মা দূর্গা
মা দূর্গা
(১)
পায়েল, কলকাতার সবচেয়ে বড়ো সোনার দোকান রায় অ্যান্ড সন্স-এর কর্ণধার রাজশেখর রায়ের একমাত্র নাতনী। দাদুর আদরে আহ্লাদে অত্যন্ত বেপরোয়া, বদমেজাজি আর খামখেয়ালি ধরনের। একমাত্র ঠাকুমা ছাড়া আর কারোর কথা শোনে না। ওর মা, মানে রায়বাড়ির পূত্রবধূ, লাবণী মেয়ের এই ছন্নছাড়া জীবন একদম মেনে নিতে পারে না। কতবার করে বোঝায় যাতে জিনিসপত্রের অপচয় না করে। এটাও বলে এমন কত মানুষ আছে যারা চাইলেই সব পায় না, ও পাচ্ছে যখন তখন সেটার সদ্ব্যবহার করতে। কিন্তু কে শোনে কার কথা। পায়েলের কোনো পরিবর্তন হয়নি। এখন লাবণীও তাই হাল ছেড়ে দিয়েছে। এটা ভেবে নিজেকে সান্ত্বনা দেয় যে সময় এলে ঠিক বুঝে যাবে।
(২)
-মা, বলছিলাম আমার জুতোটা ছিঁড়ে গেছে।
-আমি এই মাসের মাইনে পেয়ে তোকে কিনে দেব।
-আচ্ছা ঠিক আছে মা।
রিমি, মালতীর মেয়ে। ওদের এই অভাবের সংসারে সব কিছু সহজে পাওয়া যায় না। তাও মালতী চেষ্টা করে সাধ্যমতো মেয়ের ইচ্ছে পূরণ করার। রিমি পড়াশোনায় খুব ভালো। ও অনেক পড়তে চায়। মালতী তাই দিনরাত পরিশ্রম করে যাতে মেয়েটাকে মানুষ করতে পারে। যতদিন ওর বর, নরেন ছিল ততদিন ওদের সংসারটা ভালো মতোই চলত। কিন্তু সবার কপালে সুখ বোধহয় দীর্ঘস্থায়ী হয় না। একদিন কাজ থেকে ফেরার পথে লড়ির ধাক্কায় নরেন মারা গেল। সেই থেকে ওদের কষ্টের শুরু। এখন তাই ওরা মা-মেয়ে মিলে চালিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। তবে কদিন ধরে মালতীর এক নতুন চিন্তা শুরু হয়েছে। দুদিন পর থেকে মেয়ের স্কুলের ছুটি পড়ে যাচ্ছে। মেয়েকে একা রেখে কাজে যাবে কি করে এটাই ভেবে পাচ্ছে না। শেষমেশ অনেক ভেবেচিন্তে ঠিক করে মেয়েকে সাথে নিয়েই কাজের বাড়িতে যাবে।
(৩)
দুইদিন পর...
-কীরে মালতী, এটা তোর মেয়ে?
-হ্যাঁ গো বৌদিমণি। আজ থেকে ওর স্কুলে ছুটি পড়েছে তো তাই বাড়িতে একা রেখে আসতে সাহস পেলাম না।
-ভালো করেছিস। কি নাম তোর?
-আমার নাম রিমি।
-বাহ, খুব মিষ্টি নাম। আয় তুই আমার সাথে আয়।
-ও কে?
-ও মালতীর মেয়ে রিমি।
-সেই যাই হোক। ওকে তুমি আমার খাটে কেন বসিয়েছ?
-ছিঃ! পায়েল, ওই ভাবে কাউকে বলে? তুমি কি আজকাল মানুষকে সম্মান করতেও ভুলে যাচ্ছ?
পায়েল কোনো কথার উত্তর না দিয়ে ওখান থেকে চলে যায়। লাবণী রিমিকে বলে- কিছু মনে করিস না রে। ও এরকমই। তুই এই খাবারগুলো খেয়ে নে।
এমনি করে প্রতিদিন মালতী ওর মেয়েকে নিয়ে আসে। আজকাল লাবণীও খুব ভালো থাকে। সারাদিন রিমিকে পড়ায়, গান শেখায়। পায়েলের জন্য যা যা করতে ওর ইচ্ছে হত সেই সব কিছু ও রিমির জন্য করে। রিমিও ওর এই নতুন জেঠিমাকে পেয়ে খুব খুশি। পায়েলের এসব কিছুই ভালো লাগে না। ও রিমিকে একদম সহ্য করতে পারে না।
(৪)
-ঠাম্মু, আজকে আমার বাড়ি আসতে দেরী হবে। কাল তো আমার জন্মদিন তাই আজ বন্ধুদের সঙ্গে একটু বেরব। তুমি চিন্তা করো না। আমি আসছি।
অনেকক্ষণ হয়ে গেলেও পায়েল বাড়ি না আসায় সবাই খুব চিন্তায় পড়ে যায়। ওর ফোনও সুইচ অফ থাকায় ওরা কেউই ওর সাথে যোগাযোগ করতে পারে না।
-এ কী রিমি, তুই এত রাতে এখানে?
-আসো পায়েলদি।
-পায়েল, তুই আর রিমি একসাথে কি করছিস? আমাকে পরিস্কার করে বলবি?
