প্রকৃত বন্ধু
প্রকৃত বন্ধু
-কী ব্যাপার দাদুন! তুমি আজকে এতো তাড়াতাড়ি উঠে পড়েছো?
-এই যে দাদুভাই, আমার বন্ধুরা কালকে রাতে আমার স্বপ্নে এসে বলল।
-কী বলল দাদুন?
-ওদের অনেকদিন আমি ঠিক মতো খেয়াল রাখেনি বলে ওরা আমার ওপর রাগ করেছে।
-কী সব বলছো তুমি দাদুন? ওরা আবার কথা বলতে পারে নাকি?
-হুম, খুব পারে দাদুভাই। ওরা তো আমার বন্ধু। ওদেরও আমাদের মতো প্রাণ আছে।
-তোমার বন্ধু যখন তখন রাগ করবে কেন? তুমি ওদের বুঝিয়ে বলো যে তোমার কদিন শরীর খারাপ ছিল তাই তুমি ওদের ঠিক মতো খেয়াল রাখতে পারোনি।
-হা হা হা, তুমি একদম ঠিক বলেছো দাদুভাই।
-দাদুন, আমিও তোমার সাথে ওদের খেয়াল রাখব তাহলে ওরাও আমার বন্ধু হবে?
-অবশ্যই হবে।
***
সুবিমল এসে ওর স্ত্রী দীপ্তিকে জিজ্ঞেস করে-কী গো, টুকাই কোথায়?
দীপ্তি বলে-তোমার বাবার সাথে তো নীচে বকবক করছিল।
সুবিমল খেতে খেতে উত্তর দেয়-আচ্ছা, আমি বেরোবার সময় ওকে ওপরে পাঠিয়ে দেবো।
সুবিমল নীচে এসে দেখে টুকাই ওর দাদুর সাথে মিলে গাছেদের পরিচর্যা করছে। টুকাইকে সকাল সকাল এইসব করতে দেখে সুবিমল খুব রেগে গেল। ওকে ধমক দিয়ে ওপরে মায়ের কাছে যেতে বলে নিজের বাবাকে বলল-
"বাবা, এখন ওর পড়াশোনার বয়স। তুমি ওর মাথায় এসব আজগুবি জিনিস ঢুকিও না। কতো টাকা খরচ করে ওতো বড়ো একটা স্কুলে পড়াচ্ছি সেটা কি সকাল সকাল তোমার সাথে কাঁদা-মাটি ঘাটার জন্য? ও তো বাচ্চা, তাই কিছু বোঝে না। তুমি তো আর বাচ্চা নও। তুমি এই বয়সে এসে এসব করছো করো। আমার বা দীপ্তির এতে কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু টুকাইকে তুমি এসবের মধ্যে জড়াবে না।"
কথাগুলো বলে সুবিমল গটগট করে বেরিয়ে গেল। পরিমলবাবু এতক্ষন ধরে ছেলের বলা কথাগুলো একমনে শুনছিলেন। আগে হলে হয়তো কষ্ট পেতেন। কিন্তু এখন এসব ওনার অভ্যেস হয়ে গেছে। যখনই টুকাই ওনার কোনো কাজে সাহায্য করার জন্য আসে তখনই এরকম অনেক কথাই ওনাকে শুনতে হয়। উনি মনে মনে ভাবতে থাকেন-ওদের কাছে গাছেদের পরিচর্যা করা হলো বুড়ো বয়সে সময় কাটানোর একটা উপায় মাত্র। তাই ওনার জন্য এসব করাতে ছাড় কিন্তু নাতির জন্য নৈব নৈব চ। কিন্তু এই গাছই মানুষের অস্তিত্ব রক্ষার প্রধান উপাদান অক্সিজেন জোগায়। এদের পরিচর্যা করা আমাদের উচিত। এই সত্যিটা মানুষ আজ নয়তো একদিন ঠিক বুঝবে।
পরিমলবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার নিজের কাজে মন দেন। এখন সারাদিন ওনার গাছেদের সঙ্গেই কাটে। এরাই ওনার প্রকৃত বন্ধু। এদের সাথেই পরিমলবাবু নিজের সব দুঃখ-কষ্ট, খারাপ-ভালো ভাগ করে নেন।
***
(কয়েক মাস পর)
সকাল থেকে টুকাইকে কোথাও দেখতে না পেয়ে সুবিমল ওর বাবার ঘরে যায়। কিন্তু সেখানে ওর বাবা একাই চা খাচ্ছে দেখে ও বাইরে উঠোনে এসে দেখে টুকাই ওর বাবার আনা একটা চারাগাছকে যত্ন সহকারে মাটিতে পুঁতে তার গোড়ায় জল দিচ্ছে। ছেলেকে এমন কান্ড করতে দেখে সুবিমল ওকে জিজ্ঞেস করে-এসব কী হচ্ছে টুকাই?
