঠিক তেমনি।"
"তাই?তা এতো অভিমান? সেটা তোর হওয়ারই কথা।নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে আর পিছু ফিরতে পারিনি রে।"
"ভালোই করেছো,প্রতিষ্ঠা তো পেয়েছো,পিছু ফিরে কি বা পেতে?"
"হুম বুঝলাম, এসব ছেড়ে আদা চা কর দেখি খাবো।"
"কফি আছে খাবে? সাহেবদের আদা চা বেমানান লাগে।"
"কে বলেছে আমি সাহেব?আদা চা টা দিবি? না চুলটা টানবো?"
"রাজীবদা কি এখনো ওখানেই থাকে?"
"হ্যাঁ,তা রাজীবের বড় খোঁজ নিচ্ছিস?"
"এমনি,জানতে মন চাইলো।"
"রাজীব দুদিনের মধ্যে এখানে আসছে।"
"ও,তা আপনার বিয়ের অনুষ্ঠান এখানে করবেন না?মেম বৌ, ভালোই মানিয়েছে দুজনকে।"
"বলছিস?"
"হ্যাঁ" বলে মনে মনে কবিতার লাইন আওড়ে নিলো কিশোরী 'জুড়িয়ে দিলো চোখ আমার, পুড়িয়ে দিলো চোখ,
বাড়িতে এসে বলেছিলাম ওদের ভালো হোক'।কিশোরীর মা-বাবা কিশোর এসেছে শুনে ঘরে ঢুকতে এই ফাঁকে চা বানানোর অজুহাতে কিশোরী ঘর থেকে বেরিয়ে নিজের চোখের জলটাকে লোকের চোখে পড়ার হাত থেকে বাঁচালো।
"বাহ্, চা টা দারুন করেছিস তো, আগের মতোই একই স্বাদ।"
"রাতের খাবার খেয়ে তারপর বাড়ি যাস কিশোর।"
"না কাকিমা,বাড়ি গিয়ে ডিনার করতে হবে।আমার এক অতিথি এসেছে,পরে সব জানাবো তোমাদের,চলি আজকে,কিশোরী চললাম রে।"
"হ্যাঁ,আসুন,বাড়িতে কিটি অপেক্ষা করছে,বিদেশের স্ত্রী-রাও কি স্বামীদের বাড়ি আসার অপেক্ষা করে? না খেয়ে বসে থাকে?"
"তা থাকে বৈকি,কে থাকে জানি না,কিটি কিন্তু পুরো আমাদের কালচারের মতো জানিস।অদ্ভুত ভালো মেয়েটি।"
"একি রে কিশোরী তুই কিশোরকে আপনি কেন বলছিস?"
"থাক না মা,আপনি বলাটাই তো ভালো,বিদেশের নাম করা ডাক্তার,সম্মান দিতেই ধরে নাও বলছি।"
"আমার কিন্তু বেশ লাগছে আপনিটা শুনতে কাকিমা,তুই আপনি বলিস।চলি কাকিমা"।
কিশোরের মুখে এই কথাটা শুনে কিশোরীর মন আরো ভারাক্রান্ত হয়ে গেলো।মনে মনে বলতে লাগলো "এতোটা পর হয়ে গেলে কিশোরদা, আজ আর কিছুই মনে নেই তোমার,কিশোরীকে দেওয়া কোন কথায় তোমার মনে নেই, সব মিথ্যে মোড়ানো নাটক ছিলো, ছোটবেলার খেলার মতো আমিও তোমার খেলনা ছিলাম। তুমি কিন্তু তা একেবারেই ছিলে না, তোমাকে কোনদিন মনে করিনি এমন দিন এখনো অবধি আমার জীবনে আসেনি। মনে যে থাকে তাকে কি করে ভুলবো?"
কিশোরী কিশোরকে সদর দরজা অবধি এগোতে এলো.......
"তা বয়ফ্রেন্ড করেছিস নিশ্চয়ই?"
