বিসর্জন
বিসর্জন
- দুর্গা.... এই দুর্গা... কোথায় মা তুই.. আয় খেয়ে নে...
- হ্যাঁ যাই মা.. মায়ের নয় নম্বর হাতটা গড়তে আর একটু বাকি আছে..
উচ্চস্বরে বলে ওঠে বছর কুড়ির মেয়েটি..
দরমার ঘরটি প্রায় অর্ধভগ্ন তারই পাশে কোন রকমে ত্রিপল টাঙিয়ে তারই নীচে তৈরী হচ্ছে মৃন্ময়ীর মূর্তি।
- হয়েছে, এবার একটু বিশ্রাম নে।সেই যে কোন ভোর থেকে কাজ শুরু করেছিস।নিজের একটু খেয়াল রাখবি না?
খাবারের পাত্রটা নিয়ে মাটির ওপর বসে পড়ে দুর্গার মা রমলা দেবী।
পরণে তার আধময়লা ছেড়া কাপড়।
দুর্গা তার কোমর থেকে রঙ তুলির ব্যাগটা খুলে রেখে রমলা দেবীর কাছে এসে বসে..
সদ্য কুড়িতে পা দেওয়া মেয়েটার শরীরে যেন যৌবন উথলে উঠেছে। মাথার ঘন চুল কোমর ছাড়িয়ে গেছে,গায়ের গৌর বর্ণ আর আর ডাগর চোখ সব মিলিয়ে যেন সাক্ষাৎ মা দুর্গা, কৈলাস থেকে নেমে এই মর্ত্যে পা দিয়েছেন।
দুর্গার পরনে নোংরা কমদামি একটা ছেড়া শাড়ি, পরণের শাড়িতে বেশ কিছু জায়গায় মাটি লেগে রয়েছে।
- আজ কি রেধেছো মা..
- বামন দিঘির পাশে কালো কচু গুলো খুব হয়েছে জানিস তো?তাই আজ..
- কালো কচু...! আমার তো খুব ভালো লাগে। দাও দাও তাড়াতাড়ি দাও আমায়..
রমলা দেবীকে কথাটা সম্পূর্ণ করতে না দিয়েই উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে দুর্গা...
রমলা দেবীর চোখটা ছলছল করে ওঠে, আঁচলের খুটে চোখ মোছেন তিনি।
- আবার কি হোল মা..? কাঁদছো কেন..?
- তোর কপালটা এতই খারাপ। একটু যে তোকে ভালোমন্দ খাওয়াবো সে ক্ষমতাও আমার নেই।এই বয়সে যেই মেয়ের সুখে শান্তিতে শশুর বাড়ির ঘর করার কথা সে কিনা দিন রাত এক করে মা ভাইয়ের দুবেলা খাওয়ার জন্য খেটে মরছে।
- মা...! তুমি আবারও শুরু করলে...
- কি করবো বল.. তোর মুখটা দেখলে যে আর এসব সইতে পারিনা..
একটা শাড়ি পর্যন্ত তোকে কিনে দেবার মত সামর্থ্য নেই.. তোর বাপটা যদি ওইভাবে গায়ে আগুন দিয়ে না মরতো অন্তত তোর ওপর এত দায় ভার এসে পড়তো না। সেই দেনা মেটাতে গিয়ে সব কিছু বিক্রি করে আজ এই খোলা আকাশের নীচে থাকতে হচ্ছে।
কান্না জড়ানো গলায় বলে ওঠেন চল্লিশোর্ধ্ব মহিলা রমলা দেবী।
- বাবা আত্মহত্যা করেনি মা।তাকে মেরে ফেলা হয়েছে।এত পরিশ্রম করে ঠিক মত টাকা না পাওয়ায় ঋণ ধারের পাওনাদারের তাগাদা যে সে সইতে পারেনি।
- আর সেই ঋণের দায় ভার এখন তোকে সামলাতে হচ্ছে।
- মা তুমি এত কেন চিন্তা করছো বলোতো..
