তৃপ্তি
তৃপ্তি
নীল প্রাইভেট টিউশন পড়তে যাবে। এখন অমল স্যারের কাছে পড়া। তিনি রিটায়ার করেছেন প্রায় ছ'সাত বছর। তবু ছেলে মেয়েদের অনুরোধে এখনও পড়িয়ে চলেছেন। প্রতি বছরই ভাবেন আর সামনের বার থেকে পড়াবেন না। কিন্তু কোন বারই তা হয়না। যে কোন ভাবেই হোক তাকে চিন্তার পরিবর্তন করতে হয়। এ বছরও সেই একই ঘটনা ঘটেছে।
অমল স্যার বাংলা পড়ান । ছাত্র ছাত্রীদের চাহিদা দেখেই বোঝা যায় পড়ানোর ক্ষেত্রে তার দক্ষতা আর কায়দা অন্যদের থেকে আলাদা। তাই হয়তো
তার কাছে সবাই ছুটে আসে।
তবে অমল স্যার নিজে এখন বুঝতে পারেন পড়াশোনা এখন আর আগের মত নেই। একেবারে আকাশপাতাল পরিবর্তন হয়ে গেছে। তিনিও চেষ্টা করছেন তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে। তাতে তার পড়ানোর ধরন পাল্টে গেছে তিনি নিজেই বেশ বুঝতে পারছেন।
তবু তিনি তার সমস্ত মন দিয়ে ছাত্র ছাত্রীদের চাহিদা পূরণের চেষ্টা করেন। আর তাতে সফল হয়েছেন বলেই এখনও তার টিউশনি চলছে। রিটায়ারের পর এতটা মন দিয়ে হয়তো সবাই পড়ায় না সেটাও একটা কারণ।
নীল স্যারের ঘরে যখন ঢুকলো তখনও তিনি পড়াতে বসেননি। ও গিয়ে প্রতিদিনকার মতো পিছনের জায়গাটায় গিয়ে বসল। সামনে জায়গা ফাঁকা থাকলেও ও বসবে না। অবশ্য তার একটা কারণ আছে। পড়াশোনায় ওর মন বসে না সবার মতো। সুযোগ পেলেই দুষ্টুমিতে মেতে ওঠে। কখন কিভাবে কার পিছনে লাগবে এটাই ওর মাথায় ঘোরে মনে হয়।
অমল স্যার তার সমস্ত ছাত্র-ছাত্রীদের স্বভাব সম্পর্কে সচেতন। নীলের সম্পর্কেও তিনি ভালোই জানেন। প্রতিদিনই সে কিছু না কিছু এরকম কাজ করে। পড়ানোর সময় ও এমন ভাব করে যে স্যারের পড়ানোর দিকে ভালোভাবে খেয়াল করছে। আসলে কিন্তু ওর মন তখন অন্যদিকে কাজ করছে। হঠাৎ করে সামনে থেকে দেখলে বোঝা যাবে না ভেতরে ভেতরে কি চলছে।
দু' দিন আগে এরকম একটা ঘটনা ঘটিয়েছিল নীল। স্যার তখন পড়াচ্ছিলেন। প্রতিদিনকার মত ও পেছনেই বসেছিল। বাকিরা সবাই স্যারের পড়ানোর দিকে মনোযোগী থাকলেও নীলের সেদিকে খেয়াল ছিল না। ওর মাথায় তখন ওর স্বভাব মতো দুষ্টু বুদ্ধি খেলছিল। ওর সামনে বসে থাকা অমিতাভের পেছনে দড়ি দিয়ে একটা কাগজ ঝুলিয়ে দিচ্ছিল বেল্টের সঙ্গে। স্যারের পড়ানো শেষে যখন ও উঠলো তখন সবার নজরে এটা পড়লে সারা ঘর ছাত্র-ছাত্রীদের হাসির শব্দে ভরে উঠলো।
কারণ অনুসন্ধান করার পর দেখা গেল এর পেছনে নীল রয়েছে। অমল স্যার মুচকি হেসে বললেন,' শুধু দুষ্টুমি করলে হবে না পড়াশোনাটাও একটু কর। ভবিষ্যতের কথাটাও তো ভাবতে হবে।'
নীল মাথা নিচু করে চুপ করে থাকে। অমল স্যারও তার ছাত্র ছাত্রীদের কড়া কথা বলেন না বা তাদের ওপর রাগারাগি করেন না। আগেকার মতো পড়ানোর পদ্ধতি থাকলে অন্য শিক্ষকেরা হয়তো তাদেরকে শাস্তি দিতেন তাদের দুষ্টুমির জন্য। কিন্তু অমল স্যার আগেও যেমন ছিলেন এখনো তাই। সহজ সরল নরম স্বভাবের। ছাত্র-ছাত্রীদের এরকম বিভিন্ন ধরনের আচরণ তার কাছে তাদের বয়স হিসাবে স্বাভাবিক মনে হয়। তিনি ভাবেন এটাই তো বয়স দুষ্টুমি করার।