"সে আর কি আমার মতো মেয়ের জন্য? আমি ভেতরে গেলাম" বলে এক দৌড়ে কিশোরী সদর দরজা থেকে নিজের ঘরে চলে গিয়ে কাঁদতে লাগলো। সব পুরোনো কথা মনে পড়ছে। যে কিশোর ওকে একজনের সাথে অভিনয় করতে দেখে হিংসে করতো, অভিমান করতো, সেই কিশোর আজ ওকে হেসে হেসে কি সুন্দর জিজ্ঞাসা করছে কোন বয়ফ্রেন্ড আছে কিনা?সত্যি মানুষ কত সহজে পাল্টে যায়!দুনিয়াটা বড়োই বিচিত্র।"
(৪)
পরেরদিন কিশোরী স্কুল থেকে ফিরে মায়ের মুখে শুনলো আগামী পরশু কিশোরদের বাড়িতে একটা অনুষ্ঠান আছে।কিশোরের মা-বাবাও চলে এসেছেন। গ্রামের সকল মানুষদের নিমন্ত্রণ ওদের বাড়ি। রাজীবও এসেছে এই অনুষ্ঠানে। সেদিন রাতের পর কিশোরের সাথে কিশোরীর দেখা সাক্ষাৎ হয়নি। পুজোর অনুষ্ঠানের রিহার্সালেও মন লাগছে না কিশোরীর। আজ সবার কিশোরদের বাড়ি নিমন্ত্রণ। বিকেলে তাই রিহার্সাল রাখা হয়েছে।কিশোরদের বাড়ির বিশাল আয়োজনের সম্ভার আজ স্কুলে আসার সময় দেখেছে কিশোরী। তাড়াতাড়ি কোনমতে রিহার্সাল শেষ করে কিশোরী বাড়ি চলে গেলো।ওর মা-বাবার অনেক বলা সত্ত্বেও কিশোরী কিছুতেই কিশোরদের বাড়ি গেলো না।সদর দরজা না আটকিয়েই কখন যে কিশোরী নিজের ঘরে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছে নিজেও জানে না।একটা হাতের স্পর্শে ধরমরিয়ে উঠলো সে। চোখের জল ঘুমের ঘোরেও ফেলছিলো মেয়েটা তার প্রমান চোখ খুলতেই জল গড়িয়ে এলো গালে। তাকিয়ে দেখছে কিশোর ওর মাথায় হাত বোলাচ্ছে।
"একি! সবাই আপনার বাড়িতে আর আপনি এখানে?এটা কি শোভা পাচ্ছে আপনার?"
"সবাই তো আমার বাড়ি যায়নি! আমার মূল্যবান লোকটাই তো অভিমান করে চোখের জলে এখানে বালিশ ভিজিয়ে ক্লান্ত শরীরে ঘুমিয়ে পড়েছে।"
"কি সব বলছেন,বিবাহিত পুরুষ হয়ে আমাকে এসব বলাটা আপনার ঠিক না।"
"আজকের অনুষ্ঠানে গেলেই তো বুঝতে পারতিস কার বিয়ের অনুষ্ঠান হচ্ছিল।"
"মানে?"
"ওরে পাগলী তোর কিশোরদা কি এতোটাই খারাপ ছেলে যে তার কিশোরীকে ছেড়ে কোন মেমকে বিয়ে করে নেবে? ওটা রাজীবের বৌ,তুই তো জানিস রাজীবের পরিবার বলতে কেউ আর নেই।ওর বাবা তো অনেক ছোটতে মারা যান,ওর মাও বিদেশে যাওয়ার পর মারা গেলেন, ওখানকার আবহাওয়ার সাথে খাপ খাওয়াতে পারছিলেন না। তার ওপর ওর বাবার মৃত্যুশোকটাও নিতে পারেননি। সব মিলিয়ে রাজীব বিদেশে পড়া চলাকালীনই সব হারিয়ে ফেলেছিলো। কিটি ওর জীবনে এলো, দুজনের প্রেম হলো,বিয়েও করলো।রাজীবের ইচ্ছে জন্মস্হানে কিটিকে আনবে। ওর তো পৈত্রিক ভিটে বলতে কিছু নেই, আমাদের বাড়িতেই তাই সব আয়োজন করা হলো।"
"ও,রাজীবদার জন্য এসেছো এখানে!"
