চড়াই পাখি
চড়াই পাখি


ক্লাস টু এ পড়ে ছোট্ট সবুজ।করোনা ভাইরাসের জন্য স্কুল এখন অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ। তাই তার স্কুল যাওয়া বন্ধ,বাইরে খেলাধূলো বন্ধ। সারাদিন ঘরের মধ্যেই ছবি আঁকা, বই পড়া, কার্টুন দেখা চলছে। সবুজের যে আর ভালো লাগে না বাড়িতে থাকতে, মাঝে মাঝেই দোতলার ঘরে বসে জানালা দিয়ে বাইরের দূর দূরান্তটা দেখতে থাকে। কখনও বা ছাদে গিয়ে বসে একাই।একদিন দুপুরে খাওয়ার পর শুয়ে আছে, হঠাৎই তার পাখির কিচির মিচিরের শব্দে ঘুম ভেঙে যায়।চোখ মেলতেই দেখে একটি চড়াই পাখি তার বিছানার ওপর দিয়ে উড়ছে আর চি চি চি করছে। যেন সবুজকে সে কিছু বলতে চায়...
- হুস হুস...যাহ..সবুজ হাত উচিয়ে বলতে থাকে আর পাখিটাকে তাড়ানোর চেষ্টা করে। কিন্তু নাহ পাখিটা তবুও যায় না।
- কি হয়েছে তোর..?কিছু বলবি..?সবুজ বিছানা থেকে নেমে পাখিটার কাছাকাছি গিয়ে বলে। পাখিটা সবুজের কথা বুঝি বুঝতে পারলো, সে দরজা দিয়ে বেড়িয়ে যেতেই সবুজ চড়াই পাখিটাকে অনুসরণ করে। চড়াই পাখিটা দোতলার ছাদের ঘরে গিয়ে আরও উচ্চস্বরে চিৎকার করতে থাকে। সবুজ দেখতে পায় ছাদের ঘরের ওপরের দিকে একটা ফাকা জায়গায় চড়াই পাখিটা বাসা করেছে,আর সেই দিকেই একটি হুলো বেড়াল ধীর পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে।ছোট্ট সবুজ বুঝতে পারে এইজন্যই বুঝি চড়াই পাখিটা তাকে ডেকে এনেছে। সবুজটা ঢিল ছুড়তেই হুলো বেড়ালটা মিয়াও করে পালিয়ে গেল। বাসার দিকে এগিয়ে সবুজ দেখার চেষ্টা করে সে দেখে সেখানে দুটো ছোট্ট চড়াই পাখির বাচ্চা। মুখ টা হা করে চি চি চি করছে।
- তোর বাচ্চার আর ভয় নেই,আমি এসে গেছি। না,সবুজের কথা বুঝি চড়াই পাখি টা বুঝতে পারলো।পাখিটা আনন্দে সবুজের মাথার ওপর উড়ে বেড়াতে লাগলো আর চি চি চি চি করতে লাগলো যেন সবুজকে ধন্যবাদ জানাচ্ছে। এরপর থেকে প্রতিদিন সে চড়াই পাখিটা সকাল বেলায় সবুজের বিছানার ওপর দিয়ে উড়ে বেড়াতো আর চি চি চি করতো। আর সেই চড়াই পাখির ডাকেই সবুজের ঘুম ভাঙে। চড়াই পাখিটা যেন সবুজের অ্যালার্ম হয়ে উঠলো। আর নিয়ম করে প্রতিদিন সবুজ সেই চড়াই পাখির বাসায় গিয়ে খোজ নেয়, বাচ্চা গুলো কতটা বড় হোল। হঠাৎ একদিন চড়াই পাখিটা আর সবুজকে ডাকতে এলো না। চড়াই পাখিটা না আসায় সবুজ ছুট্টে ছাদের ঘরে যায়,গিয়ে বাসাটাতে উকি দিতেই দেখে বাচ্চা গুলো আছে কিন্তু ওদের মা নেই। সেদিন সারাদিন চড়াই পাখিটার জন্য সবুজ অপেক্ষা করলো কিন্তু চড়াই পাখিটা আর এলো না। ছাদের ঘরে সবুজ গিয়ে দেখে,বাচ্চা গুলো মুখ টা হা করে চিচিচি করছে,এই বুঝি তাদের মা তাদের জন্য খাবার এনে মুখে ঢেলে দেবে। সবুজের বাচ্চা গুলোর জন্য খুব কষ্ট হোলো, সে ফুল বাগান থেকে ছোট ছোট পোকা, কেঁচো, তারপর বিস্কুট এসব এনে বাচ্চা গুলোর মুখে দিতে লাগলো। এভাবে তিন চারদিন কেটে গেল কিন্তু চড়াই পাখিটা আর এলো না। এমনই একদিন দুপুর বেলায় মনমরা হয়ে জানালার ধারে বসে আছে সবুজ, সে দেখতে পায় একটি লোক খাচা করে পাখি নিয়ে যাচ্ছে। সে দৌড়ে নীচে নেমে আসে, সবুজ লোকটিকে চিনতে পারে, এই লোকটি তাদের পাড়াতেই থাকে। সবুজের কি মনে হোল সে লোকটির পিছু পিছু যায়, গিয়ে দেখে তার বাড়িতে মস্ত একটা বড় খাঁচা বানিয়েছে..যেখানে লোকটা অনেক ধরণের পাখি ধরে খাঁচায় ভরে রেখেছে। আর সেটা দেখতেই পাড়ার অন্য বাচ্চারাও এসে ভিড় জমিয়েছে। অন্য বাচ্চারাও বেশ আনন্দ পাচ্ছে। কিন্তু পাখি গুলোকে খাঁচায় দেখে সবুজের মনে কষ্ট হোল। সে ওই লোকটিকে কিছু বলতে পারলো না, সেখান থেকে সড়ে আসতেই সেই চেনা চড়াই পাখির চিচিচি শব্দটা তার কানে আসে। সে চারপাশে তাকিয়ে চড়াই পাখিটাকে খুজতে থাকে। তারপর সে দেখতে পায় চড়াই পাখিটা খাঁচার ভেতরে বন্দী।আর চড়াই পাখিটাও সবুজকে দেখে চি চি চি করে ডাকতে থাকে। যেন বলতে চাইছে,
-সবুজ আমায় এখান থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে যাও, আমার যে বাচ্চারা না খেয়ে আছে। সবুজের চোখটা ছলছল করে ওঠে। সে লোকটির কাছে গিয়ে বলে..
