তন্ত্র শক্তি ( পঞ্চম পর্ব)
তন্ত্র শক্তি ( পঞ্চম পর্ব)
সেদিন পরিচয় ও কুশল বিনিময় পর মালতী এ ঘটনা সব বলে ,আকুতিভরা আবেদনে জানাল, কোন ভালো তান্ত্রিক, এবিষয়ে তাদের কোন ভাবে সাহায্য করতে পারে কিনা!
হরিশ ভীষণ পরোপকারী ও দ্বায়িত্বশীল মানুষ মালতীর মনে হয়েছিল।কিন্তু দিনের পর দিন মালতী ফোন করলে সেই এক উত্তর আসে ,"আমি আপ্রাণ চেষ্টায় আছি বোন, ভুলে যায় নি ।"
মালতী ফোনে কথা বলার মধ্যেই কেঁদে ফেলত, বলত আমার স্বামী দিন দিন কেমন হয়ে যাচ্ছে।আপনার তান্ত্রিক আসার আগে কী হবে জানি না, ততদিন ও থাকবে তো ! বড় দুশ্চিন্তার আছি শঙ্কায় ঘুম হয় না ।
মালতীর হরিশ কে খুব ভরসা বিশ্বাস করেছিল নিকট আত্মীয়র মত সেটা সত্যিই হল। ছদিন পর হরিশ জানাল, "এক বড় তান্ত্রিকের সন্ধান পেয়েছি, ভৈরব নারায়ণ মহারাজ, যিনি আপনি যার কথা বলেছেন সেই, দিব্যজ্যোতি তান্ত্রিকে চিনতেন। একশো পাড় করে সে বছর দশ মারা গেছেন।
ভীষণ উগ্র আর নেগেটিভ মনের মানুষ ছিলেন দিব্যজ্যোতি তান্ত্রিক, তন্ত্র বিদ্যায় ওর মস্ত জ্ঞান ছিল, কিন্তু কু কাজে ব্যয় করতেন, ভৈরব নারায়ণ তান্ত্রিক মহারাজের সাথে উনার বনাবনি হত না। তর্ক লেগেই থাকত।
ভৈরব নারায়ণ জীর মতে কঠোর বাস্তব আর সত্য স্বীকার করলে পৃথিবীটা সুন্দর হত না, জগতে সংসার থাকত না। কত সন্তান সন্ততি অসময়ে বাবা মাকে দেখে না, নির্যাতন জ্বালাতন করে, যাদের জন্য অপমান অসম্মান হয় ,মৃত্যুরও কখনও কারণ হয়, যড়যন্ত্র করেও কখন সন্তান সন্ততিরা মারে, নিজের হাতে হত্যা করার উদাহরণ অনেক আছে।
তাই বলে কী বাবা মা তাদের শিশু সন্তানদের বুকে রেখে আদর করে মানুষ করে না! নিজের জীবনের চেয়েও ভালো বাসে না !ভালো মন্দ ,আলো আধাঁর, কুৎসিত সুন্দর, এই নিয়েই সংসার ,তাই জগত এত রহস্যের, এত বিচিত্র, সব সত্য স্বীকার , কঠোর বাস্তবকে অনুসরণ করলে জীবন ধারণ আর বেঁচে থাকার অর্থ কী ! তাই সংসার হল মায়া আর ভ্রম । কিন্তু এর জন্য কে দায়ী এ বোধ বিচার করা যেমন যথার্থ নয়,তেমনি সংসারে কোন কিছুতে নিরাসক্ত হতে পারো, কিন্তু ঘৃনা বিদ্বেষ পাপ, এই সব দর্শন নিয়ে তাদের তীব্র মতভেদ হতো। ভৈরব নারায়ণ তান্ত্রিক, দিব্যজ্যোতির নেগেটিভ দর্শনকে অশ্রদ্ধা করতেন ,মস্ত তান্ত্রিক হলেও উনাকে মানতেন না।
যাক তিনি চ্যালেঞ্জ নিয়েছেন, আরও এবিষয়ে চর্চা করছেন, অন্য তান্ত্রিকদের সাথে তিনি আলোচনা করছেন ,কিন্তু কাল বিলম্ব চলবে না, সময় যে কম উনি নিজেই বললেন। তাই আগামী কালই উনি কালকা মেলে উঠবেন, আমি উনার যাতায়াতের সব টিকিট করে দিয়েছি, তৎকালে একটু বেশী ভাড়া লাগলেও সময় নষ্ট করা যাবে না।"
মালতী বলল, " টাকার কথা ভাববেন না ,আমি উজার করে দেবো, আমার স্বামীকে ঐ দুষ্ট আত্মার অভিশাপ শুধু মুক্ত করুন। "
"আমি সব বুঝেছি, আর জীবনে টাকাই সব নয়, বিশ্বাস আসল,আপনাদের সাথে গতবছর আলাপ হয়ে ভীষণ ভালো লেগেছিল, সম্পর্ক টা আরও গভীর হোক। যাক কাজের কথায় আসি, পরশু সকালে উনি বর্ধমানে নামবেন, আপনারা গাড়ি নিয়ে হাজির থাকবেন, ওখান থেকে কি যেন কোথায় !"
