STORYMIRROR

সৌরদীপ সৌমিত্র চৌধুরী "চন্দ্রচূড়"

Horror Tragedy Inspirational

4.5  

সৌরদীপ সৌমিত্র চৌধুরী "চন্দ্রচূড়"

Horror Tragedy Inspirational

উপকার

উপকার

11 mins
1.2K

প্ল্যাটফর্ম নম্বর একেই দাঁড়াল ট্রেনটা। ছোট স্যুটকেসটা হাতে নিয়ে বগি থেকে নেমে পড়লাম 'মৌলিগ্রাম হল্ট' স্টেশনের নিঝুম প্ল্যাটফর্মে। হাতঘড়ির দিকে চাইলাম, রাত একটা। গাড়ি পাক্কা ছয় ঘণ্টা লেট, নইলে আমার এইখানে নামার কথা সন্ধ্যা সাতটার সময়। একেই জানুয়ারি মাসের প্রচণ্ড ঠাণ্ডা, তার উপর আবার চারিদিক ঘন কুয়াশায় আচ্ছন্ন। নিজের থেকে দু'হাত দূরে কী আছে, তাই ভাল করে ঠাহর করা কঠিন। আমার গরম স্যুটের ভিতরেও বেশ খানিকটা শিহরণ অনুভব করলাম।

উত্তরবঙ্গের এই ছোট্ট স্টেশনে আমি একাই নামলাম ট্রেন থেকে। কাউকে গাড়িতে উঠতেও দেখলাম না; প্ল্যাটফর্ম এক্কেবারেই জনমানবশূন্য। ভাল করে লক্ষ্য করে দেখলাম, মৌলিগ্রাম স্টেশনে মাত্র দুটো প্ল্যাটফর্ম। একটা ছোট ওভারব্রিজ সেই দুটিকে সংযুক্ত করেছে। লম্বা প্ল্যাটফর্মের পাশে লাগানো কাঠের ব্যারিকেডের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে অনেক নাম না জানা পাহাড়ি গাছগাছালি। কিছুটা দূরত্বে পর-পর মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকা ল্যাম্প-পোস্টগুলো নীরবে জ্বলজ্বল করছিল।

এইখানে ট্রেন দাঁড়ায় মাত্র দু'মিনিট। সেই ক্ষণিক সময় অতিক্রম হওয়া মাত্রই গার্ড হুইসল্ বাজিয়ে সবুজ আলো দেখালেন। তিন বার হর্ন দিয়ে ট্রেন ঝিক্-ঝিক্ শব্দ তুলে এগিয়ে চলল তার পরবর্তী গন্তব্যের দিকে। ট্রেনের অন্তিম কোচের পিছনের লাল আলোটা কুয়াশার পুরু চাদর ফুঁড়ে অনেক দূর অবধি চোখে পড়ছিল। ওটা রাত্রির তমসায় সম্পূর্ণ ভাবে বিলীন না হয়ে যাওয়া পর্যন্ত সেদিকেই নির্নিমেষে তাকিয়ে ছিলাম। ট্রেনটা প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে বেরিয়ে যেতেই আবার গোটা স্টেশন জুড়ে নেমে এল নিশীথের গাঢ় আঁধার এবং শ্মশানের নীরবতা।

ও....কথায়-কথায় তো আমার পরিচয়টাই দেওয়া হয়নি। আমি ডঃ গৌরব চট্টোপাধ্যায়। বয়স ঊনত্রিশ। থাকি কলকাতায়। এই প্রথমবার মৌলিগ্রামে এসেছি বন্ধু সরোজের নিমন্ত্রণ পেয়ে। আমি আর সরোজ দীর্ঘ দশ বছর ধরে একসাথে পড়েছি কলকাতার এক নামজাদা স্কুলে। স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে আমি যদিও ডাক্তারি পড়ার সিদ্ধান্ত নিই, কিন্তু সরোজ ঠিক করে যে সে ইন্টারমিডিয়েট অবধি পড়ে দেশে ফিরে যাবে ওর পৈতৃক ব্যবসা সামলাতে। উত্তরবঙ্গের এই প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলই হল ওর তিন পুরুষের ভিটেমাটি। বিধবা মা আর ছোট বোন কে নিয়ে ওদের সুখের সংসার। বহুদিন থেকে পীড়াপীড়ি করছিল, যাতে আমি অন্তত কিছুদিন ওর কাছে কাটিয়ে যাই। তাই এইবার ওর চিঠি পেয়ে, বেশি সাত-পাঁচ না ভেবেই বেরিয়ে পড়লাম।

