তীরন্দাজ:-
তীরন্দাজ:-


তীরন্দাজ:-
সন্দীপা সরকার
*****
সুরেন্দর শর্মা একজন নাম করা তীরন্দাজ।তাকে হারাতে পারার মত এখন অবধি কেউ জন্মায়নি।খুব কষ্ট করে এই বিদ্যা আয়ত্ব করেছে সুরেন্দর।ছোট থেকেই ওর টিপ খুব ভালো ছিলো।বিহারের প্রত্যন্ত গ্রামের ছেলে সুরেন্দর।গুলতি মেরে এক টিপে বলে বলে গাছ থেকে বন্ধুদের কথায় কুল,পেয়ারা পাড়া বাঁ হাতের খেলা ছিলো ওর।এটাই পরবর্তীকালে ওকে তীরন্দাজ হতে সাহায্য করেছে।এই খেলার সুবাদে রেলে চাকরীও পেয়ে যায়।সপরিবারে এখন দিল্লিতে থাকে। জুনিয়ার ওয়ার্ল্ডকাপে একবার রৌপ্যপদক ও একবার স্বর্ণপদক জেতা তিরিশ বর্ষীয় সুরেন্দর দিল্লির একটা ন্যাশনাল ক্লাবে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে ওয়ার্ল্ড কাপে লড়ার জন্য।সেখানে বাঘা বাঘা তীরন্দাজের ভীর।নানান দেশ থেকে তারা আসছেন।এইবার ওর আসল লড়াই ওদের সাথে।এবারেই হবে ওর পরীক্ষা লক্ষ্যভেদের।ভারত থেকে ও যাচ্ছে লড়তে,বাকী আরো পাঁচজন তীরন্দাজের সাথে।এয়ারপোর্টে পৌঁছনোর সময় ঘটল এক মর্মান্তিক ঘটনা।মুখোমুখি লরি আর ওর প্রাইভেট কারের সাথে ঘটল সংঘর্ষ।গাড়ির ভেতর চেপ্টে পড়েছিলো।প্রানে বাঁচলো ডাক্তারদের অনেক চেষ্টায়,তবে চোখদুটো বাঁচাতে পারলো না।গাড়ি নিজে ড্রাইভ করছিল,সামনের দিকের কাঁচ ভেঙে চোখ মুখ ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছিলো।দুটো চোখই নষ্ট হয়ে গেলো,সারাজীবনের জন্য।যেদিন সুরেন্দর কোমা কাটিয়ে সুস্হ হয়ে উঠেছিল সেদিন ডাক্তারবাবুকে বলেছিলো খুব বেদনা কন্ঠে "বাঁচালেন কেন আমাকে?এজীবন রেখে কি করব?চোখ ছাড়া কর্মজীবন,খেলার জীবনে ফিরব কি করে?চোখই যদি না থাকে তীরন্দাজী কি করে করব?পরিবারের বোঝা করে রেখে দিলেন"?
ডাক্তারবাবু সুরিন্দরকে হেলেন কেলারের গল্পের কথা মনে করালেন।সুরেন্দরের এসব গল্প শুনতে ভালো লাগছে না।নিঃস্ব মানুষের ভীরে নিজের নাম লেখাবে এটা কোনদিন এই পরিশ্রমী মানুষটা কল্পনাতেও আনতে পারেনি।চোখের অভাবে ভলেন্টিয়ারি রিটায়ারমেন্ট নিতে বাধ্য হলো সুরেন্দর।ধীরে ধীরে একা একা হাঁটা চলা শিখছে।পারছে না।হোঁচট খেয়ে পড়ে যাচ্ছে।বাড়ির পাশের পার্কের পেছনে একটা গাছ আছে,সেই গাছের তলায় সুরেন্দর দেখতো একজন মাঝবয়সী লোক প্রতিদিন এসে বসেন।আজ ও সেই লোকটার পাশে গিয়ে বসলো।লোকটার চোখে কালো চশমা।লোকটাকে দীর্ঘ পাঁচবছর পার্কে আসতে দেখছে সুরেন্দর।হাতে একটা লাঠি থাকলেও সেটার ভরে কোনদিন চলতেন না।কি অদ্ভুত ভাবে বুঝে যেতেন সামনে লোক আসছে।চোখ যতদিন ঠিক ছিলো সুরেন্দর লোকটাকে দেখত,তবে কে কি করেন এসব নিয়ে মাথা ঘামায়নি।আজ লোকটার পাশে গিয়ে বসলো সুরেন্দর।ও নিজেই অবাক হয়ে গেলো দেখতে না পেয়েও লোকটার পাশে ঠিক গিয়ে বসলো।শুরু করলেো আলাপচারিতা,লোকটার নাম ইয়াংসি চুং।তবে খুব ভালো হিন্দি বলছেন।লোকটা জন্মান্ধ।ওঁর সব কাহিনী শুনে সুরেন্দর হাঁ হয়ে প্রশ্ন করলো "আপনি চোখে না দেখে কি করে লক্ষ্যভেদ করতে পারেন?এ অবিশ্বাস্য ব্যাপার"।লোকটা সরেন্দরকে দাঁড় করিয়ে মাথায় একটা ছোট ইঁটের ঢেলা রাখলেন।তারপর আর একটা ইঁট দিয়ে সেটাকে এমনভাবে মারলেন ইঁটটা গিয়ে একেবারে মাথায় বসানো ইঁটটাকে ছুঁয়ে যেতে মাথার ইঁটটা পড়ে গেলো।সুরেন্দর অবাক হয়ে ভাবছে লোকটা সত্যি অন্ধ?না ভান করে থাকেন?
