Sipra Debnath

Horror Others

4  

Sipra Debnath

Horror Others

অসমাপ্ত ডায়রি

অসমাপ্ত ডায়রি

10 mins
461


(নভেম্বর ৯- বিষয়-হরর)


সন্ধ্যে গড়িয়ে রাত নেমেছে। গ্রামগঞ্জের পথ ঘাট শহুরে রাস্তার মতো নয়। হাঁটার সময় হাওয়াই চটি চট্ চট্ আওয়াজ তুলছে আর শরীরের পেছন দিকের জামা কাপড়ে কাদা ছিটছে। যাবার পথে রাস্তার একধারে টিনের চালার ছোট্ট একটি ঘুমটি ঘরে একটি চায়ের দোকান। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি পড়ছে আর সেই টিনের চালায় বৃষ্টির জল পড়ে একটি অদ্ভুত আওয়াজের সৃষ্টি করে মাথা ঝিম ধরিয়ে দিচ্ছে।


  জনা চারেক বন্ধু মিলে এই বৃষ্টির রাতে ঘুমটি ঘরে চা খেতে বসে আড্ডা দিতে দিতে সন্ধ্যাকালীন মজলিস পুরো জমিয়ে তুলেছে।

  

ভুখা মিছিলের খবর, খেলার খবর মেট্রো রেল, সিনেমা ইত্যাদি ইত্যাদি গল্প করতে করতে একসময় নিজে থেকেই গল্পের মোড় ভূতের গল্পের দিকে এগিয়ে গেল। 


সাহসী দামাল ছেলেমেয়েরা ভুতের গপ্পো টপ্পোকে তোয়াক্কা করে না। তারা নিজেদের জীবনকে তুরি মেরে উড়িয়ে দিতেই পছন্দ করে। এরা ভূত বলে কোন কিছু হয় এটা বিশ্বাসই করতে চায় না। এটা ঠিক ঠাট্টার বিষয় বলে মনে হয় তাদের কাছে। চায়ের মজলিসে ঝালমুড়ি মাখা খাওয়ার মত মুখরোচক গপ্পো। গরম চা আর মুড়ি চানাচুর মাখায় সন্ধ্যে মজলিস জমে উঠেছে বইকি। এমনি করে চার বন্ধুতে মিলে ভূতের গল্পে মশগুল হয়ে উঠলো। এই মুহূর্তে বাইরের দিকে তাকাবার ফুরসত নেই তাদের। বৃষ্টির আওয়াজে কর্ণপাত করার সময় নেই। অবশ্য বাইরের দিকটা এতটাই অন্ধকার যে সেদিকে তাকালেও কিছুই চোখে পড়বে না। অনেক সময় ধরে যে একঘেয়েমি ছন্দে বৃষ্টি পড়ছিল তাতে যে কোন 

ম্যাড়ম্যাড়ে গল্পোও বেশ জমে ওঠে। আর এই গল্প তো ছিল কিনা সান্ধ্য মজলিসের জবরদস্ত অনুপান ভুউউউউতের গল্প!!! কাজেই ওরা চার বন্ধু নিজেদের মধ্যে গল্প করতে করতে নিজেদেরই বোনা মাকড়সার জালে জড়িয়ে যাচ্ছিল। রীতিমত সম্মোহন যাকে বলে। ওরাও অজানা কোন তরঙ্গে সমাধিস্ত হতে থাকলো।


   হঠাৎ টিনের সেই ঘুমটি ঘরে ভেতরে উদয় হল এক রহস্যজনক চেহারার রেইনকোট পরহিত এক ব্যক্তি। তার সারা শরীর ঢাকা রয়েছে। রেইনকোট গড়িয়ে টপটপ করে জল পরছে অনবরত।


  ওরা চার বন্ধু চমকে ওঠে অবাক দৃষ্টিতে লোকটির দিকে ভালো করে তাকালো। ওদের মনে হলো তাদের আলোচিত ভূতের গল্পেরই কোন এক নায়কের আবির্ভাব ঘটল বাইরের সেই সুচিভেদ্য অন্ধকার ভেদ করে। এদের অবাক হবার পালা এখানেই শেষ নয়। ওরা ভালো করে লক্ষ্য করে দেখল যে লোকটি এদেশীয় কেউ নয়। একেবারে যেন খাটি সাহেব। ওদের বিস্ময়ের পরিধি ছাড়িয়ে গেল।

