আসা যাওয়ার পথের মাঝে
আসা যাওয়ার পথের মাঝে
(পর্ব ১)
সিংহ বাড়ীতে আসা ও যাওয়ার মাঝে কেটেছে মাত্র একটি মাস।
তবু এটুকু সময়ের মধ্যেই রর
যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছে তাতে
একটা ছোটখাটো উপন্যাস লেখা
যায়। রর সবসময় লেখার প্লট খুঁজে বেড়ায়, কিন্তু এই প্লটটা তাকে খুঁজতে হয়নি। নিজেই এসে
ধরা দিয়েছে ওর কাছে।
রর র পরিচয়টা এবার জানাতে হয়।
রর একজন লেখক। পেশায় সে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। লেখাটা
ওর শখ। খুব ছোটবেলা থেকেই
রর ভাবত যে ও লেখক হবে।
কিন্তু মায়ের ইচ্ছাতেই ররকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে হয়েছিল।
চাকরী করার পাশাপাশি রর লিখত আর এতে মা কখনো বাধা দেন নি, বরং উৎসাহ দিয়েছেন।
রর র জীবনে ওর মায়ের একটা বিশেষ জায়গা আছে, কারণ বাবা
মারা যাওয়ার পর মা অনেক কষ্ট
করে ওকে মানুষ করেছিলেন এবং কখনো বাবার অনুপস্থিতি বুঝতে দেন নি।
রর এই নামেই পাঠক মন্ডলের কাছে পরিচিত তাই ওর সম্পূর্ণ নামটা উহ্য রাখলাম। রর ওর ঠিক ছদ্মনাম নয়। স্কুলের বন্ধুরা
ওর নাম ও পদবীর আদ্যাংশ নিয়ে ওকে রর বলে ডাকতো। তাই রর
ওর একটা ডাক নাম হয়ে গেছে।
রর যখন প্রথম সিংহভিলায় পা রাখল তখন প্রথম দর্শনেই ও
এই বিশাল প্রাসাদটিকে ভালো
বেসে ফেললো। প্রকান্ড সদর দরজা । অবশ্যই গ্রীলের। গ্রীলের ডিজাইনটা বাংলা বর্ণমালা দিয়ে
তৈরী। সবকটাই স্বরবর্ণ।কালো
রঙের অ আ ই ঈ গুলোর মাত্রা
সোনালী রঙের। দারোয়ান দরজা খুলে দিতেই গাড়ী ঢুকে বাঁদিকের
গাড়ীবারান্দায় থামল । তারপর সুন্দর ও বিশাল বাগান। মাঝখানে মোরাম বিছানো হাঁটা পথ শেষ হয়েছে শ্বেত পাথরের সিঁড়িতে।দুধাপ অর্ধগোলাকৃতি সিঁড়ি পেরিয়ে বিশাল প্রাসাদ।
বাগানের বামদিকে দেখা যাচ্ছে
মস্ত দিঘি। তার ধারে বাঁধা আছে
মোটর চালিত ছোট বোট।আরো পেছনে বিশাল বিশাল গাছ, তার ছায়া পড়েছে দিঘির জলে। সেই জল যেমন নিস্তরঙ্গ,প্রাসাদটি ততোধিক নিঃস্তব্ধ।
পদবী সিংহের সঙ্গে পশুরাজের
কোন সম্পর্ক আছে কিনা রর
জানে না। তবে অবাক হয়ে দেখল
বাগানের মাঝখানে পশুরাজ
সিংহের একটি মূর্তি , তার মুখগহ্বর থেকে নির্গত হচ্ছে ফোয়ারা। তার চার পাশে শ্বেত পাথরের বসার জায়গা।
আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে এখানে
চারিদিকে শান্তি বিরাজমান। তবুও
রর র মনে হল এই গভীর শান্তির
আড়ালে কোথাও কোন ষড়যন্ত্র
লুকিয়ে নেই তো?
সিংহ ভিলা থেকে যাওয়ার দেরী আছে, এখন এখানে আসার কারণটা জানা যাক।
বিগত বেশ কিছুদিন আগে রর র মা অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁর ব্লাডক্যান্সার ধরা পড়ে।
রর র মাবসুমতী দেবীর অসম্ভব মনের জোর। তিনি ররকে বলেন যে
"ভাবিস না, চিকিৎসা করলে সেরে যাবে। চল আমরা মুম্বাই যাই। টাটা
হসপিটালে চিকিৎসা করাবো।
রর এক কথায় রাজী হয়ে মাকে
নিয়ে মুম্বাই যায়। দীর্ঘদিন চিকিৎসা করানোর পর চিকিৎসকরা বলেন বসুমতি দেবী
বিপদ মুক্ত। রর মাকে নিয়ে ফিরে
আসে। মা তো মোটামুটি সুস্থ কিন্তু
ওই প্রবাদ আছে না যে কিছু পেতে গেলে কিছু দিতে হয়। তাই ফিরে আসার পর দেখা গেল যে মায়ের
ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স প্রায় শূন্য আর রর র চাকরীটি ও নেই। দীর্ঘ দিন
কামাই করার অপরাধে কোম্পানী
ওকে ছাঁটাই করে দিয়েছে। মায়ের চিকিৎসা চলছে। মাসে মাসে চেক
আপ, ব্লাড টেস্ট চলতেই থাকবে। মাকে পুষ্টিকর খাবার খাওয়াতে হবে।ভরসা শুধু মায়ের পেনশনটুকু। রর হন্যে হয়ে চাকরী
খোঁজে। এরই মধ্যে করোনার করাল গ্রাসে শুরু হলো লকডাউন। সমস্ত অফিসবন্ধ।
কর্মী ছাঁটাই শুরু হয়েছে। রর র
অবস্থা শোচনীয়। ছোট থেকে
কখনো কোন সমস্যায় ও পড়েনি, মা পক্ষীশাবকের মত ডানা দিয়ে
ওকে আগলে রেখেছেন এতদিন।
আজ মায়ের বিপদের সময় ও
অসহায়।
রর এতদিন মায়ের চিকিৎসা করানোর জন্য ব্যস্ত থাকায় লিখতে পারে নি এতদিন। একটা ধারাবাহিক অসমাপ্ত হয়ে আছে।
রর তাই সেদিন সময় করে প্রকাশকের বাড়ী গেল পাওনা টাকা আদায়ের জন্যে।
প্রকাশক হতাশ হয়ে বললেন,"দেখছেন তো অবস্থা । করোনার জন্য সব বন্ধ। কর্মীরা
আসবে কী করে?কজন কর্মী মারা
গেছেন। ছাপা খানা বন্ধ। মাইনে পত্র দিতে পারছিনা, আপনার টাকা কীভাবে দেবো মশাই?"
কিছু বলার নেই। রর ফিরে আসে।
এরপর একদিন মায়েরও করোনা
হয়। উডল্যান্সে ভর্তি করে মাকে। ভাবে বাড়ীটা মর্টগেজ রেখে টাকা
লোন নেবে। কিন্তু মায়ের ঘনিষ্ঠ
বন্ধু করবী মাসী দশলাখ টাকা
ধার দেন, বলেন, "পরে শোধ করে দিস।"
সদ্য ক্যান্সার থেকে মুক্ত বসুমতী দেবী অনেক লড়াই করে ও জিততে পারলেন না, করোনার
কাছে হেরে গেলেন। রর মায়ের মুখটুকুও শেষ সময়ে দেখতে ,ছুঁতে পারলো না। প্লাস্টিকের ব্যাগে মোড়া দেহ চরম অশ্রদ্ধায় দাহ করা হল।
মা চলে যাওয়ায় রর একদম একা
হয়ে গেল।খুব কাছের মানুষ কে হারানোর ব্যথা রর আগে কম বয়সে দুবার পেয়েছে। বাবা ও ঠাকুমাকে হারানো ছাড়াও খুব কাছের এক বন্ধু কে ও হারিয়েছে।
প্রত্যেকবার পাশে মা ছিলেন। ওকে দুহাতে আগলে রেখেছেন। এখন মা চলে গিয়েওর মাথার ওপরের ছায়াটাই সরে গেছে।
রর এখন করবী মাসীর টাকা শোধ করার চিন্তায় পাগলপ্রায়। এমন সময়ে প্রকাশক মশাই ফোন করে ডেকে পাঠালেন।
রর প্রকাশকের বাড়ীতে গেলে তিনি বললেন,"বিখ্যাত লেখক
রণজয় সিংহকে চেনেন? তিনি
অপনাকে ডেকে পাঠিয়েছেন
তাঁর বাড়ীতে।"
রর বলে,"না, চিনি না। আমাকে
কেন ডেকে পাঠিয়েছেন? আর যে কেউ ডাকলেই আমি যাবো কেন?"
"সে আপনার ব্যাপার মশাই।ওনার সেক্রেটারী ফোন করে বললেন
একটা কাজ করাতে চান আপনাকে দিয়ে,যা টাকা লাগবে
দেবেন।"
"কী কাজ?"
"তা তো বলে নি। তবে মনে হয়
লেখা জোখার কাজ।"
এবার রর বলে,"কখন, কোথায় যেতে হবে?"
"আপনি একটু অপেক্ষা করুন, চা
পান করুন,আমি ফোন করছি,উনি গাড়ী পাঠিয়ে দেবেন।"
রর কিছু ক্ষণ অপেক্ষা করার পর
গাড়ী এলো।গাড়ীতে বসে রর চিন্তা করছিল কেন ওকে অতবড় একজন লেখক ডেকে পাঠিয়েছেন। মায়ের অসুখের জন্য
অনেকদিন অন্য কারো লেখা পড়তে পারে নি রর। তবে শুনেছিল যে রণজয় সিংহ র লেখা
উপন্যাস অবলম্বনে হওয়া সিনেমা
দর্শকমহলে হৈ চৈ ফেলে দিয়েছে।
আরো দু টি ভাষায় ডাবিং হয়েছে।
রর অবশ্য সেই সিনেমা দেখেনি।
বইটিও পড়ে নি। নেতিবাচক গল্প
রর র পছন্দ নয়। রর নিজে
অন্য ঘরানার লেখক,তবে ওর সঙ্গে রণজয়ের দেখা করতে চাওয়াটাই ওকে অবাক করেছে।
গাড়ী ওকে নিয়ে সিংহভিলায় এলো। রর মুগ্ধ হয়ে চারপাশ টা
দেখছিল। গাড়ীর আওয়াজ পেয়ে
একটি ফুটফুটে শিশু প্রাসাদের ভেতর থেকে বেরিয়ে অবাক হয়ে
রর র দিকে তাকিয়ে রইল।
পরের পর্ব আগামী কাল।
পর্ব ২
শিশু টির ঠিক পেছনেই একজন পরিচারিকা এসেছিল। সে খুব সম্ভ্রমের সঙ্গে ররকে ডেকে একটি বিশাল ড্রইংরুমে বসিয়ে বলল,"আপনি বসুন, ম্যাডাম এখুনি আসছেন।" নরম গদির সোফায় ডুবে গিয়ে রর দেখল শিশু কন্যাটি অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। কোঁকড়ানো ঝাঁকড়া চুলে মেয়েটির চোখ ঢাকা পড়ে গেছে। উৎসূক দুটি চোখ চুলের ফাঁক দিয়ে ররকে নিরীক্ষণ করছে। গালদুটি আপেলের মত লাল। ঠিক যেন একটা পুতুল। রর ওকে কাছে ডেকে নাম জিজ্ঞেস করায় মিষ্টি হেসে বলল "জিনি", তার পর একছুটে বেরিয়ে গেল। তারপরে যে ঘরে ঢুকলো তাকে দেখে রর অবাক হয়ে গেল। সেই চোখ, সেই মুখ। কী করে হয়? সে তো আর নেই। থাকলেও তার হাতে তো শাঁখা পলা, মাথায় সিঁদুর এসব থাকার কথা নয়! ররকে চমকে দিয়ে সেই নারী দুহাত জোড় করে ররকে বলল, "নমস্কার"।সেই পরিচিত কন্ঠস্বর। রর উঠে দাঁড়িয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মত বলল,"নমস্কার"। "বসুন, বসুন মিঃ রর।" রর বসলো। "চা না কফি?" "না না, কিছু লাগবে না। মিঃ রণজয় সিংহ আমাকে ডেকেছেন, তিনি কোথায়?" রমণী মাথা নীচু করছ থাকে কিছু ক্ষণ, তারপরে বলে,"মিঃ রর, আমি আপনাকে কিছু কথা বলবো।আপনাকে কতটা ভরসা করতে পারি?" "কোন ব্যাপারে ম্যাডাম?" "যে ব্যাপারে ডেকেছি, সেই ব্যাপারে।" "আপনি ডেকেছেন?" "হ্যাঁ, আমিই ডেকেছি।" "মিঃ সিংহ ডাকেন নি?" "না, মিঃ রর, রণজয় সিংহ আমার স্বামী। উনি খুব অসুস্থ। এই কথাটা আপনাকে গোপন রাখতে হবে।আমি জানি আপনাকে বিশ্বাস করা যায়, নির্ভর করা যায়।" "কী করে জানলেন? আপনিতো আমাকে প্রথম দেখছেন।" সন্দিগ্ধ চোখে তাকায় রর। "মেয়েদের মানুষ চেনার ক্ষমতা পুরুষের থেকে বেশী। আপনাকে একবার দেখেই আমি অনেকটা চিনে গেছি।" "তাই নাকি? আচ্ছা এবার বলুন মিঃ সিংহের কী হয়েছে?" "একটা মারাত্মক দুর্ঘটনার কবলে পড়ে উনি শয্যাশায়ী। কথা বলা বা চলাফেরার শক্তি নেই। উনি একটা উপন্যাস লিখেছিলেন,শেষ করার আগেই দুর্ঘটনাটা ঘটে। ওটা শেষ হলে অনেক টাকা পাওয়ার কথা ছিল। আপনাকে আমি ডেকে পাঠিয়েছি কারণ আমি চাই যে আপনি ওই উপন্যাস টি শেষ করে দিন। আপনি যা টাকা চাইবেন আমি দেবো। শুধু ব্যাপারটা গোপন থাকবে।" "তা, আমাকেই ডেকে পাঠালেন কেন? আমাকে চিনলেন কী করে? আমার লেখা কী আপনি পড়েছেন?" "মিঃ রর, আপনার অনেক বই আমি পড়েছি, তাতে আমার মনে হয়েছে যে আপনি আমাকে সাহায্য করতে পারবেন।" "কিন্তু আমি মিঃ সিংহ র লেখা বই বেশী পড়িনি। কারণ ওনার লেখা চরিত্রগুলো বড় বেশী নেতিবাচক। আমার অমন লেখা পছন্দ নয়। খলনায়ক নায়িকা প্রধান চরিত্র আমার কলম থেকে বের হবে না,সরি। তাছাড়া ব্যাপারটা আমার ঠিক পছন্দ হচ্ছে না।" মিসেস সিংহের সুন্দর চোখ দুটি জলে ভরে গেল। "অনেক আশা নিয়ে , অনেক কষ্ট করে আপনাকে খুঁজে বার কর লাম। আসলে ওনার চিকিৎসার জন্যে অনেক টাকা খরচ হচ্ছে তো। উনি আর কোনদিনও লিখতে পারবেন না,তাই ভাবলাম ওনার শেষ লেখাটা যদি শেষ করা যায় তবে অনেকগুলো টাকা পাওয়া যায়। অল্পই বাকী। আপনার প্রকাশকের কাছে আপনার খোঁজ করছিলাম, উনি বললেন আপনার মা অসুস্থ, আপনার টাকা দরকার। তাই আপনাকে বিরক্ত করলাম। আপনি রাজী না হলে ও কাউকে ব্যপারটা বলবেন না প্লিজ। ওনার পাঠকরা , ফ্যানরা জানে না উনি এখন অক্ষম।" "ম্যাডাম, আমাকে ভাবার জন্য একটু সময় দিন। একথা ঠিক, আমার টাকার দরকার ছিল। মা মারা গেছেন। অনেক ধার হয়ে গেছে। তাও ভেবে দেখি পারবো কিনা।" " মা আর নেই? তবে আপনি কী এখন একা মিঃ রর?" "হ্যাঁ, একা।" "তাহলে এক কাজ করুন না, আমার বাড়ী এসে কদিন থাকুন। ওনার স্টাডিতে গিয়ে উপন্যাস টি পড়ুন, ওনার লেখা আরো কিছু পড়ে দেখুন আপনি পারবেন কিনা।" রর বললো, "আমি রাজী। রবিবার আমি আসবো। তার আগে কিছু কাজ আছে সেরে নেবো। তবে সকালে এসে আমি সন্ধ্যায় চলে যাবো।" মিসেস সিংহ বলল,"আমি কৃতজ্ঞ।" চলে যাবার সময় রর দেখলো বাগানে একটা হুইল চেয়ারে এক সুদর্শন ব্যক্তি আধশোয়া হয়ে আছেন। একজন নার্স পাশে দাঁড়িয়ে। ভদ্রলোকের হাত পা দুটো ই অসহায় ভাবে এলিয়ে পড়ে আছে। অত বড়ো একজন লেখকের এই পরিণতি ররকে ব্যথিত করে। মিসেস সিংহ বললেন,"আমার স্বামী।" রর হাত জোড় করে নমস্কার জানালো। লক্ষ্য করলো ভদ্রলোক তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন রর র দিকে। সেই জ্বলন্ত দৃষ্টি যেন ররকে ভষ্ম করে দেবে। মিসেস সিংহ ররকে গাড়ীতে তুলে ড্রাইভারকে বলল,"স্যারকে বাড়ীতে নামিয়ে দেবে, আবার রবিবার নিয়ে আসবে।" রর আপত্তি করায় মিসেস সিংহ বলে,"এত দূরে বাড়ী আমার। আপনি কেন কষ্ট করবেন? দরকার তো আমার।" রর বলছ,"আপনার নামটা..." একটু চুপ করে থেকে উত্তর দেয়,"ললিতা"। গাড়ীতে যেতে যেতে রর ভাবে দুটো মানুষের এত মিল কী করে হয়? অতীতে মন বিচরণ করতে থাকে। কলেজে গিয়ে বন্ধুত্ব হয়েছিল আর এক রর র সঙ্গে। রর নাম্বার ২ । ওদের গভীর বন্ধুত্বের জন্যে অন্য বন্ধুরা ওদের একসঙ্গে বলত রর স্কোয়ার। এই দ্বিতীয় রর ছিল তরুণী। রীনা রহমান। ভিন্ন ধর্মের কারণে ই বোধ হয় ওদের ভালোবাসা ছিলো অনুচ্চারিত। তবে দুজনেই বুঝতো ওরা পরস্পরকে ভালো বাসে। রীনার আপা রাবেয়া মেডিকেল কলেজে পড়তো। ভালো বাসতো জয় সেনকে। ফাইনাল ইয়ারে রাবেয়া বললো,"রীনা, আমি আজ আব্বু আর ভাইয়াকে বলবো জয়ের কথা।" রীনা বলেছিল ররকে সবটা। সেদিন রাতে রাবেয়ার কাছে সব শুনে আব্বু বলেছিলেন," জয়ের বাড়ীতে মেনে নিলে আমার আপত্তি নেই। যদিও আমাদের সমাজ মেনে নেবে না হিন্দুর ছেলের সঙ্গে শাদী। তবে তুমি ।