জয়হিন্দ কে সেনা
জয়হিন্দ কে সেনা


ত্রিধা ওর বরের সাথে ট্রেনে করে ঘুরতে যাচ্ছে।সিটটা পেয়েছে বাথরুমের কাছে।ত্রিধার এটা একদম পছন্দ হচ্ছে না।রাত বাড়লে বাথরুমের গন্ধে নাক জ্বলতে থাকবে এই আতঙ্কে সে রেগে গেলো বরের ওপর।রিজারভেশন সিট ওপর নীচে হাসবেন্ড-ওয়াইফ শুয়ে পড়লো রাতের খাবার খেয়ে।কিছুক্ষন পর ত্রিধার চোখটা গিয়ে বার বার পড়ছে বাথরুমের পাশে বসা ভারতীয় একজন সৈনিকের দিকে।দেখে বুঝতে পারছে সিট পাননি বলে এমন দূর্গতি।বাথরুমের ধারে বসেই কাটিয়ে দিচ্ছেন।ত্রিধা চোখটা বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করছে।পারছে না, বার বার চোখটা চলে যাচ্ছে জওয়ান ভাইয়ের দিকে।মনে পড়ছে কদিন আগের তাজা ঘটনা......
ভারতীয় সেনা বাহিনীর কনভয় বেরিয়েছে।ভেতরে পয়তাল্লিশ জন বসে।সারা রাস্তা চলছে ওদের প্রতিবারের মত কেউ নিজেদের মধ্যে গল্প করছে,কেউ গান গাইছে,কেউ প্রেমিকার সাথে গল্প,কেউ বৃদ্ধ মা-বাবার সাথে ফোনে কথা বলে খোঁজ নিচ্ছে।এদের মধ্যে একজন সৈনিক সদ্য পিতা হওয়ার আনন্দে আত্মহারা হয়ে চোখের জল মুচছেন "এখনই হোয়াটসঅ্যাপে ছবিটা পাঠা" বলে।আর একজন সৈনিকের পরশুদিন বিয়ে।সেই নিয়ে বাকীসব সৈনিকরা ইয়ারকি মারছেন।আর সে ভাবছে আজকের পরে লম্বা ছুটি।নতুন বিবাহিত জীবনের কথা।সুন্দরী বৌয়ের লাস্যময়ী মুখ ভাসছে মনকোঠরে।পকেট থেকে পার্সটা বের করে ছবিটা বার বার দেখছে।সবাই মিলে সময় কাটাতে জোরে জোরে গান ধরলেন "ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা"।একটা বিকট আওয়াজে পুরো কনভয়টা দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো।শত্রু সেনাদের আচমকা আক্রমনে কেউ কিছু বোঝার আগেই সব শেষ।শত্রুপক্ষের আরডিএক্স বোঝাই গাড়ি আগে থেকেই ভারতীয় সেনার গাড়িকে অনুসরণ করে ওড়ানোর পরিকল্পনা ছকে ফেলেছিলো।যার কোনরকম জানান সেদিন ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে ছিলো না।তার ফলে হারালো চল্লিশটি তাজা সংকল্পিত প্রান।তার সাথে চল্লিশটি পরিবারের ভাঙলো স্বপ্ন।
মিডিয়ায় কয়েক মিনিটের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল মর্মান্তিক খবর।ভারতের সেনাবাহিনীর ওপর আচমকা হামলা।একটি কনভয়ে চল্লিশ জনের মধ্যে সবাই শহীদ হয়েছেন।সারা দেশ জুড়ে নেমে এলো শোকের ছায়া।পরিবার গুলোতে স্বজন হারানোর আকুতি।মিডিয়ার চ্যানেলগুলোতে চলল চুল চেরা বিশ্লেষণ।দুদিন পর শহীদরা যে যাঁর বাড়ি ফিরছেন কফিন বন্দী হয়ে।দেশমাতৃকার পতাকা গায়ে জড়িয়ে।সেই কফিন দুটোও ফিরলো, সদ্য পিতা হয়ে সন্তানের ছবিটাও যিনি দেখতে পেলেন না,আর ফিরলেন আজকের দিনে বর বেশে স্ত্রীকে সিঁদুর রাঙানোর স্বপ্ন নিয়ে হওয়া শহীদ।প্রথম কফিনটা এসে সাতটা নাগাদ নামলো সেই জওয়ানের বাড়ি যাঁর আজ বিয়ে ছিলো।এই সাতটাতেই আজ ওদের বিয়ের লগ্ন ছিলো।বিয়ের বেশে হাসি মুখে মেয়েটি হবু বরের কফিনের সামনে এসে এমনভাবে দাঁড়ালো যেন শুভদৃষ্টি করছে।হয়ত কফিনের ভেতরের মানুষটাও শুভদৃষ্টি করছেন তাঁর হবু স্ত্রীয়ের সাথে।কফিনের ওপর একগুচ্ছ গোলাপের তোড়া রেখে সিঁদুরের কৌটোটা কফিনে ঠেকিয়ে সেইটা থেকে নিজেই নিজের সিঁথি রাঙিয়ে নিয়ে কফিনটাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লো মেয়েটি।সারা পরিবার চোখের জলে বিদায় জানালেন বীর সেনাকে। ঠিক একই সময়ে সদ্য হওয়া পিতার কফিনটা গিয়ে নামলো বাড়িতে।ফুটফুটে একটি ছোট্ট সাদা কাপড়ে মোড়ানো মেয়েকে এনে শোয়ানো হলো কফিনটার ওপর।মেয়েটা সেখানে শুয়ে এমনভাবে হাত-পা নেড়ে খেলছে ঠিক যেন ওঁর বাবা ওকে কোলে নিয়েছেন,সেই আনন্দে হাসছে আর হাত-পা ছুঁড়ছে।জয়হিন্দ ধ্বনি উঠলো, বাচ্চাটাকে তুলে নেওয়া হলো কফিনের ওপর থেকে। পরিজন সহ সবাই চোখের জলে বিদায় জানালেন।বাবার কফিনটা যেতে দেখে সেও ডুকরে কেঁদে উঠলো।হয়ত কফিনের ভেতরের মানুষটাও মেয়েকে ছেড়ে চিরবিদায় নিতে কফিনে শুয়ে কাঁদছেন।
ত্রিধা চোখ খুলে দেখছে জওয়ান ভাই ঘুমিয়ে পড়েছেন।ক্লান্ত মুখটা দেখে ত্রিধার নিজেকে নীচু মনে হচ্ছে।যাদের জন্য আজ আমরা শান্তিতে থাকছি।তাদের জীবনটাতে সুখ বলে কিছু নেই।সদা তৎপর সর্বদা দেশমাতৃকার সেবায়।ট্রনটা যাচ্ছে জব্বলপুরের দিকে।ওদিকেই সেনাবাহিনীর পোস্টিং হয়।হয়ত উনিও বাড়ি ছেড়ে রওনা দিচ্ছেন আমাদের রক্ষা করতে।কাল ট্রেন থেকে নেমেই হয়ত ডিউটি জয়েন করবেন, নির্ঘুম রাত্রি যাপন করে।ত্রিধার অনুশোচনায় দগ্ধ মনটা বলতে বাধ্য করলো বাথরুমেের সামনে বসা ভারতীয় সৈনিককে গিয়ে "ভাইয়া আপ মেরি সিট পে সো যাইয়ে,ম্যায় মেরী হাসবেন্ডকে সিট শেয়ার কর কে সো যাতি হু"।
সমাপ্ত
*****