এই তো চক্রবর্তী বাড়ির দুর্গা প্রতিমার বায়নাটা পেয়েছি।
- তাতে কি..? এই একচালা প্রতিমায় কত টাকাই বা আর দেবে।তাতে কি আর সংসারের টানাপোড়েন ঘুচবে।
- যাইহোক,যেটুকুই আসুক। এত চিন্তা কোর না তো তুমি। দেখো মা আমি মেয়ে বলে যারা আমায় আজ হেয় করে আমার কাছে প্রতিমার বায়না দিতে চায় না, আমি এত সুন্দর প্রতিমা গড়বো যে তারাই একসময় আমার কাছে প্রতিমা বানানোর জন্য আসবে।
বাবার যে নামডাক ছিল সেটা তো হারালে চলবে না।
-জানি না, ভগবান কবে মুখ তুলে চাইবেন। আমি যে আর এই দিন দেখতে পারছি না রে..
গলা ধরে আসে রমলা দেবীর। একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন তিনি।
- মা..তুমি কি আমায় খেতে দেবে..?নাকি পুরোনো কথা বলে কান্না কাটি করবে..?
- না না তুই খা। দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে।
রমলা দেবীর দুর্গার মাথায় হাত বুলিয়ে স্মিত হাসেন।
খাবারের গ্রাস মুখে তুলতে নেবে এমন সময় কেউ একজন ডেকে ওঠেন।
- হারান দা আছেন নাকি?
গম্ভীর পুরুষ কন্ঠ স্বর শুনতে পেয়ে দুর্গা হাতে জল নিয়ে হাতটা ধুয়ে শাড়ির আঁচলে মুছতে মুছতে উঠে দাঁড়ায়। রমলা দেবীও আগন্তুক দের অচেনা মুখ দেখে চিন্তা করতে থাকেন।
-এনারাও কি পাওনাদার নাকি? জানি না আর কত দেনার দায় মেটাবে মেয়েটা।
নিজের মনেই বলে ওঠেন রমলা দেবী।
- বাবা কে খুজছেন?
- হ্যাঁ, এটা হারান পালের বাড়ি তো তাই না?
- হ্যাঁ, উনি আমার বাবা।
আগন্তুক ব্যক্তির বয়স প্রায় পঞ্চাশ ছুই ছুই হবে সাথে আরও দুটি ছেলে এসেছে তাদের বয়স এই পচিঁশ ছাব্বিস হবে।
- ওহ, তা বাবাকে ডাকো তো?
- বাবা তো আর নেই। তিনি গত বছর দুর্গা পূজোর পরই মারা গেছেন।
ধীরে ধীরে উত্তর দেয় দুর্গা।
- কি? উনি মারা গেছেন। ওহ শেট.. ঠিক আছে। তবে আসছি।
চলে যেতে নেয় তারা কিন্তু দুর্গা বলে ওঠে।
- আপনারা বলুন না কেন এসেছেন?
- আমি রাজশেখর রায় প্রধান। আসলে আমাদের ক্লাবের এবছর রজত জয়ন্তী বর্ষ। তাই আমরা এবছরের প্রতিমা বিশেষ আকর্ষণীয় তৈরী করতে চাইছি। হারান দার চারিদিকে খুব নাম ডাক তাই ভেবেছিলাম ওনাকে দিয়েই এ বছরের প্রতিমা তৈরী করবো।
কিন্তু..
- বাবা নেই তো কি হয়েছে। আমি গড়বো প্রতিমা। আপনারা যেমন চান বলুন, আমি গড়িয়ে দেবো।
- তুমি পারবে?
বিস্মিত হয়ে রাজশেখর বাবু জিজ্ঞেস করেন।
- হ্যাঁ পারবো। এই যে দেখুন এটা আমি গড়েছি।
কথাটা বলেই দুর্গা ত্রিপলের নীচে রাখা একচালার মৃন্ময়ী মূর্তি টা দেখায়।
- বাহ বেশ ভালো। কিন্তু আমাদের প্রতিমা তো এক চালা হবে না অনেক বড় হবে। আর তাছাড়া সময়ও তো বেশি নেই।
-তবুও পারবো আমি। আমাকে যে পারতেই হবে। দয়া করা আমাকে বায়না দিয়ে যান। আমি ঠিক পারবো।
হাত জোড় করে দুর্গা অনুরোধ করে রাজশেখরের সামনে।
শেষে রাজশেখর দুর্গা প্রতিমার জন্য সামান্য কিছু টাকা বায়না দিয়ে যায়।
তারা চলে যেতেই রমলা দেবী বলে ওঠেন।
- তুই এত বড় দায়িত্ব কেন নিতে গেলি দুর্গা? তুই কি পারবি একা একা সবটা করতে?
- আমাকে তো পারতেই হবে মা। নাহলে যে কোন উপায় নেই। এই বায়নার টাকাটা দিয়ে যতটা হোক মূর্তি গড়ার প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে হবে।
- নিজের জন্যও তো একটা শাড়ি কিনতে পারিস?
- ওসব পরে হবে। এখন কিন্তু মন দিয়ে এই ক্লাবের জন্য খুব সুন্দর প্রতিমা গড়তে হবে তো।
দিন রাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে এক দুর্গা আর এক দুর্গার মৃন্ময়ী রূপ গড়তে থাকে।
সকাল থেকে রাত কেটে যায় দুর্গার সেই ত্রিপলের তলায়।
বাবার করা দেনা তাকে মেটাতে হবে। সব কিছু নতুন করে গড়তে হবে তাকে। সংসারের দায় এখন নিজের কাঁধে সেজন্য আর পড়াশোনাটাও বেশি করতে পারেনি সে।
মহালয়ার দুদিন পরে চক্রবর্তী বাড়ির একচালা প্রতিমা নিয়ে যায় আর সাথে টাকাও দিতে যায়।
সেই টাকা পেয়ে দুর্গার চোখে মুখে যেন আর উচ্ছ্বাস ধরে না।
বাজার থেকে মায়ের শাড়ি আর ভাইয়ের জন্য নতুন প্যান্ট শার্ট কিনে বাকি টাকাটা রেখে দেয়।
আরও দুদিন তো চলতে হবে তাদের।
নতুন জামা পেয়ে ছোট ভাই বেশ খুশি কিন্তু রমলা দেবী আর চোখের জল বাঁধ ধরতে থাকতে পারে না।
- তুই কেন নিলি না? তুইও একটা নতুন শাড়ি নিতে পারতি।
- মা.. সেসব পরে হবে।
এই যে এই প্রতিমাটা নিয়ে গেলে অনেক বেশি টাকা পাব। তখন না হয় নিজের জন্য কিনে নেব একখানা শাড়ি।
মহালয়া থেকেই শুরু হয়ে যায় দেবীপক্ষ কিন্তু রাজশেখরের ক্লাব থেকে কেউ প্রতিমা নিয়ে যেতে আসে না।
চিন্তায় পড়ে যায় দুর্গা।
চতুর্থী পঞ্চমী পেরিয়ে যেতেই দুর্গার যেন আর ধৈর্য্যের বাধ ধরে রাখতে পারে না।
ষষ্ঠীর দিনটাও সারাটাদিন কেয়ে যায় দুর্গার সেই ত্রিপলের নীচে।
মৃন্ময়ী মূর্তির ওই কাজলকালো চোখের দিকে নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে দুর্গা।
দুর্গার চোখ থেকে ঝড়ে পড়ছে তখন অশ্রুধারা।
নিজের হাতে গড়া দুর্গা প্রতিমার সাথে নিজের সুখ দুঃখের কথা বলতে বলতে কেটে যায় সারা রাত, কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে সে, সেই খেয়াল নেই।
- দুর্গা...এই দুর্গা.. ওঠ..দ্যাখ আমি এসেছি রে..
দুর্গা আধবোজা চোখে তাকিয়ে দেখে সামনে স্বয়ং মা দুর্গা দাঁড়িয়ে। সারা শরীর দিয়ে বেড়িয়ে আসছে আলোর বিচ্ছুরণ। অপরূপা সুন্দরী, সারা শরীরে গয়না যেন ঝলমল করছে।
- আর কদিন পরেই আমি ফিরে যাচ্ছি কৈলাসে তুই যাবি আমার সাথে?