মালতী বলে," সিউড়ি,বর্ধমান থেকে একশ কিমি দুর, আমরা উনাকে গাড়িতে নিয়ে যাব। "
হরিশ বলে "ঐ ঘরে উনি যাবেন,আপনি আপনার স্বামীকে সঙ্গে থাকতে হবে। উনি কোন গৃহ বাস করেন না , সন্ধ্যার মধ্যেই বর্ধমানে ফিরতে হবে আটটায় ট্রেন, বর্ধমান থেকেই ধরবেন । "
নবীন আজ নদিন হল, দুষ্ট আত্মার তন্ত্র শক্তির বলে অভিশাপে কেমন হয়ে পরছিল। মালতীর পাশে শুয়ে তার প্রতি আসক্তি দুরে থাক, তার স্পর্শে চমকে ওঠে, রাতে বাথরুম গেলেও ভয়, মালতীকে পাশে থাকতে হয় ।সব সময়ই কেমন উদভ্রান্ত আতংকিত, ভয়ে শঙ্কিত, ক্লান্ত অবসন্ন তাকে গ্রাস করেছে। এ কদিনে তার বয়স হঠাৎই যেন বেড়ে গেছে ,চুল পেকেছে, হাতের জোর কমেছে, গায়ের চামড়া কেমন অল্প জড়া ভাব হয়ে যাচ্ছে ,যেন সত্তর ধাক্কা মারছে।
মালতী কেমন দিশেহারা ,বাড়ির বাইরে তারা বের হয় না, ছেলেটা বাইরে পড়াশোনা করে কিছুই বলা হয়নি, কিন্ত মেয়েটাকে দিন দিন কেমন উদভ্রান্ত বিষন্ন দেখাচ্ছিল, চুপচাপ বাবার কাছে বসে থাকে নীরবে , সামনে তার পরীক্ষা কিন্তু পড়াশোনায় মন বসছে না। এটা কোন জটিল রোগ তার ধারনা ।
দুষ্ট আত্মার অভিশাপ তাকে বলা হয়নি।তাহলে ভয় পাবে, সে তো আরও বিপদ! রাতে একা ঘরে শুতেই পারবে না। বাড়িটা কেমন নিশ্চুপ নীরব হতাশায় ঢেকেছিল।কাজের মেয়েটি এলে অবাক হয়ে মাঝে মাঝেই নবীনের দিকে তাকাত, এমন কেন কাকুটা হয়ে যাচ্ছে ! উদাসীন নবীন দিন দিন নিয়তীকে মেনে নিচ্ছিল। মালতী, নবীনের আড়ালে স্বামীর এই অকাল বার্ধক্য মেনে নিতে না পেড়ে কাঁদত, ঈশ্বর কে ডাকত।
সেদিন বর্ধমান স্টেশনে তান্ত্রিকসিদ্ধ ভৈরব নারায়ণ স্বামী কালকা থেকে নামলেন। গাড়িতে কামারকুন্ড থেকে ভোর চারটে বের হয়ে সাড়ে পাঁচটায় মালতী নবীনকে নিয়ে বর্ধমান স্টেশনে, গাড়ি বাইরে রেখে প্লাটফর্ম টিকিট কেটে , দুই নম্বর প্লাটফর্মে তারা তীর্থের কাকের মত কখন কালকা মেল থেকে তান্ত্রিক বাবা ভৈরব নারায়ণ অবতারন করেন,তার প্রতিক্ষায়, তার বর্ননা ও মোবাইল নম্বর হরিণর কাছে নেওয়া ছিল। ভৈরব নারায়ণের কাছেও মালতীর মোবাইল নম্বর ছিল।
এতসব দরকার হল না। ট্রেন থেকে একজনই গেরুয়া বসনে, সৌম দর্শন, এক সত্তরের আশপাশ তান্ত্রিক সন্ন্যাসী নামলেন, দেহের বর্ণনা মিলে গেল, তাই মালতী ছুটে গেল, ভুমিষ্ঠ হয়ে প্রনাম করল। নবীন কেমন যেন ভ্যবলাকান্ত হয়ে গেছে। স্ত্রীই এখন তার গার্জেন, একমাত্র তাকেই ভরসা করে , তাই স্ত্রীকে অনুসরণ করে তান্ত্রিককে প্রনাম করলে তান্ত্রিক তাকে নির্ভয় আশ্বাস দিলেন।