যদি খুশি থাকো,তবে কাল দেখা করতে বোলো আমার সঙ্গে। রীনা খুশীতে উচ্ছ্বল হয়ে বলেছিল ররকে,"আপার শাদীতে আব্বু মত দিয়েছেন আমি ভাবতেও পারছি না।আপার শাদীর পর আমিও আব্বুকে বলবো আমার কথা।" হঠাৎ করেই চুপ হয়ে যায় রীনা "কী বলবে রীনা?" "জানি না, যাও।" লজ্জায় লাল হয়ে যায় রীনা। কিন্তু পরদিন রীনার আব্বুর সঙ্গে দেখা করতে আসার পথে জয় পথ দুর্ঘটনায় মারা যায়। রাবেয়া পাথরের মত স্তব্ধ হয়ে যায়। ধীরে ধীরে অবসাদে চলে যায়, শেষে একদিন প্রচুর ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যা করে। রীনা কলেজে আসা বন্ধ করে দেয়। বেশ কদিন পরে কলেজে আসে। ক্লাস করে না। বলে ,"চল কথা আছে।" ওর চেহারা দেখে মনে হয় ওর ওপর দিয়ে বড় ঝড় বয়ে গেছে। রেস্টুরেন্টে র কেবিনে বসে একটা চিঠি দেখিয়ে ছিল। "বোন, নিজের লোক বিশ্বাস ঘাতক হলে কী করে তাদের সঙ্গে থাকা যায়, তাদের কীকরে শ্রদ্ধা করা যায়? জানিস, আমি লুকিয়ে ওদের কথা শুনে বুঝেছি যে জয়কে গাড়ীচাপা দেবার পেছনে ভাইয়া আর আব্বুর হাত আছে। আমার সঙ্গে সেদিন অভিনয় করেছিল ওরা। আমি জয়ের কাছে চললাম। ওদের থেকে সাবধানে থাকিস। তোর আপা। কান্নায় ভেঙে পড়ে রীনা।" কাউকে ছাড়বো না। পুলিশের কাছে যাবো।" রর বোঝায়,"আপা ঠিক বলেছে কি না তুমি জানো না। অনুমানের ওপর ভিত্তি করে কিছু কোরো না রীনা। ওঁরা তোমার আপনজন। "আপা ঠিক বলেছে রর।ওরা খুব রক্ষণশীল। সেদিন আব্বু মত দেওয়াতে আমিও অবাক হয়েছিলাম। এখন বুঝছি সব নাটক ছিল। আমি আজকে ই প্রতিবাদ করবো।" রীনা এরপর উদভ্রান্তের মত ছুটে চলে যায়। রর জানে না রীনা প্রতিবাদ করেছিল কি না। কারণ পরদিন থেকে রীনা কে খুঁজে পাওয়া যায় নি। দুদিন পরে বড় ঝিলে ভেসে উঠেছিল রীনার ওড়না আর চটি। কিন্তু অনেক তল্লাশি করেও দেহ পাওয়া যায় নি। হয়তো কোন গভীর গর্তে আটকে গেছে। আজ ললিতাদেবীকে দেখে রর নাম্বার ২ এর কথা মনে পড়ে কষ্ট পাচ্ছিল রর। জীবনের আসা যাওয়ার পথে কত দুঃখ জমে থাকে অন্য কেউ তার হদিস পায় না।
পরের পর্ব আগামী কাল।
পর্ব ৩
রবিবার সকাল আটটায় সিংহ ভিলা থেকে গাড়ী এলো। রর
গাড়ীতে বসেও ভাবতে লাগলো
ও যে কাজ করতে যাচ্ছে তা ন্যায় সঙ্গত কিনা। ওর বিবেক দ্বিধাবিভক্ত হয়ে দুরকম ভাবে চিন্তা করছে। একভাগ ভাবছে
এক অসুস্থ মানুষ কে সাহায্য করে তার পরিবারের উপকার করবে। এতে দোষ কোথায়। ও তো নিজে
কোন প্রতারণা করছে না।
আর এক ভাগ ভাবছে লেখক যদি একদিন সুস্থ হয়ে যান, সেদিন যদি উনি শেষ লেখাটি সমাপ্ত করতে গিয়ে দেখেন ইতিমধ্যে তা সমাপ্ত,
তখন উনি নিশ্চয় আঘাত পাবেন।
আবার টাকারও তো দরকার।
অন্যের লেখা শেষ করার জন্যে
যদি পারিশ্রমিক পাওয়া যায় তবে দোষ কোথায়?
ভাবতে ভাবতে অনেকটা রাস্তা পার হয়ে এসেছে। সিংহ ভিলা শহর ছাড়িয়ে অনেকদূরে। গ্রামের পর্যায়েই পড়ে জায়গাটা। গাড়ী না থাকলে এতদূর থেকে শহরে যাতায়াত করা সম্ভব হতো না।
ধানক্ষেত, আমবাগান, কলা বাগান পেরিয়ে ওই তো দেখা
যাচ্ছে সিংহ ভিলার প্রকান্ড সদর দরজাটা।
শুধু উপন্যাস আর গল্পলিখে এতটাকা উপার্জন করা যায় যে
এতবড় প্রাসাদ তৈরী করা যায়
অবাক হয় রর।
এই কদিনে রর রণজয় সিংহ র
খোঁজ খবর নিয়েছে একাধিক
প্রকাশকের কাছে। সবাই বলেছে
ওনার মত ভালো মানুষ খুঁজে পাওয়া যায় না। সৎ এবং পরোপকারী হিসেবে ওনার সুনাম আছে।
সিংহভিলায় গাড়ী ঢুকলে রর র
ভাবনায় ছেদ পড়লো। ড্রাইভার
গাড়ীর দরজা খুলে দিলে ও বেরিয়ে এলো।আগেরদিনের পরিচারিকা ওকে বসিয়ে চলে
গেল।
বাড়ীটা অসম্ভব চুপচাপ। এতবড় প্রাসাদ অথচ জনশূন্য। শুধু একটা
পাখীর শিষ ধ্বনি শোনা যাচ্ছে একটানা। কী পাখী দেখার জন্যে
জানলার কাছে গিয়ে বাইরে দৃষ্টি
মেলে ধরে। মস্ত বড় বড় গাছ জড়াজড়ি করে একটা ছায়াঘন
পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। তারই ফাঁক
দিয়ে অনেক দূরে দেখা যাচ্ছে দু একটা কুঁড়েঘর।
রর র মনে হয় এই পরিবেশে থাকতে গেলে প্রাসাদ নয়, ওই কুঁড়েঘরই উপযুক্ত থাকার জায়গা।
এবার ললিতাদেবী নিজে এসে
রর কে খাবার টেবিলে নিয়ে গেল।
টেবিলের একপ্রান্তে ছোট্ট জিনি
বসে আছে। লুচি ,আলুর দম, ডিমের ওমলেট খেতে খেতে রর জানতে চায় রণজয় ব্রেকফাস্ট
করেছেন কিনা। ললিতা বলে নার্স ওকে সুপ খাইয়ে দিয়েছে আর নিজের ব্রেকফাস্ট নিয়ে ওপরে চলে গেছে।
খাওয়ার পরে ললিতা এক কাপ কফি এনে বলে," আপনার কফি।"
"আমি চিনি ছাড়া ব্ল্যাক কফি খাই।"
"আমি জানি তো।" ললিতা হেসে
বলে।
"কী করে জানলেন?"চমকে ওঠে
রর।এ বাড়িতে শুধুই চমক!
"আমার প্রিয় লেখকের পছন্দ
অপছন্দ জানবো না? ফ্যানদের কাছে সব খবর থাকে।"
"কিন্তু আমি তো অত বড় লেখক
নই যে আমার খবর সবাই জানবে।"
একটু হেসে ললিতা বলে,"চলুন এবার স্টাডিরুমে।"
কোথায় দাঁড়ি টানতে হয় ললিতা
ভালো করেই জানে।
বিরাট স্টাডিরুম। একপাশে সোফা। মাঝখানে চেয়ার টেবিল।
"লিখতে লিখতে ক্লান্ত লাগলে
সোফায় বসে বিশ্রাম নেবেন।এই
বেলটা বাজালেই মালতী এসে চা কফি দিয়ে যাবে। আমি কিছু ক্ষণ
থাকবো না। জিনিকে স্কুলে দিয়ে কিছু কেনাকাটা করতে যাবো। "
অসমাপ্ত উপন্যাসের পান্ডুলিপিটা
ররকে দিয়ে ললিতা বেরিয়ে গেল।
রর পড়তে শুরু করলো। নেগেটিভ
লেখা ওর পড়তে তেমন ভালো না
লাগলেও রর মন দিয়ে পড়তে থাকল। কিন্তু এই বাড়ীর অসম্ভব
নিস্তব্ধতা ওকে অস্বস্তিতে ফেলছিল। অনেক দূরে গেটে
দারোয়ান , ওপরে একজন অর্ধচেতন মানুষ আর নার্স
মাঝখানে রর একা। যে দুজন পরিচারিকা আর মালী কাজ করে তারা যে যার কাজ সেরে চলে গেছে। মালতী কোথায় জানা নেই। হঠাৎ সেই শুনশান পরিবেশ ভেদ করে কারো কন্ঠস্বর শোনা গেল । কন্ঠস্বরটি পুরুষের।
এখানে পুরুষ বলতে দারোয়ান আর রর। দারোয়ান কে
দেখা যাচ্ছে চুপ করে বসে আছে।
তাহলে কথা বলছে কে?
রর ঘুরে দেখবে নাকি? কিন্তু ললিতাদেবী তো তাকে সারা বাড়ীতে ঘুরে বেড়ানোর অনুমতি
দিয়ে যায় নি। বিনা অনুমতিতে কারো ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক গলানোটা ঠিক হবে না। আচ্ছা,
ললিতা ও রণজয়ের বিরুদ্ধে কোন ষড়যন্ত্র হচ্ছে না তো?
পড়ায় মন বসাতে পারছে না রর।
টেবিল থেকে উঠে বাগানে পায়চারী করবে বলে রর বাগানে
গেল। হঠাৎ ওপরে চোখ পড়তে মনে হল পর্দার আড়াল থেকে একটা মুখ চট করে সরে গেল। কিন্তু নার্সটি তো ঝিলের পাড়ে
বসে আছে। তাহলে ওপরে কে?
ঘরে গিয়ে বেল বাজাতে মালতী
ছুটে এলো।
"কিছু লাগবে স্যার?"
"মালতী , ওপরে কেউ এসেছেন?
গলার আওয়াজ শুনলাম।"
"না তো স্যার। কেউ নেই।"
"ঠিক আছে।"
রর বুঝলো মনের ভুল। রর আবার
পড়তে শুরু করলো।
খলনায়ক ব্ল্যাক প্যান্থার নায়িকার বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র
করছে। ইতিমধ্যে চারটে খুন হয়ে গেছে। পঞ্চম খুনের চেষ্টা চলছে।
কিন্তু খলনায়ককে কিছুতেই ধরা যাচ্ছে না। সে ভাল মানুষের মুখোশ পরে লুকিয়ে আছে সবার মাঝে। অনেক গুলো এপিসোড
লেখা হয়ে মাসিক পত্রিকায় বেরিয়ে গেছে। গল্পটি এক প্রযোজকের খুব পছন্দ হওয়ায়
তিনি প্রচুর টাকা অ্যাডভান্স দিয়ে
আগাম কিনে রেখেছেন উপন্যাস টি চলচ্চিত্রের জন্যে।এখন যদি গল্পটি শেষ না করা যায় তবে
সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। প্রকাশক
ললিতা দুজনেই বিপদে পড়বে।
তাই রর রণজয়ের লেখা আরো
কয়েকটা লেখা পড়ে দেখবে কীভাবে শেষ করলে লেখাটি ঠিক
রণজয়ের লেখার মতই হবে।
এইভাবে রোজ রর এখানে এসে
স্টাডিরুমে ব্যস্ত থাকে। ললিতা
রোজ জিনিকে নিয়ে স্কুলে যায়। আবার বিকেলে ফেরে। মালতী
ররকে খেতে দেয়।
এর মধ্য আরো দুদিন ওপর থেকে
ভেসে এসেছে পুরুষ কন্ঠস্বর।
নার্সটি রণজয় ঘুমলে বাগান নয়তো ঝিলপাড়ে বসে থাকে।
মালতীকে প্রশ্ন করলে ওর ভয়ার্ত চাউনি চোখে পড়ে।
রর র নিশ্চিত যে এই বাড়ীতে
কোন রহস্য আছে।
এইভাবে কেটে গেলো আটটা দিন। রর এক লাইন ও লিখতে
পারে নি এখনও।
এরমধ্যে ঘটে গেল এক ঘটনা।
ন দিন পার হয়েছে। সেদিন দুপুর
থেকেই শুরু হয়েছে প্রচন্ড ঝড় বৃষ্টি। সন্ধ্যায় তা প্রবল আকার ধারণ করলো।
সিংহভিলা ছিল ডায়মন্ড হারবারের কাছাকাছি এক গ্রামে।
ড্রাইভার জানালো স্যারের বাড়ী
বালিগঞ্জে এখন যাওয়া যাবে না, রাস্তায় এত জল জমেছে যে ইঞ্জিনে জল ঢুকে যাবে। ললিতা
ররকে থেকে যেতে বললো।
অত বড়ো একতলায় একা একটা
ঘরে শুয়ে রর র গা ছমছম করতে
লাগলো।
মাঝরাতে ওপরে খুব জোর একটা
আওয়াজে রর র ঘুম ভেঙে গেল।
কিছুক্ষণ পরে দরজায় ঘন ঘন
করাঘাতে দরজা খুলে দেখে
ললিতা। ললিতা বললো,"রর, এখুনি ওপরে চলুন। রণজয় খাট থেকে পড়ে গেছে।ওকে তুলতে
হবে।"
ওপরে গিয়ে দেখে রণজয় উপুড়
হয়ে পড়ে আছেন। দুজন মিলে
ধরাধরি করে তাঁকে খাটে শোয়ান হলো। ললিতা একটা খাতা খুলে
ররকে বললো ডক্টর আদিত্যের নম্বরে ফোন করতে। ললিতা তখন পরিশ্রম করার ফলে হাঁপাচ্ছিল।
ফোন ডায়াল করে রর ললিতাকে দিল। ডাক্তার একটা ওষুধ খাইয়ে
দিতে বললেন। ওষুধ খেয়ে রণজয় চোখ বন্ধ করলেন।
রর নেমে এলো। ঘরে এসে নেট সার্চ করে দেখল ওষুধ টা একটা
মামুলি ভিটামিন ওষুধ।
একটু পরে ললিতা এলো। কিছু
সময় চুপ থাকার পর কান্নায় ভেঙে পড়লো। খানিক সামলে
নিয়ে ধীরে ধীরে বলল,"রর আজ
আপনি না থাকলে আমি কী করতাম। মালতী আর আমি এই দুজন মেয়ে এত বড় বাড়ীতে একা
থাকি। রর, প্লিজ আপনি তো একা। এখানে থেকে যান না।আপনি থাকলে আমি সাহস পাবো।"
রর বললো,"ঠিক আছে, বইটা
লেখা শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমি
থাকবো।"
পরের পর্ব আগামীকাল।
পর্ব ৪
রর কে ললিতা কিছু নতুন জামা
কাপড়, টুথব্রাশ প্রভৃতি দিয়ে বলল,"এই বৃষ্টির মধ্যে এখন
আপনাকে বাড়ী গিয়ে সব আনতে
হবে না। রণজয়ের জন্য কেনা ছিল। এগুলো এখন পরে কাজ চালিয়ে নিন।"
রর একটু লজ্জায় পড়ে গেলেও
বাধ্য হয়ে রণ র পোশাক পরে
স্টাডিরুমে গিয়ে একটা অন্য পান্ডু
লিপি খুলে বসলো। আসলে ও চাইছে রণজয়ের লেখনী ঘরানার
সঙ্গে পরিচিত হতে। দশদিন পার হয়ে গেল এখনো এক কলম লেখা
হলো না।
পান্ডুলিপির প্রথম দিকটা পড়ার পর রর র মনে হল এটা কোন
উপন্যাস নয়, এটা একটা রোজ
নামচা বা ব্যক্তিগত ডায়েরী।
এটা পড়া কী উচিত হবে? যেটুকু
পড়েছে তাতে পড়ার আগ্রহ আরো
বেড়ে যাচ্ছে।
বাইরে তুমুল বর্ষণ। আকাশ কালো
করে আছে। আজ ললিতা বাড়ীতেই আছে। জিনি মাঝে মাঝে এসে পর্দা সরিয়ে টুকি করে
চলে যাচ্ছে।
একটা বিষয় এই কদিনে রর লক্ষ্য করেছে, যে জিনিকে ওপরে উঠতে দেয় না ললিতা। অথচ ললিতা কাছাকাছি না থাকলেই জিনি ওপরে চলে যায়। ললিতা আসার আগেই মালতী জিনিকে ডেকে নেয়। এই ব্যাপারে জিনি আর মালতীর মধ্যে একটা বোঝাপড়া আছে।
ডায়েরীতে মনোনিবেশ করে রর।
"আমি রণজয় সিংহ। সাহিত্য নিয়েই আমার পড়াশোনা করা।
তুলনামূলক সাহিত্যে এম এ করার পর পি এইচ ডি করে অধ্যাপনা
করছিলাম। আমার বাহির টা দেখে সবাই সম্মান করলেও
ভিতরে আমি একজন অন্য মানুষ।
...............................
....... ........
"ললিতাকে আমি খুব ভালো বাসি। ও আমার জীবনে এসেছে আলো হয়ে।ও আমার অন্ধকারের
প্রদীপ।
ললিতা শুধু আমার। ওকে আমি
অন্য কারো সঙ্গে ভাগ করে নিতে
পারবো না। আমাদের মাঝে যেই
আসুক তাকে সরে যেতে হবে। সে যেই হোক না কেন।তাই প্রথম যেদিন শুনলাম ললিতা মা হবে,
সেদিন থেকেই আমি চেষ্টা করতে লাগলাম কীভাবে সেই শিশুকে
পৃথিবীতে না আসতে দেওয়া যায়।
বাথরুমে সাবান জল ফেলে রেখেছি, ললিতা পড়ে গেছে। সিঁড়িতে ক্রিম ফেলেছি,ললিতা
গড়িয়ে গেছে। সববারই ও বেঁচে
গেছে।
সুস্থভাবেই জন্মেছে রাজ, রাজর্ষি,
ললিতার পুত্র, ললিতার দেওয়া নাম।"
এইজায়গাতে থমকে গেলো রর।
ললিতা তার ছেলের নাম রেখেছে
রাজর্ষি!এটা কী কাকতালীয়?
"রাজ তো আমার ও সন্তান, কত আদরের ধন, কিন্তু যখন দেখি
ললিতা দিনের বেশীর ভাগ সময়
রাজকে দিচ্ছে, এমন কী রাতেও
ও রাজকে ছেড়ে আমার কাছে
আসছে না, তখন আমার মাথায়
আগুন জ্বলে উঠতো। একবার ওকে আমি বোটে চড়ানোর নাম করে জলে ফেলে দিলাম। সাঁতার
জানা সত্ত্বেও ইচ্ছা করেই ওকে
তুলতে দেরী করলাম।
রাজ চলে
গেল। ললিতা পাগলের মত হয়ে গেল। ওই সময়ে আমি সারাদিন
ওর কাছে থাকতাম। ললিতা সব
সময় আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে
ধরে থাকত। আমি আমার ললিতাকে নিজের করে ফিরে
পেলাম। দ্বিতীয় বার যখন ললিতা
মা হবে জানলাম, তখন আবার
আমার মধ্যের শয়তান টা জেগে
উঠলো।..."
রর র গা শিউরে উঠছিল প্রতিটি
লাইন পড়ার সময়। ও একবার
ভাবলো ললিতাকে সবটা বলে দেবে। পরক্ষণে ভাবলো কী দরকার এইসব অশান্তির মধ্যে
ঢোকার, তার থেকে ভালো যে কাজ করতে এসেছে সেটা করে
তাড়াতাড়ি চলে যাওয়া ভালো।
রর ডায়েরীটি বন্ধ করে আসল কাজে মন দিল।
বৃষ্টি কমে গিয়ে আবার শুরু হয়েছে। টি ভির পর্দায় দেখাচ্ছে
জলবন্দী কলকাতার দৃশ্য।
বেশ বেলা হয়ে গেছে।এমন সময়
ললিতা দুকাপ কফি নিয়ে এসে
সোফায় বসে ররকে ডাকল।
রর একটু হেসে উঠে এলো।
ললিতা বলল," মনে হচ্ছে পৃথিবী
ধ্বংস হয়ে যাবে।"
জিনি এসে মায়ের কোল ঘেঁষে বসল।এদের মা মেয়েকে দেখে
রর র মনে পড়ে গেল ডায়েরীর কথা। রণজয় কী জিনিকেও
শেষ করতে চেয়েছিল?
ললিতা বলল,"আজ নার্স আসে নি বৃষ্টির জন্য।"
"তাহলে রণজয় বাবুর সব কাজ
আপনাকেই করতে হবে?"
"হ্যাঁ,সব করা হয়ে গেছে। স্পঞ্জ
করিয়ে দিয়েছি। খাওয়ানো টা
বাকী।"
"উনি কী খাবেন?"
"চামচে করে মুখের কাছেধরলে
উনি সব খেতে পারেন। আজ
মালতী খিচুড়ি করেছে। বৃষ্টির দিনে খিচুড়ি ওনার খুব প্রিয়।
রর আপনি স্নান করে নিয়ে টেবিলে চলে আসুন, ঠান্ভা বেগুনি তো আপনি পছন্দ করেন
না।"
"রর র গলায় কফি আটকে গেল?
কী? আপনি কীকরে জানলেন?"
"আপনার লেখা "একা আমি"
উপন্যাসের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদের
তৃতীয় পাতায় লেখা আছে, পড়েছি।"
"আপনি এত মন দিয়ে আমার
লেখা পড়েছেন জেনে আমি নিজেকে ধন্য মনে করছি, কিন্তু
অতটা যোগ্যতা কী আমার আছে?"
"তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে টেবিলে
আসুন, বেগুনি ঠান্ডা হয়ে যাবে।"
রাতের খাওয়ার পরে কিছুক্ষণ
রর স্টাডিরুমে থাকে। এখানে এসে রণজয়ের ডায়েরীর বাকী
অংশ টা পড়তে আগ্রহ হল।সেই
দুর্দম ইচ্ছা সামলাতে না পেরে রর
আবার পড়তে শুরু করল।
"ললিতা দ্বিতীয়বারে জন্ম দিল
একটি কন্যার। নাম রিনী।শুরু
হল রিনীকে নিয়ে রাতজাগা। আমার ভেতরকার শয়তান টা
আবার জেগে উঠল।
মুখে বালিশ চাপা দিয়ে ছোট্ট রিনীকে শেষ করে দিলাম। আমার
হাত একটু ও কাঁপল না।
রিনীকে হারিয়ে একটু খারাপ লেগেছিল, কারণ ললিতা ভীষণ
দুঃখ পেয়েছিল। ললিতা আবার
আমার কাঁধে মাথা লাগলো।
আমাকে ছাড়তেই চাইত না। আমার হাতে ছাড়া খেত না, আমাকে কোথাও যেতে দিত না।
আমি চাইছিলাম যাতে ললিতা
আর মা না হয়, কিন্তু ও তৃতীয় বার মা হল। ওর শরীর তখন খুব খারাপ। জিনি হবার পর ললিতার
শরীর এতটাই্য ভেঙে পড়েছিল যে জিনির দেখাশোনা করার জন্য
আমাকে আয়া রাখতে হল।
মালতীই জিনিকে মানুষ করেছে
আর ললিতা লতানো গাছের মত
আমাকে জড়িয়ে থেকেছে।তাই
আর জিনিকে মারার আমার
প্রয়োজন হয়নি। জিনি বড় হয়ে আমার আদর কেড়ে নিয়েছে ওর
মিষ্টতা দিয়ে, আমার কাছ থেকে
ললিতাকে কেড়ে নেয়নি। তবে
কোনদিন যদি দেখি আমার থেকে
ও জিনিকে বেশী প্রাধান্য দিচ্ছে,
তখন হয়তো আমার পশুটা আবার জেগে উঠবে।"
রর পড়া শেষ করে ভাবছিল
ললিতাকে সব জানাবে কি না।
জানানোই তো উচিত, একটা
মানুষের মুখোশ খুলে দেওয়া উচিত।
আবার ভাবে এখন তো মানুষ টা
প্রতিবন্ধী অসহায়, এখন জিনির কোন ক্ষতি করার ক্ষমতা নেই। তাই ললিতার মনে দুঃখ হবে, তার মন ভেঙে যাবে, এমন কাজ রর কীকরে করবে? ললিতা যে তার
প্রিয়তমার প্রতিচ্ছবি, যে একদিন
তার প্রিয়জনদের বিশ্বাসঘাতকতা
মেনে নিতে না পেরে নিজেকে অনেক দূরে সরিয়ে দিয়ে ছিল।
ললিতা র ক্ষেত্রে যদি সেরকম
কিছু হয় তবে ছোট্ট জিনির কী হবে?
ললিতা ঘরে ঢোকায় চিন্তা য় বাধা
পড়লো। ললিতা বললো," রর,
আপনার লেখা কতদূর? প্রকাশক
মশাই তাগাদা দিয়েছেন। ওনার
কাছে আর দুমাসের লেখা জমা
আছে। তৃতীয় মাসের লেখা এই মাসের শেষেই জমা দিতে হবে।
আমি যে আপনার ওপর বড় বেশী আশা করে আছি রর।"
"আশাকরি এই মাসের মধ্যেই একটা লেখা দিতে পারবো।
আপনি বসুন ললিতা, আপনার সঙ্গে কথা আছে।"
ললিতা বসে বলে,"কী কথা রর?"
ললিতার মুখের দিকে তাকিয়ে মত পরিবর্তন করে রর কথা ঘোরায়।
বলে, "আপনার সঙ্গে রণজয়ের
বিবাহটা কীভাবে হয়েছিল ললিতা? আপনি কি আগে থেকেই
ওনাকে চিনতেন, না হঠাৎ ই বিয়েটা হয়েছিল?"
ললিতা উঠে দাঁড়িয়ে বলে,"অত তাড়া কেন মিঃ রর? আপনি তো আরো কিছু দিন থাকবেন।সব জানতে পারবেন সময় মত।"
ললিতা র জবাবে কাঠিন্য ধরা পড়ায় রর অপমানিত বোধ করে।
পরের পর্ব আগামী কাল।
পর্ব ৫
ললিতার উত্তর দেবার ধরণে রর
আহত হয়, অপমানিত বোধ করে।
বলে,"সরি ললিতা, আমি ব্যক্তিগত প্রশ্ন করে ফেললাম।
আসলে আপনি রণ জয় সম্পর্কে
কতটুকু জানেন তা জানার চেষ্টা করছিলাম। একটা মানুষের হয়ে
কিছু লিখতে গেলে তার সবটা
জানতে হয়, তার মানসিকতার সঙ্গে পরিচিত হতে হয়। মনে প্রাণে
সে হয়ে না উঠলে লেখাটা তার
নিজের লেখা মনে হবে না"।
"রণজয় একজন খুব ভালো মনের মানুষ ছিল । ছিল বলছি
এই কারণে যে এখন তো সব ভাল
মন্দের ঊর্ধে উনি।"
আগের ব্যবহারের জন্য অনুতপ্ত
হয় ললিতা। বলে,"বসুন, আমি যত টুকু জানি বলছি।
রণজয়ের মা শৈশবেই মারা যান।
বিমাতা ওনাকে ভালো চোখে
দেখতেন না। ওনার বাবার মৃত্যুর
পর বাবার অতুল সম্পত্তি থেকে
বঞ্চিত করেন বিমাতা। বৈমাত্রেয়
ভাই মনোজিত ওনাকে প্রাণে মারার ষড়যন্ত্র করে। তখন সব ছেড়ে স্বোপার্জিত অর্থ নিয়ে লোকালয় থেকে অনেক দূরে এখানে এসে উনি থাকতে
শুরু করেন। অধ্যাপনা ছেড়ে দেন।
লেখা নিয়ে ই থাকেন। এরপর ওনার তিনটে উপন্যাস সিনেমা হয়। হু হু করে ওনার বই বিক্রি
হতে থাকে। এই পর্যায়ে আমার সংগে ওনার বিবাহ হয়। সব হারিয়ে আবার নতুন করে বাঁচার প্রেরণা পান।
আমিও জীবনে একটা বড় আঘাত পেয়েছিলাম।অনেক অবিচার সহ্য করতে হয়েছে। প্রতিবাদ করতে গিয়ে ও হেরে গেছি। আমাকে একটা সংকট থেকে উনি বাঁচান।ওনাকে পেয়ে আমার ও বেঁচে থাকার প্রতি আগ্রহ জন্মায়।আমাকে খুব ভালো বাসতেন।তবে ওই ভাগ্য, যা আমার চিরকালই খারাপ। এরপর আমার জীবনে
দুটি দুর্ঘটনা ঘটে। আমার পুত্র মারা যায়। এবং দুবছর পরে
আমার কন্যা সন্তান ও মারা যায়।
আমাকে উনি প্রাণ দিয়ে আগলে
রাখতেন। এরপর জিনি আসে।
জিনিকে নিয়ে বাঁচতে থাকি।
তারপর গত চার মাস আগে
একটা পথ দুর্ঘটনায় রণজয় পঙ্গু
হয়ে যায়। এই সংবাদ মিডিয়া
জানে না। এই গ্রামের মানুষ রণজয়ের লেখক পরিচিতি টা জানে না।এই উপন্যাসটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত কেউ তা জানতে
পারবে না।
রর , আপাততঃ এইটুকু জানাই আপনার পক্ষে যথেষ্ট বলে মনে হয়।"
ললিতা যদিও কথাগুলো সুন্দর ভাবে গুছিয়ে অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বলছিল, তবুও রর র মনে হয় যে ও কিছু আড়াল করছে আর এ ব্যাপারে রর র সঙ্গে কথা
বলায় ওর আগ্রহ খুব ই কম।
নিম্নচাপ কেটে গেছে। ঝলমলে
রোদ উঠেছে। মালতী জিনিকে
নিয়ে বাগানে গেছে। জিনি আপন মনে খেলে বেড়াচ্ছে। ললিতা
গাড়ী নিয়ে বেরিয়েছে কেনাকাটা
করতে। করোনার তৃতীয় ঢেউ
আসায় সব স্কুল আবার বন্ধ।
জিনি তাই এখন থেকে বাড়ীতেই থাকবে , অনলাইনে ক্লাস হচ্ছে
এখন সব স্কুলেই।
রর হঠাৎ জানলা দিয়ে দেখে
জিনি ওপরদিকে তাকিয়ে হাসছে,
কাউকে কিছু বলছে, হাত নাড়ছে।
নার্স এখনো আসে নি, রণজয় বিছানায়, তবে জিনি কার সঙ্গে
কথা বলছে। ধীর পায়ে বেরিয়ে
আসে রর, ওকে দেখেই জিনি
ছুটে চলে যায় মালতীর কাছে।রর র মনে হয় দোতলার পর্দাটা যেন দুলে উঠল। ওখানে কে ছিল?
কে কে কে?
জিনির কাছে গিয়ে ওকে আদর করে রর, জিজ্ঞেস করে," কার সঙ্গে কথা বলছিলে?"
জিনি চুপ। মালতী বলে," স্যার,
ও আপন মনে কথা বলে যায়, কল্পনার জগতে বাস করে।"
জিনি মুখ ফিরিয়ে থাকে।
রর স্টাডি রুমে যায়। সেই ডায়েরীটা খোলে। রাজ এর
মৃত্যু সম্পর্কে বিশদ লেখা।
" আমি রাজ কে নিয়ে বোটে
চড়লাম। মাঝামাঝি এসে বোটটাকে প্রচন্ড জোরে দোলাতে লাগলাম। রাজ যত ই ভয় পায় আমি ততই তৃপ্তি পাই। রাজ বলে,
"বাপী ফিরে চলো",আমি ওর ভয়
উপভোগ করতে থাকি। অনেকক্ষণ ওকে ভয় পাওয়াই। আমার ললিতাকে ও কেড়ে নিয়েছে, ওর বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই। শেষে বোট কাত করে ওকে ফেলে দিই, তারপর
বোট চালিয়ে অনেকটা দূরে চলে আসি।মিথ্যে খোঁজার ভান করি।
ললিতা চলে আসে। ও অজ্ঞান
হয়ে যায়। আমি রাজকে খোঁজা
বন্ধ করে ললিতার কাছে আসি,
ওর চোখে মুখে জল দিই। একটু পরে রাজের নিথর দেহটা ভেসে ওঠে ঝিলের জলে। আমি ললিতাকে বলি রাজ একা বোটে
উঠেছিল। এরপর ললিতা আমাকে আঁকড়ে ধরে।"
নৃশংস মানুষ টার হয়ে লেখাটা শেষ করতে রর র ঘৃণা বোধ হতে থাকে। রণজয়ের ডায়েরীর কথা
ললিতা কে বলতে পারে না।
রণজয় সম্পর্ক বিশদ জানার চেষ্টা
করতে থাকে।
রর র মনে হয় জিনির সঙ্গে ভাব করে ওর বিশ্বাস অর্জন করলে
অনেক কিছু জানা যাবে।
ওপরে কে কথা বলে? জিনি কাকে
হাত নাড়ছিল? মাঝেমধ্যে ওপরে
কিসের আওয়াজ হয়?
এতগুলো প্রশ্নের উত্তর ররকে
পেতেই হবে।
বেলায় ললিতা বাজার সেরে ফিরলে রর বাড়ী গিয়ে আরো কিছু জামা প্যান্ট ও দরকারী জিনিস নিয়ে আসে, সঙ্গে আনে
বেশ কিছু চকোলেট ও খেলনা।
লেখার জন্য যে অ্যাডভান্সটা পেয়েছে তার কিছু টা দিয়ে করবী মাসীর ধার শোধ করে।
পরদিন ললিতা রণজয়ের ডাক্তার
আদিত্য নারায়ণার সঙ্গে দেখা করতে যায়। রর চকোলেট দিয়ে
জিনি র সাথে ভাব জমায়। এইভাবে কয়েকদিনের চেষ্টায়
জিনির বিশ্বাস অর্জন করে ও।
সেদিন নার্স লিজা রণজয়কে
বাগানে রোদ্দুরে বসিয়ে দিয়ে ভেতরে কোন কাজ করতে গেছে।
রর গিয়ে বলে,"নমস্কার, আমি
রর, আপনার লেখাটা আমি শেষ করছি।" উদাসী দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থাকে রণজয় একভাবে।
ওকে আঘাতে আঘাতে ক্ষত বিক্ষত করে দিতে মনচায় রর র।বলে," আপনাকে বলেই বা কী হবে? আপনি আর একটা জড় পদার্থ একই। আপনার মত ঘৃণ্য জীবের বেঁচে থাকার কোন অর্থ হয় না। ধিক্ আপনাকে।"
কথাকটা বলে রর লক্ষ্য করতে থাকে রণজয়ের মুখের বা চোখের কোন পরিবর্তন হয় কিনা। না,
কোন পরিবর্তন নেই , মুখের একটা রেখাও কাঁপছে না।শুধু
মূক দৃষ্টি মেলে তাকায়ে আছেন, সেই দৃষ্টি বক্তার প্রতি ঘৃণা আর করুণা মাখা।
নার্স লিজা বাড়ীর ভিতর থেকে
আসছিলেন, রর র কথার কিছু
অংশ ওনার কর্ণগোচর হয়েছিল।
অ্যাংলোইন্ডিয়ান রমণী আধভাঙা
বাংলায় বললেন,"মহাশয়, অসহায়ের প্রতি এমন ব্যবহার
করতে নেই। ঈশ্বর যেন আপনাকে
ক্ষমা করে।"
রর লজ্জিত হয়। নেতিবাচক লেখা পড়ে ও লিখে সেও কী অমানবিক
হয়ে গেল?
জিনি খেলতে খেলতে ছুটে এসে
বাপী বলে আবার ছুটে চলে গেল। সেই দিকে তাকালে রর লক্ষ্য করলো রণজয়ের দৃষ্টিতে বাৎসল্য
ভাবের প্রকাশ হয়েছে। সন্তান হত্যাকারীর চোখে সন্তানের প্রতি ভালোবাসা র দৃষ্টি কী করে জন্মায়? ? ?
একটা পর্ব শেষ করেছে রর। আর কদিনের মধ্যেই ললিতার হাতে
তুলে দেবে। তারপর আরও তিনটি পর্ব লিখে দায়িত্ব শেষ করে চলে যাবে রর। তার আগে অনেক প্রশ্নের উত্তর পেতে হবে।
জিনির সঙ্গে সম্পর্কটা সহজ হয়ে
গেছে। জিনির কাছ থেকে জানতে পারে ঠিক ওপরের ঘরটাতেই রণজয় থাকেন। আর দুর্ঘটনার আগে এই ঘরে ই বেশী সময় থাকতেন রণজয়। স্টাডি ছাড়াও
এঘরে বসেই লিখতে পছন্দ করতেন তিনি।
"জানো আঙ্কেল, ওই টেবিলে যেই মণিটরটা আছে, ওটা দিয়ে ওপরের ঘরটা দেখা যায়।"
"তাই নাকি?"
"হ্যাঁ, আমি যখন ওপরের ঘরে খেলতাম, মা থাকতো না, তখন বাপী ওটা দিয়ে দেখত আমি কোন দুষ্টুমী করছি কি না।"
রর র দেওয়া পুতুল টা নিয়ে চলে যেতে যেতে জিনি বলে গেল,
"তুমি কিন্তু মাকে কিছু বোলো না।"
"না, সোনা, বলবো না।"
পরের পর্ব আগামী কাল।
পর্ব ৬
রর ওপরের ঘর থেকে চলাফেরার
আওয়াজ আজও পেলো। রর
নিশ্চিত যে ওপরে রণজয় ছাড়াও কেউ আছে। হয়তো ললিতা। কিন্তু
ললিতার অবর্তমানে পুরুষ কন্ঠে
কে কথা বলে? এই রহস্য ররকে উদ্ঘাটিত করতেই হবে।
হঠাৎ ই রর র মনে পড়ে যায় জিনির কথা।"জানো আঙ্কেল, ওই
মনিটর দিয়ে ওপরের ঘরটা দেখা যায়।"
একটা পাঁচ বছরের শিশুর কথায় বিশ্বাস করাটা কী ঠিক?
আর যদি ঠিক ও হয়, অন্যের ঘরে
উঁকি দেওয়া কী উচিত হবে?
যদি ললিতা রণজয়ের সঙ্গে
ঘনিষ্ঠ অবস্থায় থাকে, তবে রর
নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে না।
এখানে আসার পরদিন থেকেই মানসিক দ্বন্দ্বে আছে রর। প্রতি কাজে কী করা উচিত আর কী নয় এই দোলায় দুলছে ও।
অবশেষে আগ্রহই জয়ী হলো। বাঁদিকের টেবিলে রাখা মনিটরটার ধুলো ঝেড়ে প্লাগ লাগিয়ে সুইচ অন করে দেয় রর। দুচারটে আলোর ঝলকানি র পর ছবি
ফুটে ওঠে।অবাক হয়ে রর দেখে
রণজয় পায়চারী করছেন ঘরে।
দীর্ঘদেহী সুদর্শন ভদ্রলোক ঋজু
ভঙ্গীতে হেঁটে গিয়ে আলমারী খুলে
একটা খাতা বার করে খাটের ওপর বসলেন, তারপর লিখতে
শুরু করলেন।
রণজয় কী তবে অসমাপ্ত উপন্যাসটি লিখছেন? ললিতা মিথ্যেই ররকে দায়িত্ব দিলো। ও জানেই না ওর স্বামী সক্ষম।
কেন এই লুকোচুরি? কী এই রহস্য?
রণজয় অনেকসময় নিয়ে কিছু
লিখলেন, তারপর খাতাটা আলমারীরতে রেখে শুয়ে পড়লেন। আলোটা ঘরে জ্বলতেই
থাকলো। এখন রণজয়ের শোবার ভঙ্গী দেখে মনে হচ্ছে তিনি কত অসহায়। একটা হাত আর পা
এলিয়ে আছে খাটের ওপর, পাশ বালিশ টা ঝুলে গেছে। একটুপরে তিনি খাটের পাশের স্ট্যান্ডটা তুলে
দিলেন।
রর মনিটরের সুইচটা অফ করে
প্লাগটা খুলে রাখলো।
রর র ঘুম আসছে না। ললিতা
প্রতারিত হচ্ছে। আগেও হয়েছে
এবং এখনো হচ্ছে। রর র মনে হয়
রণজয় যে পঙ্গু নয় এই কথাটা
জিনি এবং মালতী জানে।
রর ঠিক করলো ললিতাকে সব বলবে। একসঙ্গে নয়, একটু একটু
করে। বাঁধাকপির একটা একটা করে খোসা ছাড়ানো র মত রয়ে সয়ে বলবে। বলা উচিত। দুই সন্তান কে যে হৃদয়হীন পিতা হত্যা করেছে সে যে জিনিরও ক্ষতি করতে পারে।
সব শুনে ললিতা যাতে
ভেঙে না পড়ে তাই বুঝিয়ে সব বলতে হবে।
পরদিন সকালে চায়ের টেবিলে
রর ললিতাকে বলে,"আপনার
সঙ্গে জরুরি কথা আছে। যদি একটু সময় দেন ভালো হয়।
খুব ই প্রয়োজন।"
ললিতা বলে দুপুরে জিনি আর মালতী ঘুমিয়ে পড়লে, লিজা
চলে গেলে আমি আসবো। আপনার লেখা কতদূর?"
"দুপুরে সব বলবো।"
নিঃস্তব্ধ সিংহভিলা আরো নিশ্চুপ
হয়ে গেলো দুপুর বেলা। লিজা তার ছোট্ট গাড়ী নিয়ে বেরিয়ে গেলে দারোয়ান দরজা বন্ধ করে
নিজের ঘরে একটু গড়িয়ে নিচ্ছে।
একটা কুবো পাখী কুব কুব করে
গাছের আড়ালে লুকিয়ে ডাকছে।
তখন ললিতা এলো। হালকা আকাশী রং এর শাড়ী পরে, এলো
চুলে হাত খোঁপা বাঁধা।
রর তখন স্টাডিরুমে ছিল। ললিতা
একটা চেয়ার টেনে বসে বলল,
"বলুন, কী বলবেন।"
"ম্যাডাম, আপনার কথায় এই বাড়ীতে এসেছিলাম, আপনার উপকার করার সঙ্গে সঙ্গে আমার
নিজেরো উপকার হবে এই আশায়। এখানে এসে অনেক অভিজ্ঞতা হলো। অনেক কিছু
জানলাম।আপনি হয়ত ভাববেন আমি অনধিকার চর্চা করছি।
সে আপনা যাই ভাবুন না কেন, যা
জেনেছি তা আপনাকে জানানো
আমার কর্তব্য।"
এই পর্যন্ত বলে রর রণজয়ের ডায়েরীটা ললিতার হাতে দিয়ে
বললো,"পড়ুন।"
ললিতা মাথানিচু করে বসে থাকে।খাতাটা সামনেই পড়ে থাকে।
রর অপেক্ষা করে। তারপর বলে,
"পড়ুন ললিতা, আপনার পড়া উচিত। আপনার ও আপনার মেয়ের জীবনের সুরক্ষা র জন্য
আপনার উচিত এটা পড়া।"
"ওটা আমার আগেই পড়া রর, পাঁচ মাস আগেই।"
"আপনি তাহলে সবটা জানেন?
তাহলে ওই খাতাটা নিয়ে পুলিশের
কাছে যান নি কেন?"
" রর, আমি সরাসরি রণজয়কে
বলেছিলাম। অস্বীকার করলো।
প্রথমে আমি ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে ছিলাম। ওকে আঁচড়ে কামড়ে
ক্ষত বিক্ষত করেছিলাম। বলেছিলাম তোমার বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই। তারপর মনে হল যে ওর মানসিক চিকিৎসা র
প্রয়োজন। কিন্তু ওকে আমি সহ্য
করতে পারছিলাম না। এইরকম একটা সময়ে ওর দুর্ঘটনাটা ঘটলো।ও পঙ্গু হয়ে গেলো। আমার
মন দুর্বল হয়ে পড়ল। মানুষ টা তো
শাস্তি পেয়েই গেছে ।
জানো রর একদিন ও আমাকে
আশ্রয় দিয়েছিল, বড় ভালোবাসা
দিয়ে ছিল। নতুন জীবন দিয়ে ছিল। ওর শৈশব হয়েছিল অনেক অত্যাচারিত, মায়ের স্নেহ
ভালবাসা পায়নি। তাই হয়ত অজান্তেই মানসিক রোগ দানা
বেঁধে ছিল ওর মধ্যে। তাই ওকে
ক্ষমা করে দিয়েছি।
কিন্তু রর, আমি কী পেলাম বলুন
তো? যখনই কোন হাত শক্ত করে ধরতে চেয়েছি, তখনই তা হারিয়ে
ফেলেছি।" কান্নায় ভেঙে পড়ে
ললিতা। লতার মতই রর র কাঁধে
মাথা রেখে ফুলে ফুলে ওঠে, ওর চোখের জলে ভিজে যায় রর র
পাঞ্জাবী র কাঁধের অংশটা। রর র
ডান হাত ললিতার মাথা স্পর্শ করে। এই স্পর্শে ছিল না কোন
কামানুভূতি। রর র মনে হল ছোট্ট
একটি শিশু বকুনি খেয়ে অভিমান করে কাঁদছে আর রর তাকে
স্বান্তনা দিচ্ছে।
এইভাবে কেটে গেল অনেকটা সময়। রর ললিতাকে সময় দিচ্ছে
কেঁদে হালকা হওয়ার।
হঠাৎ রর র চোখ পড়ে সিঁড়ির দিকে। চকিতে সরে যায় একজন।
রর র বেশ বুঝতে পারে যে ওটা
রণজয়।
রণজয় কীভাবে সিঁড়িতে এলো?
তাহলে রর র অনুমান সঠিক।
রণজয় এখনো ঠকিয়ে চলেছে।
ও পঙ্গু নয়। যে কোনদিন ও যে জিনির ক্ষতি করতে পারে।
কিন্তু কীভাবে বলবে রর? একজন
তাকে তার বাড়ীতে থাকতে দিয়েছে, তাইবলে তার ঘরে ক্যামেরা দিয়ে দেখার অনুমতি
তো দেয়নি, এটা করা অন্যায়।
রর হঠাৎ বললো,"ললিতা, রণজয়
এইমাত্র সিঁড়িতে এসে ছিলেন। উনি প্রতিবন্ধী নন।"
"কী বলছেন কী, এটা অসম্ভব?"
