Sandipa Sarkar

Drama

4  

Sandipa Sarkar

Drama

ভাঙা ঘরে চাঁদের আলো

ভাঙা ঘরে চাঁদের আলো

4 mins
2.1K


"কি সারাক্ষন খিট খিট করে কথা বলো?কান খুলে শুনে নাও রূপা,আমার একটা বেসিক স্টেটাস আছে।অফিস মিটিং,পার্টি এগুলো সাধারণ ব্যাপার।এগুলো অবশ্য তুমি কি করে বুঝবে?দিন আনা দিন খাওয়া ঘরের মেয়ে হয়ে।কোনদিন এসব চোখেও দেখনি"।

"তুমি আকন্ঠ মদ খেয়ে,মেয়েদের লিপস্টিকের দাগ গায়ে নিয়ে বাড়ি ফেরাটাকে স্টেটাস বলছো শ্যামল?মেয়েটা বড় হচ্ছে,তার সামনে এসব করতে লজ্জা করছে না?আর কি বললে আমি জীবনেও এসব চোখে দেখিনি?তুমি নিজে কি ছিলে?এক কামরার বস্তির ঘর,আর দুহাজার টাকার মাইনে।তাই দেখে বিয়ে করেছিলাম।আজ যা কিছু করছো সব আমার সাহয্যে,অামার ভাগ্যে"।

রূপার গালটা টিপে ধরে শ্যামল "একদম বেশী কথা না হ্যাঁ,যা করেছি এই ফ্ল্যাট-গাড়ি-ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স সব নিজের যোগ্যতায়।তোর আবার কিসের ভাগ্য রে?" বলে রূপাকে ঠেলে ফেলে দিয়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

ছোট্ট আট বছরের মেয়ে কাবেরী মা-কে কাঁদতে দেখে জড়িয়ে ধরে সেও কাঁদতে লাগলো।

প্রতিদিনের এই এক গল্প রূপা আর শ্যামলের সংসারে।দিন দিন তিক্ততা বাড়তে বাড়তে একদিন চরম পর্যায়ে পৌঁছিয়ে গেলো।তার পরিনতিতে দুজনের ডিভোর্স হয়ে গেলো।আইনের সাহায্যে রূপা মেয়েকে নিজের কাছে পেলো।কোর্ট চত্ত্বর থেকে বেরিয়ে রূপা সবার অলক্ষ্যে খুব কেঁদেছিলো মেয়েকে জড়িয়ে ধরে,পাঁচবছরের প্রেমের পর ওদের নয় বছরের বিবাহিত জীবন।আলাদা হয়ে গেলো এক মুহূর্তে দুটো জীবন একটা পেনের খোঁচায়।


