ডেলিভারি বয়
ডেলিভারি বয়
(এক ডেলিভারি বয়ের করুণ জীবন কাহিনী যা আমার খুব পরিচিত একজনের কাছে শোনা। আমার বান্ধবীর ছেলে। নামটা পর্যন্ত এক রেখেছি। ওর বলা কথা গুলো সাজিয়েছি মাত্র।আমার নিজের তো কোন অভিজ্ঞতা নেই, তাই তোর কাছে শুনে লিখলাম
তন্ময়, পড়িস কিন্তু।)
রাত তখন প্রায় দশটা। শহরের আলো জ্বলে উঠেছে, কিন্তু তন্ময়র চোখে শুধু ক্লান্তি। সারাদিন মানুষের প্রয়োজন পৌঁছে দিতে দিতে হাত-পা অবশ। ভিজে গেছে জামা, কপাল থেকে ঘাম গড়িয়ে পড়ছে হেলমেটের ফাঁক দিয়ে। তবু অ্যাপের নোটিফিকেশন বেজে উঠলেই আবার ছুটে যেতে হয়—আরও এক অর্ডার, আরও এক ঠিকানা।
তন্ময় একসময় কলেজে পড়ত। ইংরেজি নিয়ে গ্র্যাজুয়েট হতে চেয়েছিল, শিক্ষক হবে ভেবেছিল মনে মনে। কিন্তু চাকরী নেই। সংসারের হাল সামলাতে বইয়ের জায়গায় হাতে উঠল মোবাইল। ডেলিভারি ব্যাগ পিঠে নিয়ে সে নামল রাস্তায়—রোদে, বৃষ্টিতে, ধুলোয়।
অ্যাপের মানচিত্রে শহরটা ছুটে চলে—লালচে বিন্দুর মতো রেস্টুরেন্ট, নীল বিন্দুর মতো গ্রাহক। তন্ময় এক বিন্দু থেকে আরেক বিন্দুতে দৌড়ে বেড়ায়, কিন্তু নিজের জীবনে কোনো গন্তব্য নেই। রাস্তায় সিগন্যাল ভাঙতে গিয়ে একদিন প্রায় অ্যাকসিডেন্ট হয়েছিল। সেদিন ভাবল—জীবনটাও যেন এক সিগন্যালের মধ্যে আটকে আছে, সবুজ আলো জ্বলে না কোনোদিন।
মাঝে মাঝে বিল্ডিংয়ের দরজায় দাঁড়িয়ে যখন সে “Order, sir!” বলে চেঁচিয়ে ওঠে, কেউ দরজা খুলে খাবারটা নিয়ে হাসে, কেউ বিরক্ত মুখে টাকা দেয়। কেউ কেউ ‘থ্যাঙ্ক ইউ’ বলে, তবু তন্ময়ের বুকের মধ্যে একখানা দীর্ঘশ্বাস লেগে থাকে—সেই খাবার, যেটা সে পৌঁছে দেয় গরম গরম, নিজের ঘরে কখনও বসে খেতে পারে না।
একদিন রাত বারোটার সময় শেষ ডেলিভারিটা ছিল হাসপাতালের পাশে। রোগীর আত্মীয় কাচের জানলার ফাঁক দিয়ে বলল, “দাদা, একটু তাড়াতাড়ি আনো।” তন্ময় তখনো বাইক থেকে নামেনি। চোখে ঘুম, শরীরে ব্যথা, কিন্তু মুখে হাসি রেখে বলল, “হয়ে যাচ্ছে, দাদা।” অর্ডারটা পৌঁছে দিয়ে যখন সে ফিরছে, তখন হঠাৎ ফোনে মায়ের কল—“বাবা, ওষুধটা আনতে ভুলিস না।” এটাও তো একরকম অর্ডার ডেলিভারি, তাই না?
আজ শহরের রাস্তায় ভয়ানক জ্যাম। এক রাস্তায় চারটে অটো, দুইটা বাস, পঞ্চাশটা বাইক দাঁড়িয়ে। ডেলিভারির সময় পেরিয়ে গেছে। ফোনে গ্রাহকের গলা —
“এই, এত দেরি কেন? ঠান্ডা খাবার খাওয়াবে?”
