স্কন্ধকাটা
স্কন্ধকাটা
পুরুলিয়া চলেছি।মুখোশ নিয়ে একটা লেখা লিখবো। আসলে পুরুলিয়ার ছৌ নাচের কথা আলাদা করে আজ বলার নেই। এখনতো সাত সাগর পেরিয়ে বিদেশের আঙিনায় ছৌনাচ সন্মান পায়েছে এই নাচ। ছৌনাচের শিল্পীরা বিভিন্ন পুরস্কারে সম্মানিত হয়েচ্ছে। ১৯৮১ সালে শিল্পী গম্ভীর সিং মূড়া ও ১৯৮৩ সালে শিল্পী নেপাল মাহাতো পদ্মশ্রী মতো পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন৷ ছৌনৃত্যশিল্পী প্রভুদাস কুমারের সুযোগ্য পুত্র ভুবন কুমার পেয়েছেন সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি পুরস্কার পেয়েছেন। ঝাড়খণ্ডের সরাইকেলায় ছৌনাচের এই নাচ শুরু হয়েছিল বোধহয়।পরবর্তী কালে মানভূম অঞ্চলে, পরে পুরুলিয়া জেলায় ও উড়িষায় ছড়িয়ে পড়ে। উড়িষার ময়ূরভঞ্জেও ছৌনাচ খুব জনপ্রিয়। লোক জন বলে থাকেন, বাঘমুন্ডীর জমিদার মদন মোহন সিংহ দেব পুরুলিয়াতে ছৌনাচের প্রচলন করেছিলেন আজ থেকে প্রায় দেড়শো বছর আগে। কিন্তু কেউ কেউ বলেন , তিব্বতী সংস্কৃতির ছাম নৃত্য থেকে ছৌ নাচের এসেছে। কুড়মালী ভাষায় ছুয়া বা ছেলে থেকে এই নাচের নামকরণ ছৌ ।কারণ ছৌ নাচ প্রধানত ছেলেদের নাচ । রাজেশ্বর মিত্রের যেমন দাবি করেন , তিব্বতী সংস্কৃতির ছাম নৃত্য থেকে ছৌ নাচের উদ্ভব ঘটেছে। তেমনি ডঃ সুকুমার সেনের দাবি করেন শৌভিক বা মুখোশ থেকে নাচটির নাম হয়েছে ছৌ । আবার ডঃ সুধীর করণের মতে ছু-অ শব্দের অর্থ ছলনা ও সং। ছৌ শব্দের এসেছে এই ছলন থেকে। মুখোশ পরে সং সেজে , (ছলন বা প্রতীক )নাচা হয় বলে ছৌ।কোনো কোনো আধুনিক গবেষক মনে করেন, ছৌ শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ছায়া থেকে। কিন্তু সীতাকান্ত মহাপাত্র মনে করেন, এই শব্দটি ছাউনি শব্দটি থেকে এসেছে। রামায়ন, মহাভারত ও নানা পৌরাণিক কাহিনীর ঘটনাকে ছৌনাচ তুলে ধরে। দুর্গা, অসুর, শিব, পার্বতী, বিভিন্ন দেব দেবী, সিংহ, হনুমান বিভিন্ন পশুপাখির বিভিন্ন ধরনের মুখোশ পরে শিল্পীরা নেচে থাকেন । ছেলে, মেয়ে বা যেকোনো চরিত্রে শুধুমাত্র ছেলেরাই কিন্তু নেচে থাকেন। মুখোশ পরে নাচ এরা। চরিত্রের মুখের বিভিন্ন অভিব্যক্তি তারা তাদের শরীরী ভঙ্গিমায়, বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গকে সঞ্চালনা করে ফুটিয়ে তোলে। যা একটু জোরেই করতে হয় । মাথা ও ঘাড় ঘুরিয়ে, মাঝে মাঝে শূন্যে লাফ দিয়ে, এবং বিভিন্ন ভঙ্গিমার সাহায্যে চরিত্রের মনের ভাব প্রকাশ করে থাকেন এরা। মা কিন্তু বেশ কঠিন কাজ। চরিত্রের অনুযায়ী হাতে থাকে ঢাল, তরোয়াল, তীর, ধনুক ইত্যাদি। বাংলার পুরুলিয়ার ছৌনাচ ঐতিহ্য বাহী কারণ এটি বীরত্বব্যঞ্জক । সোজা কথায় বীর রসের প্রাধান্য বেশী। লোকনাট্যবিশারদ আশুতোষ ভট্টাচার্য মশায় বিদেশে পুরুলিয়ার ছৌ নাচ নিয়ে গিয়েছিলেন । পরে তিনি আক্ষেপ করেছিলেন যে সেরাইকেল্লার নমনীয় ছৌ-এর বদলে পুরুলিয়ার বীররসাত্মক ছৌ নিয়ে যাবার ফলে যে craze তৈরি হলো, তাতে সেই নাট্য শুধু ডিগবাজি খাওয়ায় পরিণত হয়েছে আজ, আর সেরাইকেলার ছৌ-এর অনবদ্য শৈলীর কথা লোকে ভুলেই গেছে। ছৌ নাচের মধ্য দিয়ে , দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন, বার্তা পৌঁছে দেন। অধর্মের পরাজয় ও ধর্মের জয় বার্তা পৌঁছে দেন। নাচের সাথে ধামসা, নাকাড়া, ঢোল, বাঁশি, কাঁসর ও ঝাঝর প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করা হয়। তবে এই নাচের আগে কথক ঝুমুর গানের মাধ্যমে পালার বিষয় বস্তু সকলের সামনে তুলে ধরেন। তারপর শুরু হয় নাচের অনুষ্ঠান। এবার আসলে কম ছুটি পেয়েছি। রাজ্য রাজনীতিতে এখন উত্তাল গন্ডগোল হবার সম্ভাবনা আছে। যখন তখন ট্রেন অবরোধ হতেই পারে তাই দ্বি চক্র যানকে সাথে নিয়ে বেড়িয়ে পরেছিলাম কলকাতা থেকে। যাত্রাপথ অচেনা হয় তবুও তোক্কা করি নি। ভেবেছিলাম ট্রেন লাইন ধরে ঠিক পৌছে যাবো।একটা সময় পরিবেশ প্রেমি ছিলাম। কলকাতা শহরে সাইকেল লেন দাবি তে আন্দোলন করতাম। তাই সাইকেল চালিয়ে হেতায় হোতা ঘুরতে। আজ কে আপনার যাকে ব্লগার বলেন সেই রকম গোছের ছিলাম আরকি। তাই অচেনা মানুষ কে বন্ধু করতে আমি ভালোই পারি। তাই সাহস টা আমার একটু বেশি। পুরুলিয়া দুরত্ব মাত্র ২৫০ কিলোমিটার বোধহয়। ভালো বাইক রাইড রা পৌঁছে যাবে ৬ থেকে ৭ ঘন্টা য়। Chakulia ,Ghatsila tatanagar Junction, ChandilJunction, থেকে Barabhum পৌছাতেই আমার সময় লেগে গেলো 10-11 ঘন্টা। ঐ আমার বেশি কথা বলার স্বভাবের জন্য। আলো কমে গেলো হঠাৎ করেই। বুকটা দুর দুর করছে। মনে মনে ইষ্ট দেবতার নাম নিলাম। ইষ্ট দেবতার নাম নিতেই কাজ হলো। জুমটো অ্যাপের থেকে তারাতারি কাজ হলো। একটা বড়ো ছৌ মুখোশ পড়ে মহিষাসুর দাড়িয়ে রয়েছে আমার জন্য। ছেড়ে দিতে হবে কাছাকাছি একটা গ্রামে।