কিন্তু এই তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে একটা চরম মূর্খামিও করে ফেলেছি....আমার আসার তারিখটা সরোজ কে অগ্রিম জানানো হয়নি। জেনেশুনেই কাজটা করেছিলাম, ভেবেছিলাম হঠাৎ করে সোজা বাড়িতে হাজির হয়ে ওকে একদম চমকে দেব। কিন্তু এখন দেখছি যে এইরকম উদ্ভট সারপ্রাইজ না দিলেই ভাল হতো। এত গভীর নিশুতি রাতে এই গ্রামে তো কোনও যানবাহন পাওয়ার সম্ভাবনাই নেই। আর আমার বন্ধু যেহেতু আমার আসার খবর পায়নি....তাই ও যে আমায় রিসিভ করতে স্টেশনে লোক পাঠাবে, সেই আশা করাও বৃথা। সব ল্যাজে-গোবরে হয়ে গেল ট্রেনটা লেট করে। বেশ বুঝতে পারছিলাম, আজ স্টেশনেই আমাকে নিশিযাপন করতে হবে।

প্ল্যাটফর্মের আরেক প্রান্তে এক পীতাভ আলো চোখে পড়ছিল। কুয়াশার নিবিড় আবরণ কেটে কাছে যেতেই বুঝলাম, সেই আলোর উৎস ছিল ছোট্ট একটা চায়ের গুমটির ভিতরে রাখা কালিমাখা এক টিমটিমে হ্যারিকেন। যাক, তবুও একজন জীবিত মানুষের সন্ধান মিলল! দোকানি ঝাঁপ-টাপ বন্ধ করে বাড়ি ফেরার উপক্রম করছিল। আমাকে আসতে দেখেই একটু নড়েচড়ে বসল।
"চা কত করে?"
"আজ্ঞে, চার আনা বাবু।"
এক ভাঁড় ধূমায়িত চা নিয়ে বসলাম। উত্তরবঙ্গের হাড়-কাঁপানো শীতের এক কুয়াশাচ্ছন্ন গভীর নিশীথে এই নির্জন পাহাড়ি স্টেশনের যে কী মায়াবী রূপ ফুটে ওঠে, তা আমি বলে বোঝাতে পারব না। পূর্ণিমার চাঁদ মধ্যগগনে ঝলমল করছে। তার মোহময় কিরণধারা ঘন কুহেলিজাল ছিন্ন করে গোটা স্টেশন চত্বর কে এক অপার্থিব আলো-আঁধারিতে ভরিয়ে তুলেছিল। বশীভূতের মতো খানিকক্ষণ চেয়ে রইলাম। দিনের বেলায় এই স্টেশনে হয়তো বহু মানুষের সমাগম হয়, কিন্তু রাত্রিবেলা তার কোনও চিহ্নই খুঁজে পাওয়া দায়। সত্যিই তো, এই পৃথিবীতে কত ব্যস্ততা! কত আসা যাওয়া....কত মিলন, কত বিচ্ছেদ। রয়েছে বুকভরা আনন্দ, আবার তার সাথেই পাল্লা দিয়ে আছে হৃদয়ভাঙা যন্ত্রণা। কত রকম কাণ্ডকারখানাই যে চলছে এই পৃথিবীতে! আমরা কতটুকুই বা খবর রাখি?