      ***********


"উঠে পড় মা,আজ জয়েন্টের রেজাল্ট"।

"আর,একটু পরে উঠছি মাম্মাম"।

"ও তুমি কিছু চিন্তা করো না দিদি,মেয়ে আমাদের ফাস্টো হবেই"।

"নারে বিমলা খুব ভয় করছে"।

"ওঠ সোনা আমার"।

"মাম্মাম" বলে রূপাকে জড়িয়ে ধরে গালে একটা চুমু দিলো সেই আটবছরের মেয়েটা।যে এখন অষ্টাদশী।দশটা নাগাদ ওয়েবসাইটে রেজাল্ট বের হবে তার সাথে কাবেরীর ভাগ্য নির্ধারণও। ভালো ফল করে ডাক্তারীতে চান্স পেয়ে গেল কাবেরী।মেয়েটার মনে ছোট থেকেই একটা চাপা কষ্ট কাজ করত।বাবাকে না পাওয়ার।পড়ার ফাঁকে পড়ার বইয়ের ভাঁজে ওর বাবার একটা পাসপোর্ট ছবি সেই আটবছর বয়স থেকে বহন করে আসছে।ওদের স্কুলে একবার ফ্যামিলি প্রজেক্ট করিয়েছিল।সেখানে ওর বাবার ছবিও লাগানো হয়েছিলো।খাতাটা থেকে একমাত্র ওর বাবার ছবিটাই কিভাবে যেন খুলে পড়ে গিয়েছিলো এবাড়িতে ওর মায়ের সাথে আসার পর।সেটা কুড়িয়ে ও বইয়ের ভাঁজে রেখে প্রতিদিন দেখে।কথা বলে মান-অভিমানের,সব শেষে বাবাকে মিস করে চোখের জল ফেলে।এক শহরে থাকলে হয়ত বাবার সাথে ওর দেখা হতো।কিন্তু ওর মা চায়নি এক শহরে আর থাকতে।উত্তরবঙ্গ থেকে সোজা চলে এসেছিলো দক্ষিন বঙ্গে।ডিভোর্সের পর রূপা শ্যামলের থেকে কোন খোরপোষও দাবি করেনি,নিজের দমেই সে মেয়েকে মানুষ করবে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করেছিল।শিক্ষিত হলেও চাকরী জোটা খুব মুশকিল।প্রথমে নাজেহাল দশায় চলে দিন যাপন।একমাস কি ভাবে চলেছিল না খেয়ে সে সব ভাবলে আজও রূপার চোখ দিয়ে জল পড়ে।সাথে শ্যামলের প্রতি ততোধিক ঘৃণা বাড়তে থাকে।তারপর নিজের চেষ্টায় একটা অল্প মাইনেতে চাকরি জোটায়।এই করে কাবেরীর জীবন থেকে একটা বছর নষ্ট হয়ে যায়।পয়সার অভাবে স্কুলে পড়াতে পারে নি সেই একটা বছর।এই ক্ষোভটাও মারাত্মক দানা বেঁধে আছে রূপার প্রতি।সব মিলিয়ে শ্যামল রূপার জীবনে একটা ধ্বংসাত্মক অতীত ছাড়া আর কিছু না।রূপার শরীরে আজ বৈধব্যের সাজ।লোককে পরিচয়ও দেয় "সিঙ্গেল মাদার" বলে।তারপর অনেক ঘাত প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে রূপার জীবন বদলায়।হঠাৎ দেখা পেয়ে যায় কলেজের বান্ধবী শ্রীতমার সাথে।ও উত্তরবঙ্গেরই মেয়ে ছিলো।বিবাহ সূত্রে কলকাতায় থাকে।আর ভালো চাকরীও করে।ও সব শুনে রূপাকে ওর কোম্পানিতে ব্যবস্হাও করে দেয় একটা ভালো চাকরীর।তারপর থেকে রূপার জীবনে সুদিনের দেখা মেলে, যা আজও বর্তমান।


