মানবিক মূল্যবোধ(প্রবন্ধ)
মানবিক মূল্যবোধ(প্রবন্ধ)
শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য হলো একটি উন্নত মানবজাতির জন্ম দেওয়া অর্থাৎ প্রকৃত মানুষ তৈরি করা। যাদের মধ্যে থাকবে দেশপ্রেম নৈতিক শিক্ষার সামাজিক ও মানবিক মূল্যবোধ। আদর্শ মানবিক মূল্যবোধ সমাজের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ। যেটা না থাকলে মানুষ প্রকৃত মানুষে পরিণত হতে পারে না। মানুষের তখনই মানবিক মূল্যবোধের প্রকাশ ঘটবে যেদিন সে ভালো এবং উত্তম মানের কাজ করতে পারবে। যখন একটি মানুষ সৎ হয় আর নিজের কাজ সম্পর্কে দৃঢ় হয় তখন তার চরিত্র ধীরে ধীরে মানবিক মূল্যবোধের অধিকারী হতে থাকে।
প্রাত্যহিক আমরা যে জীবন যাপন করি সেখানে একজন ব্যক্তির যে জিনিসটি একান্ত প্রয়োজন সেটি হল মূল্যবোধ। মূল্যবোধ যে চারিত্রিক গুণ সেটা আমরা নিজেদের পরিবারের নিকট জন্মলগ্ন থেকে পেয়ে থাকি। সকল সৎ গুণের মধ্যে মূল্যবোধ শব্দটি মানুষের চরিত্রের একটি বলিষ্ঠ গুণ যা আমরা রপ্ত করতে সক্ষম হই পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি থেকে।
একজন মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন মানুষ সমাজ কল্যাণ বা রাষ্ট্র কল্যাণ যেকোনো পরিস্থিতিতেই হোক না কেন এগিয়ে আসতে দ্বিধাবোধ করেন না। একই সাথে অন্য একজন মানুষ তার নিজের চোখের সামনে খারাপ কিছু ঘটে যাওয়া কিংবা তার নিজের সাথে কোন অন্যায় মেনে নিচ্ছেন নত মস্তকে, বুঝতে হবে তার নিজের মানবিক চেতনা লোপ পেয়েছে। সে অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে পারে না। অর্থাৎ মূল্যবোধ লালন-পালনে তার নিজের কোন ইচ্ছাই নেই। সে যেমন প্রতিবাদ করতে পারেনা তেমনি সে অন্যায় মেনে নিতে কুণ্ঠাবোধ করে না।
আমাদের নিজেদের শিক্ষার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য গৌরবময় ইতিহাসকে যদি টিকিয়ে রাখতে চায় তাহলে আমাদের মানবিক মূল্যবোধের প্রয়োজন। নচেৎ আমরা কিছুতেই পারবো না নিজেদের অতীত ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখতে। আমাদের দরকার একনিষ্ঠ লক্ষ্য সুষ্ঠ মূল্যবোধসম্পন্ন মনুষ্যত্ব অর্জন করা। মনুষ্যত্বের সাথে মানুষের নৈতিকতার প্রয়োজন রয়েছে সঠিক মানবিক মূল্যবোধের জন্য। মানুষের মূল্যবোধ পারে মানুষকে যথার্থভাবে সাফল্যমন্ডিত করে তুলতে এবং তার চরিত্রের সৌন্দর্যায়ন করতে। মানুষের এই মানবিক মূল্যবোধের উপর নির্ভর করে সমাজের মূল ভিত্তি। উন্নত রাষ্ট্র গঠনের একমাত্র চাবিকাঠি হচ্ছে এই মানবিক মূল্যবোধ। যার মূল্যবোধ আছে তিনি বিবেকবান ব্যক্তি। আর সেরকম একজন ব্যক্তি সহমর্মী হয়ে থাকেন। তিনিই পারেন সমাজ কল্যাণ কার্যে ব্রতী হতে আর একসাথে নিজের ও অন্যের সুখ সুবিধা দেখতে এবং সেই কাজে তার বিবেক তাকে সাহায্য করে থাকে।
