সুখটান
সুখটান
বারান্দায় বসে একমনে সুখটান দিচ্ছেন সমীরণ রাহা। এই বারান্দাটা খুব প্রিয় সমীরণের। যখনই ডুয়ার্সে আসেন , আগে থাকতে সময় নিয়ে এই বনবাংলোটাই বুক করেন। বলা যায় শুধু এই বারান্দার জন্যই বাংলোটা এত পছন্দ সমীরণের।
এখানে চাঁদের আলো মাখা বন্য নির্জনতা তাকে বারবার প্রেয়সীর মত হাতছানি দিয়ে ডাকে।
রাতের খাবার খাওয়া হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। কান পাতলে শোনা যাচ্ছে শুধু টুপটাপ শিশির পড়ার শব্দ, হাওয়ার সাথে পাতাদের মরমর সংলাপ আর কখনো কখনো কোনো নাম না জানা পশুর পায়ের খসখস শব্দ। সামনের টেবিলের ওপর রাখা Wills Classic এর শেষ সিগারেটটা বের করে বাক্স টা তাক করে ছুঁড়ে দিলেন কোনে রাখা ওয়েস্ট পেপার বক্সটির দিকে। মোবাইলটার কথা সময় দেখার প্রয়োজন না হলে মনেই থাকে না এখানে। মোবাইলটা পকেট থেকে একবার বের করে দেখলেন। সময় তখন রাত ১১.৩৯। যথারীতি কোনো টাওয়ার নেই। তেমনটাই হওয়ার কথা। থাকলেই বরং অবাক হতে হত। সিগারেটটা ধরালেন সমীরণ। ঠিক করলেন এটা শেষ হলেই শুয়ে পড়বেন গিয়ে।
চেয়ারে শরীরটা আরেকটু এলিয়ে দিয়ে লম্বা টান দিয়ে বাতাসে ভাসিয়ে দিলেন ধোয়ার রিং। সেই সময়েই হালকা একটু হাওয়া এসে যেনো দুলিয়ে দিয়ে গেলো রিংটা। সমীরণ সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে পরপর আরো কয়েকটা রিং ছাড়লো। রিংগুলো পরস্পরের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে হতে যেন ভেঙেচুরে ফেলল নিজেদের। তারপর আবার জোড়া লেগে লেগে নতুন আকার নিল। চেয়ে দেখতে দেখতে সমীরন মনে মনে ভাবলো - "আজ স্কচটা এতটা না খেলেও হত। বারবার কেমন যেনো গুলিয়ে যাচ্ছে দৃষ্টি"। যদিও চাঁদের আলোয় ধোঁয়াদের এই রহস্যময় গতিবিধি দেখতে মন্দ লাগছিল না সমীরণের। কেমন যেনো একটা ঝিমধরা মাদকতা আচ্ছন্ন করে ফেলছিল তার সমস্ত চেতনাকে। সব ভুলে মোহোগ্রস্থের মত সেদিকেই ঘোলাটে চোখে তাকিয়ে রইল সমীরণ।
ধোঁয়ার শরীরটা এখন যেন কোনো তন্বীর। সে যেনো জন্মেছে সমিরনের জন্যই, যেনো তাঁর মধ্যে মিশে যেতে পারলেই সম্পূর্ণ হবে সে। তাঁর আকুতি যেনো ভেতরে ভেতরে ছুঁয়ে যাচ্ছিল, উষ্ণ করছিল সমীরণকেও। সমীরণও যেনো সেই অমোঘ মুহূর্তের জন্য মেলে দিয়েছিল নিজেকে, হয়তো বা নিজের অবচেতনেই।
হাওয়ার তালে তালে নাচতে নাচতে এগিয়ে আসতে লাগলো ধোঁয়ার অবয়বটা। আর সেই সাথে বাতাসে ভর করে একটা চাপা গন্ধও। সিগারেটের ধোয়ার মধ্যে নিকোটিনের গন্ধটা যেন ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে লাগলো।
