সন্তান সম
সন্তান সম
“আচ্ছা মা আমি যখন হয়ে ছিলাম তখন কি তোমার খুব কষ্ট হয়েছিল?” জিজ্ঞাসা করলো তৃষা।
মা দিশা এমব্রয়ডারির সুতোয় গিঁট দিতে দিতে মৃদু হেসে বললেন, “না না। কেন? হঠাৎ কি ব্যাপার?”
“না ওই জেঠিমা পানুদাকে বলছিল, পেটের শত্তুর বড় শত্তুর, বত্তিরিশ নাড়ি ছিঁড়ে বেরিয়েছো কিনা... তা বত্তিরিশ নাড়ি ছিঁড়লে তো নিশ্চয়ই অনেক ব্যথা লাগবে। তাই জিজ্ঞাসা করলুম।”
“ওঃ! ... ও তোর জেঠিমা রেগে গেলে অনেক আজে বাজে বকে। তা তোর পড়াশোনা হয়েছে? নাকি খালি পাড়া বেড়ান হচ্ছে।” নিজের সেলাই এর বাক্সটা গোছাতে গোছাতে জিজ্ঞাসা করলো দিশা।
“পড়ে নেব, তুমি ভেব না।” মায়ের সেলাইটার দিকে নির্নিমেষ চোখে তাকিয়ে থাকে তৃষা। দিশা একটা শ্রী কৃষ্ণের ছবি এমব্রয়ডারিতে তুলছে। অপূর্ব হাতের সেলাই দিশার। তৃষার জন্মের আগের থেকে ও ওই সেলাইটা শুরু করেছে। রোজ দুপুরে একটু একটু করে নিয়ে বসে। এখন অর্ধেক এর বেশী হয়ে গেছে। দূর থেকে দেখলে মনে হয় আঁকা।
“এটা আমার মধুসুদন দাদা তাই না মা?” বলে তৃষা।
“হুম ... তাই তো।” হেসে বলে দিশা। একদিন এমনি মজা করেই দিশা বলেছিল তৃষাকে, “দ্যাখ তোর জন্মাবার আগের থেকে আমি এনাকে বানাচ্ছি। তাই ইনি হলেন তোর দাদা। মধুসূদন দাদা।”
এবার দিশা রান্নাঘরে যাবে। স্বামী অসীমের আসার সময় হল। প্রথমে একটু কিছু জলখাবার বানাবে। তারপর বিকালের রান্না চড়াবে। অসীম একটা ফ্যাক্টরিতে ছোটোখাটো কাজ করে। মাইনে খুব একটা বেশী পায় না। কিন্তু দিশা খুব গোছানে মেয়ে। এই অল্প টাকাতেই খুব সুন্দর করে সংসার চালায়। নিজের ছোট্ট বাড়ীটাকে খুব সুন্দর করে সাজিয়ে রাখে ও। সস্তা কুশন কভারের ওপর সুন্দর ফুলের ডিজাইন করে তাকে বানিয়ে ফেলে অসাধারণ। ঘরের পামোছা থেকে বিছানার চাদর, সবেতেই ওর হাতের ছোঁয়া দেখা যায়।
ওর আরেকটা নেশা হল রান্না। নানা রকমের রান্না করতে ওর খুব ভালো লাগে। রোজ নিত্যনতুন জলখাবার বানিয়ে ও অসীম আর তৃষাকে অবাক করে দেয়। এটা ওদের একটা মজার খেলা। প্রথমে ওদের গেস করতে হবে আজ জল খাবারে কি আছে। তারপর জল খাবার পরিবেশন করবে দিশা। আজ ভেবেছ ‘ফ্রায়েড ইডলি’ বানাবে। সেদিন পাশের বাড়ীর ইলা বউদির থেকে চেয়ে আনা ম্যাগাজিনে পড়েছিল ওটা। নতুন নতুন রান্না যা ও খবরের কাগজে বা ম্যাগাজিনে দেখে তা হয় কেটে বা টুকে রেখে দেয়। ইলা বউদি দেখাচ্ছিল আজকাল মোবাইলেও কত রান্না শেখা যায়। কিন্তু তার জন্য একটা স্মার্ট ফোনের দরকার। মাঝে মাঝে সখ হয় একটা স্মার্ট ফোন কেনার কিন্তু এক্ষুনি সম্ভব নয়। কয়েকটা মাস যাক। একটা মাটির ভাঁড়ে পয়সা জমাচ্ছে ও।
মেয়ে তৃষা পড়তে বসেছে। উঁকি মেরে দেখে আসে দিশা, এখন চট করে ও উঠবে না। পড়াশোনায় খুব মন তৃষার। নিজে পড়েই ক্লাসে ফার্স্ট-সেকেন্ড হয়। স্কুলের টিচাররা ওকে খুব ভালোবাসে। এইসব নানা কথা ভাবতে ভাবতে জলখাবারটা নিয়ে এসে ডাইনিং টেবিলের ওপর রাখল দিশা। একটা রবীন্দ্রসঙ্গীতের কলি গুন গুন করতে করতে প্রথমে বাড়ীটা ঘুরে দেখে নিলো ও। নাঃ সব ঠিকঠাক আছে। তারপর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চুলটা ঠিক করে নিলো ও।
বাইরে অসীমের বাইকের আওয়াজ শুনতে পাওয়া গেলো। একটা হাল্কা হাসি খেলে গেলো দিশার মুখে। পারফেক্ট টাইমিং।
বাইকটা পার্ক করে হাতে হেলমেট নিয়ে অসীম ঘরে ঢুকলো। খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে ওকে। ওর হাত থেকে হেলমেটটা নিয়ে দিশা জিজ্ঞাসা করলো, “তোমার শরীরটা কি খারাপ? এরকম দেখাচ্ছে কেন তোমায়?”
“আজ কাজের খুব চাপ ছিল। দাঁড়াও স্নানটা করে আসি তাহলেই ফ্রেশ লাগবে। আজ জলখাবারে কি আছে?” বলতে বলতে অসীম জামা ছাড়তে চলে গেলো।
“গেস কর।” হেসে বলল দিশা। “তৃষা আয় বাবা এসেছে।” ডাকল দিশা।
“আজ কি আছে জলখাবারে?” বলতে বলতে তৃষা বেরিয়ে এসে টেবিলে বসলো।
“দাঁড়া বাবাকে আসতে দে!” প্লেট সাজাতে সাজাতে হেসে বলল দিশা।
“আজ উপমা আছে।” মাথা মুছতে মুছতে ঢুকল ও অসীম।
“না না, ভাজা কিছু আছে। আমি ভাজার গন্ধ পাচ্ছি।” বলল তৃষা।
“আজ ভাজা ইডলি...... টান-টা-না।” বলল দিশা।
একটা ইডলি খপ করে তুলে নিয়ে অসীম বলল, “ইডলি আবার ভাজে নাকি?”
“আরে বসে খাও।” পরিবেশন করতে করতে ধমক লাগালো দিশা।
“আমি আগে খাব।” লাফিয়ে উঠলো তৃষা।
“আহা যা বানিয়েছ না......একঘ...” কথাটা শেষ করতে পারলো না অসীম। ওর শরীরটা টাল খেয়ে চেয়ার থেকে বাঁদিকে মাটিতে পড়ে গেলো।
দিশা আর তৃষা একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠলো। দিশা ছুটে গিয়ে অসীমকে ওঠানোর চেষ্টা করলো কিন্তু পারলো না। চেঁচিয়ে বলল, “শিগগির পানুদাকে ডেকে নিয়ে আয় তৃষা।”
তৃষা তীর বেগে ছুটল। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে বাড়ীতে দশ-বারো জন পড়শি জমা হয়ে গেলো। সবাই মিলে অসীমকে তুলে বিছানায় শুইয়ে দিলো। পাড়ার ডঃ ধরকে ডাকা হল। উনি দেখে বললেন সেরিব্রাল অ্যাটাক। শরীরের বাঁ দিকটা প্যারালাইস হয়ে গেছে। মুখটাও একদিকে বেঁকে গেছে।
“ওনাকে এক্ষুনি হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে।“ বললেন ডঃ ধর।
সঙ্গে সঙ্গে এ্যাম্বুলেন্সকে ফোন করে ডাকা হল। অসীমকে ভর্তি করা হল হাসপাতালে। ওখানকার ডাক্তারবাবু পরীক্ষা করে বললেন, “ব্রেইন এর অর্ধেকটা ব্লাড ক্লটে ভরে আছে। সার্জারি করতে হবে। তাতে উনি বেঁচে যাবেন, কিন্তু বাঁ হাত আর বাঁ পা টা কোনদিনই পুরোপুরি স্বাভাবিক হবে না।”
মাস দুয়েক লড়াই চলল । ইন্সিওরেন্সের টাকা, ওদের জমানো টাকা, দিশার গয়না সবই চলে গেলো অসীমের চিকিৎসার জন্য। তারপর হুইল চেয়ারে অসীমকে নিয়ে বাড়ী ফিরল দিশা।
অসীমের ফ্যাক্টরি ওর প্রভিডেন্ড ফান্ড, গ্র্যাচুইটি ইত্যাদি মিলিয়ে এককালীন কিছু টাকা দিল। কিন্তু দিশাকে চাকরি দিল না।
আত্মীয় স্বজনরা ধীরে ধীরে আসা কমিয়ে দিলো । আজকাল বেশীরভাগ আত্মীয় ফোনেই খবর নেবার সামাজিকতাটা সেরে ফেলেন।
তৃষা আবার স্কুলে যাওয়া শুরু করলো। স্কুল কর্তৃপক্ষ তৃষার ভালো ফলের জন্য ওর মাইনেটা মাফ করে দিলেন। কিন্তু সংসারের অবস্থা দিন দিন আর শোচনীয় হয়ে উঠলো। অসীম সব কাজের জন্যই দিশার ওপর নির্ভরশীল। দিশার পক্ষে বাড়ীর থেকে বেরনো সম্ভব নয়। অথচ কিছু একটা না করলে সংসার অচল।
একদিন তৃষার পানু জেঠিমা এলেন। একথা সেকথার পর হঠাৎ বললেন, “দিশা! এমব্রয়ডারির অর্ডারি কাজ করবি?”
