Sudeshna Mondal

Drama Classics Inspirational

4  

Sudeshna Mondal

Drama Classics Inspirational

স্ব-অধীন

স্ব-অধীন

5 mins
301


সকাল থেকেই মল্লিকবাড়িতে আজ সাজো সাজো রব। আর হবে নাই-বা কেন। আজ এই বাড়ির একমাত্র মেয়ে ঋতজার বিয়ে ওর ছোটবেলার বন্ধু প্রীতমের সঙ্গে। সম্বন্ধটা অবশ্য ঋতজার মামণি, সুরঙ্গনাদেবীই করেছিলেন। আসলে উনি ছাড়া ঋতজার আপন বলতে কেউ নেই। তাই ওনার অবর্তমানে ঋতজার যাতে কোনো অসুবিধা না হয় সেজন্যই ঋতজার বিয়ে দিচ্ছেন। নাহলে ঋতজা তো বিয়ে করবে না বলেই ঠিক করেছিল।

প্রীতম খুবই ভালো ছেলে। একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি করে। ওর পরিবার বলতে মা-বাবা আর ও। সুরঙ্গনাদেবী প্রীতমকে অনেক দিন ধরে চিনলেও ও যে ঋতজাকে এতটা ভালোবাসে সেটা উনি আগে জানতেই পারেননি। বেশ কিছু মাস আগে একদিন প্রীতমের মায়ের সঙ্গে কথায় কথায় উনি এই ব‍্যাপারটা জানতে পারেন। আর সবথেকে আশ্চর্যের ব‍্যাপার ঋতজাও কিচ্ছুটি জানত না। প্রীতম কোনোদিন ওর মনের কথা ঋতজাকে জানানোর সাহসই পাইনি। তাই সুরঙ্গনাদেবী সবকিছু জানার পর ওদের চারহাত এক করে দিতে বেশি দেরী করেননি। আর আজই সেই আনন্দের দিন। কিন্তু এই এত হই-হট্টগোলের মধ্যে ঋতজাকে কেউ সকাল থেকে কোথাও দেখেনি। সারাবাড়ি খুঁজেও ঋতজাকে না পেয়ে সুরঙ্গনাদেবী একটু চিন্তিত হয়ে পড়লেন। ওকে অনেকবার ফোন করেও না পেয়ে শেষমেশ প্রীতমকে একবার ফোন করলেন। কিন্তু ফোনটা প্রীতম না ধরে ওর বাবা ধরলেন। ওপ্রান্ত থেকে ভেসে এল,

-হ‍্যালো, মিসেস মল্লিক বলুন।

-ওহ, মি.সেন প্রীতম নেই?

-ও তো কিছুক্ষণ আগে কোথাও একটা বেরোল। তাড়াহুড়োতে ফোনটাও বাড়িতে ফেলে গেছে। কোনো দরকার ছিল?

প্রথমে ভাবলেন ওনাদের কিছু না জানানোই ভালো। আবার ওনারাও চিন্তা করবেন। তারপর কী মনে হতে সুরঙ্গনাদেবী বললেন,

-আসলে ঋতুকে সকাল থেকে বাড়িতে পাচ্ছি না। তাই একবার প্রীতমকে জিজ্ঞেস করতাম ও কিছু জানে নাকি।

-সেকি!!! ওকে ফোন করেছিলেন?

-হ‍্যাঁ অনেকবার। কিন্তু একবারও ফোন ধরেনি।

-আচ্ছা আপনি অত চিন্তা করবেন না। নিশ্চয়ই কোনো কাজে গেছে। এক্ষুনি চলে আসবে।

-আজকের দিনে আবার কীসের কাজ। আজ তো কোনো কাজ রাখতে বারণ করেছিলাম।

-আচ্ছা, আমরা কর্তা-গিন্নি এক্ষুনি আপনার বাড়িতে আসছি। আপনি ততক্ষণ শান্ত হয়ে অপেক্ষা করুন। অত চিন্তা করবেন না।

অখিলেশবাবু ফোনটা রেখে দিয়ে নিজের গিন্নিকে তাড়াতাড়ি তৈরি হতে বললেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওনারা মল্লিকবাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলেন।