কোনও এক রাত্রিচর পাখির ডাকে আমার ভাবনার তার কেটে গেল। পৌনে দুটো....না, অনেক রাত হয়ে গেছে। এতক্ষণে দোকানিও তার গুমটি বন্ধ করে চলে গেছে। এখন এই স্টেশনে আমি সম্পূর্ণ নির্বান্ধব। তাড়াতাড়ি চা শেষ করে বিষণ্ণ মনে একটা পাথরের বেঞ্চে গিয়ে বসলাম। পকেট থেকে একটা সিগারেট বার করে ধরাতে যাব, হঠাৎ ওই নিস্তব্ধ প্রান্তরে এক সুরেলা কণ্ঠস্বর শুনে চমকে উঠলাম।
"এই যে, শুনছেন?"
"কে?"
চকিতে ঘুরে তাকাতেই দেখি, দূরে একটি মানুষের অবয়ব। আমার দিকেই হেঁটে আসছে। কুয়াশার দেওয়াল পার করে আমার সম্মুখে এসে দাঁড়াল সেই মূর্তি। একটা মেয়ে। বয়স হবে তেইশ-চব্বিশের কাছাকাছি। পরনে কচি কলাপাতা বর্ণের লালপাড় শাড়ি। মুখখানা বেশ মিষ্টি। মাথাভর্তি কোঁকড়ানো চুল বাতাসে এলোমেলো হয়ে উড়ছিল।

আমাকে অমন স্তম্ভিত ভাবে চেয়ে থাকতে দেখে খিলখিলিয়ে হেসে উঠল মেয়েটি। নূপুরধ্বনির মতো ওর হাসির শব্দ প্ল্যাটফর্মের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত অবধি প্রতিধ্বনিত হয়ে বাতাসে মিলিয়ে গেল। আমি খানিকটা লজ্জিত হয়ে চোখ নামিয়ে নিলাম।
"এত রাতে কোন ট্রেনের অপেক্ষা করছেন আপনি?" বলে উঠল মেয়েটা, "রাতের শেষ গাড়িটা তো ঘণ্টাখানেক আগেই বেরিয়ে গেছে।"
"জানি। ওই ট্রেন থেকেই আমি নেমেছি। গাড়িটা বিশ্রী রকম লেট করায় এইখানে ফেঁসে গেছি। আসলে আমার নামার কথা তো সন্ধ্যা বেলায়।"
"হুম, বুঝেছি।" মেয়েটা মাথা নাড়ল, "আচ্ছা আপনাকে কেউ নিতে আসেনি?"
"নাহ্...." আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম, "আমি এখানে এসেছি আমার বন্ধুর সাথে দেখা করতে। কিন্তু সে আমার আসার কোনও আগাম খবর পায়নি। এখন তো এই অজ পাড়াগাঁয়ে কোনও রিকশা-টিকশাও পাওয়া যাবে না।"
"তা ঠিক। মহা সমস্যায় পড়েছেন দেখছি।"

আমার মনে কিন্তু একটা খটকা লাগল। আমার খুব স্পষ্ট মনে আছে, আমায় বাদ দিয়ে অন্য কেউ এই স্টেশনে নামেনি। তাছাড়া এতক্ষণ ধরে তো আমি এই প্ল্যাটফর্মেই ঘোরাফেরা করছিলাম, কিন্তু ওই বৃদ্ধ চা-বিক্রেতা কে ছাড়া অন্য কোনও মানুষের অস্তিত্ব মোটেও খুঁজে পাইনি। তবে মাটি ফুঁড়ে কোত্থেকে হল এই তরুণী'টির আবির্ভাব? কী তার উদ্দেশ্য? আর কেনই বা সে আমার মতো একজন অচেনা পুরুষ মানুষের ব্যাপারে এত বেশি কৌতুহল দেখাচ্ছেন? মনে অনেকগুলো প্রশ্নের একসাথে উদয় হওয়াতে কেমন যেন এক ধাঁধায় পড়ে গেলাম।

"আচ্ছা একটা কথা বলুন," প্রাথমিক জড়তাটা কাটাবার জন্য এবার আমিই মুখ খুললাম, "আপনিও কি ওই ট্রেন থেকেই নামলেন?"
আমার এই প্রশ্নের কোনও উত্তর দিল না মেয়েটি। যেন শুনেও শুনতে পেল না। কথা ঘোরানোর ছলে বলল-
"আপনি যদি কিছু মনে না করেন, আমি কি জানতে পারি যে আপনি কার বাড়িতে যাবেন?"
"সরোজ কুমার ঘোষালের বাড়ি।"
"ও....আমি চিনি!" আগন্তুক হঠাৎ কিছুটা সপ্রতিভ হয়ে উঠল, "তা সে তো এইখান থেকে বড়জোর আধ মাইল দূর। মিছিমিছি স্টেশনে সারারাত বসে হয়রান হওয়ার চাইতে হেঁটে চলে যাওয়াটাই বেশি বুদ্ধিমানের কাজ হতো না কি?"
"কী করে যাব? আমি মৌলিগ্রামে এই প্রথমবার এসেছি। রাস্তাঘাট যে কিছুই চিনিনা।"
"তাও বটে।"
মেয়েটা খানিকক্ষণ গম্ভীর ভাবে চিন্তাভাবনা করে, শেষে একটু ইতস্তত করে বলল-
"আপনার যদি কোনও আপত্তি না থাকে, তবে আমি আপনাকে সেইখানে পৌঁছে দিতে পারি। আমি তো এই গ্রামেরই মেয়ে, তাই এখানকার সব রাস্তাই আমার নখদর্পণে।"