এককথায় রাজি হয়ে গেলাম। কলকাতা থেকে আসছি শুনে লোকটা একটু ঘাবরে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, "আপনার একা আসতে ভয় করলো না " মজা করে বললাম " ট্রেন লাইনের পাশ দিয়ে যাচ্ছি তাই রাস্তা হারাবার ভয় নেই। তবে স্কন্ধকাটা খপ্পরে পড়ার ভয় আছে। কিন্তু ওদের আমি ভয় পাই না। " উনি আমতা আমতা করে বললেন " স্কন্ধকাটা ভয় নেই কেন?? " আমি বললাম " স্কন্ধকাটা দের মতো অসহায় কোন ভুত আছে নাকি?? " উনি বললেন " এখন তো সব ভুতেরাই অসহায়, থাকার জায়গা নেই, চাকরি নেই, আবার বহিরাগত দের ঝামেলা। " আমি ওনার মুখের কথা টেনে এনে বললাম " সত্যি কথা, আজকাল বাচ্চার ড্রাকুলা, ভ্যাম্পায়ার দের দেখে দেশি ভুত দের ভয় পায় না। তবে স্কন্ধকাটা দের আরো অসহায় মনে হয় তার কারণ একটাই। বিজ্ঞান বলে আনন্দ হোক দুঃখ হোক সেই সব অনুভূতি আমরা কিছু তো উপভোগ করি মাথা দিয়ে কিন্তু সেটা তো ওদের নেই। " উনি সেটা শুনে বলেন " হু দীর্ঘ শ্বাস ফেলতে পারে না স্কন্ধকাটা রা। " আমি বললাম " পশ্চিম বঙ্গ কিন্তু স্কন্ধকাটা দের জন্য একটা ভালো পেশা আছে!! ' উনি বললো " রাজনৈতিক নেতা, বুদ্ধি জীবী আর সাংবাদিক হওয়া। তিনটে করতে গেলে আপনার লজ্জায় মাথা কাটা যাবার কথা কিন্তু মাথা না থাকলে মাথা কাটাবে কি করে।।"' উনি হেসে ফেলেন বললেন " এবার চলি বন্ধু। " আমি বললাম " এই জঙ্গলে কোথায় যাবেন বাড়ি অবধি ছেড়ে আসছি " উনি বললো "আমার কোন বাড়ি নেই এই রেললাইন আমার বাড়ি। " উনি আমাকে অবাক করে ছৌ নাচে মুখোশটা হেলমেট মতো খুলে আমাকে মুখোশটা উপহার দিলেন। আমি প্রথম একটা স্কন্ধকাটা কে দেখলাম ভুত দেখার মতো। উনি অভয় দিয়ে বলেন " আপনি ভয় পাবেন না। পৃথিবীর প্রথম স্কন্ধকাটা কে আপনারা তো মশাই পূজা করেন। "" আমি একটু আমতা করে বললাম " আপনি কার কথা বলছেন?? " উনি বললেন' " গনেশ ঠাকুর, পরে ঐ হাতির মাথা লাগিয়েছে। আমি আপনার মুন্ডটা লাগানো ভাবনায় ছিলাম। কিন্তু এখন আর লাগাবে আপনার মাথা। " আমি বললাম " কেন?? " উনি বললেন " ঐ যে আপনি উনি ফোন করলো, আপনি তো সামনে স্কন্ধকাটা দলে নাম লেখা বেন। আপানার আমার থেকে খারাপ অবস্থা হবে। মাথা থেকে মাথার কোন কাজ থাকবে না। "" উনি আসতে অন্ধকারে মিলিয়ে গেলেন তবে উনার গান কানে ভেসে আসতে থাকলো। " আমার বউ বলেছে মরতে আমায়, আমার বউ বলেছে মরতে আমায় জীবন আর রাখতে পারবো না। বউ আমার নয়নমনি ফেলতে কথা পারবোনা। কিন্তু মোর গুমর ভারী বেচতে মাথা পারবোনা। জিততে যদি না পারি তবুও আমি হারবোনা। কিন্তু বউয়ের কথায়, কিন্তু বউয়ের কথায় বাঁদর হয়ে উঠতে বসতে পারবোনা, ভাই উঠতে বসতে পারবোনা। রেল লাইনে বডি দেবো মাথা দেবোনা, রেল লাইনে বডি দেবো মাথা দেবো না।"