   সাহেবজনা হনহন করে একেবারে ওদের কাছে চলে এলো। তারপর ওদের দিকে চোখ রেখে ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করল যে এদিকে যে একটি ভূত বাংলো রয়েছে সেটি কোথায় আপনারা জানেন??? ওরা চার বন্ধুই কলেজ স্টুডেন্ট। তাই বিদেশী সাহেবের সাথে কথাবার্তায় তাদের তেমন কোন অসুবিধা হলো না।

    

  বন্ধুদের মধ্যে সর্বপ্রথম রঞ্জুই মানে রঞ্জিতই কথা বলল। সে বলল, এই গ্রামের ভেতর দেড়- দু কিলোমিটার পথ হেঁটে চলে গেলে একটি পুরনো বড় জমিদার বাড়ি পাবেন। বহুকাল পুরনো। বর্তমানে সেখানে কেউ বসবাস করে না। সে বাড়ির তেতলায় একটি ফাঁকা কামরা আছে । কেন বলুন তো? আপনি কি সেখানে যাবেন নাকি?

  সমু মানে সৌম্যজিৎ রঞ্জুর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলে উঠলো, সেই নির্জন কামড়ায় যদি এক রাত কাটাতে পারেন তাহলে আপনি সত্যিকারের ভূতের সন্ধান পেয়ে যাবেন।


  সৌম্যর কথা শুনে ওই বিদেশী সাহেব কেমন একটা কুৎসিত কণ্ঠে হেঁসে উঠলেন। অনেক বেশি চিৎকার চেঁচামেচি করার পর মানুষের গলার স্বর যেরূপ খসখসে কর্কশ হয়ে যায় ঠিক তেমন তার কণ্ঠস্বর।

  ওনার চলার বলার ধরন দেখে চার বন্ধু ভীষণ অস্বস্তি বোধ করতে লাগলো। অপরিচিত সেই সাহেব ওদের দিকে বাঁকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখে নিল। তারপর নিজের কোমরে গুজে রাখা বন্দুকটি খুলে নিয়ে ডান হাতের তালুর উপর নাচাতে শুরু করল।

চার বন্ধুর মাথায় এখন একই কথা ঘুরপাক খাচ্ছে। কে এই সাহেব? কোথা থেকেই বা এলো? ওনার মৃত্যই কি উনাকে এ বৃষ্টি-ঝরা অন্ধকার রাতে এত দূরে এই অজ পাড়াগাঁয়ে ডেকে নিয়ে আসলো? নয়তো কোন পাগল এরকম আবহাওয়া ঘর থেকে বের হয়!!!


বুধু মানে বোধন ওদের মধ্যে এক বন্ধু ঠাট্টা করে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল, তা সাহেব সেই ভুতুড়ে বাড়িতে তুমি একাই যেতে পারবে তো? নাকি সঙ্গী-শাপদ লন্ঠন ইত্যাদি তোমার সঙ্গে দিয়ে দিতে হবে?


সাহেবটি আবার খসখসে গলায় তার রহস্যজনক হাসি হেসে উঠলো। নিজের পকেট থেকে একটি টর্চ লাইট বের করে তারপর বাইরের জমকালো অন্ধকারের উদ্দেশ্যে তার টর্চ থেকে যেন আলোর বুলেট ছেড়ে দিল।

সত্যিই জবরদস্ত টর্চলাইট খানি মানতে হবে।। এক বড় আম গাছের মাথায় টর্চের আলোটা গিয়ে পড়তেই কয়েকটি বাদুর ডানা ঝাপটে আকাশের উদ্দেশ্যে রওনা দিল।

সাহেব যেভাবে আচমকায় ঘরের ভিতর প্রবেশ করেছিল ঠিক সেভাবেই রহস্যময় গতিতে প্রবল বৃষ্টির মধ্যেও সে বাইরে বেরিয়ে এগিয়ে চলতে থাকলো। যতদূর দেখা যায় তার টর্চের আলো জ্বলছিল আর নিভছিল।