"তাড়াতাড়ি ওপরে চলুন, প্রমাণ হয়ে যাবে কোনটা সত্যি, কোনটা
মিথ্যে।"
লঘু পদক্ষেপে ওপরে উঠে ওরা দেখলো রণজয় খাটে শুয়ে আছেন।খাটের পাশের স্ট্যান্ডটি
উঁচু করে তোলা, তার ফাঁক দিয়ে
ডান হাতটি বেরিয়ে ঝুলছে,
ঠোঁটের কোণ থেকে লালা পড়ছে।
রর হতবাক। ললিতা বলে, "চলুন
রর, আমরা নীচে যাই।"
নীচে গিয়ে ললিতা বলে,"রণজয়ের ডায়েরী পড়ে ওর
বিরুদ্ধে আপনার মনে বিরূপ মনোভাবের সৃষ্টি হয়েছে।তাই ওটা
আপনার কল্পনা। রণজয়ের
এ্যাকসিডেন্ট হবার কিছু পরে উনি জ্ঞান হারান। তার আগে যারা ওনাকে উদ্ধার করেছিল তাদের কাছে ওনার ঘনিষ্ঠ বন্ধুডাক্তার আদিত্য নারায়ণের নার্সিং হোমের
নাম বলে যান।
পথচারীরা ওঁকে সেখানে নিয়ে যাবার পর আদিত্য আমাকে ফোন করেন। রণজয় সেখানেই একমাস
থাকেন। আই সি ইউ তেই ছিলেন।
আমি বিকেলে দূর থেকে দেখার অনুমতি পেতাম। জ্ঞান ফিরে
এলেও কথাবলার ও হাঁটাচলা র
ক্ষমতা চলে যায়। ডাক্তার বলেন
ওনাকে এইভাবেই থাকতে হবে সারা জীবন। প্রচন্ড ধাক্কায় ওনার স্নায়ুতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। উনিই
নার্স লিজাকে রণ র সেবা করার ভার দিয়েছেন । লিজা দিনে দুবার আসে ও ওষুধ ইনজেকশন দিয়ে
যায়। স্পঞ্জ করে খাইয়ে দেয়।
বাকী সময় মালতী দেখে।আমি
খুব দরকার না থাকলে ওনার কাছে যাই না। ডাক্তার বারণ করেছেন, কারণ আমাকে সামনে দেখলে উনি কাছে পেতে চাইবেন, আবেগপ্রবণ হয়ে যেতে পারেন। এসব ওনার পক্ষে ক্ষতিকর।
সুতরাং রর, আপনা যা ভাবছেন
তা ভুল।"
"মিরাকল তো হয় ললিতা। হয়তো
এই কমাস চিকিৎসা য় উনি ভালো
হয়ে গেছেন কিন্তু কাউকে বলছেন
না হয়তো কোন উদ্দেশ্য আছে।
এর আগে আমি অনেকবার ওপরের ঘর থেকে শব্দ পেয়েছি।"
ক্যামেরা ও জিনির সঙ্গে কথা
বলার ব্যাপার দুটো চেপে গেল রর।
পরের পর্ব আগামী কাল।
পর্ব ৭
ললিতা আগের আবেগ সামলে নিয়েছে। ররকে বলে,"আপনি বিশ্রাম করুন। মালতী একটু পরে এসে চা দিয়ে যাবে। রর,ওপরে মালতী প্রায়ই রণজয়কে দেখতে যায়, ওর পায়ের আওয়াজ শুনেছেন হয়তো। আর ডাক্তারের নির্দেশে মাঝে মাঝে রণজয়ের ঘরে টি ভি চালিয়ে দেওয়া হয়, খবর, খেলা এইসব।আপনি টিভি র কন্ঠস্বরই শুনেছেন বোধহয়।চিন্তা করবেন না। আপনার সঙ্গে আবার ডিনার টেবিলে দেখা হবে।" ললিতা চলে যায়। রর ভাবে যে হাতেনাতে ধরতে হবে রণজয়কে, তবেই জিনিকে বাঁচানো যাবে। সেদিন রাতদুটোর সময় আবার হাঁটার আওয়াজ শুনে ক্যামেরা অন করলো রর, এদিনও রণজয় লিখছিলেন। লিখতে লিখতে হঠাৎ শুয়ে পড়লেন,খাতাটা বালিশের তলায় লুকিয়ে রাখলেন। তারপর রর অবাক হয়ে দেখলো যে ললিতা ঘরে ঢুকছে। একটু দাঁড়িয়ে চাদরটা রণজয়ের গলা অবধি ঢেকে চলে গেল। আচ্ছা তার মানে ললিতা নিজে চোখে দেখে গেল রণজয়কে। আর উনিও ললিতার পায়ের আওয়াজে চুপ করে শুয়ে পড়েছেন। তার মানে উনি খেলছেন। হাইড এ্যান্ড সিক। লুকোচুরি। এরপর দুদিন চুপচাপ। কোন আওয়াজ শোনা গেল না। রর ও ক্যামেরা অন করে কিছু দেখতে পেল না। রর মন দিয়ে লেখা শেষ করে এই গোলমেলে বাড়ী থেকে চলে যাবে মনস্থ করলো।অন্যের বাড়ীর কেচ্ছায় জড়ানো উচিত নয়। রর ললিতার মধ্যে তার এক প্রিয়জনের ছায়া দেখেছিল, তাই ললিতা র প্রতি তার একটা আবেগ সৃষ্টি হয়েছিলো আর তাই ও ললিতার ভালো চাইছিল। এখন ললিতা যদি এতে অসন্তুট হয়, তবে রর রই বা কী দরকার। সেদিন রর ললিতাকে জিজ্ঞেস করলো দুদিন রণজয়কে বাগানে দেখলাম না তো!লিজা ম্যাডাম ওনাকে রোজ সকালে বাগানে নিয়ে যান তাই বলছি। ললিতা উত্তর দেয়,"ওনার শরীর খারাপ।" "তাই নাকী, তা ডাক্তারকে বলে ছিলেন?" "হ্যাঁ,উনি বিশ্রাম নিতে বলেছেন।" "তাহলে তো ওনার কাছে রাতে কারো থাকা উচিত।" "হ্যাঁ, কাল থেকে লিজা থাকবেন। আজ মালতী মাঝে মাঝে দেখে আসবে। আপনার আর কিছু জিজ্ঞেস করার আছে?থাকলে বলুন।উত্তর দেবো।" "ললিতা দেবী, আমি কাল বাড়ী চলে যাবো।যেটুকু লেখা বাকী আছে বাড়ীতে ই লিখবো। আমার লেখা হয়ে গেলে ফোন করে দেবো। ড্রাইভারকে পাঠিয়ে দেবেন।এই কদিনের আতিথেয়তার জন্যে অনেক ধনবাদ।" ললিতা আজ যেন অন্যরকম। এই মেয়েকে বোঝা যায় না। একদিন আনন্দ করে আবাহন করেছিল, আর আজ বিসর্জন দেবার সময় মনে হচ্ছে ররকে যেন চেনেই না। রর র নিজেকে অপমানিত মনে হল। চলে যাবার কথা শুনে ললিতা একবারও থেকে যেতে বলল না। বরং বলল,"আপনার যা সুবিধা।এই কদিন যে থেকেছেন এজন্য আমি কৃতজ্ঞ।" এরপর আর কোন কথা হয় না। এক মুহুর্তে ললিতা ওকে পর করে দিল। আজ আর লেখালেখি করতে ভালো লাগছিল না রর র। ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়ে ভাবল যে শেষ বারের মত রণজয়কে দেখবে। মনিটর অন করলো, রণজয় লিখছেন। খাতায় কিছু লিখে কয়েকটা পাতা ছিঁড়ে বালিশের তলায় রাখলেন। তারপর নীচে নেমে একটা নীল রঙের সুটকেস খুলে দেখে সেটা আবার খাটের নীচে ঢুকিয়ে রাখলেন। তারপর দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ই খাটে শুয়ে পড়লেন। একটু পরে ললিতা এসে একটা বাটি থেকে তরল জাতীয় কিছু চামচে করে রণজয়কে খাইয়ে দিল, লিজা আসে নি বলেই বোধ হয় ললিতা খাওয়ালো। যত্ন করে খাইয়ে দেবার পর তোয়ালে দিয়ে মুখ টা মুছিয়ে দিয়ে চাদরটা বুক অবধি টেনে দিল। তারপর চলে গেল। রণজয় ঘুমিয়ে পড়লেন। কিছুক্ষণ পরে রর র মনে হলো যে রণজয়ের ঘুমটা যেন স্বাভাবিক নয়। বেশ কিছু সময় পরে মালতী এলো। আঁচলের তলা থেকে একটা প্লেট বার করল। রর দেখল তাতে পরোটা আর চিকেন আছে। রর বুঝতে পারল কারণ রাতের ডিনারে ও ওটাই খেয়েছে। মালতী রণজয়কে ডাকল, কিন্তু উনি উঠলেন না। মালতী চলে গেল। তার মানে মালতী জানে রণজয় পঙ্গু নন। একটা পূর্ণাঙ্গ মানুষ কী সারাদিন তরল খেয়ে থাকতে পারে? তাই মালতী ওনাকে পরোটা খাওয়াতে এসেছিল ললিতাকে লুকিয়ে। রর তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় দিয়ে বুঝতে পারছে যে রণজয়ের ঘুমটা ঠিক স্বাভাবিক নয়। আজকে রর সারারাত লক্ষ্য রাখবে রণজয়ের ঘুম কখন ভাঙে। বেশকিছু সময় পার হয়ে গেল।রর র চোখ ঘুমে জড়িয়ে আসছে।চোখে জল দিয়ে ঘুম তাড়ালো। এবার ললিতা ধীর পায়ে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। তারপর ঘুমন্ত রণজয়ের মুখে একটা বড় বালিশ চেপে ধরল। রণজয়ের হাত দুটি উঠে মুঠো করে কিছু ধরতে চাইল,পা দুটি ছটফট করে স্তব্ধ হয়ে গেল। ললিতা উঠে দাঁড়ালো। বড় বড় নিঃশ্বাস পড়ছে। একটু অপেক্ষা করল। তারপর বালিশটা যথাস্থানে রেখে বেরিয়ে গেল। রর স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। এক গায়ে কাঁটা দেওয়া রহস্যময় ঘটনা র প্রত্যক্ষ সাক্ষী হয়ে স্থানুর মত বসে রইল। ঘড়িতে তখন চারটে বাজে। সিংহবাড়ীতে আসার পর থেকেই প্রতিটি ঘটনায় রর র মন দ্বিধা দ্বন্দ্বে দোদুল্যমান হয়। এবাড়ীতে রহস্য আছে না নেই? রণজয় অথর্ব না সমর্থ? রণজয় দেবতা না পিশাচ? ললিতা কে রণজয়ের কথা বলা উচিত না উচিত নয়? জিনি কী ওর বাবার রহস্য জানে না জানে না?এই সব প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে ওর মন বার বার দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যেত। এখন ওর মনে প্রশ্ন জেগেছে ললিতা অন্যায় করেছে না ঠিক করেছে? একদিকে সন্তান হত্যাকারী একব্যক্তির উচিত সাজা হয়েছে, তার হাত থেকে জিনিকে বাঁচানো গেছে। আবার অন্যদিকে ললিতার উচিত হয়নি আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া। এখন রণজয় ও ললিতা দুজনেই সমান দোষে দোষী। এর পরেই যে ভাবনাটা রর র মাথায় এলো, সেটা হল রর র সামনে ঘোর বিপদ। সকাল হলেই রণজয়ের মৃত্যু সামনে আসবে। চিকিৎসক যদি বুঝতে পারেন যে মৃত্যুটা অস্বভাবিক, তবে তিনি ডেথ সার্টিফিকেট দেবেন না। পুলিশ এসে তদন্ত করলে রর র কে দেখে নানা প্রশ্ন তুলবে। তারপর যদি একটা ত্রিকোন প্রেমের গল্প তৈরী করে তাহলে রর র কেরিয়ার শেষ। রর ঠিক করল ভোরের আলো ফোটার আগেই ও এখান থেকে চলে যাবে। সিংহ বাড়ী সারারাত টাইগার আর ডেভিল নামে দুটি ভয়ংকর সারমেয় পাহারা দেয়। ভোর পাঁচটার সময় দারোয়ান তাদের ঘরে ঢুকিয়ে নিজে পাহারার দায়িত্ব নেয়। ঠিক তখনই বেরিয়ে যাবে রর। সুটকেস গুছিয়ে বসে রইল। পাঁচ টায় দারোয়ান এসে টাইগার ও ডেভিলকে ওদের খাঁচায় ঢুকিয়ে দেবার পর রর বে হতে গিয়ে দেখে প্রাসাদের গেটে তালা দেওয়া। ওটা মালতী খোলে। সাড়ে পাঁচটায় মালতী গেট খুলতে এলে রণজয় সুটকেস নিয়ে বেরিয়ে মালতীকে বলল, "ম্যাডামকে বলে দিও আমি যাচ্ছি। " মালতীর উদ্ভ্রান্ত চেহারা বলে দিচ্ছে কোন অঘটন ঘটেছে। ও বলল, "স্যার , সর্বনাশ হয়ে গেছে। আমাদের স্যার আর নেই। ম্যাডাম চুপ করে বসে আছেন। আপনি এখন যাবেন না প্লিজ। আমি পাড়ায় যে ডাক্তারবাবু আছেন, তাঁকে ডাকতে যাচ্ছি। ততক্ষণ আপনি নীচে বসুন। ম্যডামকে জিজ্ঞেস করে আমি আপনাকে ওপরে নিয়ে যাবো।" রর বলে," কী করে কী হল?" রর র গলায় কাঁপুনি। ম্যাডামের মুখোমুখি হবার সাহস ওর নেই। যদি বেফাঁস কিছু বলে দেয়, যদি ললিতা জানতে পারে রর সব জানে তবে ওকে মেরে ঝিলের ওপারে পুঁতে ফেললেও কেউ টের পাবে না। রর ভাবে মালতী বেরিয়ে গেলেই ও বেরিয়ে যাবে। কিন্তু মালতী বাইরে থেকে তালা দিয়ে চলে গেল আর বলে গেল," স্যার, এখনো ভাল করে সকাল হয়নি, শুয়ে পড়ুন।" আগামীকাল পরের পর্ব।
পর্ব ৮
মিনিট পনের পর ডাক্তার বাবু এলেন। বয়স প্রায় আশী। চোখেরও সমস্যা আছে মনে হয়।
মালতী তাঁকে ওপরে নিয়ে গিয়েই
ররকে ডাকতে এলো।
বাধ্য হয়ে ররকে যেতে হলো।
ডাক্তার রোগীর বিষয়ে সব শুনে
বললেন 'কার্ডিয়াক ফেলিওর।'
মালতী কাঁদছে।
ললিতার চোখে জল নেই। পাথরের মতো কঠিন।
ডাক্তারকে এক মুঠো টাকা দিয়ে
ললিতা বললো," কষ্ট করে এতো
সকালে আসার জন্য আমি কৃতজ্ঞ।"
ডাক্তারটি বললেন,"এতো আমার
ফিজের থেকে অনেক বেশী টাকা!"
ললিতা বলল," এখন অত হিসেব
নিকেষ করবেন না দয়া করে।"
প্রবীন ডাক্তার বলেন,"তা বটে,
উনি খুব ভালো মানুষ ছিলেন।
আচ্ছা তবে যাই মা?"
"আসুন।"
ললিতা এবার মালতীকে বলে,
তোমার কাকার ছেলেকে খবর দাও, তাড়াতাড়ি আসতে। জিনি
ওঠার আগে আমাদের চলে যেতে
হবে। এই অবস্থায় জিনি ওনাকে
দেখলে কষ্ট পাবে।"
তারপর ররকে বলে," মিঃ রর, আমি আর মালতী যাবো, আপনি
প্লিজ জিনির কাছে থাকুন। ও ওঠার আগেই হয়ত আমরা ফিরে
আসবো। না আসলে আপনি একটু সামলে নেবেন।"
রর তির্যক দৃষ্টিতে প্রশ্ন করে, "ওনার চিকিৎসক, আই মিন
আদিত্য বাবু এলেন না?"
"উনি এখন কলকাতার বাইরে আছেন।"
"তা কোথায় যাচ্ছেন, কালীঘাট
না সিরিটি?"
"না,না। গঙ্গার ধারে। ভারী সুন্দর
জায়গা। ভীড়ও হয় না তেমন।"
ললিতা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব
ব্যাপারটার ইতি চায়।
রর কোন প্রতিবাদ করতে পারেনি
দুটি কারণে, এক ও নিজে জড়িয়ে
পরার সম্ভাবনা, দুই ললিতাকে ভয়।
রণজয়কে ফুলে প্রায় ঢেকে দেওয়া হয়েছে। মালতীর কাকার ছেলে প্রচুর ফুল এনেছে। যদি ওনার শরীরে শ্বাস,আটকে মৃত্যুর কোন চিহ্ন ফুটে ওঠেও তা ঢাকা পড়ে যাবে ফুলে।এই ভাবে একজন মহিলা ঠান্ডা মাথায় খুন করেও নিজেকে সুন্দর ভাবে রক্ষা করল।
ওরা বেরিয়ে গেল। হাতে গোনা লোক হয়েছিল শেষ যাত্রায়।
অত বিখ্যাত লেখকের শেষ যাত্রার এই পরিণতি? কুকাজ ঢাকতেই
এতো তাড়াহুড়ো বোঝাই যাচ্ছে।
এই প্রথম রর ওপরে এলো।
জিনি যেমনটা বলেছিল সেইমত বিশাল হলঘর পেরিয়ে ডান হাতি
সুসজ্জিত ঘরের একধারে সুদৃশ্য পালঙ্কে ছোট্ট রাজকুমারী জিনি
গভীর নিদ্রায় মগ্ন।
টেবিলের ওপর ছোটদের ওষুধ
Phenergan syrup এর ঢাকা খোলা। ওটা সেভেটিভ। তার মানে জিনিকেও ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে।
ওখান থেকে আন্দাজে রণজয়ের ঘরে গেলো রর। কালকে দেখা
ঘরের সব কিছুই আছে শুধু
ঘরের মালিক নেই।
রর র হঠাৎ মনে পড়ে রণজয় গতকাল বালিশের তলায় কিছু রেখেছিলেন।
এই সুযোগ। রর বালিশ তুলে দেখে
লাইনটানা খাতার কটা পাতা।
রর পাতাকটা নিয়ে ভাঁজ করে ঘরে চলে এলো। তারপর সুটকেসে
রেখে দিল।
বেলা দশটার মধ্যে কাজশেষ করে
ললিতারা চলে এল। ওদের গাড়ী
যখন ঢুকছে ঠিক তখনই জিনি
চোখ মুছতে মুছতে সিঁড়ি দিয়ে
নেমে এল।
"কী হয়েছে জিনি?"
"বাপী কোথায়?"
"ডাক্তারের কাছে।"
" বাপী যে বলেছিল আমাকে
নিয়ে যাবে?"
"কোথায়?"
জিনি চুপ করে থাকে, পরে বলে,
"মাকে বোলো না আঙ্কেল।"
মালতী ও ললিতা আসে। ললিতাকে দেখে মনে হচ্ছে ভেঙে
পড়েছে। রর জানে ওটা অভিনয়।
এবার লিজার গাড়ী ঢুকল।
লিজা এসে যখন শুনল তখন ও এতটাই অবাক হয়েছিল যে রর র
শার্টের কলার চেপে ধরল।
রর বলল আমি কিছুই জানি না।
মালতী বললো,"লিজা ম্যাডাম ,
ললিতা ম্যাডাম এখন কথা বলার অবস্থায় নেই। আপনাকে উনি পরে ফোন করবেন।"
আজ সকালে কিছু খাওয়া হয়নি
কারো মালতী আলুআর ডাল সিদ্ধ
দিয়ে গোবিন্দভোগ চালের ভাত
আর ঘি দিয়ে রর আর জিনিকে
খেতে দিল।
দুপুরে যখন সবাই ঘুমিয়ে আছে
সারাদিনের ধকলের পর,তখন
দরজা বন্ধ করে রণজয়ের লেখা
কাগজ খুলে পড়তে শুরু করলো।
"আমার ললিতা,
তুমি কখনোই আমার লেখা পড়তে না, ইন ফ্যাক্ট, ভালো বাসতে না। সেই তুমিই আমার ওই লেখাটা পড়লে , যেটাকে তুমি আমার আত্মকথা বলে মনে কর।
আমি তোমাকে কতবার বলেছি
ওটা আমার ব্যক্তিগত রোজনামচা
নয়। ওটা আমার লেখা প্র্যাকটিসের একটা খসড়া মাত্র।
তোমার মনে আছে ললিতা, আমার লেখা 'রক্ত নদীর ওপারে'
উপন্যাস প্রকাশিত হবার পর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এসেছিলেন প্রখ্যাত লেখক 'কাল কেউটে'যিনি
খলচরিত্র সৃষ্টির জাদুকর। তাঁকে আমি একান্তে জানতে চেয়েছিলাম
আমার বই ওনার কেমন লাগে।
উনি বলেছিলেন, খলচরিত্র সৃষ্টি করতে গেলে নিজেকে খল বলে ভাবতে হবে। আমি জানতে চাই
লাম সেটা কী করে সম্ভব?