স্মিত হেসে সেই অপরূপা রমণী বলে ওঠে।
- আমি যাব, আমি যাব তোমার সাথে। তুমি আমায় তোমার সাথে নিয়ে চলো।
কথাগুলো বিড়বিড় করে নিজের মনেই বলতে থাকে দুর্গা।
-এই দুর্গা কি বলছিস তুই?
রমলাদেবীর স্পর্শে সম্বিত পায় দুর্গা।
চোখ মেলে তাকিয়ে দেখে তার মা রমলা দেবী দাঁড়িয়ে।
- মা তুমি?
-হ্যাঁ আমি, কাল সারারাত এখানেই ঘুমিয়ে ছিলি?
রমলা দেবীর আলতো স্পর্শ করে বলেন।
- মা তুমি জানো মা দুর্গা স্বয়ং এসেছিলেন আমার কাছে। উনি আমায় ওনার সাথে নিয়ে যেতে চান।
- তাই বুঝি।
মৃদু হাসেন রমলা দেবী।
- কিন্তু মা, ষষ্ঠী যে পেরিয়ে গেলো, ওরা তো প্রতিমা নিতে এলো না। তাহলে কি ওরা এই প্রতিমা নেবে না? আমি যে এত পরিশ্রম করে মায়ের মূর্তি গড়লাম। সেটার কি হবে?
গলা ধরে আসে দুর্গার।
- তুই একবার সেই ক্লাবে গিয়ে খোজ নিতে পারিস তো।
- হুম আজ যাব।
সপ্তমীর সকালে দুর্গা বেড়িয়ে পড়ে সেই ক্লাবের উদ্দেশ্যে, ক্লাবে পৌছেই যা দেখে তা দেখে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না।কান্নায় ভেঙে পড়ে দুর্গা। সেখানে পূজো হচ্ছে কিন্তু অন্য প্রতিমা দিয়ে। সে যে এত দিন দু চোখের পাতা এক করতে পারেনি তার কোন মূল্য নেই।
ক্লাব ঘরের কাছে গিয়ে সে রাজশেখর কে দেখতে পায়।
তার কাছ থেকে প্রতিমা না নেওয়ার কারণ জানতে চাইলে বলে,
- তুমি বড্ড ছোট, এতবড় দুর্গা প্রতিমা কি আর একা তৈরী করতে পারতে? তার মধ্যে তুমি আমার সামনে হাত জোড় করছিলে সেই জন্যই সামান্য টাকা দিয়েছিলাম।
- কিন্তু আমি যে সারা দিন রাত খেটে প্রতিমা গড়েছি। আপনি চাইলে দেখতে পারেন।
কান্না জড়ানো গলায় বলে ওঠে দুর্গা।
- কিন্তু আমরা তো অন্য জায়গায়
থেকে প্রতিমা আনিয়েছি।
- এবারে আমার প্রতিমার কি হবে? বলুন আপনারা? কেন এমন করলেন আমার সাথে?
একটা প্রতিমা গড়তে কত সময়, কত খরচ লাগে সেসব জানেন আপনারা?
অঝোর ধারায় কেঁদে ওঠে দুর্গা।
দুর্গার কান্না দেখে রাজশেখর সামনে এগিয়ে আসে, দুর্গার দু কাধে হাত রাখে,
-তুমি চিন্তা কোরনা, তোমার প্রতিমা গড়ার টাকা দিয়ে দেব। দশমীর দিন ক্লাবে এসো..
- সত্যি বলছেন?