ঘরের ভেতর চার বন্ধু বাকরুদ্ধ হয়ে বসে থাকলো। ভাবতে লাগলো সাহেবকে এই ঝড় জলের রাতে একা ওই পোড়া বাড়িতে যেতে দেওয়া ঠিক হলো কিনা। মানা করার সময়টুকু পর্যন্ত সাহেব দিল না।। এই কথা ভেবে ওদের মনে একটি অজানা আশঙ্কার সৃষ্টি হলো।


ওদের বাড়ি ফিরবার তারা ছিল না। কারণ ওরা সামার ভ্যাকেশন কাটাতে যে যার বাড়িতে ফিরেছে। বাড়ি ফিরতে রাত যতই হোক না কেন ভাত ঢাকা দেওয়া থাকবে ঠিক। ওরা আরো কিছু সময় বসে থাকার পর সাহেবের কথা ভাবতেই তার জন্য অস্বস্তিবোধ করতে লাগলো। সত্যিই যদি এই অচেনা লোকটি জমিদার বাড়িতে গিয়ে কোন বিপদে পড়ে তাহলে ওরা নিজেদেরকে কখনোই ক্ষমা করতে পারবে না। ঘরের বাইরে জমকালো বিদঘুটে অন্ধকারের দিকে দেখে আর অবিরাম ঝমঝম শব্দে বৃষ্টির কথা ভেবে চার বন্ধুর মন ভারাক্রান্ত হয়ে উঠলো। ভাবছে মানুষটিকে ইয়ার্কির ছলে মৃত্যু ফাঁদে ঠেলে দেওয়া হল না তো?


চার বন্ধুর এই নিজের নিজের মোটরসাইকেল ছিল। চায়ের দোকানের বিল মিটিয়ে দিয়ে ওরা চুপচাপ বেরিয়ে এলো। তারপর মোটরসাইকেল স্টার্ট দিয়ে এগিয়ে চলল ওই পোড়া বাড়িটির দিকে। ওদের নিজেদেরও অনেক কাল হলো সে অঞ্চলে যাওয়া হয়নি। সেখানে পৌঁছে ওরা চার বন্ধুই চমকে ওঠে থমকে দাঁড়ালো। পুরনো জমিদার বাড়ির সামনে এত ঝোপঝার জঙ্গল কাটা গাছ গজিয়ে উঠেছে যে বাড়ির ভিতর প্রবেশ করা একেবারেই দু:সাধ্য ব্যাপার।


তবুও ওরা অনেকক্ষণ ধরে সে বাড়িতে ঢোকার অনেক চেষ্টা চালালো। জীর্ণদশার বাড়িটিতে ঢোকার সব চেষ্টাই নিষ্ফল। ভূত না হয় নাইবা থাকলো, এই জনাকীর্ণ ঝাঁর জঙ্গল বিশিষ্ট বাড়িটিতে সাপ কোপের উপদ্রবওতো থাকতে পারে! ঝড় জলের রাতে এই পোড়া বাড়িতে প্রবেশ করার চেষ্টা মানেতো সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাতে নিজেদের সঁপে দেওয়া।


এর আগেও যারা এই বাড়িতে ঢুকেছে পরবর্তীতে তাদের কোন চিহ্নমাত্র খুঁজে পাওয়া যায়নি। ওরা বাড়ির বাইরে থেকে এসেই বিদেশি সাহেবকে উদ্দেশ্য করে ডাকাডাকি করতে শুরু করল, কিন্তু সেই শব্দ বাড়ির দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে প্রতিশব্দ হয়ে ফিরে আসতে থাকলো। সাহেবের কোন সাড়া পাওয়া গেল না।


সায়ক বলল যে রাত ভোর না হলে খবর নেবার মতো কোনো উপায় নেই। শিবুর মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। সে বলল আমরা আর কিছু করতে না পারি গায়ের চৌকিদারকে একটা খবর অন্তত দিয়ে যেতে পারি পারি যে সে যেন রাতে বাড়িটার উপর একটু দৃষ্টি রাখে। তাতে চার বন্ধুরই মনে হলো যে এটাই ঠিক হবে। সেই মতো ওরা চৌকিদারকে খবরটা দিয়ে যে যার বাড়ি ফিরে এলো।

