STORYMIRROR

Alpana Ganguly

Horror

4.5  

Alpana Ganguly

Horror

সত্যি ভূত

সত্যি ভূত

6 mins
18

বন্ধু শুভর বৌভাত উপলক্ষ্যে সমুদ্রগড়ে গিয়েছিলাম আমরা কজন। আমি, সুমন, রতন, জয় আর হোসেন। আমরা সবাই একই অফিসের সহকর্মী ও বন্ধু। সমুদ্রগড়ের নাদনঘাটে শুভর আদি বাড়ি। দাদু ঠাকুমা আছেন। তাই ওখানেই বৌভাতের অনুষ্ঠান হয়েছে। গতকাল শুভ যখন বৌ নিয়ে ফিরছিল তখনই ওর সংগে আমরা এসেছিলাম। শুভর বাবা বললেন,"যাচ্ছ যখন একটু ঘুরে ফিরে দেখবে না? আগের দিন চল, আমরা খুব খুশি হবো।" সমানে কাজ করে করে কেমন একঘেয়ে লাগছিল।তাই সবাই মিলে বেরিয়ে পড়লাম। সমুদ্রগড়ে শুভদের বিরাট বাড়ী, বাগান। খুব ভালো লাগছিলো। দুপুর বেলা আমরা একটু এদিক ওদিক ঘুরতে বের হলাম। শহরে মানুষ তো, গ্রামের রাস্তা ঘাট দেখে মুগ্ধ হলাম। হাঁটতে হাঁটতে নদীর ধারে চলে গিয়েছিলাম। কিছুটা যাবার পর একটা জঙ্গলের সামনে চলে এলাম। একটি কাঠুরে মাথায় কাঠের বোঝা নিয়ে আসছিলো, আমাদের বারণ করলো দুপুর বেলা জঙ্গলে না ঢুকতে। কারণ জিজ্ঞেস করতে বললো দুপুরে তেনারা একটু বিশ্রাম করেন, রাত জাগতে হয় তো, বিশ্রামে ব্যাঘাত ঘটলে ওনারা আবার ক্রুদ্ধ হন। আমরা তো খুব হাসাহাসি করলাম। লোকটি চলে গেলে জঙ্গলে ঢুকে পথ হারিয়ে ফেললাম। জঙ্গলটা ক্রমশ ঘন হচ্ছিল, অন্ধকার হয়ে আসছিল চারপাশটা। গা ছমছম করছিল আমাদের। যতই  রাস্তা খুঁজছি,ততই যেন হারিয়ে যাচ্ছি। হোসেন নিজের গলার তাবিজটা ধরে মনে মনে কি যেন বলছিল। সুমন ভগবানকে ডাকছিল। আমি, রতন আর জয় একটু সাহসী, কথায় কথায় ঈশ্বরকে স্মরণ করি না। আমরা মাথা ঠান্ডা রেখে রাস্তার সন্ধান করছিলাম। হঠাৎই পথে একটি লোকের উদয় হলো। মাসটা ছিল ফাল্গুন,  কিন্তু লোকটা আপাদমস্তক চাদর মুড়ি দিয়ে ছিল। আমাদের দেখে জিজ্ঞেস করলো আমরা কোথা থেকে, কী উদ্দেশ্যে জঙ্গলে এসেছি। উত্তরে সন্তুষ্ট হয়ে আমাদের পথ দেখিয়ে জঙ্গলের বাইরে নিয়ে এলো। তারপর শুভদের বাড়ীর পথ দেখিয়ে আবার জঙ্গলের দিকে চলে গেলো। বাড়ী ফিরলাম যখন তখন বিকেল হয়ে এসেছে। আমাদের জন্যে সবাই চিন্তা করছে। আমরা সব কথা বলার পর দেখলাম সবাই কেমন গম্ভীর হয়ে গেলো। যাইহোক, আমরা পোষাক পাল্টে তৈরী হলাম বৌভাতের অনুষ্ঠানের জন্যে। কথা ছিল প্রথম ব্যাচে খেয়ে আমরা যাবার ট্রেন ধরব। কিন্তু তা আর হলো না। আগে আগে খেতে লজ্জা করলো। তাছাড়া সবাই অনুরোধ করছিল থেকে যেতে। কিন্তু পরদিন অফিস যেতেই হবে। আমাদের স্টেশনে যেতে দেরী হয়ে গেলো। রাত নটার ট্রেনে উঠলাম। হাওড়া পৌঁছতে রাত প্রায় একটা বাজবে। তারপর ট্যাক্সি ধরে বাড়ী ফিরতে অনেক রাত হবে। আমার বাড়ী বেহালা। অত রাতে বেহালার ট্যাক্সি না পেলে আমি কী করবো ভাবছিলাম। ট্রেনটা প্রায় ফাঁকাই ছিলো। একটা ফাঁকা কামরা দেখে আমরা উঠে পড়লাম। হাত পা ছড়িয়ে যাওয়া যাবে। ট্রেন ছাড়লে দেখি এককোণে একজন বসে আছে, মাথায় চাদর জড়িয়ে। সুমন বলে ," এই সকালের সেই লোকটা না?" সত্যিই তো। একই চাদর ,একভাবে জড়ানো। আমি সংগে করে একটা ছোট লুডোর বোর্ড নিয়ে গিয়েছিলাম।  