"না,বৌ নিতেও এসেছি।"
"বৌ নিতে মানে?"
"তোকে বিয়ে করে নিয়ে যেতে।"
"তুমি তো আমার এতোদিন কোনও খোঁজই রাখনি!আমার যদি বিয়ে হয়ে যেত অন্যকারো সাথে?"
"যদি অন্যকারোর বৌ হতিস জানতাম ছোটবেলায় বলা সব কথা তোর ছোটবেলার অপরিপক্ক মাথা থেকে মনের খেয়ালে বেরিয়েছিলো।আমার প্রতি তোর প্রেম বলে কিছু ছিলো না,মনকে মানিয়ে নিয়ে নিজেও মেনে নিতাম,আমার কিশোরী আমাকে ভালোবাসে না বলে।তবে আমি জানতাম আমার কিশোরী আমারই থাকবে, যেমন আমি তার আছি।তোকে বেশী তো বুড়ি হতে দিইনি, সবে তো পঁচিশে পড়েছিস,এরপর দেরী হলে বলতে পারতিস তোকে বুড়ি করে বিয়ে করতে এসেছি।দেখি দেখি সব কটা দাঁত ঠিক আছে তো?নাকি দু একটা ঠাকুমাদের মতো পড়ে গেছে?আর চুলগুলো কটা সাদা হয়েছে দেখি দেখি" বলে কিশোর কিশোরীর মাথায় বিলি কেটে দেখতে গেলো।কিশোরী আগের মতোই লজ্জা পেয়ে হাতটা মুঠো পাকিয়ে কিশোরের বুকে আলতো করে মেরে কিশোরের বুকে মাথা গুঁজলো।
"কাল স্কুলে ছুটি নিও,মা-বাবা আসবেন বিয়ের কথা বলতে,আর একটু ঝাল করে তেঁতুল মেখোতো কতদিন খাইনি এসব।"
কিশোরের মুখে তুমি ডাকটা কিশোরীর মনে হাজার হাজার জলতরঙ্গের বোল তুলছে।বুকের ধুকপুকানিটা ক্রমশ বাড়ছে,আস্তে করে "ঠিক আছে" বলে কিশোরের বুকের ঘ্রাণ নিতে লাগলো।কতদিন পর ভালোবাসার গন্ধ পাচ্ছে।প্রান ভরে সেটা অক্সিজেনের মতো গ্রহন করছে কিশোরী।
(৫)
শঙ্খ উলুধ্বনি আর বড়দের আশীর্বাদের সাথে কিশোর-কিশোরীর চার হাত এক হলো। ফুলসজ্জার ঘরে দুটি দীর্ঘ প্রতিক্ষীত প্রান একে অপরকে চাতকের মতো দেখছে।কিশোরের মুখে তুমি সম্বোধনটা বার বার শিহরণ জাগাচ্ছে কিশোরীর মনে।শাড়ির আঁচলের সেফটিপিনটা কিশোর খুলতেই কিশোরী লজ্জায় লাল হয়ে "কিশোরদা" বলে জড়িয়ে ধরলো।
"এবার তো দাদাটা তুলে দাও।আমি তো একমুহূর্তে তুই থেকে তুমিতে চলে এসেছিলাম,এবার তুমিও দ্বিধাহীনভাবে নিজেকে মেলে ধরো, আমার প্রেমে নিজেকে হারিয়ে ফেলো।"
"লাজুক কিশোরী কিশোরের উদ্দেশ্যে বললো "শুনছো, আলোটা নিভিয়ে দিয়ে আমাকে আপন করে নাও চিরদিনের জন্য।"
বিয়ে বাড়ির বৌদি-দাদা গোছের মানুষরা ইয়ারকি ঠাট্টা করে গান ধরেছেন, বাইরের গান ভেসে আসছে ওদের দুজনের কানেও- "প্রেমের জোয়ারে,ভাসাবে দোঁহারে,
বাঁধন খুলে দাও,
দাও,দাও,দাও......."।।