  ততক্ষণে বৃষ্টিটা কমেছে কিন্তু রাস্তার দুপাশের বড় গাছগুলো থেকে তখনো টুপটাপ করে জলের ফোঁটা পড়ছে।। রাতের খাবার শেষ করে ওরা চার বন্ধুতে আবার একত্রিত হলো সায়কের বাড়িতে। ওদের বসার ঘরটা ফাঁকাই পড়ে থাকে। তাই ওরা ঠিক করল যে সে ঘরেই রাত্রিবেলাটা আড্ডা মেরে কাটিয়ে দেবে। কিন্তু ওদের মনে স্বস্তি নেই এই ভেবে যে ওই অপরিচিত সাহেবের যদি কিছু ক্ষতি হয়ে যায় তাহলে প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে কিন্তু ওরাই দায়ী থাকবে কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলে।

সৌম্য বলল, চল তাহলে আজ রাত্রে আমরা বিনিদ্রই কাটিয়ে দিই। যদি কোন বাজে ঘটনা ঘটে তবে চৌকিদার এসে আমাদের ডাকবেই।


কিন্তু ওদের রাত জাগা আর হলো না। গল্প করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে সে কথা ওদের চারজনের কেউই টের পায়নি।। ভোরের দিকে হঠাৎ এই ওদের ঘুম ভেঙ্গে গেল সকলের চৌকিদারের ডাকাডাকিতে। ওদের কথামতো চৌকিদার বাড়িটার উপর দৃষ্টি রেখেছিল। টহলদারির শেষের দিকে নাকি সে ওই বাড়ির ভেতর থেকে একটা বিচ্ছিরি ধরনের হাসির শব্দ শুনে থমকে যায়। তারপর ভয়ে সে রাম নাম জপ করতে শুরু করে উচ্চস্বরে। একা বাড়ির ভেতর ঢুকে কি ঘটেছে তা দেখার সাহস চৌকিদারের ছিলনা। তাই সে এই বাবুদের ডাকতে এসেছে। চৌকিদারের সাথে ওরা যখন জমিদারের ভাঙ্গা বাড়িতে গিয়ে পৌঁছায় তখন পূবাকাশ প্রায় ফর্সা হয়ে এসেছে।

চৌকিদার নিজের লাঠি দিয়ে আগাছা গুলোকে সরিয়ে ওদের ভেতরে ঢোকার রাস্তা করে দিচ্ছে। ওরা সবাই তার পেছন পেছনে এগিয়ে চলছে। মানুষের সারা পেয়ে দু'চারটে জংলি কুকুর কেউউ করে উঠলো আর ওদের দিকে এক পলক তাকিয়েই দে ছুট। একতলাটা প্রায় বেশিরভাগটাই ভেঙ্গে গিয়েছে। দোতলার সিঁড়ি খুঁজে নিয়ে যেই না ওরা উপরে উঠতে গেল তেমনি গুষ্টি শুদ্ধ এক ঝাঁক চামচিকে ওদের মাথার উপর দিয়ে বৃত্তাকারে চিচি আওয়াজ করে ঘুরতে শুরু করেছে। ওরা সে সবকিছু গ্রাহ্য না করে উঠে এলো দোতলার বিশালাকার বারান্দায়। তখনই শুনতে পেলো দোতলার একটি ঘর থেকে একটি গোঙ্গানির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।। সেই ঘরের দরজাটায় ওরা সজোরে ধাক্কা মারতেই খুলে গেল আর ওরা সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়লো সেই ঘরের ভেতর একসঙ্গে। তারপর সকলে একসঙ্গে উঠে দাঁড়ায়---

কি আশ্চর্য!!!

এ তো সেই সাহেবই!!!

লোকটার বুকের পাটা আছে বলতে হবে। এই ভাঙ্গা জনাকীর্ণ বাড়িটাতে একা একা ঢুকতে ওর এতোটুকুও ভয় করল না!!! কিন্তু এখন সে অর্ধচৈতন্য অবস্থায় পড়ে রয়েছে আর তার মুখ দিয়ে সেই গোঙ্গানির আওয়াজ বেরিয়ে আসছে।


সায়ক বলল, টর্চ লাইট জেলে সাহেব কিছু লেখার চেষ্টা করেছিল।

সৌম্য নিচু হয়ে বসে মন্তব্য করল যে এ তো দেখছি ডায়েরী!!!

সাহেব তাহলে ডায়েরী লিখছিল?

