ভাগীদার
ভাগীদার
মিটার ঘরের নীচে ছ ছটি ছানার জন্ম দিয়ে রোডেশিয়ান লালী লরী চাপা পড়ল। দুর্বল দেহে খাদ্যের খোঁজে বেরিয়েছিল, দৌড়ে পালাতে পারে নি।
পাড়ার লোক ভেঙে পড়লো। এতদিন যারা দুবেলা লালীকে দেখলে লাঠি নিয়ে তাড়া করতো, তারাই এখন হায় হায় করছে।
তাড়া করবে নাই বা কেন? কেউ কী চায় যে একটা ঘেয়ো কুকুর তার বাড়ীতে আশ্রয় নিক, ছানার জন্ম দিক।
সব জায়গায় তাড়া খেয়ে আমার বাড়ীটাকেই ও প্রসূতিসদন হিসাবে সম্মান দিলো। সম্মানিত বোধ করবো কিনা ভেবে একবার মিটার ঘরের দিকে গেলাম। দেখি ছটা ছানা ছিল, এখন পাঁচটা, একে অপরকে জড়িয়ে কিলবিল করছে
ছাল ছাড়ানো গুলো।
দুপুরের মধ্যে ওদের সংখ্যা দুই এ দাঁড়ালো। দুটো চিলে নিয়ে গেছে। একটা দুধ না পেয়ে মরে গেছে।
বিকেলে মেয়ের চীৎকারে ছুটে গিয়ে দেখি একটা ছানাকে কাক ঠোকরাচ্ছে। হুশ হুশ , যাঃ। চলে যাবার সময় মুখে করে নিয়ে গেল। "হারাধনের "একটি পড়ে রইল। সহোদরদের গায়ের ওম না পেয়ে জড়োসড়ো হয়ে আছে। আমারই বাড়ীতে পাঁচটি ছানার এই গতি হলো , নিজেকে দোষী মনে হয়। মেয়ের চোখে জল। মনে মনে ভাবলাম লালী তোর সঙ্গে আবার
দেখা হলে ক্ষমা চেয়ে নেবো তোর ছানাদের রক্ষা করতে পারিনি বলে।
কিন্তু একটা তো আছে! প্রায়শ্চিত্ত হিসাবে ছানাটাকে হাতে প্লাস্টিক জড়িয়ে তুলে নিয়ে সিঁড়ির তলায় বস্তা পেতে রাখলাম। মেয়ে উবু হয়ে বসে দেখছে। ওর চোখে জলের বদলে এখন হাসি ঝিকমিক করছে। এটাই আমার বড় প্রাপ্তি।
মালতীর খুব উৎসাহ, সব কাজ ফেলে আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছে।
" বৌদি গো অত বড় বস্তাটা তো একবার ইয়ে করলেই ভিজে যাবে তখন গন্ধে টিঁকতে পারবে না। তার থেকে বস্তার ওপরে এই পেলাস্টিকটা পেতে দাও। চিলেকোঠা থেকে একটা পুরোনো বড় প্লাস্টিক এনে হাজির। তার সঙ্গে একটা ছেঁড়া চাদর ও এনেছে। চাদরটা কয়েক টুকরো করে বললো," পেলাসটিকের ওপর এই একটা চাদরের টুকরো বিছিয়ে দাও। আমি মাঝে মাঝে পাল্টে দেবো। রাজকীয় শয্যা প্রস্তুত। এবার মেয়ের পুরোনো একটা দুধের বোতল এনে মালতী বললো," জল মিশিয়ে এট্টুকুন দুধ দাও তো বৌদি।" মেয়ে হাততালি দিচ্ছে।
আমার বাড়িতে উৎসব।
দেওর বললো," বৌদিদি, একটু বড় হলেই টয়লেট ট্রেনিং দেবো।"
ঘরের নির্লিপ্ত মানুষটির মুখেও হাসি দেখলাম।
এতটুকু ছাল ছাড়ানো লিকলিকে টা এখন গোলগাল কান ঝুলুয়া, লেজ ফুলুয়া গুটি গুটি ঘুরে বেড়ায় বাগানে।
মালতী ওর নাম দিয়েছে ভাগীদার। যে যা খায় ওকে ভাগ দেয়। যতক্ষণ না দিচ্ছে লেজ নাড়াতে থাকবে। মালতী বলে,
" অতটুকু লেজ, অত নাড়ালে তো খসে পড়বে বাপু।"
সব মিলিয়ে আমার সংসার জমে উঠেছে।
ভাগীদার বড় হয়েছে। বাড়ীটাকে আগলে রাখে। এখন আর সিঁড়িঘরে নয়, বাগানে ওর জন্যে একটা ঘর বানিয়ে দিয়েছে সলোমন মিস্ত্রি, পাঁচ বাই পাঁচ, উচ্চতা সাত ফুট। মাথায় বাহারী রঙীন প্লাস্টিকের ছাউনি।
ভাগীদার বেশ বড়ো হয়ে গেছে। অচেনা লোকের আসার যো নেই। কামড়ায় না, তাড়া করে।
গরম পড়েছে খুব। রান্নাঘরটা শোবার ঘর থেকে একটু দূরে। আমি রান্না করছি। এইসময়ে কেউ থাকে না বাড়ীতে। দরজাটা টানা আছে , বারান্দার অন্য প্রান্তে রান্নাঘর। ঘেমে নেয়ে একসা হয়ে গেছি। ভাগীদার চিল চিৎকার শুরু করে। " ওরে তোর রান্না হয়নি এখনো। একটু সবুর কর।"
চালের মধ্যে চিকেনের ছাঁট ফেলে এক গামলা করে দিই, দুবেলা হয়ে যায়। হতে দেরী আছে। কিছুতেই থামে না। মাথা গরম হয়ে গেলো। বেড়াল তাড়াবার লাঠি দিয়ে দুঘা দিয়ে বললাম ," দূর হয়ে যা, একখুনি।'
মারাটা কী জোরে হয়েছিল?
কী জানি , আঘাতটা বুঝি দেহে নয়, মনে লেগেছিল। এই তিনবছরে প্রথম গায়ে হাত তোলা। মুখ নীচু করে চলে গেল। একটু পরে দরজার কাছ থেকে আর্তনাদ শুনে ছুটে গেলাম।
একটা কুচকুচে কালো ভূতের মত চেহারার লোকের.পা কামড়ে ধরে আছে ভাগীদার। আমার চেঁচানিতে পাড়ার ছেলেরা ছুটে এলো। চোর বাবাজী বামাল সমেত ধরা পড়লো। শুধু আমার ঘরের জিনিস নয়, পাশের বাড়ীর জিনিস ও পাওয়া গেল ওর ঝোলায়। খাবার চাইতে নয়, চোর এসেছিলো জানান দিতে ও চেঁচামেচি করছিলো। আমি না বুঝে মারলাম।
এইসব ডামাডোল মিটলে আদর করে ডাকি ," ভাগীদার আয়, খাবি আয়।"
কোথায় সে? মনুষ্য নামক জাতির ওপর বিশ্বাস হারিয়ে কোথায় ছলে গেলো কে জানে? আর আসেনি। মেয়ের মুখ ভার। কেউ জানে না আমি মেরেছিলাম ওকে। ওকে হ্যংলা বলেছিলাম। পশুরও মান অপমান বোধ থাকে জানলাম।
আবার কখনো দেখা হলে ক্ষমা চাইবো তোর কাছে। ভাগীদার একবার আয়। প্লিজ, মায়ের ওপর রাগ করে থাকিস না।