-গাছ লাগাচ্ছি বাপি।
-কিন্তু কেন? এগুলো তো তোমার দাদুনের কাজ। তুমি এসব করছো কেন?
-জানো তো বাপি, আমার দিদিমণি কালকে আমাদের অনলাইন ক্লাসে বলেছেন, যে গাছেরও আমাদের মতো প্রাণ আছে। আর ওরা আমাদের বন্ধু। ওরা আমাদের বেঁচে থাকার জন্য অক্সিজেন দেয়। আমাদের দিদিমণি আরও বলেছেন, এখন করোনার জন্য চারিদিকে অনেক মানুষের অক্সিজেনের খুব অভাব হচ্ছে। আমাদের তাই বেশি বেশি করে গাছ লাগানো উচিত। দাদুনও আমাকে বলে, গাছ আমাদের প্রকৃত বন্ধু। তাই তো আমি আজ এই চারাগাছটা লাগালাম।
টুকাইয়ের কথা শুনে সুবিমল মনে মনে ভাবে-সত্যিই তো, আমরা এই যান্ত্রিক জীবনের মোহে প্রকৃতিকে একদম ভুলেই গেছি। প্রকৃতির অবদান কখনোই অস্বীকার করার নয়। যখনই আমরা সেটা ভুলে যাব প্রকৃতি চোখ রাঙানি দিয়ে আমাদের মনে করিয়ে দেবে।
ও তাই ঠিক করে কালকে সবাইকে একটা দারুণ সারপ্রাইজ দেবে।
***
(পরেরদিন সকালে)
"কই গো তোমরা সবাই কোথায়? তাড়াতাড়ি নীচে এসো।"
সকাল সকাল সুবিমলের গলার আওয়াজ পেয়ে দীপ্তি, টুকাই, পরিমলবাবু বাইরে বেরিয়ে আসেন। ওনারা এসে দেখেন সুবিমল অনেকগুলো চারাগাছ, টব কিনে এনেছে। ওরা সবাই কাছে আসতেই ও বলে-বাবা, পারলে আমাকে ক্ষমা করো। তোমার কাজকে না বুঝেই অনেক অপমান করেছি। টুকাই আমার চোখ খুলে দিয়েছে। আজ থেকে রোজ না পারলেও সপ্তাহে একদিন অন্তত তোমার সাথে গাছেদের পরিচর্যা করব। আমিও চাই তোমার আর টুকাইয়ের মতো ওদেরকে আমার বন্ধু করতে। সুবিমলের কথা শুনে দীপ্তিও ভীষণ খুশি হয়।
সুবিমল আরও বলে-আজকে বিশ্ব পরিবেশ দিবস। তাই আমাদেরও উচিত প্রকৃতিকে কিছু উপহার দেওয়া। তাই এই চারাগাছগুলো নিয়ে এলাম। ওদের পরিবারে সদস্য সংখ্যা বাড়ানোর জন্য। চলো, আজ বাবা আমাদের নির্দেশ দেবে আর আমরা সেইমতো ওদেরকে লাগাবো।
ওরা সবাই মিলে আনন্দের সাথে গাছ লাগাতে শুরু করে। ওদের দেখাদেখি আশেপাশের বাড়ির লোকেরাও গাছ লাগাতে উৎসাহিত হয়। আজ পরিমলবাবু খুব খুশি। আজ ওনার ইচ্ছে পূরণ হয়েছে। এতদিন উনি চাইতেন মানুষ নিজের অবসর কাটানোর জন্য নয় বরং ভালবেসে গাছ লাগাক। আজ সেটা কিছুটা হলেও সফল হয়েছে। উনি আশাবাদী আগামীদিনেও হয়তো এটা আরও বড়ো পরিসরে সফল হবে। আরও বেশি সংখ্যক মানুষ এই কাজে সামিল হবে। পৃথিবী আবার আগের মতো সুস্থ হয়ে যাবে। সব দুঃখ-কষ্ট ভুলে গিয়ে আবার সবাই প্রাণোচ্ছল হাসিতে মেতে উঠবে।