চৌকিদার বলল, বড় তাজ্জব ব্যাপার! ডাইরিটা তো তাহলে পড়ে দেখতে হয়। সেও নিচু হয়ে বসে পড়ল। সবাই একসঙ্গে বলে উঠলো তাড়াতাড়ি পড়। সাহেব কি লিখতে লিখতে অজ্ঞান হয়ে গেল সেটা একবার দেখা দরকার।


চৌকিদার ডায়রিটা নিয়ে পড়তে শুরু করল---


রাত ১ টা বাজতে ১০ মিনিট বাকি। দোতলায় উঠে আসতে প্রচুর বেগ পেতে হয়েছে। তবে ভয়ের কোন ব্যাপার নেই। পরিত্যক্ত বাড়িটি বাদুড় চামচিকে আর আর শিয়ালদের আড্ডা খানায় পরিণত হয়েছে। রাতটা কোনরকমে এ ঘরেই কাটিয়ে দেবো বলে ঠিক করলাম।

মেঝের কিছু অংশ খানিকটা পরিষ্কার করে নিয়ে রেনকোটটাই পেতে নিলাম ভালো করে। টর্চটি জ্বালিয়েই রাখলাম। বেশ ঠান্ডা ঠান্ডা অনুভব হচ্ছে তাই জানালার পার্টগুলো বন্ধ করে দিলাম।


  দুচোখে ঘুম জড়িয়ে আসছিল। হঠাৎ একটি অস্বাভাবিক আওয়াজে ধরফরিয়ে ওঠে বসে চোখ মেলে তাকালাম। রাত এখন দেড়টা। দেখতে পেলাম বাইরের হাওয়ার চাপে ধাক্কা খেয়ে বিকট আওয়াজ তুলে জানালার পার্টগুলো খুলে যাচ্ছে। আমি তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়িয়ে দেখতে পেলাম বাইরে আর বৃষ্টি পড়ছে না। আমি আশ্চর্য বোধ করলাম। চাঁদের ক্ষীন আলোয় বাইরের দিকটা খুব একটা ভালো নজরে পড়ছে না। মনে হলো পাশের ঘর থেকে কারো ফুপিয়ে কাঁদার শব্দ ভেসে আসছে।

  কিছুক্ষণ পরেই আবার একটা বুক ভাঙ্গা কান্নার আওয়াজ। বিব্রত বোধ করলাম। সামনে তাকাতেই দেখি পাশের ঘরের দরজা ভেদ করে একটি কঙ্কাল বেরিয়ে আসছে।। রুক্ষ কান্না, খুব অস্বস্তি হচ্ছে। কঙ্কালটি দু হাতে নিজের মুখ ঢেকে রেখেছে। এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে কোমরে গুজে রাখা রিভলবারটি বের করে কঙ্কালটিকে উদ্দেশ্য করে একটি গুলি ছুঁড়লাম। সমস্ত ঘর ধোঁয়ায় ভরে গেল। টর্চের আলো ফেলে দেখি কঙ্কালটি উধাও।

  ঘড়ির দিকে চোখ ফেলতে দেখি রাত প্রায় সোয়া দুটো। এখন আর কান্নার শব্দ নয়!!! বিকট খিলখিল হাসি, খেয়াল হতেই দেখি কতগুলো কঙ্কাল বৃত্তাকারে ঘুরছে আমার মাথার উপর। ওদের হিমশীতল নিঃশ্বাস আমার ঘাড়ে পিঠে এসে পড়ছে। ক্ষণিকের মধ্যে সেই জায়গাটি জমে যেন বরফ হয়ে গেল। তড়িঘড়ি মেঝে থেকে উঠে দাঁড়ালাম, প্রচন্ড জোরে চিৎকার করে উঠলাম। ভয় পেয়েছি বলে নাকি ওদের ভয় দেখাতে সেটা আমি নিজেই বুঝতে পারিনি। উপরের দিকে তাকাতেই দেখতে পেলাম বৃত্তাকারে ঘুরতে থাকা কঙ্কালগুলি হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে।


 ততক্ষণে চোখ থেকে ঘুম উধাও। ঘড়িতে চোখ পড়তে দেখলাম এখন রাত আড়াইটে বাজে। অসম্ভব শীত লাগছে আমার। মনে হচ্ছে ডিসেম্বরে দার্জিলিং এ আছি। সঙ্গে কোন উলেন ক্লথ নিয়ে আসা হয়নি। গরমকাল বলে। জোর হাওয়ায় সব জানালাগুলো খুলে গিয়েছে। খোলা জানালা দিয়ে হু হু করে ঠান্ডা হাওয়া এসে কাঁপন ধরিয়ে দিল। আমি জানালাগুলো ফের বন্ধ করে দিলাম।