****

অন‍্যদিকে গায়ে হলুদের তত্ত্ব ছেলের বাড়ি থেকে চলে এসেছে। বাড়ির সবসময়ের কাজের লোক রামুদা সবাইকে নিয়ে ভেতরের একটা ঘরে গেল। ওখানেই তত্ত্বের জিনিসগুলো রাখার ব‍্যবস্থা করা হয়েছে। সবকিছু গুছিয়ে রাখার পর ওনাদের জলখাবারের বন্দোবস্ত করতে বললেন সুরঙ্গনাদেবী। কিন্তু ওনার মন থেকে দুশ্চিন্তার মেঘটা তখনও কাটেনি। যতক্ষণ না পর্যন্ত ঋতজা বাড়ি আসবে ততক্ষণ এই মেঘ কাটবার নয়। বাড়ির অন‍্যরা চিন্তা করতে বারণ করলেও ওনার মন কিছুতেই শান্ত হচ্ছে না। এরমধ্যেই পাড়ার কয়েকজন মহিলারা চলে এসেছেন। এখানে আসার পথে ওনারা শুনেছিলেন ঋতজাকে নাকি পাওয়া যাচ্ছে না। তবুও বাড়িতে ঢুকেই সেই কথাটাই আবার তুললেন ওনারা। পাড়ার ঘোষগিন্নীর তো স্বভাব সবকিছু খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে জিজ্ঞেস করা। সেইমতো উনিই শুরু করলেন,

-হ‍্যাঁ রে, সুরঙ্গনা শুনলাম ঋতুকে নাকি পাওয়া যাচ্ছে না। তা মেয়েটা আজকের দিনেই বা গেল কোথায়?

সুরঙ্গনাদেবী খুব ভালো করেই ওনার স্বভাব জানেন। তাই কোনো উত্তর না দিয়ে চুপ করে বসে রইলেন। কিন্তু উনি (ঘোষগিন্নী) তো এত সহজে ছাড়বার পাত্রী নন। তাই আবার জিজ্ঞেস করলেন,

-তা বাপু, মেয়ের এই বিয়েতে আদৌ মত ছিল তো? তোর আবার সবেতেই একটু বাড়াবাড়ি। এত আদ‍্যিখেতা করিস ঋতুকে নিয়ে। তোর মতো অত আদ‍্যিখেতা কেউ নিজের পেটের মেয়েকে নিয়েও করে না।

ওনার কথার সুর ধরে আরেকজন বলতে শুরু করলেন,

-যা বলেছেন ঘোষগিন্নী। সুরঙ্গনাদি একটু বেশিই মাথায় তুলে রাখেন ঋতুকে। তাই না আজ কাউকে কিছু না বলে এরকম বেপাত্তা হয়ে গেল। সবসময় তো 'মামণি-মামণি' করে ঢঙ করত। আর আজ সে একবারও নিজের মামণির মান-সম্মানের কথাটা ভাবল ?

সবার সব কথা এতক্ষণ ধরে চুপচাপ শুনছিলেন সুরঙ্গনাদেবী। একবারও কোনো প্রতিবাদ করেননি। তবে ঘোষগিন্নীর বলা শেষ কথাটা যেন আগুনে ঘি ঢালার মতোন কাজ করল।

"পরের মেয়েকে অত স্বাধীনতা দিলে এই হয়। পর সবসময় পর-ই থাকে। আপন কোনোদিনই হয়না। এতটা লাগাম ছাড়া স্বাধীনতা না দিলেই পারতে।"

কথাটা শোনামাত্রই সুরঙ্গনাদেবীর চোখটা ছলছল করে উঠল। এই গত পাঁচবছরে তো ওনার একবারও মনে হয়নি ঋতজা ওনার মেয়ে নয়। তাহলে কি...