বুকটা ধড়াস করে উঠল। এত রাতে একটা অচেনা মেয়ের ভরসায় অজানা পথেঘাটে বেরিয়ে পড়ব? শুনেছি এসব গ্রামাঞ্চলে নাকি আজও ঠগীর দল বেরোয়। পথভ্রষ্ট পথিকদের ভুলিয়ে-ভালিয়ে এনে তাদের হত্যা করে সর্বস্ব লুণ্ঠন করে। মেয়েটা কি তেমনই কোনও দলের সঙ্গে....না না, আমি হয়তো একটু বেশিই ভেবে ফেলছি। সকাল হতে এখনও ঢের দেরি। সারাটা রাত স্টেশনে বসে-বসে জমে বরফ হওয়ার চাইতে বেরিয়ে পড়াই মঙ্গল। আর বেশি দ্বিরুক্তি করলাম না। একটা সঙ্গীও জুটে গেল; আধ মাইল পথ দিব্যি গল্প করতে-করতে চলে যাওয়া যাবে। বাকিটা ভগবান ভরসা!

"তবে তাই চলুন। অনেক ধন্যবাদ, আপনার এই উপকার আমি কোনও দিন ভুলব না।"
"সেই ভাল। শহুরে মানুষ, শেষে বিদেশ-বিভুঁয়ে এসে বিপদে পড়তেন।"
"আপনি কী করে জানলেন যে আমি শহর থেকে আসছি?"
আমার এই বোকা-বোকা প্রশ্ন শুনে মেয়েটি আবার খিলখিলিয়ে হেসে উঠল।
"বুঝব না আবার! শহরের মানুষ না হলে কেই বা এমন স্যুট-বুট পরে গ্রামের মাটিতে ঘুরে বেড়ায়? তাছাড়া মৌলিগ্রামে পা রাখা ইস্তক আপনি যেমন নাজেহাল হচ্ছেন!"
"তা অবশ্য ঠিক। আপনি নিজের সম্পর্কে তো কিছুই ভেঙে বললেন না। অন্তত আপনার নামটুকু জানতে পারি?"
"পারুল।"
যদিও নামটা যথেষ্ট প্রচলিত এবং বহুশ্রুত, তবুও কেন জানি না....এই নামটা শোনা মাত্রই আমার ভিতরটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। এই হাড় কাঁপানো শীতের মধ্যেও আমি আমার থ্রি-পিসের ভিতরে কুলকুল করে ঘামতে লাগলাম।
"আর বাক্যব্যয় করে কাজ নেই," পারুল একটু অধৈর্য্য হয়ে উঠল, "চলুন, উঠে পড়ুন এবার।"
মেয়েটা আমার আগে-আগে হাঁটা শুরু করল। আমিও হাতে স্যুটকেসটা বাগিয়ে অন্ধকারের মধ্যে ওকে চুপচাপ অনুসরণ করতে লাগলাম।

