আকাশের রঙ ফ্যাকাশে
আকাশের রঙ ফ্যাকাশে
চতুর্ত্রিংশতি অধ্যায়
- আপনি বাঘ হতেই পারেন মিঃ রক্ষিত ; আমিও কিন্তু হায়েনা । শিকারীর কাছ থেকে শিকার ছিনিয়ে নিতে জানি।
কথাটা কিছু ভুল বলেননি বড়দা । কথা হচ্ছিল তাঁর উপস্থিতিতে লঙ্কেশ্বর কথা বলবেন গোপার সঙ্গে বুকুন অফিস থেকে ফিরে এলে ।
তখন সবে সন্ধ্যা হয় হয় । সূর্য্য পশ্চিমে হেলে পড়েছে। টকটকে লাল রঙে ঢেকে গিয়েছে তার সর্বশরীর । তাই দেখে পাখিদের মনে পড়ে গেছে এবার বাসায় ফিরে যেতে। গাছে গাছে তাদের আগমন বার্তা ঠিকরে পড়ছে ।
ওই তো লাল রঙটাও ঢেকে গিয়েছে । আকাশে দু'চারটে তারাও দেখা যাচ্ছে না হয়তো কিন্তু চাঁদ তার স্বরূপ প্রকাশ করতে উঠে পড়ে লেগেছে।
বুকুন অন্যান্য দিনের চেয়ে আজ একটু আগেই বাড়ী এসেছে । সৌজন্যে তারই মা - গোপা । মিঃ রায়চৌধুরীর সঙ্গে তার ব্যক্তিগত আলোচনা করে বুকুনকে একটা ম্যাসেজ দিয়ে বাড়ীতে ডেকে নিয়েছেন ।
ফোনে কথা বলা সম্ভব হয়নি কারণ বীরেশ্বর চঞ্চল হয়ে এখানে সেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছেন ।
বুকুন এসে পড়ায় তিনি সত্বর তার নিকটে যেয়ে বললেন - এই তো দাদু ভাই এসে গেছে । কই রে গোপা ? মিঃ রায়চৌধুরী চলে আসুন, আগে আলোচনা এবং ফয়সালা হয়ে যাক - কি হবে না হবে ।
বুকুন বলল - কি নিয়ে আলোচনা ?
বীরেশ্বর রক্ষিত বললেন - তোমাদের উপর কর্তৃত্ব কার - আমার নাকি ওই আগন্তুকের - মানে - মিঃ রায়চৌধুরীর, সেই ফয়সালা ।
বড়দা সব শুনেছেন । গোপাও শুনেছে। বসে পড়লেন সকলে মিলে বারান্দাতেই । হাজি তখনও গাড়ীতে এসি চালিয়ে ভাতঘুম দিচ্ছে ।
প্রথমে কথা বললেন লঙ্কেশ্বরই । গোপাকে উদ্দেশ্য করে বললেন - দেখ মা ! আজ বিয়াল্লিশটা বছর তোদের দেখা পাইনি। আর পেয়েই গেলাম যখন কোনরকম দ্বিরুক্তি না করে সোজা চলে এসেছি তোদের নিতে । যাবি না মা ?
গোপা তার উত্তরে কিছুই বলল না । বুকুন উৎসব রায়চৌধুরীর দিকে চেয়ে বলল - এর জবাব আপনিই দিয়ে দিন জেঠুমণি !
মিঃ রায়চৌধুরী বললেন - আমি কি আর বলব ! এটা তোমরাই বল কি করবে ।
বীরেশ্বর গর্জন করে বললেন - কি আর বলবে ? আমিও যখন বলে দিয়েছি তখন ওদের কলকাতায় যেতেই হবে।
মিঃ রায়চৌধুরী বললেন - তা' কি করে হয় ! আগে তো শ্বশুর বাড়ীর সম্মতি নিতে হবে ।
বীরেশ্বর রক্ষিত রাগে কাঁপতে লাগলেন ।
- আমার তর্জনী হেলনে প্রশাসন চলে ; তুমি তো কোন ছার হে ! বিচরণ ক্ষেত্রে শিকার পেলে বাঘ কি ছেড়ে দেয় ?