তবে ও চোখ থাকাকালীন দেখেছিলো লোকটা অন্ধ।এ অবিশ্বাস্য ঘটনাটা মেনে নিতে বাধ্য হলো।লোকটা একজন প্রথম সারির তীরন্দাজ।১৯৬৪ সালে আলোড়ন ফেলেছিলেন একজন প্রতিবন্ধি মানুষ। তিনি শারীরিক সক্ষমদের সাথে লড়ে সবাইকে পেছনে ফেলে আর্চারি বিভাগে সোনা এনেছিলেন।আরো বেরিয়েছিলো ইনি যতগুলো ইভেন্ট আজ অবধি লড়েছেন সবকটাই সাধারণদের বিভাগে।কোনদিনও প্রতিবন্ধিদের সাথে লড়েননি।নিজেকে তিনি প্রতিবন্ধি ভাবেন না।লোকটার সাথে কথা বলতে বলতে সুরেন্দরের মনে পড়ে গেল আর্চারি বিষয়ক বইগুলো পড়তে গিয়ে এনার নাম পড়েছিলো।তখন যৌবনকালের ছবি বিশেষ করে বইতে চাপা ছবির সাথে সাধারণত সে মেলাতে পারেনি এই সেই মহান ব্যক্তিত্ব।কত বছর ধরে প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়ে একভাবে গাছের তলায় দেখেছে,চেহারার এখনও কত যত্ন এই বয়সেও।দাঁড়িয়ে ব্যয়াম করতেন প্রত্যহ।কিন্তু এই ব্যক্তি তীরন্দাজ তা ভাবতে পারেনি সুরেন্দর।লোকটার সাথে কথা বলে সুরেন্দর এখন ভেঙে যাওয়া মানসিক বলটা অনেকটা ফিরে পেয়ে স্থির করলো সেও নিজের অধরা স্বপ্নটা পূরণ করবে এবার।ইয়াংসিকে নিজের সব কথা খুলে বলতে ইয়াংসি বললেন তিনি এই মর্মান্তিক ঘটনাটার কথা জানেন,আরো বললেন সুরেন্দর এই সোনাটা আনতে পারতো যদি লড়ার সুযোগ পেত।সুরেন্দরকে হেরে যাওয়াতে পৌরুষত্ব নেই,লড়ে যদি হারে সেটাই আসল খেলোয়াড়ের পরিচয় বলে সুরেন্দরের মনে আবার লক্ষ্যভেদের নেশা জাগিয়ে তুললেন।সুরেন্দর এতটুকু দেরী না করে ওঁর ঠিকানা চাইলো প্রশিক্ষণের আশায়।
শুরু হল প্রশিক্ষণ।বার বার লক্ষ্যভ্রষ্ট হচ্ছে সে।কিছুতেই সঠিক লক্ষ্যে লাগছে না।ইয়াংসি ওকে চিয়ারআপ করছেন "হবে, কনসেনট্রেট ম্যান,তুমি পারবে,কামঅন,প্র্যাকটিস মেক সাকসেস".....
দুমাস প্রশিক্ষণ চলছে ইয়াংসির কাছে। লক্ষ্যভেদ সে কিছুতেই করতে পারছে না।তবু ইয়াংসির অনুপ্রেরণায় সে হাল ছাড়ছে না।ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সজাগ রেখে একা একাই বাড়িতে প্র্যাকটিস করছে।এবার আর ভুল হলো না, তীর একেবারে গিয়ে ছুঁলো অর্জুনের লক্ষ্যভেদ করার মতো।দৌড়ে গেলো ইয়াংসির কাছে।একলব্যের মত আঙুল কেটে গুরুদক্ষিনা দিতে না পারলেও চোখের জলে গুরুদক্ষিনা দিলো।ইয়াংসি কৃতি ছাত্রকে জড়িয়ে ধরে বললেন এবার তোমার লক্ষ্য ওয়ার্ল্ডকাপ।জয়ী হয়ে ফিরতে হবেই,সাথে আমি আছি।তবে প্রতিবন্ধী কোটায় না,তুমি অক্ষম না।সবার মতো তুমিও সব দিক দিয়ে সক্ষম।তুমি সাধারণ বিভাগেই লড়বে,সক্ষমদের সাথে।এলো সেই সুদিন।আর্চারিতে সাধারণ গ্রুপের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করতে নামলো সুরেন্দর।লক্ষ্যভেদে সে আজ অজেয়।ভারতের হয়ে সোনার পদক পেল সে।মেডেলটা গুরুদেব ইয়াংসির গলায় পরিয়ে দিলো সুরেন্দর।জয়জয়কার পড়ে গেলো।রাষ্ট্রপতি পুরস্কারে ভূষিত করা হলো সুরেন্দরকে।সুরেন্দরকে কিছু বলতে বলা হলে সে প্রথমেই ইয়াংসির অবদান সব জানালো।যাঁর জন্য সে আজ এই জায়গায়।তারপর সকল মানুষের উদ্দেশ্যে বললো "যদি কেউ নিজের লক্ষ্য স্থির রাখেন,তবে আপনার লক্ষ্যভেদ হবেই।কোন মানুষ,কোন প্রতিবন্ধকতা আপনাদের লক্ষ্যভ্রষ্ট করতে পারবেন না"।।
সমাপ্ত:-
*****