আমরা বড় রাস্তা ধরে হাঁটছি। পাথরের নুড়ি বসানো পথের দু'ধারে পাইন বা দেবদারু জাতীয় পাহাড়ি গাছের ঘন সারি। সুদূরের পর্বতমালা যেন সেই আদিম যুগের কোনও এক দার্শনিকের ন্যায় নির্লিপ্ত ভাবে দাঁড়িয়ে ছিল। পূর্ণচন্দ্র তার জ্যোৎস্নার সমস্ত ভাণ্ডার উজাড় করে সেই ধূ-ধূ প্রান্তরটা কে আলোকের বন্যায় ধুইয়ে দিচ্ছিল। পারুল আমার সামনে পথ চলতে-চলতে একনাগাড়ে বকে যাচ্ছে। কত রকমের গল্প যে শুনিয়ে চলেছে! এই গ্রামের গল্প, নিজের ছোটবেলার গল্প, এই গ্রামে জন্ম থেকে নিয়ে বড় হয়ে ওঠার কাহিনী....আরও কত কী। খুব প্রাণ খুলে আমার সঙ্গে কথা বলে চলেছে; যেন আমি ওর বহুকালের চেনা। যদিও আমি দুম করে ওর সাথে অতটা সহজ হতে পারছিলাম না। খানিকটা দূরত্ব বজায় রেখে আড়ষ্ট ভাবে হেঁটে চলেছি, আর ওর প্রত্যেকটা কথায় হ্যাঁ-হুঁ করে যাচ্ছি।

কিছুটা রাস্তা সোজা গিয়ে পারুল বাঁ দিকে বাঁক নিয়ে একটা সরু আলপথ ধরল। আমি কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই আমার মনের সন্দেহ আঁচ করে বলল-
"এই পথ দিয়ে অনেকটা শর্টকাট হবে, বুঝলেন? তবে এই রাস্তাটা ধরলে মাঝপথে দত্তদের বাগান পড়বে। আপনি ভয় পাবেন না তো?"
"কেন? ভয় পাব কেন?"
"শুনেছি ওখানে তেনাদের খুব উপদ্রব আছে কি না...."
"কাদের? চোর-ডাকাতের?"
"ধুর!" পারুল আবার নিজের সেই চিরপরিচিত হাসিতে ফেটে পড়ল, "আরে তেনাদের উপদ্রব গো, রাত্তিরে যাদের নাম নিতে নেই।"

আর বলতে হবে না। যে কোনও সাধারণ বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের পক্ষে এইটুকু ইঙ্গিতই যথেষ্ট। বুঝতে বাকি রইল না যে পারুল কাদের কথা বলতে চাইছে!
"তবে একদিক থেকে ভালই হল। আমি আপনাকে রক্ষা করে নিয়ে যাব। আমি থাকতে কেউ আপনার কোনও ক্ষতি করতে পারবে না।"
হাজার দুশ্চিন্তার মাঝেও এই কথা শুনে আমার হাসি পেয়ে গেল! মুখ ভেংচে বললাম-
"ভারি একরত্তি মেয়ে তুমি, সে নাকি করবে আমাকে রক্ষা! ভূত যেন তোমার কথায় ওঠে-বসে....আগে নিজেকে রক্ষা করো।"

অবশেষে এসে গেল সেই দত্তদের বাগান। অবশ্য এখন এই স্থানটি কে বাগান না বলে জঙ্গল বলাই বেশি সমীচীন। বেশ একটা থমথমে ভুতুড়ে পরিবেশ। দীর্ঘদিনের অযত্নের ফলে বাগানের সমস্ত গাছপালা বৃহদাকৃতি ধারণ করেছে। তাদের ডালপালাগুলো একে-অপরের সাথে জট পাকিয়ে আড়াল করে ফেলেছে গোটা আকাশটাকে। ঠাসবুনুনি পাতার ফাঁক দিয়ে যেটুকু স্বল্প জ্যোৎস্নালোক আসছিল, তা দিয়ে সৃষ্টি হয়েছিল এক বিস্ময়কর আলোছায়া। গাছের গাঢ় সবুজ পাতাগুলো নিশীথের মৃদু হাওয়ায় তিরতির করে কাঁপছিল। মাটিতে পড়ে থাকা শুকনো পাতার মোটা আস্তরণ দেখে বুঝলাম, এই পথ বহুকাল ধরে অব্যবহৃত। রাস্তার দু'ধারে অন্ধকার জমাট বেঁধে আছে। আর সেই আঁধারে আমি স্পষ্ট অনুভব করলাম, কারা যেন নিঃশব্দে সেখানে হাঁটাচলা করছে। ঠিক যেন অনেকগুলো চোখ আমাদের অগোচরেই আমাদের সব গতিবিধির উপর তীক্ষ্ণ নজর রাখছে। ভয়ে আমার গা'টা কেমন যেন ছমছম করে উঠল। পারুলের কিন্তু এসবের বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই; সেই আগের মতোই আপনমনে বকবক করতে-করতে হেঁটে চলেছে। শুষ্ক পাতায় মর্মর ধ্বনি তুলে আমরা দ্রুত পদক্ষেপে ওই অভিশপ্ত স্থান ত্যাগ করলাম।