- কাকু..তুমি এভাবে পাখি গুলোকে ধরে রেখেছো কেনো..? ওদের ছেড়ে দাও না প্লিজ.. কাঁদো কাঁদো গলায় বলে ওঠে সবুজ।
- এই এই..যা যা ভাগ এখান থেকে..পাখি গুলো ধরেছি কি ছেড়ে দেওয়ার জন্য..?
- প্লিজ কাকু ওদের ছেড়ে দাও না..ওই পাখি গুলোর বাচ্চারা নিশ্চই কোথাও তাদের মা বাবার জন্য অপেক্ষা করছে। লোকটা কোন উত্তর দেয় না।
- প্লিজ কাকু,আচ্ছা ওই চড়াই পাখিটাকে ছেড়ে দাওনা প্লিজ,ওই পাখিটার বাচ্চা গুলো খুব কাঁদছে..দাও না ছেড়ে..
- এই তুই তো বেশি কথা বলছিস রে..?চল ভাগ এখান থেকে... সবুজ কে সেখান থেকে লোকটা দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয়। সবুজ বাড়িতে এসে নিজের ঘরে ঢুকে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে থাকে। চড়াই পাখিটার কথা ভাবতে ভাবতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়ে সবুজ। সারা শরীর গরম হয়ে ওঠে, প্রচন্ড জ্বরে দুদিন বিছানা থেকে উঠতে পারে না সবুজ..
- কি গো..সবুজের হঠাৎ করে এমন ধুম জ্বর এলো কেন গো..? সবুজের বাবা বলেন।
- সেটাই তো আমিও বুঝতে পারছি না.. বেশ তো খেলছিল,হাসছিল..হঠাৎ যে কি হোল।
সবুজের মা চিন্তিত হয়ে বলে। সবুজকে ডাক্তার দেখে যায়, ওষুধও দিয়ে যায়।
তিনদিন পর,
সবুজের শরীরটা ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে থাকে। জ্বর টা একটু কমতেই বিছানায় উঠে বসে সবুজ।কি মনে হতেই সে ছুট্টে চলে যায় সিড়ির ঘরে।গিয়ে দেখে সেই চড়াই পাখির বাসাটা নীচে পড়ে আছে।তার মধ্যে একটি বাচ্চা অদূরে মরে পড়ে আছে আর একটি বাচ্চা বাসাতেই মরে আছে।এটা দেখে সবুজ চিৎকার করে কাঁদতে থাকে.. সবুজের আর বুঝতে বাকি থাকেনা না খেতে পেয়েই বাচ্চা গুলো মরে গেছে। আজ মা চড়াই পাখিটা থাকলে বাচ্চা গুলো মরতো না।সবুজের কান্না শুনে তার বাবা মা ছুটে আসে..
- মা বাচ্চা গুলো যে মরে গেল মা।ওই লোকটা সব পাখিগুলোকে খাঁচায় ভরে রেখেছে জানোতো..?কত করে বললাম পাখি গুলোকে ছেড়ে দিতে কিছুতেই আমার কথা শুনলো না।অঝোরে কাঁদতে থাকে সবুজ। সবুজের মনের অবস্থাটা বুঝতে পারে তার বাবা মা। সবুজের বাবা লোকটিকে গিয়ে পাখি গুলোকে ছাড়ার কথা বলে কিন্তু লোকটি শোনে না এরপর তিনি বন দপ্তরে খবর দিতেই সেখানকার লোকেরা এসে পাখি শুদ্ধ খাঁচা নিয়ে বেড়িয়ে এসে খাঁচার আগল খুলে দিতেই সব পাখিরা বেড়িয়ে যায়।এদিকে সবুজ ব্যালকনিতে ঝোলানো দোলনায় আনমনা হয়ে বসে থাকে। তখনি সব পাখিরা এসে সবুজের চারিদিকে উড়ে বেড়াতে থাকে আর চি চি চি চি করতে থাকে। চড়াই পাখিটাই বুঝি সবাইকে সবুজের কথা বলেছে। চড়াই পাখিটা ছাদের ঘরে গিয়ে যেখানে বাসাটা ছিল সেটা খুজতে থাকে।সবুজও দৌড়ে যায় ছাদের ঘরে, ডুকরে কেঁদে ওঠে সবুজ।আমি তোর বাচ্চা গুলোকে বাঁচাতে পারিনি রে।না খেতে পেয়ে যে ওরা মরে গেছে।চড়াই পাখিটা চি চি চি করে সারা বাড়ি তারা বাচ্চা গুলোকে খুঁজতে থাকে কিন্তু পায় না। এরপর আর সেই চড়াই পাখিটি সবুজের ঘরে আসেনি। দিনের পর দিন সবুজ জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকে অপেক্ষা করে সেই চড়াই পাখিটার জন্য..কিন্তু সে আর আসে না..কি জানি সবুজের ওপর বুঝি তার অভিমান হয়েছে..অভিমান ভাঙলে হয়তো আবার ফিরে আসবে সে সবুজের কাছে...