আগে থেকেই নবীন পলাশ আগ্রওয়াল কে তাদের যাবার কথা বলে,অনুতপ্ত পলাশ সেদিন সব কাজ ফেলে তাদের গোডাউনে দশটার পর থেকেই ছিল। কালকা সেদিন সাতটায় বর্ধমানে ইন করে।তারপর গাড়িতে সিউড়ি যেতে প্রায় সাড়ে দশটা হল।নবীন ভীষণ ভয় আর আরষ্ট অনুভব করছিল, পলাশদের গোডাউনের দোতলায় সে উঠতে ভীষণ যেন ভয় পাচ্ছিল। তান্ত্রিক বাবা, মালতী,আর পলাশ অনেক সাহস দিল,তবু কেমন সে থতমত। এই সব তান্ত্রিক আসার কথা কোন ভাবেই কাউকে জানতে দেওয়া হয়নি। গোডাউনের কর্মচারীদের ও বলা হয়নি।
তখন এগারটা, তান্ত্রিক হিন্দিতে মালতীকে অনেক কিছু নির্দেশ পরামর্শ দিল।মালতী হিন্দি সিনেমা,ও সিরিয়াল দেখার কারনে হিন্দি মোটামুটি বোঝে। মালতী এবার পলাশ আগ্রওয়ালদের গোডাউনের ঐ অভিশপ্ত দোতলার দক্ষিণমুখী ঘরের চাবি ভাঙ্গতে মানসিকভাবে তৈরী। আজ সে যেন কোন বিপদকেই পরোয়া করছে না, বেপরোয়া। তান্ত্রিক ভৈরব নারায়ণ বললেন আজ যা কিছু কর্ম মালতী করবে, কারণ পরে বলব।নির্দেশ মত শাবল দিয়ে ঠুকে তালা ভেঙ্গে খোলা গেল, তান্ত্রিক বললেন, "দরজা খুললে ঘরে বেশ উত্তাপ পাবে, ভয় পাবে না,এক দৌড়ে ,এক নিশ্বাসে বিক্রম বাহাদুরের সমাধিস্থ দেহে স্বজোড়ে ধাক্কা মারবে।কোন ভয় নেই মা, আমি তন্ত্র বলে তোমার সঙ্গেই থাকব ।"
মালতী দরজা খুলে তান্ত্রিকে নির্দেশ মত তপ্ত ঘরের মধ্যেই দৌড়াল,আর সাধ্য মত জোরে ধাক্কা মারল বিক্রম বাহাদুরের সমাধিস্থ শরীরে ।মুহুর্তে সমাধিস্থ দেহ ভেঙ্গে চুরমার হল, কটা হাড়গোর খাটে পড়ে রইল, আর ঘরের উচ্চ তাপমাত্রা তৎক্ষণাৎ কমে স্বাভাবিক হল। তান্ত্রিক আনন্দে চিৎকার করে উঠলেন "জয় বাবা ভোলা নাথ।" তারপর বললেন "ওর মুক্তি হল, ওর তন্ত্র শক্তি শেষ, নবীন বাবা এখান তুমিও অভিশাপ মুক্ত, সাধারণ মানুষ। "
তান্ত্রিক বাবা ভৈরব নারায়ণ তার পর যা বললেন, তান্ত্রিক সিদ্ধ, দিব্যজ্যোতি ছিলেন চরম নারী বিদ্বেষী।একমাত্র যে সব পুরুষেরা নারী সঙ্গ ত্যাগ করেছে, তাদের শিষ্য করতেন ও, তন্ত্র শিক্ষায় বলীয়ান করতেন ,সঙ্গে অভিশাপ থাকত নারী সঙ্গ হলেই তার সব তন্ত্র ক্ষমতা লুপ্ত হবে। মালতীর স্পর্শে তাই তার তন্ত্র ক্ষমতা লুপ্ত হয়, তার শরীর ষাট বছর পুরোন কোন মৃতের দেহের যা হাল হয়, কয়েক খন্ড হাড়ে যা পরিনত হল ।
