STORYMIRROR

Alpana Ganguly

Others

4  

Alpana Ganguly

Others

সুরজ

সুরজ

6 mins
3

প্রতি বছর শীত পড়লেই সেই লোকটা আসে। লোকটা একজন ধুনুরী। সাইকেলের
পিছনে মস্ত বস্তায় থাকে তুলো, নানা রঙের কাপড়। সেই লোকটার ঘাড়ে থাকে ধনুকের মতো যন্ত্রটা, যা দিয়ে ও তুলো ধোনে।
"লেপ বানাবেন মা, বালিশ বানাবেন মা " বলতে বলতে হেঁকে যায় লোকটা। আর কচি কাঁচারা জড়ো হয় তার ডাক শুনে, যেখানে তাকে ডাকবে, বাচ্ছাগুলো সেখানেই
হাজার হবে। ধুনুরি যখন তুলো ধোনে, টুং টাং করে বাজনা বাজে, ওদের সেটা খুব ভালো লাগে।
এইবছরে আমাদের পালা। ঠাকুমা বলে দিয়েছে ধুনুরি গেলেই ডাকতে। ভাই বোনকে সেই কাজের জন্যে বহাল করা হয়েছে। ওরা উঠোনে খেলতে খেলতে নজর রাখছে
সেই লোকটার ওপর।
একটু পরেই ওদের কলরব শোনা যায়। "এসে গেছে," " "এসে গেছে " বলে ওরা ছুটতে ছুটতে আসে বড়োদের ডাকতে। সবাই যাই সেই লোকটাকে দেখতে। গিয়ে দেখি গেটের  কাছে দাঁড়িয়ে আছে। ঠাকুমা ভেতরে ডাকে
ওকে। ও গেটটা ঠেলে ভেতরে ঢুকে সাইকেলটা একপাশে রাখে। তারপর বস্তা নিয়ে এসে মাটিতে বসে পড়ে। মাথা থেকে পাগড়ীর মতো করে বাঁধা গামছাটা খুলে কাঁধে রাখে। ঠাকুমা তার নিজস্ব হিন্দীতে  বলে," ওমা!তুমি তো সেই আদমী নেহী। তুমি তো বহুতই  ছোটো।"
সত্যি তো, এ তো সে নয়। তবে মুখের আদল খানিকটা ওই ধরণের।  দেখে মনে হয় সাতাশ আঠাশ বছর বয়স হবে। তাগড়া জোয়ান। ফরসা রং রোদে পুড়ে তামাটে। খাড়া নাক। চুলের গোছা উত্তরের
হাওয়ায় উড়ে এসে চোখে পড়ছে।
আমি তখন কলেজে পড়ি। আমার বান্ধবী হিয়া তখন আমাদের বাড়ীতেই ছিলো।
ও বললো," ওঃ, ঠিক যেন হলিউডের হিরোর মত চেহারা
দেখেছিস!"
হিয়ার ওই স্বভাব,সুন্দর চেহারার ছেলে দেখলে ও মুগ্ধ হয়ে যায়। তখন শুধু রূপটাই দেখে, পেশা তার যাই হোক।
বুঝলাম হিয়া এখন এখান থেকে নড়বে না।
সেই লোকটা ঠাকুমার কথার জবাবে  তার মিশ্র ভাষায় বলল, " মাজী, সে আমার বাপু থে, উমর জেয়াদা হয়েছে তো, ইসলিয়ে হামি এসেছে।"
ঠাকুমা বলে," তা বাছা, ছোট উমরে তুমি ঠিকঠাক বানাতে পারেগা তো?"
" জরুর মা জী। একদম বড়িয়া লেপ বানিয়ে দেবো।
ছোটা উমরসে তো বানাই হামি। হামার মুলুকে সভি লোক বানাতে পারে।

দুটো লেপ আর চারটে বালিশ তৈরী হবে।
ঠাকুমা বাবাকে বললো," সেই লোকটা আসেনি তো কী হয়েছে, ওর ছেলেকে দিয়েই কাজটা করাই কী বল?
বাবা মত দিলে ও সব জিনিস গুছিয়ে বসলো। ততক্ষণে বেশ ভীড় জমে গেছে। সার্কাসে, খেলা দেখার মত একটু দূরত্বে গোল হয়ে বসেছে সবাই।
একদম সামনের সারিতে আছে কচিকাঁচার দল।
তার পেছনে আছি আমরা। বারান্দা মহিলার দল। এই সময়টায় দুপুরের খাওয়া দাওয়ার পর পাশের বাড়ির
মাসীমা, কাকীমারা এসে একটু রোদ পোহান ও মা ঠাকুমার সঙ্গে দুটো সুখ দুঃখের গল্প গাছা করেন।
আজ সবাই মিলে লেপ তৈরী দেখতে উৎসুক। হিয়া কিন্তু একেবারে সামনে গিয়ে বসেছে।
ছেলেটা স্তূপাকার তুলোর মধ্যে ধনুকের ছিলাটা ডুবিয়ে দিয়ে একধারে মুগুরের বাড়ি মারছে , টুং টাং করে শব্দ হচ্ছে আর ছিলাটা কাঁপছে। সেই কম্পনে তুলো গুলো পেঁজা হয়ে যাচ্ছে আর বীজ গুলো আলাদা হয়ে পড়ে যাচ্ছে।