আমি গোপার বাবা। বলেছি যখন কথা দিতেই হবে । তা না হলে ...... ।
উৎসব রায়চৌধুরী বললেন - মানে ? আপনি বাঘের উদাহরণ দিয়ে কি বোঝাতে চাইছেন ?
বীরেশ্বর একবার রেগে গেলে তাঁর কাণ্ডজ্ঞান থাকে না । এক্ষেত্রেও তাই হল । অভ্যাসবশত তিনি পকেটে হাত ঢুকিয়ে কিছু হাতড়াচ্ছিলেন ।
- আপনি বনে বাঘ; লোকালয়ে ইঁদুর। ভুল করে লোকালয়ে অনধীকার প্রবেশ করেছেন । আর করেছেন যখন; আমাকে তো হায়েনা হতেই হবে। কারণ হায়েনাই পারে অনায়াসে বাঘের মুখ থেকে শিকার ছিনিয়ে নিতে। পকেট তো অনেকক্ষণ ধরে খুঁজলেন ; কিছু পেলেন ? পাবেন কি করে ? জিনিসটাতো এখন অজয়ের জলে জলকেলি করছে ।
এ ভাবে দীর্ঘক্ষণ তর্কাতর্কি চলল । শেষে বুকুন বলে দিল - জেঠুমণির সাজেশনটা শুনি ।
মিঃ রায়চৌধুরী বলতে লাগলেন - বিয়াল্লিশ বছর আগেকার ঘটনার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ভাবে আমি যুক্ত না থাকলেও এর সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ ছিল আপনার। মিঃ রক্ষিত! মনে পড়ে সে কথা ? কি ঘটেছিল সেদিন রাতে আপনিই বলুন না !
মিঃ রক্ষিত চুপ করে রইলেন । বুকুনের জেদে মুখ খুলতে বাধ্য হলেন ।
- হ্যাঁ, সেই রাতে আমার একটা ভুল হয়েছিল ।
- তাহলে স্বীকার করুন একটা নয় আপনি অসংখ্য ভুল করেছিলেন । প্রথমত ছেলেটিকে ভয় দেখানো, দ্বিতীয়ত নিজের প্রতিপত্তি দেখিয়ে গা জোয়ারী করে রেজিস্ট্রার ডাকিয়ে বিয়েটাকে বৈধতা দেবার চেষ্টা, তৃতীয় কথাটা আপনিই আপনার মেয়ে এবং নাতির সামনে বলুন খোলসা করে কি করেছিলেন আপনি ?
বীরেশ্বরের মাথা হেঁট হয়ে গেল । তিনি যে স্ক্যাণ্ডাল ওই রাতে করেছিলেন মেয়ের এবং নাতির সামনে দাঁড়িয়ে সে কথা বলতে পারলেন না ।
তাঁকে চুপ থাকতে দেখে মিঃ রায়চৌধুরী বললেন - টিভিতে ন্যাশনাল জিওগ্রাফি বা ডিসকভারি চ্যানেল দেখেছেন কোনদিন ? যদি দেখে থাকেন তবে নিশ্চয়ই দেখেছেন একটি সিংহী ক্ষুধার্ত থেকেও একটি হরিণ শিশুকে মাতৃস্নেহে বুকে জড়িয়ে রেখেছিল । আর আপনি বাঘ হয়ে নিজের সন্তানকে ভক্ষণ করে নিলেন ?
বীরেশ্বর গর্জে উঠে বললেন - মিঃ রায়চৌধুরী!
রায়চৌধুরী বললেন - শাট আপ । বলেছি না , এখানে আপনার কোন নিয়ম-কানুন চলবে না । ওগুলো রেখে দিন আপনার পকেটেই। কই ? একবারও তো জিজ্ঞাসা করলেন না আপনার মেয়ে এখনও সিঁথিতে সিঁদুর নেয় কেন ?
স্বগতোক্তি করে ফেললেন বীরেশ্বর রক্ষিতৎ- কেন ?