তন্ত্র ক্ষমতা গুনে তার ঘরে উচ্চ তাপ বিরাজ করত। দরজা থেকে গিয়ে তাকে স্পর্শের আগেই যে কেউ দগ্ধ হয়ে মারা যাওয়া নিশ্চিত ছিল।আমি তন্ত্র শক্তি বলে,মালতীর সারা শরীর ঘিরে অদৃশ্য সুরক্ষা বলয় তৈরী করেছিলাম ,তাই মালতী তীব্র তাপ থেকে রক্ষা পায়। সেই সঙ্গে মালতীর স্পর্শে বিক্রম বাহাদুরে দুষ্ট আত্মার তন্ত্র শক্তি খতম হয়। সূর্যোদোয় থেকে সূর্যাস্ত এই সময়কালে বিক্রম বাহাদুরকে সমাধিস্থ শরীরেই থাকতে হত।তবে তন্ত্র বলে অলৌকিক ক্ষমতা অধিকারী থাকত। আর তাকে রক্ষা করত তন্ত্রের অলৌকিক ক্ষমতা গুনে উচ্চ তাপ তার ঘরে বিরাজ করত, তাকে ঘিরে অদৃশ্য সুরক্ষা বলয় থাকত, যা তার শরীরে তাপ স্পর্শ করত না।
ওর অলৌকিক শরীর প্রাপ্ত হত রাতে,রাত সাড়ে দশটা থেকে ভোর সাড়ে চারটে, ঐ সময় তার ইচ্ছা অনুসারে, যে কোন মানুষের দৃষ্ট হত হতে পারত। প্রতিদিন রাতে তার ঘর ও দিব্যজ্যোতির তান্ত্রিকের ঘর, উপরের বাথরুম টয়লেট সে যাতায়াত করত, ব্যবহার করত।এই সব ঘরে কারও উপস্থিতি রাতে তার অসহ্য ছিল। এতদিন কেউ এই এলাকায় কেউ রাতে ব্যবহার করত না, বাথরুম টয়লেট পরীক্ষা পরিচ্ছন্ন করলেও ব্যবহার কেউ করত না,তাই কারও উপর তার ক্ষোভ ছিল না, দেখা দিত না, অভিশাপ দেবার প্রশ্ন আসে না।
নবীনকে প্রথমদিন সতর্ক করে, কারণ নবীন তার কোন ক্ষতি করেনি,কোন অনাচার তার গুরুগৃহে করলেও তা না জেনে সেদিন করেছিল, তাই তাকে একটা সুযোগ দেয়। কিন্ত তাকে অগ্রাহ্য করা, আর চ্যালেঞ্জ করা ,জেনে বুঝে গুরুগৃহে অনাচার তাকে ভীষণ রুষ্ট করে। তার অভিশাপ একবার দিলে মৃত্যু নিশ্চিত ছিল। তাই সহসা কারোর উপর খুব ক্ষোভ না হলে অভিশাপ নিক্ষেপ করত না।
বৃটিশ পুলিশের সেমময় কালে বিপ্লবী সন্দেহ করলেই ভয়াবহ নির্যাতন অনাচার অত্যাচার চালাানোর কথা তিনি জানতেন, তাই বৃটিশ ভৃত্য পুলিশদের প্রতি তার তীব্র ক্ষোভ ছিল, আবার তাকে ধরতে আসছে তাই অনাচার নির্যাতন আর অপমানের হাত থেকে বাঁচতে সে স্বেচ্ছায় সমাধিস্থ নেয় ,ঘরে তন্ত্র বলে উচ্চ তাপ তৈরী করে যাতে কেউ তার সমাধিস্থ শরীর ছুঁতে না পারে,অনাচার নির্যাতন দুরে থাক ।