দিশা হাতে চাঁদ পেলো। “হ্যাঁ। কেন করবো না। কিন্তু আমি তো বাড়ীর বাইরে......”
“না না, তোকে কোথাও যেতে হবে না। এক দিদি আছেন, ওনার একটা বুটিক আছে। উনি অনেক মেয়েকে কাজ দেন। তুই ঘরে বসে কাজ করবি।”
“ তাহলে তো খুবই ভালো হয়।“
“কাল সকালে তৈরি থাকিস আমি তোকে নিয়ে গিয়ে ওনার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব।“
পরের দিন উনি দিশাকে নিয়ে যান মিসেস সাঠের কাছে। যাবার সময় সঙ্গে করে নিজের করা কয়েকটা কুশন কভার নিয়ে গিয়েছিল দিশা। ওর কাজ দেখে মিসেস সাঠে একেবারে মুগ্ধ। তারপর থেকে উনি দিশাকে নিয়মিত কাজ দেন। সংসারের গাড়ী আবার ধীরে ধীরে চলতে শুরু করলো। তৃষা স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজ তারপর ইউনিভার্সিটিতে পৌঁছে গেলো।
তৃষা রোজ বাড়ী ফিরে দেখে মা বাবার পাশে বিছানায় বসে সেলাই করতে করতে বাবার সাথে গল্প করছে। খুব শান্তি লাগে ওর। একটা অদ্ভুত পরিপূর্ণতা আছে এই দৃশ্যটাতে। ওর সবচেয়ে ভালো লাগে যখন দেখে অর্ডারি কাজ শেষ করে মা ওর মধুসুদন দাদার ছবিটা সেলাই করছে। এটা অনেকদিন আগেই শেষ হয়ে যাবার কথা ছিল, কিন্তু পরিস্থিতির চাপে হয়ে ওঠেনি।
সেদিন তৃষার এম এ পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়েছে। ফিলসফিতে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়েছে ও। ওর ক্লাসের বন্ধুরা খুব হইচই করছে ওকে নিয়ে। এমন সময় ক্লাসের নীরা এসে ওকে খবর দিল,” তৃষা তোকে প্রোফেসর রায় একবার ডাকছেন।“
তৃষা সঙ্গে সঙ্গে ছুটল। প্রোফেসর রায়কে তৃষা ভীষণ শ্রদ্ধা করে। আর ও জানে যে উনিও ওকে খুবই স্নেহ করেন। ও স্টাফ রুমে ঢুকতেই প্রোফেসর ওর দিকে তাকিয়ে হেসে উঠলেন, “ তোমার জন্য আর একটা দারুণ খবর আছে। তুমি স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে পি এইচ ডি করার স্কলারশিপ পেয়েছ।“
আনন্দে চোখে জল এসে গেলো তৃষার। তাড়াতাড়ি ওনার পায়ে হাত দিয়ে প্রনাম করল ও।
“ আশীর্বাদ করি অনেক বড় হও। আচ্ছা একটা কথা, পড়াশোনার জন্য কোন খরচ লাগবে না ঠিকই কিন্তু তোমার যাবার টিকিট আর প্রথম কয়েক মাসের থাকা খাওয়ার খরচ লাগবে। তারপর তুমি ওখানে কোন পার্ট টাইম জব পেয়েই যাবে।“
তৃষা একটু দমে গেলো। ও জানে ওই খরচটা দেওয়াও ওদের পক্ষে সম্ভব না। ওর মনে একটা মিশ্র অনুভুতি কাজ করছে।
ওকে চুপ করে থাকতে দেখে প্রোফেসর রায় বললেন,” দেখ, তুমি যদি স্কলারশিপটা না নাও, ওটা তোমার পরের জনকে দিয়ে দেওয়া হবে। আশকরি তুমি বুঝতে পারছ সেটা।“