ম্যাগনেট বোর্ড।  ঘুটিগুলো আটকে থাকে, ট্রেনের দুলুনিতেও ঘুটি পড়ে না। আমরা  সময় কাটাতে লুডো খেলছিলাম। আমি খেয়াল করিনি যে ছক্কা পাঁচে জয়কে কাটতে পারি। আমি ছক্কায় গুটি বার করতে যাচ্ছিলাম। হঠাৎই কোণায় বসা লোকটি বলে উঠল," ছক্কা পাঁচে হলুদ ঘুটি কাটা আছে।" অতদূর থেকে কী করে বলল লোকটা কে জানে? আমাদের খেলার মেজাজটাই চলে গেলো। অন্যর ফোফরদালালি মেনে নিতে মন চায় না। বোর্ড গুটিয়ে রেখে আমরা নীচু গলায় গল্প করছিলাম। আমরা নানা ধরণের গল্প করছিলাম। একসময়ে ভূতের প্রসঙ্গ উঠল। উপযুক্ত পরিবেশ ছিল ভূতের কথা আলোচনা করার। বাইরে  গভীর অন্ধকার, ফাঁকা কামরায় একজন রহস্যময় লোক। কামরার আলোটাও তেমন জোরালো নয়। জয় বললো ওর ঠাকুমা ভূত দেখেছেন সামনা সামনি। রতন বলল ওর পিসে রেলের গার্ড ছিলেন। ট্রেনে কাটা পড়া মানুষের ভূত প্রায়ই দেখতেন। হোসেন বলল," ভাই নাম নিস না। আমি ভয় পাই।" আমি বললাম ," আমাকে একটা হাড়হিম করা ভূতের গল্প বলতো কেউ, আমাকে গল্প লিখতে হবে একটা ম্যাগাজিনের জন্যে। রতন বলল,"আমার মা অনেকদিন আগে দেখেছিল। কী বীভৎস চেহারা। আগুনের গোলার মত চোখ, বনবন করে ঘুরছে, জ্বলন্ত দৃষ্টি। মা দেখে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল।" হোসেন আমার দিকে ঘেঁষে বসল। হঠাৎ চাদর মুড়ি দেওয়া লোকটি বলে উঠল," ভূতকে আপনারা খলনায়ক বানাতে ভালবাসেন কেন? ভূত মানেই ভয়ংকর দেখতে, স্বভাব খারাপ, অখাদ্য কুখাদ্য খায় এমন ভাবেন কেন? ভূতকে বন্ধু ভাবতে পারেন না?" আমি বলি," ভূত বলে কিছুই নেই, তায় ভালো আর খারাপ।মানুষ  মনের ভয় থেকে কল্পনায় ভূতের সৃষ্টি করেছে।" লোকটি হঠাৎই ক্ষেপে গিয়ে বলে ," খবরদার! নেই বলে অপমান করবেন না।ভূত মানে তো অতীত। সকলেরই অতীত থাকে। বর্তমান যেমন আছে তেমন  অতীত বা ভূতকে অস্বীকার  করতে পারেন কী?" কথাটায় লোকটির কন্ঠে কতদিনের ক্ষোভ লুকিয়ে ছিল মনে হল। সত্যিই  অপমানিত হয়েছে এমন ভাব করল। কথাটা বলেই লোকটা আবার মুড়ি দিয়ে আধশোয়া হলো। আমরা লোকটিকে পাত্তা না দিয়ে কথা চালিয়ে যেতে থাকলাম। জয় বলল," জানিস তো অনেকে ম্যাজিক করে ভূতের ভয় দেখায়। একবার এক জাদুকর ম্যাজিক করে অদৃশ্য হয়ে গিয়ে ভূত আছে বলে ভয় দেখিয়েছিল। পরে ধরা পড়ে যায় ।" লোকটি বেশ রাগতস্বরে বলে, "কতবার বলছি ভূত বলবেন না।" আমি," ভূতকে ভূত বলবো না তো কী বলবো?" লোকটি খেঁকিয়ে ওঠে," কেন অশরীরী বলতে পারেন না? নিদেন পক্ষে স্পিরিট তো বলতে পারেন?" রতন বলেন," আপনার কি মশাই? আমরা নিজেদের মধ্যে কথা বলছি, আপনি গায়ে পড়ে মন্তব্য করছেন কেন? একবার জঙ্গল থেকে বের হতে সাহায্য করে কী মাথা কিনে নিয়েছেন?" " আমি আবার কখন সাহায্য করলাম? বিয়েবাড়ীতে কী খানার সংগে পিনাও হয়েছে?" সুমন,"আপনি কী করে জানলেন যে আমরা বিয়েবাড়ী থেকে আসছি? ফলো করছেন নাকি সেই থেকে?" "আপনাদের