তার আভিজাত্যের অহংকারকে পায়ে দলিয়ে, তার গৃহে এসে, অনুগত গোকুলকে লাথ মেরে ফেলে ঘরের চাবি ভেঙ্গে তার ঘর অপবিত্র করা,ও তাকে গ্রেফতারের স্পর্ধায় এতটাই ক্ষোভ সঞ্চার করে, তার তন্ত্র শক্তির অভিশাপ তিনজন পুলিশের উপর প্রয়োগ করে। এর ফলে, অভিশপ্ত ব্যক্তিদের এক প্রহর অন্তর, তিন মাসের সময়কাল আয়ু ক্ষয় হয়।একদিন আট প্রহরে দুই বছর আয়ু ক্ষয় হতে শুরু করল,ত্রিশ দিনে ষাট বছর,আর যাদের অভিশাপ দিয়েছিল, সবার বয়স চল্লিশের বেশিছিল, তাই এক মাসে তাদের মৃত নিশ্চিত জানায়,কারণ মানুষ সাধারণত একশ বছরের মধ্যেই মারা যায়।
কোন রোগ নয়,ডাক্তার বিভ্রান্ত, কিছুই করতে পারে না, শারীরিক ক্ষয় বার্ধক্য জনিত মৃত্যু ঠেকাতে তো কোন ডাক্তার বা কোন চিকিৎসা বিজ্ঞানে এখনও কোন কিছুই অবিস্কার হয়নি। ওদের আয়ু চুরি করে বিক্রম বাহাদুর আজও সতেজ নিজের সেই তার সমাধিস্থ কালীন বয়স দিব্যি ধরে রেখেছিল। "
মালতী এবার উৎকন্ঠা ভরা মনে জিজ্ঞেস করল , "বাবা আমার স্বামী আবার পূর্ব অবস্থার বয়স ক্ষমতা, যৌবন সব ফিরে পাবে তো !"
ভৈরব নারায়ণ বললেন, " আজ ওর অভিশপ্ত এগার দিন ছিল, ওর আয়ু ইতিমধ্যেই বাইশ বছর কমে গেছে, ওটা আর ফিরে পাবে না।"
মালতী কাঁদতে লাগল, নবীন হতাশায় থমথমে মুখে, বলল "তাহলে আমি আর কদিন !"
ভৈরব নারায়ণ এবার আশ্বাস দিলেন "তোমার পরমায়ু আমার গননা অনুসারে একানব্বই বছর, তাই আরও উনিশ বছর বাঁচবে, ঐ দুষ্ট আত্মা তোমার অমূল্য সময় পঞ্চাশ থেকে বাহাত্তর বছর সময়কাল কেড়ে নিয়েছে, ওটা ফিরিয়ে দেওয়ার সাধ্য আমার নেই।" আর মালতীকে বললেন, "এবার থেকে তুমি তোমার বাহাত্তর বছরের স্বামী ভেবে ওর সাথে সেইমত দরদী সহানুভূতিশীল আচরণ করবে। "
পলাশ আগ্রওয়াল এবার ভৈরব নারায়ণ কে প্রনাম করে ,এ গৃহে আর কোন বিপদ আছে কিনা জানতে চাইল। ভৈরব নারায়ণ, পূর্ব মুখী পাঁচ নম্বর কক্ষে গেলেন, যেখানে নবীন কৃপনতাবশত দুই রাত থেকে বাইশ বছর খোয়ালো। তান্ত্রিকের তৈলচিত্রে ভষ্মের মত কিছু যেন ছুড়ে দিলেন। সমস্ত তৈলচিত্র ছাইভষ্মের মত মেঝে কালো ভষ্ম হয়ে পড়ে গেল, আর কিছু দেওয়ালে অবশিষ্ট নেই।ভৈরব নারায়ণ বললেন, এ ভষ্ম লোহার বক্সে ভরে মাটির সুগভীরে পুঁতে দেবে, আর অমঙ্গল হবে না। প্রিয় শিষ্যের দুষ্ট আত্মার আজ বিলুপ্ত হল ,তাই এখন ও প্রতিশোধ নিতে চাইবে।আজই ওর ভষ্ম গভীর মাটির নিচে পুঁতে ফেলো।"
পলাশ এবার জিজ্ঞেস করল" আর ঐ দক্ষিণমুখী অভিশপ্ত বিক্রম বাহাদুরের ঘর কী ব্যবহার করা যাবে?"