যার মানবিক বিবেক নেই সে অন্যের সমস্যায় দুঃখে কষ্টে এগিয়ে আসতে পারে না ফলে তার নিজের বেলাতেও কেউ এগিয়ে আসেন না। যখন আমাদের মানবিক বিবেক কাজ করে তখন নিজের অজান্তেই আমরা অন্যের ভালো চাই। ফলস্বরূপ অন্যের কাছ থেকেও আমরা সহমর্মিতা পেয়ে থাকি। একজন মানবিক মানুষ সবসময় আদর্শে বলীয়ান হয়ে থাকেন। তিনি সহমর্মিতা সৌজন্যবোধ মানবিকতা বিনয় শিষ্টাচার এসব গুণের অধিকারী হয়ে নিজেকে আলোকমন্ডিত করে তুলেন। সাথে নিজের আলো বিকিরণ করে মূল্যবোধের বিকাশ সাধন করেন এবং সুস্থ সবল সমাজ গঠন করতে সক্ষম হয়ে থাকেন।
মূল্যবোধ হচ্ছে নিজের বুদ্ধি আর দক্ষতার সাহায্যে প্রত্যেকটা জিনিস এবং কাজের ভালো মন্দ দোষ গুণ বিচার বিশ্লেষণ বা মূল্যায়ন করতে পারাকে বোঝায়। সুস্থ এবং সুষ্ঠ নীতির প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন থেকে আসতে পারে নীতিবোধ আর নীতিবোধ থেকে আসবে নৈতিকতা। চলমান সমাজ গঠনে নৈতিকতা ও মূল্যবোধ শিক্ষা অতি প্রয়োজনীয় এবং এর ভূমিকা অপরিসীম। এই শিক্ষার জন্য প্রয়োজন সুষ্ঠ ব্যবস্থাপনা অনুশীলন যার বীজ গ্রন্থন ঘটে পরিবার থেকে এবং ধীরে ধীরে বিকশিত হতে থাকে সমাজে। এই নৈতিক মূল্যবোধ শিক্ষার প্রথম আর প্রধান উৎস হল শিশুর বাবা ও মা। একজন শিশুর উপর মায়ের প্রভাব সব থেকে বেশি। তাই প্রত্যেকটি পরিবারের মাকে নৈতিক শিক্ষার অধিকারী এবং পরিমার্জিত হওয়া দরকার। মূল্যবোধ সততা এবং সৎ চিন্তা থেকে জন্ম নেয় যা মানুষকে মানবিক বোধশক্তিতে উজ্জীবিত করে তোলে এবং ন্যায়ের পথে চালিত করে।
তাহলে মূল্যবোধ বলতে আমরা বুঝি একজন ব্যক্তির সার্বজনীন আচরণ যা সত্য ন্যায় এবং প্রেম ভালোবাসাকে প্রতিষ্ঠিত করে। মানুষের মূল্যবোধ এমন এক জিনিস যা কালের পরিবর্তনেও পরিবর্তিত হয় না। মানবিক মূল্যবোধ মানুষের শাশ্বত গুণ। আর এই মূল্যবোধ সুষ্ঠ সমাজে সর্বজন স্বীকৃত।
আমাদের সমাজের আচারনীতি এবং মনোভাব সমাজের অনুমোদিত পারস্পরিক ব্যবহারে একজন ব্যক্তির মধ্যে স্নেহ মায়া মমতা ভালবাসা আর সততা ইত্যাদি ভাবের সৃষ্টি করে থাকে। এমনটা হয়ে থাকলে সেখানে নৈতিক সামাজিক এবং মানবিক মূল্যবোধ প্রবাহমান আছে বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে। আর এমন নৈতিক আদর্শ যে সমাজে বিদ্যমান সেখানে কোন অনাচার থাকতে পারে না। যেমন ঘুষ প্রবঞ্চনার শোষণ প্রতারণা স্বার্থপরতা এসব দুর্নীতি থেকে সমাজ মুক্ত থাকবে এবং জীবনে আদর্শের প্রতিফলন ঘটবে। ন্যায় নীতি যুক্ত এবং দুর্নীতি মুক্ত জীবনই আদর্শ জীবন।