দেখতে দেখতে কাবেরীর ডাক্তারী পড়াও শেষ হয়ে গেলো।হাউজস্টাফ হিসেবে কাজ শুরু হয়ে গেলো।কাবেরী মনে মনে ঠিক করেছিলো ও উত্তরবঙ্গের মেডিক্যাল কলেজে নিজের পোস্টিংয়ের আপিল করবে।পাশ করে দুবছর কলকাতার হাসপাতালে চাকরী করে ট্রান্সফার নিয়ে নিলো।রূপার এতোটুকু ইচ্ছে নেই ওখানে আবার ফিরে যেতে।বার বার বলছে ট্রান্সফার রুখতে। মা কে জানালো বাধ্য হয়ে তাকে যেতে হচ্ছে।আটকানো যাবে না। চলে গেলো আবার ফেলে আসা পুরোনো জায়গায়।সব কেমন বদলে গেছে চারিপাশ।কত উন্নতি চারিদিকে।কাবেরী যাতায়াত শুরু করলো নতুন হাসপাতালে।একদিন রূপা অতীতের টানে পুরোনো ফেলে আসা ফ্ল্যাটবাড়িটার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো।এখানের পরিবেশটাও চকচকে হয়ে গেছে আগের থেকে।সিকিউরিটি গার্ডও পাল্টে গেছে।দেখে তাড়াতাড়ি চলে এলো এই ভয়ে যদি শ্যামলের মুখোমুখি আবার দেখা হয়ে যায়।কাবেরী নতুন হাসপাতালে ভালোই মানিয়ে নিয়েছে।আজ রাউন্ডে বেরিয়ে একজন নতুন রোগীর দিকে চোখটা আটকে গেলো।কাছে গেলো।একমুখ দাড়ি লোকটার।অপুষ্টি-অযত্নের ছাপ সারা শরীরে।মুখটা খুব চেনা মানুষের মতো।চোখদুটোতে মায়া আর অসহায়তা মাখানো। বাড়ি গিয়ে বইয়ের ভেতর থেকে নিজের বাবার ফটোটাতে পেন্সিল দিয়ে দাড়ি করে দেখলো হুবহু ওর বাবা।পরদিন গিয়েই কৌতুহল মেটাতে ১২৫ নম্বর বেডের রোগীর নাম দেখে নিশ্চিন্ত হলো এটাই ওর বাবা।টিবি রোগের উপসর্গ নিয়ে চিকিৎসার জন্য ভর্তি হয়েছেন হাসপাতালে।প্রতিদিন গিয়ে বাবার সাথে একজন ডাক্তার হিসেবে আলাপচারিতা শুরু করে, আর ওঁর এমন দশার কারণ খোঁজে।চারদিনের মাথায় বাবার থেকে একজন ডাক্তার হিসেবেই জানতে চায় ওঁর আর কে আছে?কি করতেন, সব।প্রশ্ন গুলোতে শ্যামল কেঁদে অনুশোচনার সাথে নিজের পাপের কাহিনী,ওর মাকে ডিভোর্স,ফুটফুটে মেয়েটাকে ছেড়ে অহঙ্কারকে বেছে নেওয়া আর তার ফলে লক্ষীর মত বৌ আর মেয়েকে তাড়ানো ওর কতটা মূর্খামী হয়েছে তার প্রমান আজ ওর সর্বস্বান্ত জীবন। সব স্বীকার করে নিজেকে বার বার পাপী আখ্যা দিচ্ছেন।কাবেরীর মাথায় হাত দিয়ে বললেন "জানো মা,মেয়েটা হয়ত আজ তোমারই বয়সী হয়েছে।একবার যদি ফিরে পেতাম।মরে গেলেও আর দুঃখ থাকত না।কোথায় যে ওরা হারিয়ে গেলো আর পেলাম না।অনেক খুঁজেছি পেলাম না কিছুতেই"।

অনুশোচনায় দগ্ধ মানুষটাকে কাবেরীর খুব ইচ্ছে করছে নিজের পরিচয় দিতে।কিন্তু দিলো না।ও চায় মায়ের সাথে এসে পরিচয় দিয়ে ভাঙা ঘরটাকে আবার জোড়া লাগিয়ে সুখের আলো দিয়ে আলোকিত করতে।ওর এখন একটাই কাজ মাকে এখানে আনা।তাই করতে প্রস্তুত হলো।পরদিনই বেড়াতে যাবে বলে ও মাকে নিয়ে রওনা দিলো হাসপাতালে।ওর দৃঢ় বিশ্বাস অনুশোচনায় দগ্ধ এই সব হারানো মানুষটাকে ওর মা আবার মেনে নেবেন।ব্যাগের মধ্যে থাকা কাবেরীর কেনা আংটি দুটো পরস্পরের গা ঘেঁষে ঠোকাঠোকি করে জানান দিচ্ছে তারাও রয়েছে মিলন করানোর অপেক্ষায়।।


         সমাপ্ত:-

         *****


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama