যাই বলতে নেই
যাই বলতে নেই
পর্যটন অর্থাৎ কোন ভ্রমণক্ষেত্র বা ভ্রমণের জায়গা। আমার বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে ভালো লাগলেও সেরকম ভাবে কোথাও আমার যাওয়া হয়নি। উত্তরবঙ্গে থাকি, তাই প্রতিবছর পিকনিকেই যা একটু এদিক সেদিক পাহাড়ে যাওয়া হয়েছে। জলপাইগুড়ির বাইরে টা বলতে ওই আশ পাশ টাই দেখেছি মাত্র আসল ভ্রমণের স্বাদ কি সেটা আমার কাছে অজানাই ছিল। টিভিতে ডিসকভারি, মোবাইলে বিভিন্ন জায়গার ছবি দেখে সেখানকার প্রকৃতি, সেখানকার ঋতুকাল অনুভব করতাম মাত্র, আর নিজেকে সেই জায়গায় কল্পনা করতাম। বিয়ের পর আমার স্বামী রাতুলের হাত ধরে প্রথম পশ্চিমবঙ্গের বাইরে পা রাখি তবুও খুব বেশি দূরে নয় পশ্চিমবঙ্গের প্রতিবেশী রাজ্য সিকিম। আমার কাছে সেটাই অনেক অনেক স্মরণীয় মূহুর্ত ছিল। তিনদিন থেকেছিলাম আমরা সিকিমে। অক্টোবর মাসে আমি রাতুল আর রাতুলের বন্ধু ও বন্ধুর স্ত্রী সিকিমের জন্য জলপাইগুড়ি থেকে শিলিগুড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেই কুয়াশা মাখা ভোরের বেলা। তারপর শিলিগুড়ি পৌছে সেখান থেকে সিকিমের উদ্দেশ্যে রওনা দেই। প্রত্যক্ষদর্শীদের মুখে বহুবার সিকিমের গল্প শুনেছি। গল্প শুনেছি নাথুলা বর্ডার সম্বন্ধেও। এমনিতেই আমি একটু ভাবুক প্রকৃতির আমি নিজে নিজেই সিকিম সম্বন্ধে অনেক কল্পনার চিত্র একে ফেলেছিলাম। চারিদিক পাহাড় আর পাহাড় হবে আর নিশ্চই খুব ঠান্ডাও থাকবে সেখানে আর সবথেকে বেশি কৌতূহল ছিল বরফ দেখার। এই কৌতূহল এই শিশু মনোভাব টা আমার ছিল যে পাহাড়ের গায়ে বরফ দেখবো। বরফ তো এমনিই দেখি কিন্তু ইচ্ছে টা ছিল যে বরফ ঠেলে আমি হেঁটে বেড়াবো তখন খুব আনন্দ হবে আমার। যাইহোক সিকিম পৌছোই maya inn নামক একটি লজে আমরা গিয়ে সেখানে উঠি, সেখানে পৌছতে প্রায় সন্ধ্যে হয়ে যায়। নিজেরা ফ্রেশ হয়ে নেই ঝটপট তারপর সন্ধ্যেটা উপভোগ করার জন্য বেড়িয়ে পড়ি চারজন। বিকেল টা হেঁটেই আমরা চারপাশটা উপভোগ করি রেস্টুরেণ্টে খাওয়া দাওয়া আর কিছু টুকিটাকি জিনিস বাজার করি, এরপর লজে ফিরে এসেই ঘুমিয়ে পড়ি। ওহ আর একটি ব্যপার আমার একটু অন্যরকম লেগেছে সেটা হোল সময়। এমনিতে আমরা বাড়িতে রাতে ১২টার আগে ঘুমোই না কিন্তু সেখানে সেটি চলবে না, সিকিমে সন্ধ্যে সাতটা বাজতেই দোকান পাট বন্ধ হওয়া শুরু হয়ে যায়, আর রাত আটটাতে প্রায় সব বন্ধ। রাত নটার মধ্যে সিকিমের রাস্তা শুনশান হয়ে যায় এমনকি রাস্তায় একটা কুকুরও পর্যন্ত দেখা যায় না। আর রাত ১২টা মানে সিকিম একেবারে স্তব্ধ। কিন্তু খুব সকালেই সেখানকার মানুষজন ঘুম থেকে উঠে পড়ে, সত্যি বলতে সেখানকার মানুষ সম্পূর্ণ দিনটাকে উপভোগ করে। এছাড়াও সিকিমের রাস্তায় কোন ট্যাক্সিতে তিনজনের বেশী যাত্রী বহন করা যাবে না এটাই সেখানকার নিয়ম আর সেই নিয়ম ভাঙতে আমি সেখানে কেউ কে দেখিনি। আসলে পাহাড়ি রাস্তা বলেই হয়তো এমন নিয়ম। যাই হোক পরদিন আমরা ভোর পাঁচটায় বিছানা ছাড়ি তারপর
নিজেদের তৈরী করে বেড়িয়ে পড়ি সিকিমের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য চক্ষুগ্রাস করতে। গাড়ি রিজার্ভ করে সেখানেকার গাইড আমাদের বিভিন্ন রকম view point এ নিয়ে যান, সম্পূর্ণ সিকিমটি শুধু পাহাড় আর পাহাড়। আমরা যাই গনেশ টক এ তারপর চিড়িয়াখানায় সেখানে বিভিন্ন প্রজাতির জীবজন্তু দেখি যা আগে আমি দেখিনি, আর সব থেকে বড় ব্যপার বাঘ দেখেছি, রেড পান্ডা, ভাল্লুক আর বিভিন্ন বিলুপ্তপ্রায় পাখি দেখেছি। মোট কথা হোল জানি না আর কেমন কি লেগেছে আমি তো অন্তত যতটা পেরেছি মনের আনন্দ নিয়ে শুধুই সবকিছু উপভোগ করে গেছি। এরপর আমরা যাই নাথুলাতে। যেখানে ইন্ডিয়া আর চায়নার বর্ডার। এদিকে ইন্ডিয়া আর ঠিক কাঁটা তারের ওপাশেই চায়না। প্রথমটায় ওপরের দিকে সিড়ি ভেঙে উঠতেই পারছিলাম না, একে তো ঠান্ডা তারমধ্যে এত্ত উঁচুতে যদিও এই মূহুর্তে আমার নাথুলার উচ্চতা মনে নেই, তবে অনেক কষ্টে বর্ডার পর্যন্ত পৌছোই। চারিদিক টা ঘুরে দেখি। মেঘ গুলো যেন আমার মাথা ছুঁয়ে যাচ্ছিল এই একদম যেন কান ঘেষে বেড়িয়ে গেল। সত্যিই এ এক অপরূপ দৃশ্য, সেখানে বাবা হরভজন সিং এর গল্প শুনি যা সত্যিই আমার মন কে নাড়িয়ে দিয়েছিল, বাবা হরভজন সিং এর মন্দিরে যাই আর সেখানকার গাইড দের মুখে এবং রাতুলের মুখে বাবা হরভজন সিং এর দেশ প্রেম মাতৃভক্তির গল্প শুনে আমার তার প্রতি শ্রদ্ধা বেড়ে গিয়েছিল। ছাঙ্গু লেকে সময় কাটাই সেখানকার চমরী গাই এর পিঠে চড়ি। এরপর দুপুরের খাওয়া সেরে সেদিনই বাড়ি ফেরার পালা ছিল। মনটা খুব খারাপ লাগছিল সিকিম ছেড়ে আসতেই ইচ্ছে করছিল না। কেমন যেন বুকটা মোচড় দিয়ে উঠছিল লজে ফিরে নিজের রুম টা কে বার বার ঘুড়ে দেখছিলাম কান্না পাচ্ছিল খুব, কারণ আমি জানি আর হয়তো এখানে আসা হবে না আর আমি খুব তাড়াতাড়ি যেকোন কিছুর সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তুলে ফেলি সেটা জীবই হোক আর জড়ই হোক। maya inn এ 203 no. room এ আমি ছিলাম আর সেই ঘরের ব্যলাকনি তে গিয়ে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে দূরে পাহাড়ে দিকে তাকিয়ে থাকি আর মনে মনে বলে উঠি ভালো থেকে আর হয়তো তোমার সাথে দেখা হবে না। চোখের কোণ টা চিকচিক করে ওঠে আমার, সেই ঘরের ব্যালকনির দরজার কোণে আমি আমার নাম আর তারিখ আর একটা স্টিকার লাগিয়ে এসেছিলাম যদি কখনো আবার যাই সেটা দেখে স্মৃতিচারণ করার জন্য। এরপর আর দেরী নয় বেড়িয়ে পড়ি ব্যাগপত্তর নিয়ে রওনা দেই শিলিগুড়ির উদ্দেশ্যে তারপর জলপাইগুড়ি । সিকিমের রাস্তা শেষ হতেই অন্ধকারেই গাড়ির জানালা দিয়ে মুখ বেড় করে মনে মনে বলে উঠি....যাই..গো।
হঠাৎ করে মেঘরাজ আর মেঘ রাণী বুঝি আমাকে বকে দিল বললো যাই বলতে নেই বলো আসি। আমিও মৃদু হেসে প্রত্যুত্তর দেই হুম.. আসি। আর পেছন ফিরে তাকাইনি আমি, সোজা বাড়ি চলে আসি মনটা কেমন যেন তখনও ভাড় হয়েছিল। কয়েকদিন যার রেশ ছিল।