দুঃখের বিষয় যতদূর চোখ যায় দেখা যায় সবদিকে হীনতৎপরতার পাহাড় গড়ে উঠেছে। সমাজের ক্ষমতাবান লোকেরা ক্ষমতার অপব্যবহার করছেন। স্বীয় বৈভবের পাহাড় তৈরি করছেন। সকল ক্ষেত্রে অনৈতিকতা ও অরাজকতা বিরাজ করছে। কোথাও স্বচ্ছতা নেই। প্রত্যেকেই সামাজিক বা মানবিক দায়বদ্ধতা এড়িয়ে চলছেন। ন্যায় অন্যায়ের মাঝখানে কোন ব্যবধান নেই। বর্তমানে দেখা যাচ্ছে মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তিবিশেষের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, সমাজের শিশু এবং যেকোন অবলাপ্রাণ এরা অপরাধী না হলেও শিকার হচ্ছে কিছু বিবেকহীন মানুষের দ্বারা।
কাঠামোহীন বুনিয়াদ ও উন্নয়ন অনেক দেখা যায়। কিন্তু মানতেই হবে যে কোথাও একটা গলদ হয়ে রয়েছে। নয়তো সমাজের এত অবক্ষয় কেন? পুষ্টিগত কারণে হোক বা ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক বিভেদের জন্য হোক মনে হয় সমাজে অন্যায় অনাচার বেড়েই চলেছে। মানুষের মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয় স্বরূপ দিনে দিনে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ লুপ্ত হচ্ছে আর এর ফলস্বরূপ ভবিষ্যত দিনে মানুষের উপর কি ধরনের বিপদ ঘনিয়ে আসতে চলেছে তা ভাবলেও আতঙ্কিত হতে হয়। মনের ভিতর ছোঁয়াচে রোগের মতো ছড়িয়ে পড়ছে এই বিপর্যয় দেশ ও সমাজের প্রতিটি কোণে কোণে। সামাজিক স্বাস্থ্য বিপর্যয় ঘটছে। এই বিপর্যয়ের প্রতিকার আমরা কম বেশি সকলেই জানি। কিন্তু সঠিক কি করতে হবে জানমার পরেও সেই কাজ কেউ করছি না শুধুমাত্র নিজেদের কিছু ক্ষুদ্র স্বার্থ চরিতার্থ করবার জন্য।
এখানে কেউ কারো সর্বনাশ করার আগে দুবার ভেবে দেখার জন্য নিজেদের কাছে সময় নেই। নিজেদের লোভের বসে কচি শিশুর কাঁচা মন নিয়ে নির্দ্বিধায় খেলছি। রেখে যাচ্ছি নিষ্ঠুর অমানবিকতার চিহ্ন সরল শিশুমনে। তাদের মনে ঢুকিয়ে দিচ্ছে আতঙ্ক, ভয় আর হীনমন্যতা। আতঙ্কে তাদের শৈশব খর্ব হচ্ছে। ভুলে যাচ্ছি যে সব অন্যায় আমরা করছি সেসব পাপের প্রায়শ্চিত্তও আমাদেরকেই করতে হবে। সমাজের অমানুষদের দ্বারা গঠিত অন্যায় বা অমানবিকতার সামাজিক সম্পর্কের বন্ধন ছিন্ন করছে। দুর্বিষহ করে তুলছে মানুষের বেঁচে থাকা। মানুষ বিশ্বাস হারিয়ে ফেলছে আর আশঙ্কায় দিন কাটাচ্ছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সম্পূর্ণভাবে বিপন্ন আর এই হচ্ছে সবথেকে দুর্ভাবনার বিষয়।
আজকাল সংবাদমাধ্যমে প্রায় আমরা দেখতে পাই শিশু অপহরণ ধর্ষণ খুন এসব ঘটনা দিনে দিনে বেড়েই চলছে। নির্লজ্জের মত আমাদেরকে দেখতে হচ্ছে আর তাদের অসহায় অবস্থা। বিবেকহীন দুর্বৃত্ত বর্বরদের একমাত্র লক্ষ্যবস্তু হচ্ছে নিরপরাধ অসহায় নিষ্পাপ শিশুরা,,কেন এভাবে শিকার হচ্ছে তারা? তাহলে কি দুরাশয় ব্যক্তিরা সামাজিক শিক্ষা ও সভ্যতা থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে? তবে কি আমাদের স্বাধীনতা থেকে আমরা কিছু অর্জন করতে পারিনি এখনো?