তন্ময় মুখ নিচু করে বলে, “সরি স্যার, ট্রাফিক…”
কিন্তু লাইন কেটে যায়। যেন মানুষ নয়, অ্যাপের এক নম্বর সে — যাকে দেখা যায় না, শুধু রেটিং দিয়ে বিচার করা যায়।
গত সপ্তাহেই এমন এক ঘটনা ঘটেছিল — সামান্য ধাক্কায় এক লোক তাকে রাস্তায় চড় মেরেছিল। ভিড় জমেছিল, কেউ বলেছিল, “ওদের তো কিছুই হয় না!”
তন্ময়ের ব্যাগ মাটিতে পড়ে খাবারটা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তখন চোখে জল এসে গিয়েছিল, কিন্তু মারের কারণে নয় — ভেবে যে সেই খাবারের দাম তার মাইনে থেকে কেটে নেবে কোম্পানি।
নিজের পেট খালি রেখে যে সারাদিন অন্যের পেট ভরায়, তার ব্যথা কেউ বোঝে না।
রাত বাড়ে। আকাশে চাঁদ নেই, কেবল রাস্তায় আলো ঝলমল করছে। হঠাৎ অ্যাপের স্ক্রিনে আবার নতুন অর্ডার জ্বলে উঠল।
তন্ময় নিঃশব্দে বাইক স্টার্ট করল।
বুকে একটা কথাই বাজতে লাগল
“জীবনটা যদি একটু বিশ্রাম পেত...”
কিন্তু বিশ্রামের মানে তার কাছে এখন এক ফাঁকা রাস্তা, যেখানে কারও গালাগাল নেই, হর্ন নেই, শুধু বাতাসে শান্তি।
আর সে জানে, সেই রাস্তা খুঁজতে খুঁজতেই তার জীবন কেটে যাবে।
রাস্তার বাতাসে তখন গন্ধ কাঁচা পেট্রোলের, আর দূরে কোনো এক বাড়ির জানলা দিয়ে বাজছে গান—
“এই পথ যদি না শেষ হয়…”
তন্ময় থামল না। কারণ তার পথের শেষ মানে আজকের রোজগার থেমে যাওয়া। আর রোজগার না হলে, মা’র ওষুধ, ঘরের ভাড়া, জীবনের শ্বাস—সবই থেমে যাবে।
তন্ময় প্রচন্ড গরমে কাহিল হয়ে এক বাড়ীতে গেল তাদের মাসকাবারী ডেলিভারী দিতে। একটি কিশোরী তাকে দেখে বললো," আঙ্কেল তুমি তো ঘামছো,
ভেতরে এসো, পাখার তলায় বসো।
কিশোরী এক গ্লাস লেবু চিনির শরবৎ দিলে তন্ময়ের প্রাণ বাঁচল। সবাই যদি এমন হতো।
একদিন এক বাড়ীতে গেছে , দুধের প্যাকেট লিক করছে বলে ভদ্রলোক অভদ্রের মতো আচরণ করলেন।
তন্ময় বি এ পাশ। তার কী একটুও আত্মসম্মান থাকতে পারেনা?
বিনীত ভাবে বলে,"স্যার আমি রিটার্ন নিচ্ছি, টাকা ফেরৎ হবে।"
এই ভাবেই দিন চলে।.মাস গেলে কুড়ি হাজার হয়, তবুও নীলার বাবা একজন ডেলিভারী বয় এর সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেন না। নীলা বিয়ে অন্যত্র ঠিক হয়ে গেছে।জানলা দিয়ে বোবা চাউনি নিয়ে তন্ময়ের চলে যাবার পথের দিকে তাকায়।
তন্ময় এগিয়ে যায়। যদি কখনো তার কাজের কেউ মর্যাদা দেয়, তবেই ও বিয়ে করবে।
দিনের শেষে মা তার ঘাম মুছিয়ে বলেন,
" আমার রাজা বেটা।"
দিনের শেষে মায়ের আদর টুকুই প্রাপ্তি।
এভাবেই সে ছুটে চলে—একটা শহরের অসংখ্য আলো আর নির্লিপ্ত মুখের ভেতর দিয়ে।
তন্ময় জানে না, কখনো তার নিজের জীবনেও “ডেলিভারড” লেখা আসবে কিনা।
---