বেশভূষো, সেন্টের ভুরভুরে বিশ্রী গন্ধ , আর মাংসের ঢেঁকুরের গন্ধেই টের পাওয়া যাচ্ছে।" লোকটি ব্যঙ্গ করে বলে। জয় বললো," আর আপনার চাদরের আঁশটে গন্ধ থেকেই মালুম হচ্ছে আপনি একটি আস্ত জংলী ভূত।" লোকটি লাফ দিয়ে উঠে সবেগে বাঁ দিকের দরজার কাছে গিয়ে মারল এক লাফ। আমরা চমকে উঠি, পাগল নাকি? চেন টানতে যাই। পরক্ষণেই সেই চলন্ত ট্রেনের ডানদিকের দরজা দিয়ে এক লাফ মেরে উঠে পড়ল। আমরা হাঁ করে তাকিয়ে থাকি। লোকটি আবার লাফ মারে এবং আবার ওঠে। এইরকম বার কয়েক ওঠা নামার পর এসে সিটে বসে। আমি বলি," ব্যাপার টা কী মশাই?" "ম্যা - জিক। " জটায়ুর কায়দায় বলে লোকটি। তারপর বলে," আরো দেখবেন?" বলে চাদর খুলে নিজের মুন্ডুটাও খুলে ফেলে। তারপর  মুন্ডুটাকে নিয়ে কয়েকবার লোফালুফি করে আবার ঠিক জায়গায় সেট করে দেয়। আমাদের দিকে তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে তাকায়। আবার মুন্ডু খোলে। এবার ওর হাতে একই রকম চার চারটে   মুন্ডু নিয়ে জাগলিং করতে থাকে। প্রায় ছ ফুট লম্বা মুন্ডহীন দেহটা আকারে একটু ছোট হয়ে গিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে খেলা দেখাতে থাকে। সেই দৃশ্য দেখার পর আমরা অজ্ঞান হয়ে যাই। হাওড়া স্টেশনে গাড়ি থামলে কে যেন আমাদের চোখে মুখে জল দিয়ে জাগায়। জেগে দেখি কামরায় শুধু আমরা কজনই আছি। মনে পড়ে সব কথা। তাড়াতাড়ি ট্রেন থেকে নামি। গেটে চেকার  হাত বাড়ালে টিকিট দিতে গিয়ে দেখি সেই লোকটা।  পড়ি মড়ি করে ছুটে বার হয়ে ট্যাক্সির লাইনে দাঁড়াই। অত রাত্রিতেও বিরাট লাইন।ঠিক করি আমরা সবাই আজ রাতটুকু সুমনের বাড়ীতে কাটিয়ে কাল ভোরে যে যার বাড়ি চলে যাবো। আজ রাতে আর একলা কেউ বাড়ী যাবো না। অবশেষে ট্যাক্সি আসে। আমরা বেশী টাকার টোপ দিয়ে পাঁচজনেই উঠি গাড়ীতে।  পেছনের সিটে ওরা চারজন ঠেসাঠেসি করে বসে। আমি ড্রাইভারের পাশের সিটে বসি। যাকবাবা। ড্রাইভার বলে,"কোথায় যাবো?" তাকিয়ে দেখি সেই লোক , চাদর মুড়ি দিয়ে ড্রাইভারের সিটে বসে। "রোকো,রোকো।" চেঁচিয়ে উঠি আমরা। গাড়ী ছুটতে থাকে এলোমেলো। একটা ক্রসিংএ ট্রাফিক পুলিশ দেখে আমি ডাকি, "হেল্প, হেল্প।" পুলিশের ইশারায় গাড়ী থামে। "কী হয়েছে?" জিজ্ঞেস করে পুলিশ । আমরা বলতে গিয়ে দেখি পুলিশ আসলে সেই লোকটাই। আমরা হুঁশ হারাই। সুমনের বাড়ীর সামনে এসে আমাদের ঘুম ভাঙিয়ে নামিয়ে দেয় লোকটি। নির্বাক আমাদের বলে," আশাকরি মনে রাখবেন। ভবিষ্যতে আমাদের ভূত না বলে অশরীরী বলবেন।" আমার দিকে তাকিয়ে বলে, "আমরাও তো‌মানুষ, মান ও হুঁশ দুটোই আমাদের আছে। তাই অপমান সহ্য করতে পারি না। শুধু শুধু গাল মন্দ খেতে কার‌ই বা ভালো লাগে?  তাই বলছি গল্প লিখলে সত্যি অশরীরীর গল্প লিখবেন। বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যে লিখবেন না। নইলে--" নইলে যে কী হাল হবে তা আমরা বেশ ভালোই বুঝলাম।  


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Horror