ত্রয়ীর নতুন কান্ড
ত্রয়ীর নতুন কান্ড
ব্যাঙ্ক ডাকাত ধরায় সাহায্য করায় 'ত্রয়ী' তথা রিক, বিষ্টু, মন-এর শহরে এখন বেশ নাম ডাক; ক্ষুদে হলে কি হবে, ওদের বুদ্ধিমত্তায় সকলেই চমৎকৃত। রিকের মামা রঙ্গন
যে কোন অপরাধের রহস্য উদ্ঘাটনে আনঅফিসিয়ালি রিকদের সাহায্য নেয়। শহরের যত ছিঁচকে, বদমাস-ও এখন রিকদের সমীহ করে চলে। শুধু যে যার বাড়িতে এখনো বাবা-মায়ের শাসনের অধীন; এ বিষয়ে মন-এর অবস্থা সবচেয়ে খারাপ কারণ ওর তিন কাকা ও দুই
পিসি-ও ওদের সঙ্গে থাকে, অতএব বকুনির চাপ মন-এর ওপর সবচেয়ে বেশী।
সর্বভারতীয় একটা আবৃত্তি কম্পিটিশনের প্রস্তুতির জন্য বিষ্টু আর মন মাস্ক লাগিয়ে রিকদের বাড়ি চলে এসেছে। রিকের মা ওদের জন্য গরম গরম লুচি, তরকারি বানিয়েছে। বিষ্টু খুব ভাল আবৃত্তি করে, ইতিমধ্যেই প্রচুর
প্রাইজ পেয়েছে, ও-ই বাকীদের গাইড করছে, আবৃত্তি চর্চার ফাঁকে গল্প-ও চলছে। গল্পের ফাঁকে বিষ্টু জানালো,
দুজন নাইজেরিয়ান ওদের বাড়িতে ভাড়া এসেছে ; অন্যরকম কিছু দেখলে বা শুনলে রিকের ষষ্ঠেন্দ্রীয় বরাবর-ই সজাগ হয়ে যায়, ও বিষ্টুকে নিয়ে পড়ল আর বায়না ধরল বিকেলেই ওদের বাড়ি যাওয়ার। যদিও বিষ্টুর মা এই সামাজিক দূরত্বের দিনে ঘরে কাউকে বিশেষ ঢুকতে দিচ্ছেন না; রিক যাবে আর মন যাবে না, ওই বা বাদ থাকে কেন, ঠিক হল সবাই আজ যাবে বিষ্টুদের নতুন
ভাড়াটেদের সঙ্গে আলাপ করতে; যদিও মন বাড়ির থেকে
অনুমতি পাবে কিনা জানা নেই, তবে বিচ্ছু মনের অনেক উপায় জানা আছে ফসকে বেরিয়ে যাওয়ার।
বিকেল পাঁচটায় বিষ্টুদের তিনতলার ফ্ল্যাটের ডোরবেল বেজে উঠল, বাইরে অপেক্ষারত তিন ক্ষুদে। বিষ্টু একটু আড়ালে ছিল, সামনে মন আর রিক। দরজা খুলেই দশাসই চেহারার নাইজেরিয়ান জিজ্ঞেস করল, "কে কা আই মি,"- ওদের হকচকে মুখের দিকে তাকিয়ে বলল," হু আর ইউ"। বিষ্টু ততক্ষণে আড়াল থেকে বেরিয়ে এসেছে, ওকে দেখে বেরিয়ে আসা দ্বিতীয় নাইজেরিয়ান বলল, "আ দি ম মা," মন আর রিককে চমকে দিয়ে বিষ্টু বলল-
"নাদি উনো কানু।" পরের আলাপচারিতা অবশ্য ইংরেজিতে চলতে রইল। ঘরের মধ্যে খুব সুন্দর সুন্দর কাঠ ও ব্রোঞ্জের নানানরকমের মুখোশ সাজানো, মন আর
রিক সেগুলো ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকল। ঘরে যীশুখ্রীষ্টের