উনি পরামর্শ দিলেন," নিজেকে
খলনায়ক ভেবে নিজেকে নিয়ে
কিছু লেখ। তোমার জীবনে ঘটে যাওয়া খারাপ ঘটনা গুলো যেন তুমিই ঘটিয়েছ এমনটা ভেবে লেখা প্র্যাকটিস কর। দেখবে
তারপর থেকে তোমার চরিত্র গুলো কেমন জীবন্ত হয়ে ওঠে।"
মিনি চলে গেল রাজের পর। দুটোই ছিল দুর্ঘটনা। আমি প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতাম আমার পরিবারকে। মিনির মৃত্যুর পর তোমার শরীর ভেঙে যায়। সেই সময় বলিউড থেকে সিনেমার জন্য গল্প লেখার অফার পাই।
কালকেউটের পরামর্শ মত আমি আমাকে খলনায়ক ভেবে আমার জীবনে ঘটে যাওয়া ক্ষতি গুলো যেন আমারই সৃষ্ট এইমত লেখা
প্র্যাকটিস করছিলাম।
ওটা সেই খাতা। এরপর আমার লেখা গল্প নিয়ে বলিউডে পর পর হিট ছবি হয়।
তোমার জন্য, পরিবারের জন্য আমি একদিন প্রচুর অর্থ উপার্জন
করব এই আমার স্বপ্ন ছিল।
যে অতুল ঐশ্বর্য্য থেকে বিমাতা
আমাকে বঞ্চিত করেছে সেই পরামাণ সম্পত্তি আমি আমার পরিবারকে দিতে চেয়েছিলাম। সফলতা এসেছিল।
কিন্তু ওই লেখা পড়ে তুমি আমাকে
ভুল বুঝলে। আমার কোন কথাই
বিশ্বাস করলে না।
আমাকে মেরে ফেলতে গেলে। প্রথমে একদিন মুখে বালিশ চাপা
দিলে, পারলে না। পায়েসে বিষ দিলে, আমি খেতে ভুলে গেলাম। বদলে পুষি ওতে মুখ দিয়ে ঢলে পড়লো দেখে বুঝতে পারলাম সব। সাবধানে থাকতাম সবসময়।
তারপর একদিন সকালে বাজারে যাবো বলে বের হবার পর বুঝলাম গাড়ীর ব্রেক ফেল হয়েছে।
খল চরিত্র লিখতে গিয়ে আমার
প্রিয়তমাই খলনায়িকাতে পরিণত
হয়ে গেল।ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস। দুর্ঘটনা ঘটবেই বুঝতে
পেরে আদিত্যকে ফোন করেছিলাম। তারপর গাড়ীটা ঘুরিয়ে একটা গাছে ধাক্কা মারতে
চাইলাম যাতে পথচারীদের ধাক্কা
না লাগে। গাছর সঙ্গে ধাক্কা লাগায় আমি আহত হলাম। আদিত্য ঘন ঘন ফোন করছিল। এ্যাকসিডেন্টটা হবার পর পথচারী রা আদিত্যর ফোনটা ধরে ও আমাকে ঐর নার্সিংহোমে নিয়ে যায়। একমাস পর সুস্থ হয়েও অসুস্থর ভান করি তোমার হাত থেকে বাঁচতে। আমি জানতাম
বেঁচে আছি জানলে তুমি আবার
চেষ্টা করবে আমাকে মারার।
তাই আদিত্যর সঙ্গে পরামর্শ করে
পঙ্গু সাজলাম। আজ তিনমাস
অথর্ব সেজে আমি ক্লান্ত ললিতা।
লিজা সব জানে।
মালতীর বাবা আমার বাবার বিশ্বস্ত কর্মচারী ছিলেন।বিমাতা আর মনোজিৎ যখন আমাকে মারার চক্রান্ত করেছিল তখন
শিবু কাকা অর্থাৎ মালতীর বাবাই
আমাকে এই গ্রামে আশ্রয় দেয়।ওদের বাড়ীতে থাকতাম। তারপর শস্তায় এই সম্পত্তি, জমি জায়গা
কিনি।
আমার বিবাহ হয় তোমার সঙ্গে। জিনি হবার আগে তোমার শরীর খারাপ হয়। মালতীর বাবা তখন মারা যায়। আমি মালতীকে তোমার কাছে এনে দিই। ওর বাবাকে কথা দিয়েছিলাম ওকে সারাজীবন দেখবো।মালতী শুধু মালিক হিসেবে আমাকে শ্রদ্ধা করে তা নয়, বড় দাদার মত ভালো
বাসে। আমার ছলনার কথা ও জানে। জিনির কাছেও ধরা পড়ে গেছি।
সেদিন লেখক ভদ্রলোকের কাঁধে মাথা রেখে তোমাকে কাঁদতে
দেখেছি। লেখক ও আমাকে এক ঝলক দেখে ফেলেছিলেন। আমার
মনে হল এবার তুমি জেনে যাবে সব। তার আগেই আমাকে পালাতে হবে। তাই আমি জিনি আর মালতীকে নিয়ে চলে যাবো
অজ্ঞাতবাসে। তোমাকে লেখকের হাতে তুলে দিয়ে গেলাম।
বাড়িটা রইল, আর বেশ কিছু টাকা তোমার অ্যাকাউন্টে দেবো।
কাল ভোরে আমরা চলে যাচ্ছি।
বিদায়। যদি কখনো আমাকে বিশ্বাস করো, আদিত্যকে জানিও
ঠিক ফিরে আসবো। "
পর্ব ৯
রর চিঠিটা সুটকেসে ভরে বের
হবার সময় মালতী এসে হাজির।
মালতী বললো,"ম্যাডাম বলে পাঠালেন আপনি যেন স্যারের কাজ শেষ হওয়া অবধি থেকে যান।"
"না মালতী, তা সম্ভব নয়। একমাসের জন্য এসেছিলাম। যে কাজে এসেছিলাম তার দরকার ফুরিয়েছে। আমার নিজের কাজ
আছে। "
"আমার বলার কোন অধিকার নেই। তবুও বলছি, আপনি থাকলে
ভালো হতো।" মালতী মাথা নিচু করে।
রর এবার একটু নরম স্বরে বলে,
"মালতী আমার নিজের কাজের ক্ষতি হচ্ছে। তাছাড়া আমার পিসিমা অসুস্থ, আমাকে দেখতে চেয়েছেন। ম্যাডামকে বোলো যে আমি পরে সময়মত যোগাযোগ করবো।"
ললিতার সঙ্গে দেখা না করেই
রর চলে গেল। দারোয়ান সেলাম
করলো। আর দরজা ধরে মালতী
দাঁড়িয়ে ই থকল যতদূর অবধি
ররকে দেখা যায় সেদিকে।
এবার সে সিংহবাড়ীর ড্রাইভারের জন্যেঅপেক্ষা করলো না। বেশ কিছুটা হেঁটে অটো পেল। অটোতে উঠে বাস স্ট্যান্ডে গিয়ে একটা ট্যাক্সি পেয়ে উঠে বসলো।
মানবিকতা র খাতিরে হয়ত রর র থেকে যওয়া উচিত ছিল।একজন সদ্যস্বামীহারা তরুণী আর তার
শিশু কন্যা , এদের পাশে থাকা
উচিত ছিল। কিন্তু একজন স্বামীহন্তার পাশে দাঁড়ানোর অর্থ হলো অপরাধকে সমর্থন করা।
রর একটু আগেই জানতে পেরেছে
যে রণজয় অপরাধী নন, তাই ও
ললিতাকে এখন ঘৃণা করছে। রর জানে না রণজয়ের কথা সত্যি না মিথ্যে, কিন্তু ললিতার করা কাজটি যে অমোঘ সত্যি তা তো রর নিজের চোখেই দেখেছে। তাছাড়া
যদি ললিতা বুঝতে পারে রর সব জেনে গেছে তাহলে নিশ্চিত ওর
প্রাণসংশয় হবে।
বাড়ী গিয়ে রর আরও কয়েক বার
রণজয়ের লেখা চিঠিটা পড়লো।
অন্যের চিঠি পড়া উচিত না হলেও এই চিঠি পড়ে তার কোন
অনুতাপ হচ্ছে না, বরং একটা
ভয়ংকর সত্য জেনে ললিতার
সম্পর্কে তার ধারণাটাই বদলে গেছে।
রর র পিসিমা বনগাঁয়ে থাকেন।একমাত্র কন্যা বিদেশে। পিসেমশাই গতবছর মারা গেছেন করোনায় মায়ের আগে। এরপর
নিজের নানা ঝামেলায় পিসিমার কাছে যাওয়া হয়নি । তিনি অসুস্থ
ফোন করেছিলেন। রর তাই
পিসিমার কাছে যাবার জন্যে
প্রস্তুত হচ্ছিল, এমন সময় মুঠোফোন টা বেজে উঠল।
ললিতা। চমকে গেল রর। যাকে
এড়াতে চাইছে সে!ফোন কেটে
দিল।
আবার ফোন।
রর এবার ধরল। "বলুন"কন্ঠস্বরে
অনিচ্ছা।
আগামী পাঁচ তারিখে ওনার শ্রাদ্ধ।
গৌড়ীয় মঠে আয়োজন করেছি।
আপনি আসবেন তো? খুব ছোট আয়োজন।"
"কেন, পাঁচ তারিখে কেন?অপঘাতে মৃত্যুর কাজ তো তিন রাত্রি পরে করে!"
"কী?"
রর ফোনের সুইচ অফ করে দিল।
"এই রে, এটাই ভয় পাচ্ছিলাম।
মুখ ফস্কে এটা কী বলে ফেললাম?"
মনে মনে বলে রর।"এবার ললিতা বুঝে গেল আমি সব জানি, এবার ও আমাকে শেষ করবে।"
দরজায় তালা দিয়ে রর বনগাঁ এর
উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।
পিসীর বাড়ীতে গিয়ে রর র মনটা
ভালো হয়ে গেল। অনেকটা জায়গা নিয়ে বাড়ী। গাছপালা
দিয়ে ঘেরা। পুকুরে টলটলে জল।
ফলের, ফুলের বাগান।
পিসীর আদরে দুদিন কেটে গেল।
রর র মনে হল ওর লেখার পক্ষে
আদর্শ জায়গা এই বাড়ীটা।
কখনো পুকুরের বাঁধানো ঘাটে, কখনো আমবাগানে,কখনো ছাদে বসে রর গল্পের প্লট ভাবতে লাগলো। সিংহবাড়ীতে আসা যাওয়ার মাঝের কাহিনীটাই তার
প্লট। কিন্তু শেষটা সাজাতে পারছে
না।
পিসী আমেরিকায় মেয়ে ঊর্মিদির কাছে চলে যাবে ছমাস পরে।
যাবার আগে এই বাড়ীটা রর র নামে লিখে দিতে চায়। ঊর্মি আর ভারতে ফিরবে না। তাই স্বামীর ভিটে রক্ষার জন্য রর কেই বাড়ী দিয়ে যাবেন। গাছের ফলফুল বিক্রী করে রর র দিব্যি চলে যাবে
ও মন দিয়ে শুধু লিখবে।
আবার রর ভাবতে থাকে গল্পের শেষটা র কথা।
আচ্ছা শেষে কী ললিতা কখনো
ধরা পড়বে? কী করে পড়বে?
কোন প্রমাণ তো নেই।ওর ঘরের ক্যামেরায় কদিন ছবি থাকে এ
সম্পর্কে রর র কোন ধারণা নেই।
ললিতা র হাতে হাতকড়া পড়লে
রর খুশী হতে পারতো।
রর কলকাতায় যেতে পারছে না
মনের ভয় থেকে। সেদিন ললিতাকে ওই কথাটা বেফাঁস বলে ফেলার পর থেকেই রর ভয় পাচ্ছে।
ললিতা ফোন করলে রর ধরে না।
কেটে দেয়।
সেদিন হোয়াটস অ্যাপে একটা
মেসেজ এলো,"অপঘাত বলে কী বোঝাতে চাইছেন বুঝলাম না।দয়া করে কারণটা বলবেন কী?"
খেলা শুরু হয়ে গেছে। ললিতা কে
এবার ভয়েই রাখতে হবে।
রর রণজয়ের লেখা চিঠির একটা
জেরক্স করে ক্যুরিয়ারে পাঠিয়ে
দিল ললিতার ঠিকানায়। জেরক্স পাঠিয়ে বুঝিয়ে দিল যে অরিজিনাল চিঠি রর র কাছে আছে। আর রর র বর্তমান ঠিকানা
ললিতা যতই খুঁজুক পাবে না।
সঙ্গে নিজে ক লাইন লিখে দিল।
"ললিতা,
রণজয়ের বালিশের তলা থেকে
এই চিঠি পেয়েছিলাম আসবার দিন।একটা মানুষ কোন দোষ না
করেও শাস্তি পেল শুধু সন্দেহের বশে।
ললিতা , আমার খুব প্রিয় এক আপনার জনের ছায়া দেখেছিলাম
আপনার মধ্যে। তাই মায়ায় পড়ে
আপনার কথায় আপনাকে সাহায্য
করতে রাজি হয়েছিলাম।
রণজয়ের লেখা পড়ে আমিও
ওনাকে ভুল বুঝে ছিলাম। কিন্তু
আপনি তো ওনার স্ত্রী, ওঁকে ভুল বুঝলেন কী করে?
জানতাম বাংলার বধূদের বুকভরা
মধু থাকে , কিন্তু আপনার বুকে
এত হলাহল কীকরে ছিল?
'অপঘাত' বলেছি কারণ শেষটা
আমি জানি। প্রত্যক্ষদর্শী আমি।
আর তার প্রমাণ ও দিতে পারি।
জিনির কথা ভেবে কাউকে কিছু
বলিনি। আমার না বলাটা দুর্বলতা
ভাববেন না ।"
এরপর বেশ কটা দিন কেটে গেছে। ললিতা আর ফোন করে নি। হয় ও ভয় পেয়ে গেছে, নয় তো ররকে মারার প্ল্যান করছে।
যাক রর এখানে নিরাপদে ই আছে।
রর নিজের উপন্যাস শেষ করার উদ্যোগ নেয়। অনেক দিন না লেখার পরে প্রকাশকরা যেন চিনতেই পারেন না, অথবা চিনতে
চান না।
আকার প্রয়োজনে এতদিন অন্যের
লেখা লিখতে হয়েছিলো। এবার সবটুকু মন রর নিজের লেখায় দেবে। পিসীর সম্পত্তি পাবে এটা জানা থাকলে ললিতার প্রস্তাবে ও
রাজী হতো না। যাক একটা বড়
অভিজ্ঞতা তো হল।
কয়েকদিন পরে ললিতার একটা
মেসেজ এলো।
"ড্রাইভার আপনার বাড়ী চারদিন গিয়ে তালা দেখেফিরে এসেছে।
জানি না আপনি কোথায়। রর
আপনার পাঠানো রণজয়ের চিঠি
পেয়ে আমার ভুল বুঝেছি। প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। সিংহভিলা
বিক্রী করেছি । মিঃ বাজোরিয়া
রবিবার বাড়ীর দখল নেবেন। আমি চলে যাবো সেদিন
অনেকদূর। ৩৭/১ সুইনহো স্ট্রিটে
রণজয়ের একটা বাড়ী আছে।
সেখানে আপনার অপেক্ষায় থাকবে জিনি আর মালতী। আপনাকে ওদের খুব প্রয়োজন।"
ললিতার লেখায় অন্য রকম সুর।হেরে যাওয়া একটি মানুষের কন্ঠস্বর যেন প্রতিধ্বনিত হচ্ছে
ওই কটা পংক্তির মধ্য দিয়ে।
আগামী কালই তো রবিবার।
জিনি আর মালতী কলকাতায়?
রর কে ওদের প্রয়োজন কেন?
রর কী যাবে ওদের কাছে?
রবিবার সকালে একটি ফোন আসে। মালতী।
"স্যার, ম্যাডাম আমাকে এই নম্বর
দিয়ে ছেন। জিনি কে নিয়ে আমি
একা কলকাতায়।ম্যাডাম কোথাও
চলে গেছেন। আপনি একবার
আসবেন?"