- কারণ বাবা হয়ে আপনি যা পারেননি, ওর ভাসুর হয়ে আমি সেই কাজ করে দিয়েছি ।
- ভাসুর ? মানে ?
- ধীরে ধীরে সব মানে বুঝে যাবেন যদি আপনার মধ্যে এক কণাও স্নেহ আবশিষ্ট থাকে। আমিই সেই হতভাগ্য ছেলেটির বড়দা এবং তার নাম শ্রী পুলক রায়চৌধুরী।
- পু-পুলক ? পুলক এখনও বেঁচে আছে?
- সশরীরে সুস্থ ও অক্ষত অবস্থায় । তবে কি জানেন ওই মেয়েটির কথা ভেবে জীবনে আর বিয়েই করল না । সেইদিনই আমি শপথ করলাম এর একটা বিহিত আমাকে করতেই হবে ।
বুকুন বলল - তারপর দিল্লীতে এক সেমিনারে জেঠুমণির সঙ্গে আমার আলাপ হয় । আলাপের পর আলিঙ্গন। যখন জানতে পারি জেঠুমণি একজন গোয়েন্দা এবং রিসার্চ এণ্ড অ্যানালিসিস উইং এর একটা গোপন কাজের সুরাহা করে দিয়েছেন; আমাদের পরিচয় হয় । মায়ের ঘটনার কথা তাঁকে বলি । তিনি মন দিয়ে শুনে আমার মায়ের সাথে সাক্ষাৎ করতে চান ।
- মা ! মা ! কোথায় তুমি ?
- ও মা ! তুই এসে গেছিস ?
- শুধু আমি নই মা, এই দেখ কা'কে সঙ্গে এনেছি ।
বলে জেঠুমণির সঙ্গে মায়ের পরিচয় করিয়ে দি। মা যখন সব জানতে পারলেন মায়ের সেই বাঁধ ভাঙা অশ্রু শুধু আমরা দু'জনই দেখেছি ।
মা জেঠুমণিকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে বলেন - দাদা ! আপনাদের সংসারে যে অশান্তির বীজ ছড়িয়ে দিয়েছি আপনি নিজগুনে ক্ষমা করে দিলে বড় শান্তি পাই ।
জেঠুমণি সেদিন কি যত্ন ও আদরের সঙ্গে মায়ের মাথায় হাত রেখে বলেছিলেন - ' তোমার সিঁথির সিঁদুর অক্ষয় হোক বউমা।'
চমকে উঠেছিলেন মা । ' বউমা !' মা যেন আটাশ থেকে পড়লেন । আমি দেখেছি একটা বিদ্যুত্তরঙ্গ যেমন আকাশে খেলে বেড়ায় ; আমার মায়ের মুখে চোখে সেই আলো আমি দেখেছি।
জেঠুমণি বললেন - ঘটনাটা আমি ভাইয়ের মুখে শুনেছি। তখন তোমাদের উপর আমার ভীষণ ভীষণ অশ্রদ্ধা হয়েছিল । একটা প্রতিশোধ স্পৃহা অন্তরে দাপিয়ে বেড়াচ্ছিল । আজ তোমাকে দেখে সে সবের আর কিছু অবশিষ্ট নেই । আমি কথা দিয়ে গেলাম তোমাদের মিলন ঘটিয়ে তবে ছাড়ব । কিন্তু দুম করে তো ভাইকে বলা যাবে না ! কি ভাবে নেবে না নেবে - আগে তা যাচাই না করলে হঠকারিতা হয়ে যেতে পারে । একটু ধৈর্য্য ধরে থাকো আর আমিও সুযোগের অপেক্ষায় রইলাম।
সেদিন থেকেই শুরু হল আমার এবং জেঠুমণির যৌথ খেলা ।
বীরেশ্বরের চোখ দু'টো চকচক করতে লাগল । এ পর্য্যন্ত শুনে তিনি বললেন - তারপর ?
- তার পরের কথা নাই বা শুনলেন মিঃ রক্ষিত ! এটা কিন্তু আমাদের এক্সট্রিমলি পার্সোনাল ।
( চলবে )