ছবিও আছে, ওদের গলাতেও ক্রশের চেন, খ্রীষ্টানই মনে হল। একজন ডিবেল, অপরজন স্যামি। রান্নাঘরে স্যামি কিছু রান্না করছিল, ডিবেল জিজ্ঞেস করল,-"ফু ফু জিকে রে," সঙ্গে সঙ্গে স্যামি ওদের জন্য গরম গরম সুপ নিয়ে এলো। কি সুন্দর গন্ধ, খেতেও অভিনব, নতুনরকম সব মশলার স্বাদ পেল খেতে খেতে। ডিবেলের ফোন আসায় পাশের ঘরে চলে গেল; রিক ও ঘরের কথা শোনার জন্য
কান খাড়া করে রইল, ডিবেল কাকে যেন বলে চলেছে -
" গিনে মেরে উনে ই ই না অবিনঘি ওয়া ওয়া;" ও দিক থেকে কি উত্তর এলো বোঝা গেল না, এদিক থেকে ডিবেল বলল, "আগে ম আগে ইচি।" রিক চুপিসারে উঠে গিয়ে পাশের ঘরে উঁকি দিল, দেখল সেখানে প্রচুর ডেস্কটপ, ল্যাপটপ রাখা আছে। ডিবেল রিককে দেখে ফেলল, রিক স্পষ্ট উপলব্ধি করল ডিবেলের চাহনিতে আর বন্ধুত্বের আহ্বান নেই। সেদিনের মতো ওরা ফিরে এলো, যার যার বাড়িতে।
রিকের মামা রঙ্গন, স্থানীয় থানার ওসি, ভাগ্নে খাবে বলে
একটা বড় ইলিশ মাছ নিয়ে এসেছে; রিকের মা সেই মাছ কাটতে নাস্তানাবুদ হচ্ছে আর মামার সঙ্গে গল্প করছে।
রিক চোখের দৃষ্টিতে মামাকে ডেকে নিজের পড়ার ঘরে চলে গেল, রঙ্গন ওর ঘরে যেতেই বিষ্টুদের নতুন ভাড়াটেদের গল্প করল। মামাকে জিজ্ঞেস করল," ওরা যে
ভাষায় কথা বলছিল ওটা কি?" মামা বলল, "যতদূর জানি ওটা ' ইবো' ভাষা, নাইজেরিয়ার স্থানীয় ভাষা। মূলত শিক্ষা, চাকরি বা চিকিৎসার কারণেও ওরা ভারতে
আসে। রিক যেন বাইরে থেকে আসা লোকজনের সঙ্গে বেশী মেলামেশা না করে, একথা বার বার বলতে থাকল।
এইসময় থানা থেকে রঙ্গনের ফোন এলো, কারা যেন এক ভদ্রলোকের ব্যাঙ্ক একাউন্ট থেকে পাঁচ লক্ষ টাকা তুলে
নিয়েছে। রিক টাকাপয়সার ব্যাপারে অত ইন্টারেষ্ট পায় না, তবুও মামার ফোনের কথাগুলো রিকের মনে গেঁথে গেল। পরদিন মন আর বিষ্টুকেও জানালো ওই অপরাধের
কথা, যা সে জেনেছে। রিককে হঠাৎ দেখে ফেলে ডিবেলের চাহনির বদলের কথাও জানাতে ভুলল না। ঠিক হল বিষ্টু ওদের ওপর নজর রাখবে।
বিষ্টু তিনতলায় ডিবেলদের দরজায় আড়িপাতা শুরু করেছে, যদিও ওদের কথা বুঝতে বেশ অসুবিধে হয় আর
ভেতরের ঘরের কথা তো দরজা অব্দি আসে না। থ্রি মাস্কেটিয়ার্স ঠিক করল, আর একদিন ডিবেলদের ফ্ল্যাটে