সবার বিভিন্ন মন্তব্যের মাঝখানে একটা বহু পরিচিত গলার স্বর শুনতে পেলেন সুরঙ্গনাদেবী। আর সেটা শুনে ওনার ধড়ে যেন প্রাণ ফিরে এলো।

-" একদম ঠিক বলেছেন ঘোষ জেঠিমা। পরের মেয়েকে আপন ভাবতে নেই। তার উপর এত স্বাধীনতা তো দিতেই নেই। সবসময় নিয়মের বেড়াজালে তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখতে হয়। আর তাকে প্রতিটা পদে পদে বুঝিয়ে দিতে হয় সে বাড়ির মেয়ে নয়, বরং পুত্রবধূ রূপে বিনা মাইনের কাজের লোক। আপনাদের ভাবনা চিন্তা কোনোদিন বদলাবে না সেটা আমি জানি। যদি বদলাতো তাহলে নিজের ছেলের বউয়ের সঙ্গে রাতদিন চাকরের মতো ব‍্যবহার করতেন না। স্বাধীনতা না হোক ন‍্যূনতম সম্মানটা তাকে করতেন। কিন্তু কি বলুন তো আমার মামণি আপনার মতোন নয়। তাই ওনার ছেলে আমাকে ছেড়ে চলে গেলেও উনি আমাকে নিজের মেয়ের মতো করে আগলে রেখেছিলেন এই পাঁচটা বছর। একদিনের জন‍্যও বুঝতে দেননি আমি ওনার মেয়ে নই, পূত্রবধূ। আর এখানেই আপনাদের সঙ্গে আমার মামণির বিস্তর ফারাক।"

কথাগুলো একটানা বলে ঋতজা ওর মামণির দিকে তাকায়। সুরঙ্গনাদেবী ওর কাছে এসে বলেন,

-এতক্ষণ কোথায় ছিলিস? তোর জন্য কত চিন্তা হচ্ছিল আমার।

ঋতজা ওর মামণির গলা জড়িয়ে বলে,

-তোমাকে এতটা টেনশন দেওয়ার জন্য আমি খুব দুঃখিত মামণি। কিন্তু তোমাকে আগে থেকে বলে গেলে সারপ্রাইজটাই থাকত না। তাই ইচ্ছে থাকলেও বলতে পারিনি।

-সারপ্রাইজ!!! কীসের সারপ্রাইজ?

ওদের কথার মাঝখানে প্রীতম একটা হারমোনিয়াম নিয়ে ভেতরে ঢোকে। পিছন পিছন ওর বাবা-মাও। ওনাদের একসঙ্গে আসতে দেখে সুরঙ্গনাদেবী বলেন,

-মি.সেন আপনি তাহলে সব জানতেন। তাও আমাকে বলেননি কেন আমি যখন আপনাকে ফোন করলাম?

-কী করে বলি বলুন তো? মেয়ে তার মায়ের জন্য সারপ্রাইজ প্ল্যান করেছে আর আমি সবটা বলে দিয়ে সারপ্রাইজটা মাটি করি।

-কিন্তু সারপ্রাইজটা কি সেটা তো এবার বলুন।

এবার ঋতজা বলে উঠল,

-তোমার জন্য একটা উপহার আনতে গিয়েছিলাম মামণি।

-কী উপহার?

-হারমোনিয়াম। আমি জানি মামণি, তোমার অনেক দিনের শখ ছিল একটা হারমোনিয়ামের। কিন্তু পরিবারের চাপে সেই শখ কোনোদিন পূরণ হয়নি। বলা ভালো তোমাকে কোনোদিন কেউ সেই স্বাধীনতাটুকু দেয়নি। আমি চাই তুমি তোমার সেই শখটা এবার পূরণ করো। তুমি আজ থেকে আর কারোর অধীনে নয়, নিজের অধীনে বাকি জীবনটা কাটাও। তুমি শুধু স্বাধীন নয়, স্ব-অধীনে জীবনযাপন করো। ঠিক যেমন আজ থেকে পাঁচবছর আগে তুমি আমাকে নতুন করে জীবন‍ শুরু করতে বলেছিলে, আমি চাই তুমিও আজ থেকে নতুন জীবন শুরু করো।

ঋতজার কথা শুনে সুরঙ্গনাদেবী ওকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। আনন্দে ওনার চোখ দিয়ে নীরবে জল পড়তে থাকে। চারিদিকে একটা খুশির হাওয়া বইতে থাকে। সত্যিই যদি সব শাশুড়ি-বউমার সম্পর্ক এরকম মা-মেয়ের মিষ্টি সম্পর্কে পরিণত হয় তাহলে আমাদের সমাজটা কত-ই না সুন্দর হবে। ওদের মা-মেয়ের এই সুন্দর মূহুর্তটা প্রীতম ওর মুঠোফোনের ক‍্যামেরায় বন্দি করে নেয়।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama