সঞ্চয়িতা কাব্যের কিছু কথা
সঞ্চয়িতা কাব্যের কিছু কথা
সঞ্চয়িতার কবিতাগুলির সংকলনের ভার নিজেই নিয়েছিলেন আমাদের কবিগুরু। অন্য কাউকে দায়িত্ব দিতেই পারতেন কিন্তু নিজে করার কারণ একটাই গুরুদেবের মতে যে কবিতা লিখে তার অন্তর্নিহিত ইতিহাস একমাত্র তার কাছেই সুস্পষ্ট। অন্যদের প্রকাশে কবিতাগুলো কতটা উজ্জ্বল হয়েছে সেটা তার পক্ষে নিশ্চিত বোঝা কোন ক্ষেত্রেই সহজ হয়ে ওঠা সম্ভব নয়।
কথা হচ্ছে এই সংকলন উপলক্ষে তিনি একটি কথা বলবার সুযোগ পাওয়ার প্রত্যাশা করে এ কাজে হাত দিয়েছিলেন। যারা নাকি তার কবিতা প্রকাশ করে থাকেন অনেক দিন থেকেই তাদের সম্বন্ধে তিনি এই অনুভব করেছিলেন যে, কবির অল্প বয়সের যে সকল রচনা চলতে শুরু করেছে মাত্র, যারা ঠিক কবিতার সীমার মধ্যে এসে তখনো পৌঁছয়নি, তিনি চাননি তার সংকলনে সেসব কবিতার স্থান হোক, সেটাকে তিনি নিজের প্রতি অবিচার বলে মনে করতেন।
কোনো এক প্রবন্ধে কবির গানের সমালোচনায় এমন সকল গানকে তার কবিতায় পঙ্গুত্বের দৃষ্টান্তস্বরূপ লেখক উদ্ধৃত করেছিলেন, যেগুলো ছাপার বইয়ে প্রশ্রয় পেয়ে কবিকে অনেকদিন ধরে লজ্জা দিয়ে এসেছিল। সেগুলি অপরিণত মনের প্রকাশ পরিণত ভাষায় ছিল। কেউ কেউ আবার সে গুলোকে ভালোবেসেছেন, কবি সে গুলোকে নিজের দুর্গতি বলে মনে করেছেন এবং সেই দুর্গতির জন্য নিজেকেই দায়ী করেছেন। প্রবন্ধ লেখক কে তিনি দোষ দিতে পারেন নি কেননা তিনি মনে করতেন লেখায় তিনি যে অপরাধ করেছিলেন ছাপার অক্ষরে তাকে সমর্থন করা হয়েছিল।
যে কবিতাগুলি কবি নিজে স্বীকার করেছিলেন তার দ্বারা তাকে কেও দায়ী করলে কবির তরফে কোন নালিশ থাকতো না। কবির বন্ধুরা বলেছিলেন ইতিহাসের ধারা রক্ষা করা চাই। কিন্তু কবি যে নিজেই একদিন ইতিহাস হয়ে যাবেন সে কথা তারা ঘুনাক্ষরেও টের পাননি। কবি তখন মনে মনে বলেন তাঁর লেখা যখন কবিতা হয়ে উঠেছে তখন থেকেই তার ইতিহাস শুরু। এ নিয়ে নানান জনের মধ্যে তর্ক হতে পারে তবে এ কথা বলার জায়গা এখানে যথাযথ নয়।
সন্ধ্যাসংগীত লোকগীতি সংগীত ছবি ও গান এখনো যে বই আকারে চলছে সেটা কে কবি কালাতিক্রমণ-দোষ বলে অভিহিত করেছেন। ছোট্ট শিশু যদি প্রধানের সভায় গিয়ে ছেলে মানুষি করে তবে সেটা সহ্য করা শিশুদের পক্ষে যেমন ভালো নয় প্রধান দের পক্ষেও নয়। এই ব্যাপারটাও ঠিক সেরকম। তার মতে তার বিগত তিনটি কাব্যগ্রন্থেও একই রকম দোষ পেয়েছে। যেমন ডিমের ভেতর যে সাবকাশ এসেছে এখনো পাখি হয়ে ওঠেনি এটাতে যেমন কেউ দোষ দেবে না তেমনি কিন্তু তাকে পাখি বললে দোষ দিতেই পারে। কবি তার সঞ্চয়িতার ভূমিকায় এমনটাই বলেছেন।
ইতিহাস রক্ষার খাতিরে সঞ্চয়িতা সংকলনে তিনি যেই বইগুলোর কথা গুলো বলেছেন তার থেকে যে কয়েকটি লেখা তিনি সঞ্চয়িতা কাব্যগ্রন্থে প্রকাশ করতে পেরেছেন সেই কবিতাগুলোকে ছাড়া বাকি প্রকাশিত বইয়ের কবিতাগুলোকে তিনি গ্রহণ করতে পারবেন না বলে জানিয়েছেন। ভানুসিংহের পদাবলী সম্বন্ধেও তিনি একই কথা বলেছেন। কড়ি ও কোমলেও অনেক ছিল ত্যাজ্য জিনিস, কিন্তু সেই পড়বে তার কাব্য ভূসংস্থানে ডাঙ্গা জেগে উঠতে শুরু করেছিল। তারপর মানসী থেকে আরম্ভ করে বাকি বইগুলির কবিতায় ভালো-মন্দ মাঝারির ভেদ আছে, কিন্তু গুরুদেবের আদর্শ অনুসারে সেগুলি তখন প্রবেশ শিক্ষা অতিক্রম করে কবিতার শ্রেণীতে উর্ত্তীন্ন হয়েছিল।
সঞ্চিতা গ্রন্থে যে কবিতাগুলি করেছিলেন তার অনেকগুলোই দেওয়া হয়ে ওঠেনি, কেননা জায়গা ছিল না। ছাপার কাজ অগ্রসর হতে হতে আয়তনের স্ফীতি দেখে তিনি ভীত মানে আত্মসংবরণ করেছিলেন।
এরকম সংকলন কখনোই সম্পূর্ণ হতে পারে না বলে কবিগুরুর মনের ধারণা ছিল। সেই মুহূর্তে তার মনের অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছিল, মনোযোগ এর তারতম্য ঘটে ছিল এই ভেবে যে সংকলনের সাথে অবিচার না হয়ে যায়।
কবিগুরুর লেখা যে সকল কাব্যগ্রন্থ দীর্ঘকাল পাঠকদের পরিচিত এই গ্রন্থে তাদের থেকেই বিশেষ করে লেখা গুলো সংগ্রহ করা হয়েছিল, যেগুলো অপেক্ষাকৃত অপরিচিত সে সেগুলো যথাস্থানে পূর্ণতর পরিচয়ের অপেক্ষায় কবি রেখে দিয়েছিলেন।