চোখে মুখে বিস্ময় তখন দুর্গার।
- হ্যাঁ, সত্যি।
দুর্গার চোখের জল মুছিয়ে দেন রাজশেখর।
দুর্গা পূজোটা কেটে এমনি করে দুর্গার। তার ছোট ভাই নতুন জামা প্যান্ট পড়ে পাড়ার দুর্গা মন্ডপে সারাদিন কাটিয়ে দেয়।
দুর্গাকে অমন পুরোনো শাড়ি পড়তে দেখে চোখ আর গাল অশ্রুসিক্ত হয় রমলা দেবীর।
দুর্গার বাবা ঋণের দায় মেটাতে না পেরে ঘরেই গায়ে কেরোসিন ঢেলে আত্মহত্যা করেছিল। আর দরমার ঘরে যা ছিল সবই পুরে ভস্মীভূত হয়ে যায়।
সপ্তমী অষ্টমী নবমী পেরিয়ে আজ বিজয়া দশমী।
মা দুর্গার আজ বাপের বাড়ি ছেড়ে শ্বশুর বাড়ি যাওয়ার দিন। পূজোর এই কটা দিন দুর্গার তৈরী মৃন্ময়ী মূর্তিতে প্রতিদিন পুকুর থেকে পদ্ম এনে শিউলি ফুল তুলে মাটির প্রদীপ জ্বালিয়ে আরাধনা করে গেছে।
রাজশেখর বাবুর কথা মত দুর্গা গিয়ে উপস্থিত হয় সেই ক্লাবের দুর্গা মন্ডপে।
তখন সকল এয়োস্ত্রী রা সিঁদুর খেলায় মত্ত।
পাশেই জোড়ে জোড়ে ঢাক বাজছে।
বিদ্যার্থী ছেলে মেয়েরা হাতে বই নিয়ে মা সরস্বতীর চরণে ছোয়াতে এসেছে।
দূর থেকে সব কিছু দেখতে থাকে দুর্গা। নিজের মনেই হেসে ওঠে। অন্য দের আনন্দ করতে দেখে নিজেও সেই আনন্দ উপভোগ করে।
এমন সময় কাঁধে কারও আলতো পরশ পায়।
চমকে ওঠে দুর্গা, পেছন ফিরে দেখে রাজশেখর বাবু।
- ওহ আপনি? আমি আপনার কাছেই এসেছিলাম, আজ টাকা দেবেন বলেছিলেন?
দুর্গার চোখে তখন একটা উত্তেজনা লক্ষ্য করা যায়।
- হ্যাঁ দেব বৈকি.. ক্লাব ঘরে এসো।
রাজশেখর বাবু কে অনুসরণ করে দুর্গা ক্লাবের ঘরের দিকে যায়।
দুর্গা মন্ডপের পেছনেই ক্লাব ঘর।
দুর্গা ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখে রাজশেখর ছাড়াও সেখানে রয়েছে আরও অনেক কয়েক জন।
সকলেই দুর্গার ওপর লোলুপ দৃষ্টিপাত করে।
মাথার এলোকেশী, শারীরিক গঠন, চোখে মুখের চাহনি যেন তাদেরকে ব্যাকুল করে।
বাইরের ঢাকের আওয়াজ আর মিউজিক সিস্টেমের আওয়াজটা বুঝি আগের তুলনায় দ্বিগুণ জোড়ে বেজে ওঠে।
মন্ডপে তখন চলছে দুর্গা প্রতিমা বরণ।
আর ক্লাব ঘরেও আর এক দুর্গার বরণ হচ্ছে তখন।
কেউ মা দুর্গার গালে পান ছুইয়ে দেয়।
আর এক দুর্গার গাল তখন পর পুরুষের হাতের ছোয়ায় খুবলে যাচ্ছে। কেউ বা মিষ্টি মুখে পুড়ে দিচ্ছে মৃন্ময়ী মূর্তির দুটি ঠোটের মাঝে আর ক্লাব ঘরের দুর্গার ওষ্ঠযুগল তখন নর পিশাচের দলের ওষ্ঠযুগলের মাঝে বন্দী।
কেউ বা মা দুর্গার হাত থেকে অস্ত্র গুলো তুলে নিচ্ছে। আর এদিকে স্বয়ং দুর্গার ছেড়া শাড়িটা মেঝেতে লুটোপুটি খাচ্ছে।
প্রাণহীন দুর্গার গালে মুখে সিদুর মাখিয়ে দিচ্ছে এয়োস্ত্রীরা। আর জীবন্ত দুর্গার শরীরে তখন সিগারেটের ছ্যাকা।
আর্তনাদ করতে থাকে সমাজের জীবন্ত দুর্গা।
কিন্তু কারও কান পর্যন্ত পৌছোয় না সেই আর্তনাদ।
কয়েক ঘন্টা কেটে যায়, কিন্তু নরপিশাচের শরীরের জ্বালা মেটেনা। কেউ বেড়িয়ে যায়, আবার অন্য কেউ ভেতরে ঢোকে। এভাবে সকাল দুপুর পেড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে যায়।
বস্ত্র হীন দুর্গা তখন মেঝেতে অচেতন হয়ে পড়ে গোঙাতে থাকে। দুর্গার তখন মৃত প্রায় অবস্থা।
ক্লাব ঘর ছেড়ে একে একে সবাই বেড়িয়ে যায়।
রাজশেখর ক্লাব ঘর থেকে বেড়িয়ে দরজায় খিল দিতে নেবে এমন সময় কারও ডাকে চমকে ওঠে সে।
- রাজশেখর বাবু..