এবার আরো কাছে, আরো এগিয়ে এলো মূর্তিটা। সমীরণ টের পেলো সেই চাপা গন্ধটাও আর চাপা নেই, পাল্লা দিয়ে উগ্র হয়ে উঠেছে। গন্ধটা একেবারেই বেমানান এই অরণ্যের মাঝে। কেমন যেন কৃত্রিম একটা মিঠে আতরের গন্ধ। মাথাটা ধরে গেলো গন্ধে আর তখনই মনে হল এই গন্ধটা খুব চেনা সমিরনের। খুবই চেনা। ব্লু বেরি পারফিউমের কি? যেটা জুঁই স্নান করে উঠে ব্যবহার করত রোজ? তা কি করে হবে? এখানে এই গন্ধ আসবে কি করে? আর কিছু যেন ভাবতে পারছিল না সমীরণ। নাকটা কেমন যেন জ্বালা জ্বালা করে উঠলো। এত বাতাসের জোর সত্ত্বেও গন্ধটা কেমন চেপে বসে রইল নাকের ওপর। মাথাটা আগের মতই একটানা দপদপ করতে লাগলো সমীরনের।
এদিকে ধোয়ার কুণ্ডলিটা তাঁকে ঘিরে ঘিরে নেচেই যাচ্ছে একটানা। সমীরণ টের পেল একসময় সেই আতরের মিঠে গন্ধটাও যেন মিলিয়ে যাচ্ছে , হাল্কা হয়ে আসছে। সমীরণ এবার যেন একটু স্বস্তি পেল। বুক ভরে একটা গভীর শ্বাস নিল । অদ্ভুত ব্যাপার। তখনই আবার মনে হল এবার যেনো ওই ধোয়ার রাশি থেকে চন্দনের গন্ধ ভেসে আসছে। কাছে পিঠে বনের মধ্যে কোনো চন্দন গাছ থাকলেও তার সুবাস কখনোই এত চড়া হবে না। এই গন্ধটা যেন অনেকটা চন্দনের গন্ধ দেওয়া ধূপকাঠির মত। এটাও তার চেনা গন্ধ। না, ডুয়ার্সের বা অন্য কোনো জঙ্গলে নয়। নিজের বা
ড়িতে, ঠাকুর ঘরে। প্রতিদিন জুঁই সন্ধ্যেবেলা ঠাকুরের সামনে চন্দনের গন্ধ দেওয়া এই ধূপকাঠিটা জ্বালাতো আর সেই করতে গিয়েই তো সেদিন....।
ঘটনাটার প্রতিটি মুহূর্ত এখনও স্পষ্ট সমীরনের স্মৃতিতে। সেটাই হওয়ার কথা। জুঁই চলে গেছে, তা তো এখনও এক সপ্তাহও হয় নি। এই তো মোটে গত বুধবারের ঘটনা। জুঁই পুজোর ঘরে অন্যদিনের মতই ধূপকাঠি জ্বালিয়ে পুজো দিচ্ছিল। বেশ হাওয়া দিচ্ছিল বাইরে।বাতাসে আঁচলটা কখন যেন উড়ে এসে জ্বলন্ত ধূপকাঠির ওপর পড়েছিল। জুইয়ের চোখ বোজা ছিল। ফলে প্রথমে বোঝেনি কিছুই। যখন বোঝে তখন সব শেষ।
ধূপকাঠি তো। তাই একটু সময় নিয়েছিল আগুনটা ধরতে। যখন আঁচলটা পড়েছিল ধূপকাঠির ওপর তখনই দেখেছিল সমীরণ। পেছন থেকে। কিন্তু কিচ্ছু না বলে চুপচাপ উঠে গিয়েছিল ছাদে। সেখানে গল্প করেছে প্রতিবেশীদের সাথে। ফলে মৃত্যুটা অস্বাভাবিক হলেও পুলিশের জেরার সামনে সমীরনের হয়ে সাক্ষী দেবার অভাব ছিল না।
