আবদার
আবদার
ছুটির ঘন্টা পড়তেই সৌরভ তড়িঘড়ি স্কুল থেকে বেড়িয়ে পড়েই জোড়ে হাটতে শুরু করে।
কারণ কিছুটা দূরেই গার্লস স্কুলে তার ছোট্ট বোন ঋতমা চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ে। তারও এখনি ছুটি হবে।
প্রতিদিনই তারা দুই ভাই বোন একসাথে বাড়ি থেকে কিছুটা দূর পায়ে হেটে এসে বাসে করে স্কুলে আসে আবারও একসাথে বাড়ি ফিরে যায়।
সৌরভ এবার নবম শ্রেণীর ছাত্র। তার বোন ঋতমা কে সবসময় সে আগলে রাখে। মাঝে মধ্যে বড়দের মত শাসনও করে।
-ইসসসস দাদা আজও তুমি আসার আগে আমি স্কুল থেকে বেড়োতে পারলাম না।
প্রতিদিন বেড় হয়েই দেখি তুমি দাঁড়িয়ে আছো।
অভিমানের সুরে বলে ওঠে ঋতমা।
-এই না একদম না, আমি যতক্ষণ না আসবো ততক্ষণ কিন্তু তুই একদম স্কুল থেকে বেড় হবি না।
গম্ভীর সুরে সৌরভ বলে ওঠে।
ঋতমা কোন উত্তর দেয় না।
-কি হোল মনে থাকবে...?
ঋতমা মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকে।
সৌরভ বুঝতে পারে তার ছোট্ট বোনের অভিমান হয়েছে।
এবারে সে ঋতমার সামনে হাটু মুড়ে বসে পড়ে। আমার মিষ্টি বোনটার রাগ হয়েছে বুঝি।
ঋতমা মাথা নেড়ে সন্মতি জানায়।
-কেন... অভিমান কিসের..?
-তুমি সবসময় আমাকে নিতে আসো আমারও তো ইচ্ছে করে তোমার স্কুলে গিয়ে তোমার জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে।
আদুরে গলায় বলে ওঠে ঋতমা।
এবারে মৃদু হাসে সৌরভ।
-তুই বুঝিস না কেন বোন। তুই যে অনেক ছোট্ট, রাস্তায় কত গাড়ি চলছে, কত অচেনা লোক জন তাই তো তোকে সাবধান করি।
তুই যখন বড় হয়ে যাবি তখন তো তোকে আর নিষেধ করবো না।
এবারে বোধহয় ছোট্ট ঋতমা বুঝতে পারে।
-ঠিক আছে, তুমি যা বলবে।
-এইতো লক্ষ্মী বোন আমার, চল এবার তাড়াতাড়ি হাটতে হবে, নইলে বাস পাব না কিন্তু।
ঋতমা দাদার হাত ধরে হাটতে শুরু করে।
দুজনেই বাস স্ট্যান্ডে এসে দাঁড়ায়।
এমন সময় একটি প্রাইভেট গাড়ি এসে দাঁড়ায় বাস স্ট্যন্ডের পাশের একটি চকলেট পার্লারের সামনে।
গাড়ি থেকে একজন মধ্যবয়স্ক লোক নেমে আসে আর তার সাথেই ঋতমার বয়সী একটি ছোট্ট মেয়েও নেমে আসে।
মেয়েটি গাড়ি থেকে নেমেই ছুট্টে চকলেট পার্লারে ঢুকে পড়ে।
মধ্যবয়স্ক লোকটি বলে ওঠে, মামনি ধীরে যাও পড়ে যাবে যে।
-পাপা আজ কিন্তু আমার অনেক গুলো চকলেট চাই, চাই, চাই, চাই।
বায়না জুড়ে দেয় ছোট্ট মেয়েটি।
-এই একদম না। তোমার না দাঁতে ব্যথা। ডেন্টিস্ট আঙ্কেল কি বলেছে, ভুলে গেছো...?
-ও পাপা, আজ তো আমার জন্মদিন, প্লিজ আজ কিনে দাও আর বায়না করবো না।
মৃদু হেসে মধ্যবয়স্ক লোকটি জানায়,
-ঠিক আছে কোন চকলেট গুলো পছন্দ হয় নাও, কিন্তু বেশী নেবেনা একদম।
ছোট্ট মেয়েটি আনন্দে প্রায় গাদা খানেক ক্যাডবেরি, লজেন্স, ললিপপ নিয়ে নিল।
এই সবটাই ঘটছিল সৌরভ আর ঋতমার সামনে।
সব গুলো চকলেট সেই ছোট্ট মেয়েটি গাড়িতে নিয়ে রাখে।
-চকলেট কেনা হয়ে গেছে...?
-হ্যাঁ পাপা,
-চলো এবার তোমায় সুন্দর একখানা ফ্রক কিনে দেই।
আনন্দে নাচতে নাচতে ছোট্ট মেয়েটি তার বাবার সাথে বাস স্ট্যান্ডের পাশের একটি শপিং মলে ঢুকে যায়।
-দাদা,
একটা আলতো ডাক দেয় ঋতমা।
-কি হয়েছে বুনু
-দাদা, আমারও চকলেট খেতে ইচ্ছে করছে।
একটা কিনে দেবে?