-জেঠিমা আজ থাক। অনেক রাত হয়ে গেছে আমি বাড়ি যাই। মা না হলে চিন্তা করবে। তোমরাও পায়েলদিকে বেশি বকাবকি করো না। ওকে একটু বিশ্রাম নিতে দাও।
-হ্যাঁ হ্যাঁ বউমা, তুমি আর এখন গোয়েন্দার মতো এত জেরা করো না দিদিভাইকে। সব কথা তুমি পরে বলো।
-আচ্ছা, পায়েল তুই ঘরে যা। রিমি তুই দাঁড়া, আমি রামুকে বলছি তোকে বাড়ি দিয়ে আসবে।
(৫)
আজ সকাল থেকেই সবাই খুব ব্যস্ত। কিন্তু লাবণী কিছুতেই শান্তি পাচ্ছে না। কাল ঠিক কি হয়েছে তা না জানা পযর্ন্ত ওর শান্তি নেই। মেয়েকেও জিজ্ঞেস করতে পারছে না। ওর ঠাকুমা এমনভাবে আগলে রেখেছে যে মেয়েকে কিছু জিজ্ঞেস করার সুযোগই পাচ্ছে না।
-দিদিভাই, তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে নে। এক্ষুনি লোকজন সব চলে আসবে।
-আচ্ছা ঠাম্মু, মালতী মাসি আর রিমিও আসবে তো?
-তুই আবার ওদের খোঁজখবর নিচ্ছিস কেন?
-উফ্, তুমি উত্তর দাও তো।
-হ্যাঁ, ঠিক আসবে। তোর মা ঠিক ওদের আসতে বলেছে। তোর মায়ের রিমিকে নিয়ে কেন যে এত আদ্যিখেতা তা বুঝিনা আমি। যাক গে, তুই তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে নীচে আয়।
পায়েল।আজকে খুব সুন্দর করে সেজেছে। ওকে ঠিক কোনো পরীর মতো লাগছে। লাবণীও খুব খুশি এই প্রথম পায়েল ওর পছন্দ করা জামা পড়েছে বলে।
-কার জন্য অপেক্ষা করছিস? কেকটা কেটে ফেল।
-দাঁড়াও, আজ আমার একজন স্পেশাল বন্ধু আসবে। সে এলেই কেক কাটব।
এমন সময় রিমিকে আসতে দেখে পায়েল বলে- ওই তো আমার স্পেশাল বন্ধু এসে গেছে।
পায়েল ছুটে গিয়ে রিমিকে জড়িয়ে ধরে। তারপর নিজের কাছে নিয়ে এসে দাঁড় করায়। এইসব কিছু পায়েলের ঠাকুমা, মানে সরমাদেবীর একটুও ভালো লাগে না। এতদিন পূত্রবধূর আদ্যিখেতা উনি সহ্য করলেও আদরের নাতনীর এই আদ্যিখেতা উনি সহ্য করতে পারছেন না। গন্ডগোলটা লাগল যখন পায়েল কেক কেটে প্রথমে রিমিকে খাওয়াতে গেল। সরমাদেবী রেগে গিয়ে রিমিকে টানতে টানতে বের করে দিতে যাচ্ছিলেন। ঠিক তখনি পায়েল বলে উঠল- দাঁড়াও ঠাম্মু, তুমি ওকে বের করে দিতে পারো না। যে মেয়েটাকে "ধন্যবাদ" দেওয়া উচিত তাকে তুমি অপমান করতে পারো না।
-তুই ওই মেয়েটার জন্য আমার সাথে এইভাবে কথা বলছিস?
-ছাড়ো না, পায়েলদি। আমি চলে যাচ্ছি।
-না, তুই কোথাও যাবি না। শোনো ঠাম্মু, কাল রাতে ও যদি না থাকত তাহলে আমার যে কি হতো কে জানে। কাল রাতে আমার সত্যি সত্যিই চোখ খুলে গেছে। এতদিন যাদের বন্ধু ভাবতাম তারা যে কতবড়ো শত্রু সেটা কাল জানলাম। আর যাকে শত্রু ভেবে এতদিন দূরে সরিয়ে রেখে ছিলাম সেই আমার আসল বন্ধু। আমার
মান-সম্মান সব নষ্ট হয়ে যেত যদি না ও আমাকে বাঁচাত ওই অসভ্য ছেলেগুলোর হাত থেকে। কে বলে মেয়েরা দুর্বল। আসলে সব মেয়েদের মধ্যেই একটা করে মা দূর্গা থাকে। সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায় যার প্রমাণ পাওয়া যায়। কালকে আমার মনে হচ্ছিল আমি রিমিকে না সাক্ষাৎ মা দূর্গাকে দেখছি। যে নিজের হাতে দুষ্ট দমন করে আমাকে রক্ষা করতে এসেছে।
পায়েলের সব কথা শুনে সরমাদেবীর ভুল ভেঙে গেল। উনিও রিমিকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। রিমিও আজ একটা ঠাকুমা পেল। সরমাদেবী ওনার দুই নাতনিকে নিয়ে খাবার টেবিলে খেতে বসলেন।
খাবার টেবিলে শুরু হয় ওদের আড্ডা। ওদের এই মূহুর্তগুলো ধরা থাকে লাবণীর মুঠোফোনের ক্যামেরায়। রক্তের সম্পর্কে নয়, ভালোবাসার সুতোয় গাঁথা অটুট সম্পর্কগুলো এইভাবেই অকারণে জীবনভরের সুখ দিয়ে যায় বোধহয়।