তৃষা নিঃশব্দে মাথা নেড়ে স্টাফ রুম থেকে বেরিয়ে এলো। কেমন যেন বেকার লাগছে সব। এতো পরিশ্রম এতো চেষ্টা......। নাঃ। আর ভাববে না ও। এখন ওর মা বাবাকে সাপোর্ট দেওয়া উচিৎ। আর পয়সা চাইতে পারবে না ও মায়ের কাছে। মা বাবাকে জানতে দেওয়া যাবে না স্কলারশিপের কথাটা। অনেক রাত করে বাড়ী ঢুকল ও।
বাড়ীতে ঢুকতেই একটা আনন্দের ঝড় বয়ে গেলো যেন। ওদের বাইরের ঘরটা আবার আগের মত সাজানো হয়েছে। বাবা পরিষ্কার জামা কাপড় পরে হুইল চেয়ারে বসে। পানুদা, জেঠিমা, ওর স্কুলের বন্ধু বিদিশা, সোমা আর মিসেস সাঠে সবাই একসাথে চেঁচিয়ে উঠলো, “Congratulations!!”
মা হাসি হাসি মুখে সকলের জন্য ফ্রুট-কাসটার্ড নিয়ে এলেন। ওটা তৃষার খুব প্রিয়। বহুদিন বাদে মা বানাল। সবাই অনেকক্ষণ গল্প করে প্রায় রাত দশটা নাগাদ গেলো।
বাবাকে খাইয়ে, শুইয়ে তৃষা আর মা খেতে বসলো টেবিলে। তৃষা নিঃশব্দে খেয়ে যাচ্ছে। মা অনেকক্ষণ ধরে উসখুস করছেন কিছু একটা বলার জন্য।
“কি বলবে বলে ফেলো।” নির্বিকারভাবে বলল তৃষা।
“তোকে একটা জিনিষ দেখাব।” মায়ের মুখটা জ্বলজ্বল করছে।
তৃষা একবার মুখ তুলে মায়ের দিকে দেখে আবার খেতে লাগলো। খাবারটা বিস্বাদ লাগছে। কোনোরকমে খাওয়াটা শেষ করে মুখ ধুতে উঠে গেলো তৃষা। ফিরে এসে দেখল মা একটা কিছু ওর বিছানার ওপর বিছিয়ে রাখছে। কাছে গিয়ে দেখে ও স্তম্ভিত হয়ে গেলো। মধুসুদন দাদার ছবি, নিখুঁতভাবে সম্পূর্ণ। খানিকক্ষণ চোখ ফেরাতে পারলো না তৃষা।
“মা ......... অপূর্ব......অনবদ্য!” তৃষার কথা আটকে গেলো।
“এবার তোকে আসল কথাটা বলি। তুই বিদেশ যাবি।”
চমকে তাকালো তৃষা।
“ভেবেছিস আমি কিছু জানিনা। আমি সব খবর রাখি। তোর স্যার আমাকে ফোন করেছিলেন। তুই কি ভাবলি, তুই না বললে আমরা জানতে পারবো না?”
“কিন্তু মা সে তো অনেক টাকার ব্যাপার......।”
“হোক! তোর মধুসুদন দাদা সব ব্যবস্থা করে দিয়েছে। মিসেস সাঠে বলেছেন যা টাকা লাগে উনি দেবেন।” মার মুখটা হাসিতে উজ্জ্বল।
“এমনি...এমনি এতোগুলো টাকা দিয়ে দেবেন?”
“এমনি ঠিক নয়......” মা আমতা আমতা করলেন।
মুহূর্তের মধ্যে তৃষার কাছে সব পরিষ্কার হয়ে গেলো। “মা ......তুমি এই শ্রীকৃষ্ণের ......”
“শ্রীকৃষ্ণ নয়, তোর“তুমি কতদিন ধরে ওটাকে বানাচ্ছ...। পারবে ওটা দিয়ে দিতে?” কাকুতির মত শোনায় তৃষার গলার স্বর।
“সন্তান কি আর সারা জীবন কাছে থাকে...।” কেঁপে উঠলো দিশার গলার স্বর।
মধূসুদন দাদা। আজ যদি তোর একটা দাদা থাকত, তাহলে সে কি তোর বিদেশ যাবার খরচ জোগাড় করে দিত না?”