সৌরভ হঠাৎ করে বোনের এমন আবদারটা আশা করেনি।
-তুই চকলেট খাবি...?
- হুম
-দাড়া,
বলেই সৌরভ পকেটে হাত ঢুকিয়ে কয়েন গুলো বেড় করে গুনতে থাকে,
মনে মনে ভাবতে থাকে সৌরভ,
-মাত্র দশ টাকা আছে, দুজনের ভাড়া দিয়ে দু টাকা বাঁচবে।
এই বুনু তুই কোন চকলেট খাবি..? লজেন্স এনে দেই।
-না না, লজেন্স না ক্যাডবেরি খাব।
সৌরভ কি করবে ভেবে পায় না, সে ঋতমার থেকে বড় হলেও নিজেও তো সেই ছোট্টটিই।
আর বোনের আবদার সে ফেলতেও পারবে না, কারণ ঋতমাকে যে সে বড্ড ভালোবাসে, ক্যাডবেরি না কিনে দিলে যে তার ছোট্ট বোন টি কষ্ট পাবে।
কি করবে ভাবতে ভাবতেই কিছু একটা সে ভেবে নেই।
বোনের সামনে হাটু মুড়ে সৌরভ বলে,
-চকলেট কিনে দিতে পারি, তবে তার আগে চল একটা গেম খেলি।
খেলবি...?
-হ্যাঁ খেলবো, কি গেম দাদা..?
দূরে তর্জনী নিক্ষেপ করে সৌরভ বলে,
-দ্যাখ দূরে কত্ত হলুদ রঙের ট্যাক্সি যাচ্ছে। দেখতে পাচ্ছিস?
-হ্যাঁ দেখতে পাচ্ছি।
-তুই আর একটু সামনে গিয়ে পাশ ফিরে গুনবি ওই রাস্তা দিয়ে কত গুলো হলুদ রঙের ট্যাক্সি যাচ্ছে।
-আর তুমি...? তুমি কি করবে...?
- আমমমমমম আমি এই দিকে, তোর ঠিক উলটো দিকে কত গুলো অটোরিক্সা যাবে সেগুলো গুনবো।
-বাহ দারুণ গেম তো, হাত তালি দিয়ে ওঠে ঋতমা।
-তাহলে চল শুরু করি,
তবে যতক্ষণ না আমি আসছি ততক্ষণ কিন্তু তুই পেছন ফিরে তাকাবি না। মনে থাকবে...?
-ঠিক আছে, দাদা
এভাবেই অনেক
টা সময় কেটে যায়....
সেই মধ্যবয়স্ক লোকটি আর তার ছোট্ট মেয়ে শপিং মল থেকে বেড়িয়ে আসে।
মেয়েটি আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে নতুন জামার ব্যাগটি নিয়ে গাড়িতে বসে পড়ে। কিন্তু মধ্যবয়স্ক ব্যক্তিটি তার গাড়িটির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। কিছুটা হতবাকও হয়ে যায়।
-একি এটা কি হোল...? এই কাজটা কে করলো...?
গাড়ির পেছন থেকে বেড়িয়ে আসে সৌরভ।
-আমি করেছি আঙ্কেল,
নীচু স্বরে উত্তর দেয় সৌরভ।
-তুমি গাড়িটা পরিষ্কার করেছো..?
-হ্যাঁ, আঙ্কেল আসলে আপনার গাড়িটায় এতো ধূলো পড়েছিল, তাই........
-আমি কি তোমাকে বলেছি আমার গাড়িটা পরিষ্কার করতে...?
উচ্চস্বরে বলে ওঠে সেই মধ্য বয়স্ক লোকটি।
-না, আসলে....
আগের মতই নীচু স্বরে উত্তর দেয় সৌরভ।
-মা বাবা লেখাপড়া করতে স্কুলে পাঠায় আর তোমাদের মত বেয়েদপ ছেলেরা স্কুলে না গিয়ে এই ভাবে ঘুড়ে বেড়াচ্ছো...?
-না আঙ্কেল, আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন। আসলে আমি....
কথাটা শেষ করতে না দিয়েই লোকটি আবারও উচ্চস্বরে বলে ওঠেন,
-চুপ করো বেয়াদপ ছেলে, এখনি টাকা রোজগার করার ফন্দি শুরু করে দিয়েছো? দেখে তো ভদ্র বাড়ির ছেলে বলেই মনে হচ্ছে,
-না আঙ্কেল আপনি ভুল করছেন।
-ভুল আমি না, ভুল তুমি করছো, পড়াশোনা না করে বুঝেছো....?
নিশ্চই নেশা ধরেছো কোন কিছুর, তার জন্যই টাকা চাই নয়তো এই বয়সে টাকার কি দরকার শুনি?