হানা দেবে। এই কথামত ওরা মুখে হাসি ঝুলিয়ে, হ্যাবলা বাচ্ছা সেজে ওই বাড়িতে গিয়ে হাসি গল্প জুড়ে দিল, স্যামি, ডিবেলও তাতে যোগ দিল। রিক এক ফাঁকে ভেতরের ঘরে ঢুকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কয়েকটা পেনড্রাইভ পকেটস্থ করল। এ ঘরে এসে কার কি হবি, এই
আলোচনায় যোগ দিল, কথায় কথায় জানল ডিবেলরা কোন পড়াশোনার কারণে এ দেশে আসে নি। পাছে পরিস্থিতি বিগড়োয় রিক বিষ্টুকে একটা চিমটি কেটে ফেরার তাড়া লাগাল।
বাড়ি ফিরে মামা রঙ্গনকে পেনড্রাইভগুলোর কথা জানালো, মামা থানা থেকে ফেরবার পথে এসে ওগুলো
রিকের কম্পিউটারে চালালো। প্রথম কয়েকটায় নাইজেরিয়ার স্থানীয় নাচ, উৎসব এগুলোর ভিডিও; দেখতে দেখতে একজায়গায় চোখ আটকে গেল, যেখানে
প্রচুর প্রচুর লোকজনের ব্যাঙ্ক ডিটেলস্, দ্যাখা গেল টাকারা কেমন ডানা মেলে উড়ে এক অ্যাকাউন্ট থেকে অন্য কারো অ্যাকাউন্টে জমা পড়ছে। মামা পেনড্রাইভগুলো নিয়ে গেল ও জানিয়ে গেল, আজ রাতেই
ডিবেলদের ফ্ল্যাটে রেড হবে।
রিক কি আর থাকতে পারে; বিষ্টু, মনকে জানিয়ে বাড়ি থেকে লুকিয়ে বেরিয়ে সবাই বিষ্টুদের ছাদে জড়ো হল।
ওপর থেকে ওরা দেখল, বিশাল পুলিশবাহিনী বিষ্টুদের বাড়িটা ঘিরে ফেলছে। বিষ্টুর বাবাকে রঙ্গন ওভারটেলিফোন সব জানিয়ে রেখেছিল, নিজেদের দরজা বন্ধ রাখারও নির্দেশ ছিল। রিকরা ছাদের দরজা থেকে লক্ষ্য রাখছিল, ডিবেলদের ঘরে ধুপধাপ আওয়াজ
শোনা গেল, মনের বেশ ভয় লাগছিল, যদি গোলাগুলি চলে তাই ভেবে। পুলিশবাহিনী ডিবেলদের ঘরে,- গুলির শব্দ শোনা গেল, হঠাৎ স্যামি ছাদের দরজার দিকে এগিয়ে এলো; একটা ড্রামে ছেঁড়া একটা মশারী রাখা ছিল, মন দিল ছুঁড়ে ওটা স্যামির গায়ে, বন্দুক চালানোর
আগেই হতচকিত স্যামিকে বেঁধে ফেলল রিক আর বিষ্টু।ওদিকে রঙ্গন-ও ডিবেলকে বাগে এনে ফেলেছে। দুজনের
আর ট্যাঁ-ফো করার উপায় ছিল না। বিষ্টুর বাবা-মা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে কাঁপছে। বিষ্টু, রিক আর মন পরস্পরকে জড়িয়ে ধরল উত্তেজনায়। সাইরেন বাজিয়ে পুলিশের গাড়ি নিয়ে গেল, দুই হ্যাকারকে।
ত্রয়ীর পালকে যোগ হল নতুন মুকুট, রিক, বিষ্টু, মনরা শহরে ভিআইপির মর্যাদা পেল। পাল্টা কোন আঘাত যাতে না আসে, তার জন্য ওদের বাড়ির সামনে কিছুদিন পুলিশ মোতায়েন ছিল। কাগজে কাগজে তিন ক্ষুদের কীর্তি প্রকাশিত হল, নিষ্পাপ তিন ছেলে-মেয়ে, কিন্তু মগজাস্ত্রে অনেক বাঘা গোয়েন্দাকে টেক্কা দিতে পারে।