দত্তদের বাগান পার করে কিছুদূর এগোতেই পারুল থমকে দাঁড়াল।
"এই তো! আমরা এসে গেছি। সামনে যে একটা বড় লোহার গেট দেখতে পাচ্ছেন, ওটাই হল ঘোষালদের বাড়ির ফটক। আপনি চলে যান। আমি তাহলে এবার আসি।"
"মানে?" আমি আকাশ থেকে পড়লাম, "এই অন্ধকারে আপনি একা-একা কোথায় চললেন? এত রাতে আমি কোনও মেয়েকে একা ছেড়ে দিতে পারিনা। আমিও আপনার সঙ্গে যাচ্ছি।"
"আরে না না, আপনি ব্যস্ত হবেন না। আমার বাড়ি তো এই সামনের দুটো বাড়ি ছেড়েই। আমি ঠিক চলে যেতে পারব। শুভ রাত্রি।"
আমি কিছু বলার আগেই পারুল হনহন করে হেঁটে কুয়াশার মধ্যে মিলিয়ে গেল। কিছুক্ষণ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে থেকে আমিও আবার ধীর পদে হাঁটা দিলাম সরোজের বাড়ির দিকে।

আশ্চর্য ব্যাপার! এই মুহূর্তে আমার হাতঘড়ির কাঁটা প্রায় তিনের ঘর ছুঁইছুঁই, কিন্তু বাড়িতে এখনও আলো জ্বলছে। দরজাটাও হাট করে খোলা। সটান ভিতরে ঢুকে গেলাম। সামনের ঘরে দাঁড়িয়ে তিন-চার বার নাম ধরে ডাকতেই সরোজ বেরিয়ে এল।
"একি! গৌরব....তুই?"
"হ্যাঁ রে, অনেকদিন ধরে আসতে বলছিলি। তাই আজ সশরীরেই হাজির হয়েছি। কিন্তু এ কী দেখছি? তোর চোখে জল কেন রে?"
"ওইসব কথা পরে হবে। তুই আগে ভিতরে আয় দেখি, এত দূর থেকে এসেছিস...."
"বাজে কথা বাদ দে ভাই। আগে আমাকে সব কথা খুলে বল তো, কী হয়েছে?"
সরোজ বলবে কী? সে নিজেই দু'হাত দিয়ে মুখ ঢেকে কান্নায় ভেঙে পড়ল।
"আমার সবকিছু শেষ হয়ে গেল রে ভাই। আমার ছোট বোনটা...."
সরোজ আমাকে হাত ধরে টানতে-টানতে নিয়ে গেল পাশের ঘরটায়। সেই ঘরে ঢুকে ভিতরকার দৃশ্য দেখে আমার হাত থেকে স্যুটকেসটা প্রায় খসে পড়ল।

ঘরে বেশকিছু লোকজনের ভীড়। সবার মুখেই গভীর শোকের কালো ছায়া। একদিকে দাঁড়িয়ে কিছু ছোট-ছোট বাচ্চা হাপুস নয়নে কাঁদছে। কয়েকজন মহিলা মিলে সাদা থান পরা এক বৃদ্ধা (সম্ভবতঃ সরোজের মা) কে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। আর ঘরের ঠিক মাঝখানে শোয়ানো আছে এক নারীর মৃতদেহ। ফর্সা রং, মাথায় কোঁকড়া চুল। এবং তার গায়ে সেই কচি কলাপাতা রঙের লালপাড় শাড়ি। গলায় রজনীগন্ধার মোটা একখানা হার। মুখমণ্ডল জুড়ে খেলে বেড়াচ্ছে এক অদ্ভুত শান্তি। পুরো ঘরটা পরিপূর্ণ হয়ে ছিল ফুল আর ধূপকাঠির সুগন্ধে।
"আমার ছোট বোন পারুল," সরোজ ডুকরে উঠল, "আমাকে আর মা কে একা ফেলে রেখে...."