 অনেকটা সময় কেটে গিয়েছে । এখন সোয়া তিনটা বাজে। আমি জেগে কি ঘুমিয়ে আছি ঠিক বুঝতে পারছিনা। সেই ধবল কঙ্কাল গুলো চুপিসারে পা টিপে টিপে এসে আমার সমস্ত শরীর জুড়ে একটি বরফের চাদর বিছিয়ে দিলো। হাজার চেষ্টা করেও আমি সেই চাদর গা থেকে সরাতে পারলাম না।"আমার দুচোখ জুড়ে কাল ঘুম জড়িয়ে এলো! উফ! কি শীত করছে আমার"....

 দারোয়ান রুদ্ধশ্বাসে ডাইরি পড়ে সমাপ্ত করল। চার বন্ধু দারোয়ানের মুখের দিকে তাকিয়ে। বিস্ময়ে বিহবল সকলে। দারোয়ান ডায়রি ফেলে দিয়ে দৌড়ে গেল নীচে। 

 সে একটি পাত্রে কিছুটা জল সংগ্রহ করে আনলো। সৌম্য জলটা হাতে নিয়ে অচেত অবস্থায় নিচে পড়ে থাকা সাহেবের চোখে মুখে ছিটিয়ে দিল। দু তিনবার জল ঝাপটা দিতেই নড়েচড়ে উঠলো। তারপর চোখ মেলে তাকালে চোখ দুটো রক্তের মত লাল টকটকে হয়ে গেছে। হাহাহাহাহা করে কুৎসিত অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো সাহেব। ওরা চার বন্ধুতে চেপে ধরে থামানোর চেষ্টা করল সাহেবকে, কিন্তু সাহেবের গায়ে এত আসুরিক শক্তি যে তাকে থামানো গেল না। কিছুক্ষণ পরেই তার দেহ এলিয়ে পড়ল।


মিনিট দশেক বাদে লাঠি ভর দিয়ে এক যুবুথুবু বুড়ো ঘটনা স্থলে এসে হাজির হলো। তিনি নাকি এই জমিদার বাড়িরই দারোয়ান ছিলেন আগে। এই ভুতুড়ে বাড়িটারই আশেপাশে কোথাও একটা থাকেন। পরিত্যক্ত বাড়িতে লোকজনের আনাগোনা আর চেঁচামেচি শুনে ব্যাপার কি দেখতে এসেছেন। উনার বয়স ১১১ বছর বলে তিনি জানিয়েছেন। উনার কাছে সবিস্তারে সব ঘটনা শোনা গেল। চার পুরুষ আগে এই জমিদার পরিবারেরই একজন জমিদার নাকি খুব অত্যাচারী এবং নির্মম প্রকৃতির ছিলেন। এমন কোন খারাপ কাজের বাকি নেই যে তিনি করতেন না। কোন ক্রুর কাজ করার সময় তার হাত বা বুক বিন্দুমাত্র কেঁপে উঠতো না।


একবার দুর্ভিক্ষের কবলে পিরিত একদল সাধারন প্রজাকে ধরে এনে বেঁধে রাখে এবং তাদের দিনের পর দিন না খেতে দিয়ে শুকিয়ে মারে। আর তারপর থেকেই এ বাড়িতে ভুতের আনাগোনা। তিনি এও বললেন যে সেই জমিদার এই ভূতেদের কবলে পড়েই মারা যান। এক নিঃশেষে কথাগুলো বলে বুড়ো থামল এবং ঈশ্বরকে উদ্দেশ্য করে উপরের দিকে হাত তুলে বলল- "সবই ভাগ্য! নিয়তির পরিহাস!"তাইতো এই ভিনদেশী সাহেব এখানে এসে প্রেতাত্মার কবলে পড়ে প্রাণ বিসর্জন দিতে এসেছেন। এই বলে বুড়ো লাঠি ঠকঠক করতে করতে যেভাবে এসেছিলেন সেভাবে বেরিয়ে চলে গেলেন।

© Sipra Debnath Tultul.



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Horror