ভৈরব নারায়ণ জানালেন,"ওর অবশিষ্ট অস্থি হাড় গঙ্গায় নিক্ষেপ করলে ওর মুক্তির সাথে সাথে এ গৃহ থেকে ওর আত্মার বিদায় হবে, এ ঘর তারপর ব্যবহার করলে, আর কোন ভয় নেই।"
ভৈরব নারায়ণ ,গাড়ি করে মালতী নবীনের সাথে বর্ধমান স্টেশন অবধি সেদিন সন্ধ্যার ফিরে আসেন তার কী পারিশ্রমিক এই কথা মালতী করজোরে আবেদন জানালে, উনি বললেন " আমার কোন পারিশ্রমিক নেই।যদি সন্তুষ্ট হও হরিশ কে সাহায্য করো, ও একটা অনাথ আশ্রমে সেই অর্থ দান করবে।" নিদিষ্ট ট্রেন ছাড়া অবধি তারা ভৈরব নারায়ণের সঙ্গে ছিলেন, কোন বাইরের খাবার তিনি খাবেন না,নিজের ঝুলি থেকে কিছু যেন বার করে খেলেন। মালতী নবীনকে দিলেন, অমৃতের মত স্বাধ, একটু আহারে যেন পেট ভরে গেল। ক্লান্তি দূর হল।
ট্রেন এল,ভৈরব নারায়ণ মহারাজকে, এবার মালতী নবীন শ্রদ্ধাভরে প্রনাম করে বিদায় জানাল, আর তীব্র আফসোস সহ ,অশ্রু ভেজা বিষন্ন মনে মালতী বলল, " আপনি ঈশ্বরের এক রূপ ,যদি আপনার দর্শন আর দশদিন আগে পেতাম !"
নবীন মানসিক ও শারীরিক ভাবে ভেঙ্গে পড়েছিল আর সরকারী চাকরীর এক দ্বায়িত্বশীল পদে কাজ করার মনোবল সাহস আর ক্ষমতা কোনটাই ছিল না।তাই অকাল বার্ধক্য জীবনে সেচ্ছাঅবসর জন্য আবেদন করে।
এবিষয়ে তার অফিসের তরফে পূর্ণ সহযোগিতার পেলেও সরকারের নিজস্ব মেডিক্যাল বোর্ডের সামনে তাকে উপস্থিত হতে হয়েছিল।তার শারীরিক ও মানসিক পরীক্ষা ও নানা মেডিক্যাল রিপোর্ট দেখে বোর্ডের ডাক্তার চিকিৎসকেরা চরম বিস্মিত বিচলিত হয়েছিলেন,একজনের এজ সার্টিফিকেট অনুসারে বয়স পঞ্চাশ, কিন্ত এক সত্তর বাহাত্তর বছরের মানুষের মত তার শারীরিক লক্ষ্যন।তার মেডিক্যাল রিপোর্টে এটাই উল্লেখ করে, তাই তার স্বেচ্ছাঅবসর আবেদন মঞ্জুর হয়।
আর মালতী হঠাৎই পঞ্চাশ আশপাশ শক্ত সমর্থ যৌবনে পরিপূর্ণ স্বামীর পরিবর্তে,এক দুর্বল অশক্ত বাহাত্তর বছরের বৃদ্ধ স্বামীর সেবা যত্ন করতে করতে কিন্তু ক্লান্ত হতাশায় ভেঙ্গে পড়েছিল ।