- হ্যাঁ বলুন..
- আপনি সত্যি মহান। পূজোয় এবার আপনি যা খরচ করেছেন তার তুলনা হয় না।
আর মা দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী কে যে শাড়ি দান করেছেন তাও তো বেশ দামী।
এবছরের দুর্গা পূজোর পুরোহিত সহাস্যে রাজশেখরকে জানায়।
- আপনি খুশি তো?
- হ্যাঁ হ্যাঁ খুব খুশি। প্রতিবছর যদি আপনি দুর্গা পূজোর দায়িত্ব টা নেন তো....
- ঠিক আছে সেসব পরে হবে।
সন্ধ্যারতি সম্পূর্ণ করে দুর্গা প্রতিমা বিসর্জনের জন্য জন্য নিয়ে যাওয়া হয় নদীর তীরে।
এদিকে অচেতন দুর্গার কানের কাছে কেউ ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে,
- কি রে দুর্গা, যাবিনা আমার সাথে? যাওয়ার সময় যে হয়ে এলো।
ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকায় দুর্গা। সারা শরীরের জ্বালা যে আর সে সইতে পারছে না। যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে ওঠে দুর্গা। কিন্তু দুর্গা মন্ডপ তখন ফাকা কেউ নেই দুর্গার আর্তনাদ শোনার।
মেঝে থেকে শাড়িটা তুলে নিয়ে কোনরকম গায়ে জড়িয়ে বেড়িয়ে আসে সে।
আজ যেন শরীরের ভারটা বেশী বোধ হচ্ছে দুর্গার।
শাড়ির আঁচল তখন মাটিতে ছুয়ে যাচ্ছে।
চারিদিকের আলোর রোশনাই এখন সব অন্ধকার।
এদিকে দুর্গার মা, ভাই উন্মাদের মত খুজে বেড়াচ্ছে দুর্গাকে।
আর দুর্গা ধীরে ধীরে নদীর তীরে গিয়ে দাঁড়ায়।
হাওয়ার দাপটে দুর্গার এলোকেশী আর অগোছালো আঁচল উড়তে থাকে।
নদীর অদূরে সবাই দুর্গা প্রতিমাকে সাত পাক ঘোড়াতে থাকে।
শেষে সবাই উচ্চস্বরে বলে ওঠে,
-বলো দুর্গা মাঈ কি...
নদীতে বিসর্জন হয় মৃন্ময়ী মূর্তির..
আর তখনই নদীতে ঝাপ দেয় জীবন্ত দুর্গা..
দুর্গার শাড়ির আঁচলটা জলের ওপরে ভাসতে দেখা যায়। ধীরে ধীরে সেই মৃন্ময়ী মূর্তি ভাসতে থাকে আর তার সাথে গিয়ে মিলিত হয় জীবন্ত দুর্গার নিথর দেহ।
দুই দুর্গা তখন ভাসতে ভাসতে চলেছে কৈলাসে।
- তোমরা আমার দুর্গাকে দেখেছো গো?
কান্না জড়ানো গলায় বলে ওঠে রমলা দেবী।
- হ্যাঁ দেখেছি তো, দুর্গা এখন কৈলাস গেছে আবার পরের বছর আসবে।
মদ্যপ অবস্থায় থাকা একটি কমবয়সী ছেলে বলে ওঠে।