অমল স্যার ঘরে ঢুকতেই ছাত্র-ছাত্রীরা চুপ করে গেল। সবাই একটু যেন অবাক হল আজ। কেননা তার হাতে ছিল একটা নতুন অ্যান্ড্রয়েড ফোন। স্যার সাধারণত এই ফোন ব্যবহার করেন না। এতদিন তিনি পুরোনো মডেলের একটা বোতাম টেপা ফোন ব্যবহার করতেন। যুগের সাথে তাল মেলাতে তিনি এই নতুন ফোনটি নিয়েছেন। এই ফোনে ফেসবুক হোয়াটসঅ্যাপ এইসব করা যায় বলে সকলের সঙ্গে যোগাযোগের সুবিধা হবে। তাই তিনি এই ফোনটা নিয়েছেন।
তবে এই ফোন চালানোর ব্যাপারে তিনি অনেকটাই অনভিজ্ঞ। তিনি তার সামনে বসে থাকা অভিজিৎকে ফোনটা দিলেন। আর ওকে বললেন ফোনটা যাতে তিনি ঠিকঠাক ব্যবহার করতে পারেন তার ব্যবস্থা করে দিতে। অর্থাৎ সবার সঙ্গে ফেসবুক হোয়াটসঅ্যাপে যাতে যোগাযোগ করতে পারেন তার ব্যবস্থা করতে। অভিজিৎ পড়াশোনায় ভালো তাই এটা ও ভালো পারবে বলে স্যার ওর কাছে ফোনটা দিলেন।
কিন্তু অভিজিৎ স্যারকে বলল এইসব ফোনের ব্যাপারে নীল ভালো জানে। স্যার তাই ফোনটা নীলকে দিতে বললেন। তিনি একটু অবাক হলেন এই ভেবে যে এই কাজটা অভিজিতের চেয়ে নীল ভালো পারে। হতেই পারে না হওয়ার কিছু নেই। পৃথিবীতে এক একটা কাজ এক একজন ভালো পারে।
স্যার অভিজিৎ এর কাছ থেকে ফোনটা নিয়ে নীলকে কাছে ডাকলেন। নীল চুপচাপ উঠে এসে স্যারের পাশে দাঁড়ালো। স্যার নীলকে ফোনটা দিলেন। নীলের কাছে এসব জল ভাত। একেবারে মুহূর্তের মধ্যে ও ফোনে স্যারের চাহিদামত সব জিনিস ইন্সটল করে দিল। তারপর স্যারকে ফেসবুক আর হোয়াটসঅ্যাপ কিভাবে চালাতে হবে সেটা বিজ্ঞের মতো বোঝাতে লাগলো।
অমল স্যারও যেন বাধ্য ছাত্রের মত সব কিছু শিখতে লাগলেন। তারপর ফোনটা নিয়ে নিজেই চালাতে লাগলেন। প্রথম প্রথম ঠিকঠাক করতে পারছিলেন না। তাতে যেন বিরক্ত প্রকাশ করছিল নীল। ভাবটা এমন যে,' এত সহজ ব্যাপারটা স্যার বুঝতে পারছেন না? '
স্যারও যেন একটু লজ্জায় পড়ে যান। একটু মুচকি হাসেন তিনি। আবার নীলের কাছ থেকে তিনি ব্যাপারটা বুঝে নেন। আর তারপর আগের চেয়ে বেশ ভালো ভাবেই সেটা চালাতে পারলেন। এবার স্যার আর নীল দুজনেই যেন খুব খুশি হল। এই বয়সে এসে নতুন একটা প্রযুক্তির ব্যবহার শিখতে পেরে মনে মনে বেশ আনন্দিত হলেন অমল স্যার। নতুন একটা জিনিস শেখা গেল। আসলে তিনি তো জানেন শিক্ষার কোনো শেষ নেই। এই বয়সে এসেও কিছু শেখা যায়।
ওদিকে যে স্যার ওদের শেখায় তাকে কিছু শেখাতে পেরে নীলের মনে বেশ আনন্দেই হচ্ছিল। কাউকে কোন কিছু শেখানোর মধ্যে এত আনন্দ আছে সেটা মনে হয় ও প্রথম আজ বুঝতে পারল। স্যারও তো ওদের কত কিছু শেখায়। তাহলে তিনিও তো রোজ এ রকম আনন্দ পান। নীল মনে মনে ভাবল আজ থেকে স্যারের পড়ানোর সময় আর দুষ্টুমি নয় মনোযোগ দিয়ে শেখার চেষ্টা করবে।
ওর বসার জায়গায় ফিরে যেতে যেতে অনুভব করল কাউকে কোন কিছু শেখাতে পারার মধ্যে এক অদ্ভুত তৃপ্তি। সেই তৃপ্তিটাই ফুটে উঠেছিল নীলের চোখেমুখে।
নীল ওর জায়গায় বসার পর স্যারের চোখে মুখেও যেন দেখতে পেল একইরকম তৃপ্তির চিহ্ন। তবে সেটা শিখতে পারার জন্য। নীল বুঝতে পারল কোন কিছু শিখতে পারার মধ্যেও তৃপ্তি রয়েছে।