-প্লিজ আঙ্কেল এবার আমাকে বলতে দিন... প্লিজ
এবারে সৌরভ তার গলার স্বর একটু বাড়িয়ে নেয়।
-আপনি ঠিকই বলেছেন আমি ভদ্র বাড়িরই ছেলে। আমার নাম সৌরভ,
আমি নবম শ্রেণীতে পড়ি, আর ওই যে দূরে দেখছেন ছোট্ট মিষ্টি মেয়েটি ও আমার বোন।
ঋতমার দিকে উদ্দেশ্য করে বলে সৌরভ।
আপনি যখন আপনার মেয়েকে চকলেট কিনে দিচ্ছিলেন তখন আমার বোনেরও সেটা দেখে চকলেটের আবদার করে বসে আমার কাছে। কিন্তু আমার কাছে বাস ভাড়া ছাড়া দু টাকা আছে আর সেটা দিয়ে তো ক্যাডবেরি কেনা যাবে না। আমি বোনের আবদার যে ফেলতেও পারছি না। আমি চাইলে ভাড়ার টাকা দিয়ে চকলেট কিনে দিতে পারতাম কিন্তু এত দূরের রাস্তা হেটে বাড়ি যেতে পারতাম না। আমি পারলেও বোন তো পারবে না।
তাই ভাবলাম.......
-আর বলতে হবে না, বুঝতে পেরেছি,
সৌরভ কে কথাটা সম্পূর্ণ করতে দেয় না।
মানি ব্যাগ টা বেড় করে লোকটি একশো টাকার নোট বেড় করতেই,সৌরভ বলে ওঠে,
-না না আঙ্কেল আমার টাকা লাগবে না।
-তবে....?
-আপনি আমাকে চকলেট পার্লার থেকে চকলেট কিনে দিন তাহলেই হবে।
এবারে লোকটি মৃদু হাসে,
-ঠিক আছে তবে।
বলেই লোকটি কতগুলো ক্যাডবেরি লজেন্স এনে সৌরভ কে দিতেই,
সৌরভ বাধা দিয়ে বলে,
-এত গুলো লাগবে না আঙ্কেল, আমাকে দুটো ক্যাডবেরি দিলেই হবে।
-আরে তা কেন...? আমি খুশি হয়েই দিচ্ছি নাও না।
-না আঙ্কেল, আমাকে দুটো চকলেট দিলেই হবে আর বেশি চাই না।
লোকটি দুটো ক্যাডবেরি সৌরভের হাতে দিয়ে বলে,
-তোমাকে অনেক খারাপ কথা বলে ফেলেছি, আই অ্যাম সরি সৌরভ, তুমি সত্যিই একজন আদর্শ ছেলে, একজন আদর্শ দাদা।
-আরে কি বলছেন আঙ্কেল, আপনি যা বলেছেন না জেনেই বলেছেন। সরি বলতে হবে না আমাকে। আর তাছাড়া আমি কিছু মনে করিনি।
আমি এখন আসছি।
সৌরভ এবার একটা ক্যাডবেরি গাড়ির জানালার কাছে গিয়ে সেই লোকটির মেয়ের হাতে একটা চকলেট দিয়ে বললো, শুভ জন্মদিন বোন, আগামী দিনগুলি তোমার অনেক সুন্দর হোক।
-থ্যাঙ্ক ইউ
ছোট্ট মেয়েটি মৃদু হেসে উত্তর দেয়।
লোকটিও আর সৌরভ কে আটকায় না।
সৌরভ এবার ঋতমার কাছে গিয়ে ডাক দেয়
- বুনু
ঋতমা পেছন ফিরেই বলে
-দাদা তুমি চলে এসছো...?
- হুম, এই নে চকলেট
ঋতমা উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে,
-আরে বাহ ক্যাডবেরি
-তুই খুশি হয়েছিস?
-খুউউউউউউব
-চল এবার বাড়ি ফিরতে হবে,অনেক দেরি হয়ে গেছে,
-তুমি কিছু ভুলে যাচ্ছো দাদা
-কি...? কি ভুলে যাচ্ছি
-৫২০ টা
-কি ৫২০ টা...?
-ট্যাক্সি...! তুমি যে বললে একটা গেম খেলবে।
আমি তো গুনেছি ৫২০ টা হলুদ রঙের ট্যাক্সি ওই রাস্তাটা দিয়ে গেছে।
এবারে তুমি বলো তুমি কটা অটোরিক্সা গুনেছো...?
সৌরভা এবারে কি বলবে ভাবতে থাকে,
-আ আ আ আমি গুনেছি তো, আমমম মম ১০০ টা
দুই ভাই বোনের এই মিষ্টি সম্পর্কের কথোপকথন সেই লোকটির চোখের আড়াল হয় না।
কি মনে হোল তিনি ডাক দিতে চাইলেন সৌরভ কে,
কিন্তু... হঠাৎই বাস চলে এলো আর তারা দুজন বাসে উঠে পড়ে।
-সত্যিই আজকের ছেলেরা অনেক বেশি ভাবে, এখনি দায়িত্ব বোধ কি জিনিস বোঝে, ভবিষ্যৎটা তাহলে অনেক সুন্দর হবে আশা করি।
মনে মনেই বলে ওঠে সেই মধ্যবয়স্ক ব্যক্তিটি।