রর যখন ৩৭/১,সুইন হো স্ট্রিটে
পৌঁছল, তখন বিকেল চারটে।
বিশাল গেট খুলে দিল দারোয়ান।
এখানেও সামনে বাগান।ভেতরে
গাড়ী রাখার জায়গা। এবাড়ীর
নাম 'শান্তি নিকেতন'। 'সিংহ ভিলার' মত অত বড় বাড়ী না হলেও বেশ বড়।
দারোয়ান খবর দিলে মালতী এসে
দাঁড়ালো, সঙ্গে জিনি। রর কে
নিয়ে ওরা ভেতরে গেল।
সুসজ্জিত ড্রইংরুম। দামী দামী আসবাব।
মালতীর চোখমুখ থমথমে।
জিনি এসে রর র হাত ধরে জিজ্ঞেস করলো,"আঙ্কেল, মা
কোথায়?"
রর চুপ করে রইলো। মালতীকে
জিজ্ঞেস করলো,"কী হয়েছে
আমাকে খুলে বল।"
মালতী একটা বড় মুখবন্ধ খাম
দিল রর র হাতে। রর পরে পড়বে
বলে সরিয়ে রাখলো।
এবার জিনিকে খুশী করার জন্যে
রর গল্প করতে লাগলো। ওকে
চকলেট দিলো। জিনির প্রশ্নের উত্তরে রর বলে,"মা একটা কাজে
গেছে, ঠিক সময়ে আসবে।"
মালতীকে জিজ্ঞাসা করলো কোন
অসুবিধা হচ্চে কিনা। মালতী জানায় অসুবিধা নেই। এই বাড়ীতে দীর্ঘদিন ধরে যে কেয়ার
টেকার থাকত, সেই দোকান বাজার, রান্নাবান্না করে দেয়।
আরো বললো,"ম্যাডাম কী লিখে
গেছেন আমাকে জানাবেন।উনি
বলেছেন আপনার কাছ থেকে সব জেনে নিতে। এখন জিনির সামনে
কোন আলোচনা করতে পারছি না।"
রর জানায় , "বাড়ী গিয়ে চিঠি পড়বো, রাতে জিনি ঘুমিয়ে
পড়লে ফোনে কথা হবে।"
পর্ব ১০
অন্তিম পর্ব
বাড়ী গিয়ে রর খামটা খুলে পড়তে শুরু করলো।
"বাংলাদেশের বধূ হয়েও আমার
বুকে কেন মধুর বদলে হলাহল
এই ছিল আপনার জিজ্ঞাসা।
রর, পরিস্থিতির শিকার আমি।
রক্তের সম্পর্ক যখন বিশ্বাস
ঘাতকতা করে, তখন মানুষের
উপর থেকেই বিশ্বাস চলে যায়।
জন্মদাতা পিতার চক্রান্তের বলি
হয় আমার দিদি। প্রতিবাদ করবো
বলায় গর্ভধারিনী মাতা বলে দেয়
পিতাকে। মায়ের দেওয়া উপহার নতুন জামা জুতো দিঘির জলে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ভোর রাতে বাড়ি ছেড়ে চলে যাই, পথে একটা গাড়ী পিষে দেয় আমাকে।অচেতন হবার আগে চলে যাওয়া গাড়ীটি দেখে বুঝতে পারি ওটা আমার দাদার গাড়ী।"
এই অবধি পড়ে রর ভাবে ,"আরেক রর মানে রীনার সঙ্গেও তো এমনটাই হয়েছিল।
তবে কী আমার অনুমান ঠিক?
না না, আমার রীনা এই কাজ করতেই পারে না।"
আবার পড়া শুরু করে,
"আমাকে তুলে নিয়ে নার্সিং হোমে ভর্তি করান রণজয় সিংহ।
ডাঃ আদিত্য নারায়ণ আমাকে
সুস্থ করে তোলেন। রণজয় সব শুনে আমাকে বিবাহ করেন।উনি
আমাকে রাজরাণী করে রাখেন।
উনি আমার দেবতা।
দুটি সন্তান হারিয়ে আমার মানসিক অবস্থা আমার নিয়ন্ত্রণের
বাইরে চলে যায়।সেই অবস্থায় একদিন আমি রণজয়ের সেই পান্ডুলিপিটা পড়ি। রর, ওটা পড়ে
আপনিও তো সত্যি ভেবেছিলেন, আর আমি সন্তানহারা মা, আমার মনের অবস্থা কেমন হতে পারে
অনুমান করুন। ভেবেছিলাম
নিজের রক্তের সম্পর্ক আমার সঙ্গে যা করেছিল, রণজয় ও তেমনটা করতেই পারে। আমি
রণজয়ের প্রাণনাশ করার প্রতিজ্ঞা করেছিলাম। দুবার ব্যর্থ হয়ে তৃতীয়বারের চেষ্টায় ও মরল না বটে তবে অর্ধমৃত হয়ে বেঁচে
রইল। আমার খারাপ লাগত ওকে
দেখে।যত্ন করতাম।
কিন্তু যেদিন আপনি বললেন ও সুস্থ, সেদিন প্রথমে বিশ্বাস করিনি। তারপর অনুসরণ করে যখন বুঝলাম আপনার কথা সত্যি , ও আমার সঙ্গে প্রতারণা করছে, তখন রাগে উন্মত্ত হয়ে আমি ওকে শেষ করে দিলাম।
আমি খুনি, ঘৃণ্য নরকের কীট।
আমি প্রায়শ্চিত্ত করবো।
এই কদিনে সব কর্তব্য শেষ করেছি।
সিংহভিলা কয়েক কোটি টাকায় বিক্রি করেছি মিঃ বাজোরিয়ার কাছে। জিনি আর মালতীর সঙ্গে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সব পাঠিয়ে দিয়েছি কলকাতায়।
সব অর্থ আর অলংকার জিনির নামে জমা আছে ব্যাঙ্কে। মালতীর
নামে এক কোটি টাকা ফিক্সড আছে, ওর সুদেই ওর চলে যাবে।
জিনির নামে যা আছে তা ও সাবালিকা হলে পাবে। আর সেই
সুদে জিনির পড়া, খাওয়া চলবে।
বাড়ীর দারোয়ান , ড্রাইভার ও কেয়ার টেকারের মাইনেও জমা টাকার সুদ থেকে উকিল বাবু দেবেন।
এমনটাই বিখ্যাত ল ইয়ার মিঃ
অরুণ সাকসেনার ওপর ভার দেওয়া আছে। আব ওদের দুজনের দেখাশোনার দায়িত্ব আপনাকে দিলাম রর। আপনি
ছাড়া অর কাকেই বা বিশ্বাস করবো? জিনিকে মানুষ করার দায়িত্ব আপনি নেবেন তো? উকিল বাবু এই বিষয়ে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করবে।
আমার খোঁজ করবেন না। বৃথা চেষ্টা।
আর একটা কথা। মালতী দরিদ্রের কন্যা হলেও শিক্ষিতা, খুব ভালো
মেয়ে। আমার অনুমান ও আপনাকে ভালো বাসে।
নমস্কার। বিদায়।"
ললিতা।
পুনশ্চঃ "আপনার প্রিয়জনের
প্রতিচ্ছায়া আমার মধ্যে দেখেছিলেন। যদি জীবনের মিল
খুঁজে পান তবে দুইয়ে দুইয়ে চার
করবেন না যেন। যে যায় সে আর ফিরে আসে না।"
রাতে মালতীকে ফোন করে প্রয়োজনীয় তথ্যটুকু জানায়।মালতীর ররকে ভালো বাসার কথাটুকু জানায় না। ও ব্যাপারটা
উহ্যই থাক, কারণ মালতীর প্রতি
রর র মনে কোন অনুভূতি জন্মায় নি। ওর মন সেই অতীতের দুই বেণী বাঁধা, চুড়িদার কামিজ পরা
এক কন্যাতে ডুবে আছে এখনো।তাকে ও ভুলতে পারে নি।
মালতী বলে ররকে,"স্যার হঠাৎ কী করে মারা গেলেন আজও
আমার কাছে রহস্য।"
রর ভাবে,"সেদিন রণজয়ের সুস্থ হবার খবর যদি ললিতাকে না জানাতাম, তাহলে হয়তো উনি
আজও বেঁচে থাকতেন।"
রাতটুকু আধো জাগরণের মধ্যেই
কাটলো রর র। ললিতা একা কোথায় যেতে পারে সে সম্পর্কে তার কোন ধারণাই নেই।জিনির দায়িত্ব কেনই বা তাকে নিতে হবে?
না নিলে জিনিকে কেই বা মানুষ করবে? একা একজন গ্রাম্য তরুণীর পক্ষে কী সম্ভব জিনিকে
আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে
বড়ো করা?
এই হব প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খেতে
থাকে।
মালতীরও ঘুম আসে না। ম্যাডাম
ওকে এক গুরুদায়িত্ব দিয়ে গেছেন
ও পালন করতে পারবে তো?
পরদিন অর্থাৎ সোমবার সকালে
উঠে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে রর
খবরের কাগজ খুলে স্তব্ধ হয়ে গেলো।
"গতকাল সন্ধ্যায় গঙ্গার বড়োঘাট থেকে আধমাইল দূরে একটি
আঘাটায় এক অজ্ঞাত পরিচয় নারী র মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়।
এদিন জোয়ার আসায় পাথরে ধাক্কা লেগে মৃতার মুখ ক্ষত বিক্ষত
হয়ে যায়। মূলঘাটে একটি ব্যাগ পাওয়া যায়, তাতে ললিতা সিংহের নামের আধার কার্ড পাওয়া যায়।
মনে করা হচ্ছে মৃতদেহটি হয়ত
ললিতা সিংহের।এ ব্যাপারে কারো কিছু জানা থাকলে ডায়মন্ড হারবার থানায় যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে।"
এই তাহলে ললিতার প্রায়শ্চিত্ত!
এইভাবে জিনিকে ফেলে রেখে
চলে গেল?
ল ইয়ার অরুণ সাকসেনা খবরের কাগজ পড়েই মালতীকেফোন করেন।মালতী সব শুনে হতভম্ব
হয়ে যায়। রর কে ফোন করে।
তারপর জিনিকে রর র কাছে রেখে উকিল বাবুর সঙ্গে থানায়
যায়। মুখ দেখে সনাক্ত করতে পারে না কেউ কারণ চেনা যাচ্ছে না।মুখে একটা তিল ছিল, সেটাও
ক্ষতের আড়ালে।শাড়ী দেখেও
মালতী বুঝতে পারে না, কারণ
রণজয় মারা যাবার পর মালতী
সাদা কাপড় পরতো। কিন্তু মৃতদেহ আকাশী রঙের শাড়ি পরা। হয়ত
সেদিন আকাশী শাড়ী ই পরেছিল।
মৃতদেহ আপাতত ময়না তদন্তে
যাবে।
রর এরমধ্যে নিজেকে জড়াবেনা।
ময়নাতদন্তের পর সব দিক বিবেচনা করে অবশেষে মালতী আর ল ইয়ার শবদেহটি ললিতার
বলে স্বীকার করলো এবং দাহ
করলো। সঙ্গে সারাক্ষণ ল ইয়ার
ছিলেন।
সময় কারো জন্যে থেমে থাকে না,
নিজের গতিতে এগিয়ে যায়।
এক্ষেত্রেও তাই হলো।
ররকে জিনি মালতীর জন্যে বারবার কলকাতায় আসতে হয়,
আবার পিসিমার জন্য বনগাঁ এ ছুটতে হয়।
পিসিমা একদিন ররকে জিজ্ঞেস
করেন,"হ্যাঁরে এত কলকাতায় যাস কেন?প্রকাশকের কাছে তো
রোজ রোজ যেতে হয় না,তবে কোথায় যাস বাবা?"
"পিসিমা, আমার এক বন্ধু মারা গেছেন, তিনিও লেখক ছিলেন।
তাঁর স্ত্রী আত্মহত্যা করেছেন। ওঁদের ছোট্ট মেয়েটি আর তার সম্পর্কে মাসী একা হয়ে গেছে।
ওদের দেখতে মানবিকতা র খাতিরে আমাকে যেতে হয়।"
"তুই ওদের এখানে নিয়ে আয় না। কদিন থাক, আমার ঘর ভরে যাক।"
রর মালতী আর জিনিকে নিয়ে
বনগাঁ এ আসে। জিনি খুব খুশী।এতবড় বাড়ী, গাছপালা দেখে তার সিংহভিলার মত মনে হয়। তাছাড়া
বাড়ীতে গরু ,ছাগল, হাঁস,খরগোশ দেখে ও উচ্ছসিত। মালতী সেবা
করে পিসিমার মন জয় করেছে।
পিসিমা ররকে বলে," বাবু, তুই
মালতীকে বিয়ে করে এখানে থাক। ঊর্মির ওখানে বিদেশে যাওয়ার আমার ইচ্ছা নেই। ওরা খুব ব্যস্ত। তাছাড়া এই ঘর বাড়ী
ছেড়ে আমি থাকতে পারবো না।"
রর বলে,"কি যে বলো, গল্প লিখে
কটা পয়সা পাই যে বিয়ে করবো?"
পিসিমা বলেন,"এই আমার খেত খামার , ফল ফুল এতেই কত আয়।সব তোর। ঊর্মি বলেছে সব তোকে দিতে। "
রর হেসে এড়িয়ে যায়।
পিসি মালতীকে ধরে,"এই মেয়ে
আমার বউমা হয়ে আমার কাছে
থাকবি?ছেলে বৌ, নাতনী কে নিয়ে কদিন সুখে কাটাই।"
মালতী বলে,"পিসিমা আমি
এমনি ই তোমার কাছে থাকতে পারি। কিন্তু রর স্যারকে আমি
আমার হারিয়ে যাওয়া দাদার
আসনে বসিয়েছি। আমি ছোট থেকেই রণজয়কে ভালো বাসতাম। আর কারোকে বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।"
রর বলে,"আজ আমি এক বোনকে পেলাম পিসি। আমরা
সবাই মিলে তোমার সঙ্গে থাকবো।
এরপর কেটে গেছে তেইশটা বছর। জিনি এম এস সি পাশ করেছে। একটি মিশনারী স্কুলে র
টিচার।
একটা NGO র সঙ্গে জড়িত।সমাজ সেবা করে। এক অনাথ আশ্রমের অনুষ্ঠানে যাবার কথা।
কর্তৃপক্ষ সপরিবারে যাবার আমন্ত্রণ করেছে।
পিসিমার বয়স এখন তিরাশি। তিনি বাড়ীতেই থাকলেন। রর আর মালতী গেল জিনির সঙ্গে।
সুন্দর সাজানো মঞ্চ। প্রধান অতিথি মিস মার্গারেট ও সভাপতি
ফাদার গ্রাহামকে মালা পরানো হলো।
এবার উদ্বোধনী সংগীত।
"আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে।"
হঠাৎ জিনি লক্ষ্য করে ওদের
সুইনহো স্ট্রিটের বাড়ীতে মায়ের যে বিশাল ছবিটা আছে তার সঙ্গে
মিস মার্গারেটের অসম্ভব মিল।
মালতী ও ররকে বলে জিনি।
ওরাও অবাক হয়ে দেখে ।
মালতী বলে,"ঠিক যেন ম্যাডাম।"
রর ভাবে,"একচোখ এক মুখ।
কীকরে হয়?"
মার্গারেটের পরনে সাদা গাউন, গলায় রূপোর ক্রুশ চিহ্ন।চোখে
চশমা।মাথার চুল পিছনে তুলে
চূড়ো করে বাঁধা।তাতে সাদার আভাস। অথচ কোথায় যেন ললিতা র ছায়া। ঠিক যেমন একদিন ললিতার মধ্যে ছায়া
দেখেছিল রীনা রহমানের।
রর র মাথায় চিন্তা ঘুরতে লাগলো।
অনুষ্ঠান চলাকালীন রর বেরিয়ে
এলো হল থেকে।
একজন ফাদার কে দেখে রর
জিজ্ঞেস করে,"আচ্ছা ফাদার মিস
মার্গারেট কী আগে দার্জিলিং এ
থাকতেন? আমার পরিচিত মনে হচ্ছে।"
"ফাদার গ্রাহাম জানেন।ওঁকে
জিজ্ঞেস করলে জানতে পারবেন।"
ফাদার চলে যান।
বাড়ীতে গিয়ে ও আলোচনা হয়।
সবথেকে বেশী উত্তেজিত জিনি।
ওর মায়ের কথা মনে নেই।শুধু
ছবিতে দেখা।তিনি বেঁচে থাকলে
এইরকমই বয়স হতো।জিনি বলে
,"আংকেল, আমি মিস মার্গারেটের সঙ্গে দেখা করতে যাবো। বলবো উনি আমার মায়ের মত দেখতে।"
রর হাসলো।
পরদিন রর মিশনে গিয়ে ফাদার গ্রাহামের সঙ্গে দেখা করলো।
কথা বার করার জন্য বলল,
" ফাদার মিস মার্গারেট কী আগে
দার্জিলিং এ থাকতেন? আমার এক পরিচিতের মত দেখতে।
দেখা করতে পারি একবার?"