হিয়া দেখছে প্রতিবার মুগুর চালনার সময় ওর বাহুর পেশীগুলো কেমন ফুলে উঠছে।
খানিক পরে রায় কাকীমা বললেন আমার মাকে," এবার বাড়ী যাই রে , মেয়েটা একা বাড়ীতে আছে, কে না কে ঢুকে পড়বে , ব্যস সব খালি করে দেবে।" এই বলে উঠে গেলেন। ধুনুরি ছেলেটি বলল," কিঁউ মাই জী, ইখানে ভী  ডাকু  আছে কেয়া?"
ঠাকুমা বলে , "ডাকু না হোক চোর তো হ্যায় ।"
হিয়া বলে," তোমাদের দেশে
ডাকু আছে কী?ডাকুরা খুব খারাপ হয়।"
ছেলেটা বলে," হাঁ আমাদের মুলুকে ডাকু আছে। লেকিন
ও ডাকু বহুত আচ্ছা আদমী
আছে।"
হিয়া-- ডাকু আবার আচ্ছা হয় কীভাবে?
ছেলেটা- সিস্টার,  ও ডাকু
গরীব আদমীদের দেওতা মাফিক আছে। ঠাকুর আউর
বেওসায়ীদের বাড়ী ডাকাডালি করে , লেকিন গরীব আদমীদের ভালা করে।
ঠাকুমা-- কেন আমাদের দেশের রঘু ডাকাতের কথা শুনিস নি, ওইরকম আর কি।

ধুনুরি," হাঁ সিস্টার,মাজি যো বোলা , উসিকি মাফিক ভালা আদমি হামার মুলুকের ডাকু।

হিরোর মুখে  বারবার সিস্টার শুনে হিয়া খুব ভেঙ্গে পড়লো। ও সামনে থেকে উঠে আমার পাশে চলে এলো।