সমীরণ বাবা হতে পারত না। এমনকি বিছানাতেও সুখ দিতে পারেনি জুঁইকে।বিয়ের পর থেকে এসব জানার পর থেকেই কেমন যেন সমীরণকে ঘেন্না করতে শুরু করেছিল জুঁই। সময়ে অসময়ে অকারনেই হিংস্র হয়ে উঠতো সমীরনের ওপর। এদিকে সমীরণও বাড়ির চাপে বিয়ে করে ফেললেও প্রতিদিন মুক্তি চাইতো এই সম্পর্কের হাত থেকে। জুঁইয়ের দাপটের কোনো সিদ্ধান্তই নিয়ে উঠতে পারত না সমীরণ। অফিসের কাজের নাম করে তাই এখানে ওখানে জঙ্গলে জঙ্গলে বনে বাদাড়ে ঘুরে বেড়াত। মাস ছয় কাটতে না কাটতেই এক সময় দুজনেই দুজনের কাছে অসহ্য হয়ে উঠেছিল। এমনকি সমীরণ নিজের অগোচরেই জুঁইয়ের মৃত্যু কামনা করতে শুরু করেছিল। জুঁইও কি তাই করত? জানা নেই সমীরনের। ভীতু সমীরণ জানত তার পক্ষে জুঁইকে মেরে ফেলার মত ভাবনা মাথায় আসাটাই বিশাল সাহসের কথা। সেটা হাতে কলমে করার কথা দুঃস্বপ্নেও ভাবতেও পারে না সে।
সেদিন সুযোগটা হঠাৎই চলে এসেছিল। ঠাকুরঘরে ঘটনাটা ঘটছে দেখেও জুঁইকে না ডেকে সমীরণ ঘর ছেড়ে চলে বেরিয়ে গিয়েছিল। ডাকার যে ইচ্ছে হয়নি, তেমনটা নয়। আসলে একটা অদ্ভুত সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিল তখন সে , যেমনটা তার সাথে বরাবরই হয়। অবশেষে সেদিন যেনো কোনো অদৃশ্য শক্তি তাকে টেনে বের করে নিয়ে গেছিল ঘর থেকে। জুঁইকে ওই শেষ দেখা। তারপর যখন দিশেহারা হয়ে নিচে নামে ততক্ষনে প্রায় সব শেষ।
ঘটনার পর কেটে গেছে ছয় দিন। এখনো সে নিজের এই কীর্তির কথা ভাবলে ভয়ে শিউরে ওঠে। বিবেক দংশনে ভুগতে থাকে। সেই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতেই তো ডুয়ার্সের শান্ত সবুজ আঁচলে ছুটে এসেছিল মুখ লুকোতে। কিন্তু তা আর হল কই। জুঁই তাকে এখানেও ছাড়লো না।
ধোঁয়াটা এখন পাগলের মত পাক খাচ্ছে সমীরণের মাথার ওপরে, ঝাঁপিয়ে পড়ে মিশে যেতে চাইছে তার মধ্যে। হাতের আঙ্গুলের ফাঁকে ধরে থাকা সিগারেট অনেকক্ষণ হল পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। সমীরণ যেনো শরীরের প্রতিটি রন্ধ্রে অনুভব করছে জুঁইয়ের তীব্র আস্ফালন। চেয়ার ছেড়ে উঠতে চেষ্টা করল সমীরণ কিন্তু পারলো না। মাঝখান থেকে হাঁটুর ধাক্কায় টুলের ওপর রাখা স্কচের বোতলটা ঠনঠন শব্দ করে গড়িয়ে যেতে লাগলো সিঁড়ি দিয়ে। মুখের ভেতরটা যেন শুকিয়ে কাঠ। চেষ্টা করেও গলা দিয়ে স্বর বেরোলো না কোন। রক্তের স্রোত শরীর জুড়ে অকারণে ছুটে বেড়াচ্ছে চারিদিকে। হৃৎপিন্ডটা যেনো বুকের খাঁচা খুলে একসময় ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইল।
তারপর এক সময় ভোর হল। সারা জঙ্গল জেগে উঠলো কিচিরমিচির শব্দে। আর সেই সাথে যোগ হল পুলিশের জিপের বেআদব আওয়াজ। দেহটা পাঁজাকোলা করে নিয়ে যাওয়া হল সদর হাসপাতালে। সেখানেই সমীরণ রায়কে মৃত বলে ঘোষণা করা হল। মৃত্যুর কারণ ছিল, হঠাত স্ট্রোক এবং সেই কারণে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ ও হৃদযন্ত্র বিকল হয়ে যাওয়া।