"না, তার অনুমতি নেই। উনি কারো সংগে দেখা করেন না। প্রায় তেইশ বছর আগের কথা।
গঙ্গার জলে ভেসে যাচ্ছিলেন।
বাঁচালাম। মাথার একটা আঘাতে
স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলেন।
অনেক চিকিৎসা করেও পূর্বস্মৃতি
মনে আসে নি। মার্গারেট চার্চের দেওয়া নাম।এখানে যীশুর আশ্রয়ে শান্তিতে আছেন। ওঁকে আর বিরক্ত করবেন না।ঈশ্বর আপনার
মঙ্গল করুন।"
রর ফিরে আসে। ভাবে রীনা, ললিতা, মার্গারেট এরা সবাই কী
এক? এদের মৃত্যু নেই,বারবার এরা ফিরে ফিরে আসে। বার বার রর র মনে আশা জাগিয়ে আবার
চলে যায় দূরে।
ভালো থাক তুমি বা তোমরা।
শান্তিতে থাকো।
শান্তি, শান্তি, শান্তি।
******************
বিখ্যাত আমেরিকান সাহিত্যিক
Coollen Hoover বিচরিত
Verity শীর্ষক উপন্যাসের ছায়া অবলম্বনে রচিত সম্পূর্ন মৌলিক
লেখাটি সাহিত্যিকের প্রতি শ্রদ্ধা
জানাতে লেখা হয়েছে।
জটিল মনোস্তত্বমূলক রচনার কেন্দ্রীয়ভাবটি আমাকে আকর্ষণ
করে।মূল ভাবকে বজায় রেখে
রচনাটি মৌলিক ভাবে রচিত।
বাড়ী গিয়ে রর খামটা খুলে পড়তে শুরু করলো।
"বাংলাদেশের বধূ হয়েও আমার
বুকে কেন মধুর বদলে হলাহল
এই ছিল আপনার জিজ্ঞাসা।
রর, পরিস্থিতির শিকার আমি।
রক্তের সম্পর্ক যখন বিশ্বাস
ঘাতকতা করে, তখন মানুষের
উপর থেকেই বিশ্বাস চলে যায়।
জন্মদাতা পিতার চক্রান্তের বলি
হয় আমার দিদি। প্রতিবাদ করবো
বলায় গর্ভধারিনী মাতা বলে দেয়
পিতাকে। মায়ের দেওয়া উপহার নতুন জামা জুতো দিঘির জলে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ভোর রাতে বাড়ি ছেড়ে চলে যাই, পথে একটা গাড়ী পিষে দেয় আমাকে।অচেতন হবার আগে চলে যাওয়া গাড়ীটি দেখে বুঝতে পারি ওটা আমার দাদার গাড়ী।"
এই অবধি পড়ে রর ভাবে ,"আরেক রর মানে রীনার সঙ্গেও তো এমনটাই হয়েছিল।
তবে কী আমার অনুমান ঠিক?
না না, আমার রীনা এই কাজ করতেই পারে না।"
আবার পড়া শুরু করে,
"আমাকে তুলে নিয়ে নার্সিং হোমে ভর্তি করান রণজয় সিংহ।
ডাঃ আদিত্য নারায়ণ আমাকে
সুস্থ করে তোলেন। রণজয় সব শুনে আমাকে বিবাহ করেন।উনি
আমাকে রাজরাণী করে রাখেন।
উনি আমার দেবতা।
দুটি সন্তান হারিয়ে আমার মানসিক অবস্থা আমার নিয়ন্ত্রণের
বাইরে চলে যায়।সেই অবস্থায় একদিন আমি রণজয়ের সেই পান্ডুলিপিটা পড়ি। রর, ওটা পড়ে
আপনিও তো সত্যি ভেবেছিলেন, আর আমি সন্তানহারা মা, আমার মনের অবস্থা কেমন হতে পারে
অনুমান করুন। ভেবেছিলাম
নিজের রক্তের সম্পর্ক আমার সঙ্গে যা করেছিল, রণজয় ও তেমনটা করতেই পারে। আমি
রণজয়ের প্রাণনাশ করার প্রতিজ্ঞা করেছিলাম। দুবার ব্যর্থ হয়ে তৃতীয়বারের চেষ্টায় ও মরল না বটে তবে অর্ধমৃত হয়ে বেঁচে
রইল। আমার খারাপ লাগত ওকে
দেখে।যত্ন করতাম।
কিন্তু যেদিন আপনি বললেন ও সুস্থ, সেদিন প্রথমে বিশ্বাস করিনি। তারপর অনুসরণ করে যখন বুঝলাম আপনার কথা সত্যি , ও আমার সঙ্গে প্রতারণা করছে, তখন রাগে উন্মত্ত হয়ে আমি ওকে শেষ করে দিলাম।
আমি খুনি, ঘৃণ্য নরকের কীট।
আমি প্রায়শ্চিত্ত করবো।
এই কদিনে সব কর্তব্য শেষ করেছি।
সিংহভিলা কয়েক কোটি টাকায় বিক্রি করেছি মিঃ বাজোরিয়ার কাছে। জিনি আর মালতীর সঙ্গে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সব পাঠিয়ে দিয়েছি কলকাতায়।
সব অর্থ আর অলংকার জিনির নামে জমা আছে ব্যাঙ্কে। মালতীর
নামে এক কোটি টাকা ফিক্সড আছে, ওর সুদেই ওর চলে যাবে।
জিনির নামে যা আছে তা ও সাবালিকা হলে পাবে। আর সেই
সুদে জিনির পড়া, খাওয়া চলবে।
বাড়ীর দারোয়ান , ড্রাইভার ও কেয়ার টেকারের মাইনেও জমা টাকার সুদ থেকে উকিল বাবু দেবেন।
এমনটাই বিখ্যাত ল ইয়ার মিঃ
অরুণ সাকসেনার ওপর ভার দেওয়া আছে। আব ওদের দুজনের দেখাশোনার দায়িত্ব আপনাকে দিলাম রর। আপনি
ছাড়া অর কাকেই বা বিশ্বাস করবো? জিনিকে মানুষ করার দায়িত্ব আপনি নেবেন তো? উকিল বাবু এই বিষয়ে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করবে।
আমার খোঁজ করবেন না। বৃথা চেষ্টা।
আর একটা কথা। মালতী দরিদ্রের কন্যা হলেও শিক্ষিতা, খুব ভালো
মেয়ে। আমার অনুমান ও আপনাকে ভালো বাসে।
নমস্কার। বিদায়।"
ললিতা।
পুনশ্চঃ "আপনার প্রিয়জনের
প্রতিচ্ছায়া আমার মধ্যে দেখেছিলেন। যদি জীবনের মিল
খুঁজে পান তবে দুইয়ে দুইয়ে চার
করবেন না যেন। যে যায় সে আর ফিরে আসে না।"
রাতে মালতীকে ফোন করে প্রয়োজনীয় তথ্যটুকু জানায়।মালতীর ররকে ভালো বাসার কথাটুকু জানায় না। ও ব্যাপারটা
উহ্যই থাক, কারণ মালতীর প্রতি
রর র মনে কোন অনুভূতি জন্মায় নি। ওর মন সেই অতীতের দুই বেণী বাঁধা, চুড়িদার কামিজ পরা
এক কন্যাতে ডুবে আছে এখনো।তাকে ও ভুলতে পারে নি।
মালতী বলে ররকে,"স্যার হঠাৎ কী করে মারা গেলেন আজও
আমার কাছে রহস্য।"
রর ভাবে,"সেদিন রণজয়ের সুস্থ হবার খবর যদি ললিতাকে না জানাতাম, তাহলে হয়তো উনি
আজও বেঁচে থাকতেন।"
রাতটুকু আধো জাগরণের মধ্যেই
কাটলো রর র। ললিতা একা কোথায় যেতে পারে সে সম্পর্কে তার কোন ধারণাই নেই।জিনির দায়িত্ব কেনই বা তাকে নিতে হবে?
না নিলে জিনিকে কেই বা মানুষ করবে? একা একজন গ্রাম্য তরুণীর পক্ষে কী সম্ভব জিনিকে
আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে
বড়ো করা?
এই হব প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খেতে
থাকে।
মালতীরও ঘুম আসে না। ম্যাডাম
ওকে এক গুরুদায়িত্ব দিয়ে গেছেন
ও পালন করতে পারবে তো?
পরদিন অর্থাৎ সোমবার সকালে
উঠে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে রর
খবরের কাগজ খুলে স্তব্ধ হয়ে গেলো।
"গতকাল সন্ধ্যায় গঙ্গার বড়োঘাট থেকে আধমাইল দূরে একটি
আঘাটায় এক অজ্ঞাত পরিচয় নারী র মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়।
এদিন জোয়ার আসায় পাথরে ধাক্কা লেগে মৃতার মুখ ক্ষত বিক্ষত
হয়ে যায়। মূলঘাটে একটি ব্যাগ পাওয়া যায়, তাতে ললিতা সিংহের নামের আধার কার্ড পাওয়া যায়।
মনে করা হচ্ছে মৃতদেহটি হয়ত
ললিতা সিংহের।এ ব্যাপারে কারো কিছু জানা থাকলে ডায়মন্ড হারবার থানায় যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে।"
এই তাহলে ললিতার প্রায়শ্চিত্ত!
এইভাবে জিনিকে ফেলে রেখে
চলে গেল?
ল ইয়ার অরুণ সাকসেনা খবরের কাগজ পড়েই মালতীকেফোন করেন।মালতী সব শুনে হতভম্ব
হয়ে যায়। রর কে ফোন করে।
তারপর জিনিকে রর র কাছে রেখে উকিল বাবুর সঙ্গে থানায়
যায়। মুখ দেখে সনাক্ত করতে পারে না কেউ কারণ চেনা যাচ্ছে না।মুখে একটা তিল ছিল, সেটাও
ক্ষতের আড়ালে।শাড়ী দেখেও
মালতী বুঝতে পারে না, কারণ
রণজয় মারা যাবার পর মালতী
সাদা কাপড় পরতো। কিন্তু মৃতদেহ আকাশী রঙের শাড়ি পরা। হয়ত
সেদিন আকাশী শাড়ী ই পরেছিল।
মৃতদেহ আপাতত ময়না তদন্তে
যাবে।
রর এরমধ্যে নিজেকে জড়াবেনা।
ময়নাতদন্তের পর সব দিক বিবেচনা করে অবশেষে মালতী আর ল ইয়ার শবদেহটি ললিতার
বলে স্বীকার করলো এবং দাহ
করলো। সঙ্গে সারাক্ষণ ল ইয়ার
ছিলেন।
সময় কারো জন্যে থেমে থাকে না,
নিজের গতিতে এগিয়ে যায়।
এক্ষেত্রেও তাই হলো।
ররকে জিনি মালতীর জন্যে বারবার কলকাতায় আসতে হয়,
আবার পিসিমার জন্য বনগাঁ এ ছুটতে হয়।
পিসিমা একদিন ররকে জিজ্ঞেস
করেন,"হ্যাঁরে এত কলকাতায় যাস কেন?প্রকাশকের কাছে তো
রোজ রোজ যেতে হয় না,তবে কোথায় যাস বাবা?"
"পিসিমা, আমার এক বন্ধু মারা গেছেন, তিনিও লেখক ছিলেন।
তাঁর স্ত্রী আত্মহত্যা করেছেন। ওঁদের ছোট্ট মেয়েটি আর তার সম্পর্কে মাসী একা হয়ে গেছে।
ওদের দেখতে মানবিকতা র খাতিরে আমাকে যেতে হয়।"
"তুই ওদের এখানে নিয়ে আয় না। কদিন থাক, আমার ঘর ভরে যাক।"
রর মালতী আর জিনিকে নিয়ে
বনগাঁ এ আসে। জিনি খুব খুশী।এতবড় বাড়ী, গাছপালা দেখে তার সিংহভিলার মত মনে হয়। তাছাড়া
বাড়ীতে গরু ,ছাগল, হাঁস,খরগোশ দেখে ও উচ্ছসিত। মালতী সেবা
করে পিসিমার মন জয় করেছে।
পিসিমা ররকে বলে," বাবু, তুই
মালতীকে বিয়ে করে এখানে থাক। ঊর্মির ওখানে বিদেশে যাওয়ার আমার ইচ্ছা নেই। ওরা খুব ব্যস্ত। তাছাড়া এই ঘর বাড়ী
ছেড়ে আমি থাকতে পারবো না।"
রর বলে,"কি যে বলো, গল্প লিখে
কটা পয়সা পাই যে বিয়ে করবো?"
পিসিমা বলেন,"এই আমার খেত খামার , ফল ফুল এতেই কত আয়।সব তোর। ঊর্মি বলেছে সব তোকে দিতে। "
রর হেসে এড়িয়ে যায়।
পিসি মালতীকে ধরে,"এই মেয়ে
আমার বউমা হয়ে আমার কাছে
থাকবি?ছেলে বৌ, নাতনী কে নিয়ে কদিন সুখে কাটাই।"
মালতী বলে,"পিসিমা আমি
এমনি ই তোমার কাছে থাকতে পারি। কিন্তু রর স্যারকে আমি
আমার হারিয়ে যাওয়া দাদার
আসনে বসিয়েছি। আমি ছোট থেকেই রণজয়কে ভালো বাসতাম। আর কারোকে বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।"
রর বলে,"আজ আমি এক বোনকে পেলাম পিসি। আমরা
সবাই মিলে তোমার সঙ্গে থাকবো।
এরপর কেটে গেছে তেইশটা বছর। জিনি এম এস সি পাশ করেছে। একটি মিশনারী স্কুলে র
টিচার।
একটা NGO র সঙ্গে জড়িত।সমাজ সেবা করে। এক অনাথ আশ্রমের অনুষ্ঠানে যাবার কথা।
কর্তৃপক্ষ সপরিবারে যাবার আমন্ত্রণ করেছে।
পিসিমার বয়স এখন তিরাশি। তিনি বাড়ীতেই থাকলেন। রর আর মালতী গেল জিনির সঙ্গে।
সুন্দর সাজানো মঞ্চ। প্রধান অতিথি মিস মার্গারেট ও সভাপতি
ফাদার গ্রাহামকে মালা পরানো হলো।
এবার উদ্বোধনী সংগীত।
"আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে।"
হঠাৎ জিনি লক্ষ্য করে ওদের
সুইনহো স্ট্রিটের বাড়ীতে মায়ের যে বিশাল ছবিটা আছে তার সঙ্গে
মিস মার্গারেটের অসম্ভব মিল।
মালতী ও ররকে বলে জিনি।
ওরাও অবাক হয়ে দেখে ।
মালতী বলে,"ঠিক যেন ম্যাডাম।"
রর ভাবে,"একচোখ এক মুখ।
কীকরে হয়?"
মার্গারেটের পরনে সাদা গাউন, গলায় রূপোর ক্রুশ চিহ্ন।চোখে
চশমা।মাথার চুল পিছনে তুলে
চূড়ো করে বাঁধা।তাতে সাদার আভাস। অথচ কোথায় যেন ললিতা র ছায়া। ঠিক যেমন একদিন ললিতার মধ্যে ছায়া
দেখেছিল রীনা রহমানের।
রর র মাথায় চিন্তা ঘুরতে লাগলো।
অনুষ্ঠান চলাকালীন রর বেরিয়ে
এলো হল থেকে।
একজন ফাদার কে দেখে রর
জিজ্ঞেস করে,"আচ্ছা ফাদার মিস
মার্গারেট কী আগে দার্জিলিং এ
থাকতেন? আমার পরিচিত মনে হচ্ছে।"
"ফাদার গ্রাহাম জানেন।ওঁকে
জিজ্ঞেস করলে জানতে পারবেন।"
ফাদার চলে যান।
বাড়ীতে গিয়ে ও আলোচনা হয়।
সবথেকে বেশী উত্তেজিত জিনি।
ওর মায়ের কথা মনে নেই।শুধু
ছবিতে দেখা।তিনি বেঁচে থাকলে
এইরকমই বয়স হতো।জিনি বলে
,"আংকেল, আমি মিস মার্গারেটের সঙ্গে দেখা করতে যাবো। বলবো উনি আমার মায়ের মত দেখতে।"
রর হাসলো।
পরদিন রর মিশনে গিয়ে ফাদার গ্রাহামের সঙ্গে দেখা করলো।
কথা বার করার জন্য বলল,
" ফাদার মিস মার্গারেট কী আগে
দার্জিলিং এ থাকতেন? আমার এক পরিচিতের মত দেখতে।
দেখা করতে পারি একবার?"
"না, তার অনুমতি নেই। উনি কারো সংগে দেখা করেন না। প্রায় তেইশ বছর আগের কথা।
গঙ্গার জলে ভেসে যাচ্ছিলেন।
বাঁচালাম। মাথার একটা আঘাতে
স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলেন।
অনেক চিকিৎসা করেও পূর্বস্মৃতি
মনে আসে নি। মার্গারেট চার্চের দেওয়া নাম।এখানে যীশুর আশ্রয়ে শান্তিতে আছেন। ওঁকে আর বিরক্ত করবেন না।ঈশ্বর আপনার
মঙ্গল করুন।"
রর ফিরে আসে। ভাবে রীনা, ললিতা, মার্গারেট এরা সবাই কী
এক? এদের মৃত্যু নেই,বারবার এরা ফিরে ফিরে আসে। বার বার রর র মনে আশা জাগিয়ে আবার
চলে যায় দূরে।
ভালো থাক তুমি বা তোমরা।
শান্তিতে থাকো।
শান্তি, শান্তি, শান্তি।
******************
বিখ্যাত আমেরিকান সাহিত্যিক
Coollen Hoover বিচরিত
Verity শীর্ষক উপন্যাসের ছায়া অবলম্বনে রচিত সম্পূর্ন মৌলিক
লেখাটি সাহিত্যিকের প্রতি শ্রদ্ধা
জানাতে লেখা হয়েছে।
জটিল মনোস্তত্বমূলক রচনার কেন্দ্রীয়ভাবটি আমাকে আকর্ষণ
করে।মূল ভাবকে বজায় রেখে
রচনাটি মৌলিক ভাবে রচিত।