পারুলের শেষ কৃত্য সমাধা করে শ্মশানঘাট থেকে ফিরতে আমাদের সকাল হয়ে গেল। পরে সরোজ আমায় সবকিছু খুলে বলেছিল।
"কাল বিকেলে পারো জল আনতে নদীতে গিয়েছিল। আমাদের গ্রামে তো জলের ভীষণ সঙ্কট, তাই বাড়ির বেশিরভাগ কাজের জন্য নদীর থেকেই জল তুলে আনতে হয়। পারো রোজকার মতো কাল বিকেলেও গিয়েছিল নদীর ঘাটে। জল তুলে উঠে আসার সময় ও দেখে যে একটা বছর পাঁচেকের বাচ্চা জলে হাবুডুবু খাচ্ছে। বোধহয় স্নান করতে-করতে বেশি গভীরে চলে গিয়েছিল। আমার বোন কোনও দিকে না তাকিয়ে ওকে বাঁচাতে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু পাহাড়ি নদীর ভীষণ তোড়ে নিজেকে সামলে রাখতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত বাচ্চাটা রক্ষা পেয়ে গেল। কিন্তু ফুসফুসে অতিরিক্ত জল ঢুকে যাওয়ার ফলে পারো কে আর বাঁচানো গেল না। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল; ডাক্তার ওকে পরীক্ষা করেই মৃত বলে ঘোষণা করে দেয়।"

আমি সরোজ কে বুকে জড়িয়ে ধরলাম। বড় মায়া লাগছিল বেচারা কে এই অবস্থায় দেখে।
"আমার বোনটা বড় ভাল ছিল রে," আমার বুকে মুখ গুঁজে সরোজ ফোঁপাতে-ফোঁপাতে বলল, "সবার বিপদে-আপদে পাশে দাঁড়াত। দুঃস্থ শিশুদের বিনামূল্যে পড়ানো থেকে শুরু করে গরীব-দুঃখীদের খাবার ও বস্ত্রদান করা, এইসব কাজে মেয়েটার ছিল অগাধ উৎসাহ। শেষে কি না ওরই কপালে এমনটা লেখা ছিল?"
বিধির লিখনের উপর আমি আর কী বলব? বন্ধুকে সর্বশক্তি দিয়ে আঁকড়ে ধরে ওর পিঠ চাপড়াতে লাগলাম।

পরে একদিন সকালবেলা সরোজ প্রাতঃরাশের টেবিলে বসে আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল-
"হ্যাঁরে গৌরব, তুই তো এখানে এই প্রথমবার এলি। তা অত রাতে আমাদের বাড়ি চিনে পৌঁছলি কী করে?"
"আমাকে একজন তোর বাড়ি অবধি পৌঁছে দিয়েছিল।"
"বলিস কী রে! কে তোকে ওই ভুতুড়ে ঠাণ্ডার মধ্যে পথ চিনিয়ে আনল?"
সেই মুহূর্তে তখন ওর প্রশ্নের কোনও উত্তর দিইনি আমি। মৃদু হেসেছিলাম শুধু।
"আচ্ছা ভাই, আসার পথে তুই দত্তদের বাগানের পথটা ধরিসনি তো?"
"আমি ওই পথ ধরেই এসেছিলাম।"
"অ্যাঁ...! হায় ভগবান! এ আমি কী শুনছি?" চমকে উঠেছিল সরোজ, "ওই রাস্তা তো কেউ দিনের আলোতেও মাড়ায় না। শুনেছি নাকি ওই দত্তদের বাগানটা ভাল জায়গা নয়।"
"কে আমার ক্ষতি করত সরোজ? আমার সঙ্গে যে সাক্ষাৎ আমার রক্ষাকবচ ছিল। সে থাকতে কেই বা আমায় ছুঁতে পারত?"
"রক্ষাকবচ....মানে?"
আমি চায়ের পেয়ালাটা টেবিলে নামিয়ে রেখে সরোজের কাঁধে হাত রেখে বলেছিলাম-
"তুই ঠিকই বলেছিলি রে। পারুল সত্যিই বড় পরোপকারী ছিল। এবং ওর বিপদগ্রস্ত মানুষের সাহায্য করার স্বভাবটা কিন্তু এখনও একটুও পাল্টায়নি। মৃত্যুর পরেও না।"

**** সমাপ্ত ****


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Horror