আমি বললাম," ভাইয়া তোমাদের ডাকুর কথা বলো না। "
হিয়া আমার দিকে কটমট করে তাকায় ভাইয়া ডাকার জন্য। কারণ আমি বললে ওকেও তাই বলতে হবে, নাহলে শ্রুতিকটু লাগবে।
ও বেজার হয়ে বলে," হাঁ ভাইয়া তোমার ডাকু কেমন দেখতে, কেতনা উমর, শাদি
হয়েছে?"
ছেলেটি একটু হেসে বলে ,
" হামি সব বাতাচ্ছি থোড়া বাদ।"
তারপর স্তূপীকৃত তুলো ধোনা হয়ে গেলে, চোখ মুখ থেকে তুলো ঝেড়ে কাপড় কাটতে লাগলো কাঁচি দিয়ে।
মা এসে পরোটা আর আলু চচ্চড়ি আর একগ্লাস চা এনে
বললো," আগে খেয়ে নাও তারপর বাকীটা করো।"
ও উঠে হাত মুখ ধুয়ে এলো কল থেকে, তারপর পরোটা খেতে খেতে বলতে শুরু করলো," হামাদের মুলুকে অনেক ডাকু আছে।  বহুত খতরনাক ডাকু । লেকিন এক ডাকু আছে বহুত আচ্ছা গরিব কা দেওতা আছে। কোন গরীব বেটীর শাদী হোবে, কোন আদমীর বিমার হোবে তো ও ডাকু ওর সাথ দেবে। বড়া অদমির রুপিয়া
ডাকাডালি করে গরীবকে সে রুপিয়া দেয়।"
হিয়া আবার বলে" দেখতে কেমন? বয়েস কত?"
" দেখনে সে তো বহুত আচ্ছা , লেকিন কাপড়া দিয়ে বদন ঢেকে রাখে।যখন অন্য দেশে যায় তখন বদন খুলা থাকে।
উমর এই লগভগ সাত্তাইশ হোবে । হাট্টাকাট্টা জোয়ান।
একবার ওর বড়া চাচাকে এক ঠাকুর অ্যায়সা চাবুক মারলো যে চাচা মরে গেলো।
উসকে বাদ ও ডাকু বনে গেলো। ঠাকুরদের মেরে ওদের রুপয়া , জেবর লেকে
গরীব আদমীদের দেয়। পুলিশ অনেকদিন ওকে ধরবে বলে কৌশিস করছে, লেকিন
এতনা আসান নেহী ।
বহুত কৌশিস করেছে।
হাঁ ডাকুকা নাম সুরজ।
একবার পুলিশকে পাশ খবর থা কি সুরজের সিস্টারের শাদী, ও আসবেই। কেন কী
সিস্টার কে সুরজ খুব পেয়ার করে। শাদীর দিন পুলিশ বাড়ী ঘিরে ফেলেছে। অন্দরে নাচাগানা হচ্ছে, মেহেন্দী পরা হচ্ছে। এমন সময়ে একটা গাড়ী থেকে এক রইস আদমী নামলো। পুলিশ এসে তার হাত টেনে দেখে হাতে উলকি দিয়ে লেখা আছে সুরজ
পুলিশ ওই আদমীকে অ্যারেস্ট করলো, তব ওই শাদীর বাড়ীতে যত লেড়কা ছিল সবাই এসে বলে হামি সুরজ। হাত দেখায় লেখা আছে সুরজ। গ্রাম থেকে দলে দলে আদমীরা আসে , সব আদমীর হাতে সুরজ লেখা। সবাই বলে ," হামি সুরজ আছি, হামাকে অ্যারেস্ট করো।" ওই গ্রামের সবাই ধুনকার । সবাই এই ধুনবার মেশিন নিয়ে পুলিশকে তাড়া করে।হয় সভিকো অ্যারেস্ট করো, নেই তো সভিকো ছোড়ো। পুলিশ মজবুরি সে
সবকো ছোড় দিয়া।"
"আর আসল সুরজ ? সে আসে নি বোনের বিয়েতে?"
শুধাই আমি।
" আসলি সুরজ লেড়কী সেজে,  সিস্টারের ফ্রেন্ড দের সাথ নাচা গানা করলো। ওর হাত লাল চুড়িয়াঁয় ঢাকা ছিল , সুরজ লেখা দেখা যাচ্ছিল না। তো সারি রাত সুরজ উঁহাই থা, খানাপিনা করে সুভা চলে গেলো। পুলিশ জানতে পারলো না।"
খাওয়া শেষ, গল্প ও শেষ। হিয়া তো সুরজের প্রতি ফিদা
হয়ে গেছে।
গল্প শেষ করে সেই ছেলেটি কলে গেলো হাত ধুতে। ফুলহাতা শার্টের হাতা গুটিয়ে হাত ধোবার সময় লক্ষ্য করলাম ওর হাতে উলকী দিয়ে বড় করে লেখা
'সুরজ'। হিয়া এত জোরে আমার হাত চেপে ধরলো যে নখ বসে রক্ত বেরিয়ে গেলো।
আমরা দুজনেই উত্তেজিত।বস্তার মধ্যে বন্দুক বা ছোরা নেই তো? এ যদি সেই আসলি ডাকু হয়?"
দুজনে দুজনের হাত ধরে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকি।
হাত ধুয়ে সুরজ কাপড় পেতে তুলো সাজায়, তারপর দক্ষ হাতে মোটা ছুঁচ সূতোয় ফোঁড়
তোলে। ঠাকুমা জিজ্ঞেস করে," তোমার নামটি কী বাছা?"
সুরজ মুচকী হাসে," যো ভি হো।

"লে যায়েঙ্গে, লে যায়েঙ্গে, দিলবালে দুলহানিয়া----"
আপন মনে গান গাইতে গাইতে সেলাই শেষ করে।বালিশ ও শেষ করে।
তারপর লেপ ভাঁজ করে ঠাকুমার হাতে দেয়। বলে," যা রহা মাজী।"
ঠাকুমা ওকে টাকা দিয়ে বলে," যাই বলতে নেই, বলো আসি।তা নামটা তো বলে গেলে না।"
সেই ছেলেটা সাইকেলে উঠে
ঠাকুমাকে হাত নেড়ে বললো," সু র জ।"
আমি ধরে না ফেললে ঠাকুমা পড়েই যেতো। এই বয়েসে এত বড়ো ধাক্কাটা সামলাবে কি করে। পরে আর কখনো
সুরজকে দেখিনি।

এটি সত্য ঘটনা। এই সুরজ
আসলি না নকলি জানিনা।
ব্যাপারটা আজো আমার মনে পড়লে গায়ে কাঁটা দেয়।সত্যি কী এক ডাকুর সংগে কাটালাম দীর্ঘ সময়। ডাকু কী পুলিশের ভয়ে পশ্চিম বাংলায়
লুকিয়ে ছিল না কী সুরজের ভক্ত , আজো রহস্য থেকে গেলো।



Rate this content
Log in