আমাদের সমাজে নারীরাও সুরক্ষিত নয়। যে নারী একটি সমাজের সৃষ্টি করে থাকে যে নারী এই অনন্য পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কারিগর তারা আজ নিজেরাই সমাজের সুরক্ষিত নয়। এমনকি অনেক পরিবারেও দেখা যায় নারীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। দিনের পর দিন অবহেলিত হচ্ছে। অনেক অন্যায় অত্যাচার এবং মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে প্রতিনিয়ত শুধুমাত্র আমাদের সমাজের হীনমূল্যবোধের জন্য। নারীদের প্রতি আমরা নিজের শ্রদ্ধা ও সম্মান হারিয়ে ফেলেছি সেটা আমাদের মানবিক চেতনা বোধের অবনতির জন্যই। চাইলেই একে অপরের সাথে পা মিলিয়ে চলতে পারি, শুধুমাত্র আমাদের বিবেক বুদ্ধি কে সঠিক ব্যবহার করে একটা সুন্দর পরিবার ও সমাজ গড়ে তুলতে পারি অনায়াসে।
নারীদেরও নিজেদের অবলা না ভেবে সির্জারা শক্ত করে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রয়োজন রয়েছে। নিজেদের অন্তর্নিহিত শক্তি ও সাহসের পরিচয় দিতে হবে। এখানে স্বামী বিবেকানন্দের একটি উক্তি তুলে ধরা যেতে পারে-
"বেদান্তে সংগ্রামের স্থান আছে কিন্তু ভয়ের স্থান নেই। যখন স্বরূপ সম্বন্ধে দৃঢ়ভাবে সচেতন হইতে শুরু করিবে তখনই সব ভয় চলিয়া যাইবে। নিজেকে বদ্ধ মনে করিলে বদ্ধই থাকিবে, মুক্ত ভাবে মুক্তই হইবে।"
আজকাল ঘরে ঘরে দেখা যায় বৃদ্ধ বাবা মায়েদের অসহায় অবস্থা। যে বাবা মা নিজের সমস্তটা দিয়ে তার সন্তানদের মানস করেন সেই সন্তানই একদিন তাদের বাবা-মায়ের বৃদ্ধকালে অসহায় অবস্থা সম্মুখীন হতে বাধ্য করে। সন্তানের ঘরে বাবা মায়ের জন্য জায়গা হয় না। তাদের ঠিকানা হয় কোন বৃদ্ধাশ্রম অথবা অনাথ আশ্রম। এসবই মানবিক চেতনা বোধের অভাব।
তবে কি জন্য এত হাজার হাজার স্কুল কলেজ ইউনিভার্সিটি আর পঠন পাঠন। যদি কোন কিছুই আমাদের মনের দুনিয়ায় দাগ কাটতে পারেনি? কেন জাগলো না মানুষের মানবিক চেতনা? শিক্ষকদের ভূমিকা কি? কেন কোন ব্যবস্থাই জাগাতে পারল না মানুষের মনের সহানুভূতিশীল সত্তাকে? কেন হচ্ছে মনুষ্যত্বের পরাজয়? কেন মানুষ নিজের বিবেকের কাছে বারবার পরাজিত হচ্ছে? একই সমাজে একই পরিবারে থাকার পরও একে অপরের কাছে অপরিচিত থেকে যাচ্ছি কেন তার কারণ খতিয়ে দেখতে হবে এবং এই অবক্ষয়ের প্রতিকার করতে হবে।
সংসার সমাজ এবং দেশকে অবক্ষয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে হলে এটাই মোক্ষম সময় প্রত্যেকের মানব চেতনাবোধ জাগিয়ে তোলার। নিজের বিবেককে ভালো কাজে লাগিয়ে সুন্দর ভাবনার সৃষ্টি করার। নিজের সুন্দর অনুভূতি দিয়ে মানব মনের আঙিনায় সুন্দর বাস্তব সাবলীল স্বপ্নকে এঁকে দেওয়া যাতে করে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা এবং এক নতুন দিশা খুঁজে পায়। সকলেই যেন এক অটুট বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে থাকতে পারে এবং নিজের সৎকর্ম সৎ চিন্তার দ্বারা সমাজ ও দেশের উন্নতি সাধন করে নিজেদের গৌরবান্বিত করে তুলতে পারে।
সকলকে ভাল রাখতে হলে প্রত্যেককেই নিজের ভালোলাগার বিষয়ে সংকল্প গ্রহণ করতে হবে এবং সাধ্যমত সেই সংকল্প পূর্ণ করার চেষ্টা করতে হবে। ধর্ম ও রাজনীতি এসব বিষয় যেন আমাদের ক্ষুদ্র গন্ডির মধ্যে আবদ্ধ করে রাখতে না পারে। মানুষ হয়ে যেন আমরা মানুষ হিসাবেই পরস্পরের পাশে দাঁড়াতে পারি। "প্রত্যেকে আমরা পরের তরে" এই মানব চেতনার মন্ত্রে দীক্ষিত করতে হবে আমাদের প্রত্যেকের মনকে। প্রকৃতপক্ষে তখনই আমাদের মানব জন্ম এবং মানব জীবন যাপন সফল হবে।