বিশ্বাস ঘাতক
বিশ্বাস ঘাতক
সাধারণত এরকম বিয়ে বাড়িতে আমি আন কমফোর্টেবেল। মুম্বই এ চাকরি খোঁজার সময় রাহুল আমি এক রুমে ভাড়া করেছিলাম। ও তখন
ডিপ্লোমা ইন নটিক্যাল সায়েন্স পড়াশোনা শেষ করছে মুম্বাই একটা কলেজ থেকে। ডেক ক্যাডেট জয়েন করে ক্যারিয়ার শুরু করবে। এরপর বিভিন্ন পদ যেমন থার্ড অফিসার, সেকেন্ড অফিসার, এবং চিফ অফিসারের মধ্য দিয়ে পদোন্নতি ঘটিয়ে ক্যাপ্টেন পর্যন্ত হতে পারে।
আমি চাকরি খুজছিলাম তখন জাহাজের কুকের। ফলে মাস তিনেক বেশি একসাথে থাকায় একটা ভালো সম্পর্ক হয়ে গেছিলো। দাদা ভাইয়ের মতো সম্পর্ক হয়ে গেছিলো। আমি জাহাজে চাকরি যাবার সিদ্ধান্ত বদল করে একটা ক্যাটারিং কোম্পানিতে ঢুকলাম। তবুও ও মনে রেখেছে আমাকে দশ বছর আগে অসুস্থ হয়েছিল মুম্বাই তখন ওকে একটু দেখাশোনা করেছিলাম। সে কথা মনে রেখে। ও ওর বিয়েতে নিমন্ত্রণ করছে।
আমি মধ্যবিত্ত মানুষ, বড়লোকের এই ঝাঁচকচকে বিলাসবহুল জীবনযাপন এর সাথে নিজেকে মিলিয়ে নিতে পারি না। তাই ভীষণ আন কমফোর্টেবেল লাগছে। এর মধ্যে হঠাৎ রুবি এসে আমার হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে যেতে শুরু করলো। কুড়ি বছর পর আমাদের দেখা ও একটু বদলালো না। আমি তো ওকে প্রথমে চিনতে পারি নি।
বেশে সুটে বুটে একজন অভিজাত মানুষের কাছে নিয়ে হাজির হয়ে বললো " দেখো কাকে ধরে এনেছি। "
লোকটা আমি কোন দিন দেখি নি। সুদর্শন চেহারা । বেশ কিছু মানুষ ওনাকে ঘিরে তোসামদি করছিলো মনে হলো। উনি বললেন " ইসকিউজ মি জেন্টলম্যেন, হি ইজ মানব মন্ডল, মাই ফেবারিট স্টরি রাইটার, মাই ওল্ড ফ্যামিলি ফ্রেড আলসো। সো আই নিড সাম পারসনাল স্পেস। '
সবাই ওকে স্যার বলে, ওনাকে ছেড়ে চলে গেলো।
আমি অবাক হয়ে গেলাম, আমি ওনার পারিবারিক বন্ধু কবে থেকে হলাম??
উনি আমার ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া মুখটা দেখে, বললেন " আপনি একটু ঘাবড়ে আছেন মনে হচ্ছেন। আমি রাজ রয়।আমার পরিচয়। আপনার প্রাক্তন প্রেমিকা রবির হাসবেন্ড। ওতো আপনার ফলোয়ার সব লেখা , গল্প, সোস্যাল মিডিয়ায় পোস্ট পড়ে। আমি সময় পেলে পড়ি। কিন্তু আপনি আপনাকে কমেন্ট করলে। মেসেজ করলে জবাব দেন না তাই বন্ধুত্ব হয়নি আমার সাথে একদিন। "
আমি বিনয় সাথে বললাম " পেশাগত ভাবে আমি বুচার। 12 ঘন্টা হাড়ভাঙা খাটুনি। কারো সাথে একটা কথা বলে সময় নষ্ট না করে আমি আমার পড়াশোনা, লেখা তৈরিতে সময় দিতে পচ্ছন্দ করি। আসলে আমার কাছে সময় কম। ভালো লিখতে চাই কিন্তু ভালো লিখতে পারি না। তাই নিজেকে একটু বেশি সময় দিই। "
উনি বললেন " রুবি আমাকে খোটা দেয় কথায় কথায়। তুমি রবীন্দ্রনাথ পড়নি শরৎচন্দ্র পড়নি তুমি বাঙালির কলঙ্ক। কিন্তু দেখুন কাজের প্রয়োজন আমি ইংরেজি ছাড়াও চারটে আন্তর্জাতিক ভাষা বলতে এবং পড়তে পারি। কিন্তু বাংলা গিয়ে ওই যুক্ত বর্ণের কাছে গিয়ে হার মেনে প্রোফাইলে বাংলা জানি কথাটা যুক্ত করতে পারি নি। "
রুবি এই লোকটার সামনে রেখে দিয়ে কোথায় চলে গেলো জানি না। আমি বিরক্ত হচ্ছিলাম। "আমি বাংলা ভাষাটা দরকারী ভাষা বা কাজের ভাষা না। তাই ওটা না জানলেও মহাভারত অশুদ্ধ হবে না। "
উনি বললেন " না না, রুবি যখন জীবনানন্দ দাশ, কিংবা জয় গোস্বামীর কবিতা আবৃত্তি করে তখন খুব খারাপ লাগে। একটা যাদু আছে এ ভাষায়। যেমন ধরুন দেবদাস সিনামা দেখেছি। কিন্তু দেবদাস যখন ও আমাকে পড়ে শুনিয়ে ছিলো তখন আমি বাচ্চাদের মতো কেঁদে ফেলেছিলাম। "
আমি বললাম " ভাষা শেখাটার সাথে অর্থনৈতিক একটা সম্পর্ক আছে। ১৯১১ সালে কলকাতা থেকে রাজধানীটা দিল্লিতে না সরলে , বাংলাটা আপনি ঠিক শিখতেন। প্রায় ৫০,০০০ অক্ষরের একটি ভাষা , হলো চীনা ভাষা , কিন্তু লোকে শিখছে। ফার্সি-আরবি লিপি থেকে এসছে উর্দু, উর্দু বর্ণমালায় ৩৯টি মৌলিক অক্ষর এবং উর্দু ভাষার নির্দিষ্ট ধ্বনি উপস্থাপনের জন্য বেশ কয়েকটি অতিরিক্ত অক্ষর রয়েছে।উর্দু স্বরবর্ণ এবং ব্যঞ্জনবর্ণ সবসময় ইংরেজির মতো ভাষায় কাজ করে না। উর্দুতে স্বরবর্ণ কেবল অক্ষর দ্বারা নয়, বরং ডায়াক্রিটিক মানে চিহ্ন ব্যবহার করে বোঝানো হয়। তবুও লোকে উর্দু শিখচ্ছে। বিষয়টা ভাষাটা শেখার প্রয়োজন আছে কিনা সেটাই আসল কথা।"
রুবি কোথা থেকে হাজির হলো, আমাদের কলেজ লাইফের বন্ধবী সঙ্গীতাকে নিয়ে। এসেই আমাকে বকাবকি করে বললো। " এই রাজ তোর স্টুডেন্ট নয় যে ওকে জ্ঞান দিচ্ছিস ওকে ছাড়। রাজ শোনো কাল আমরা মানবকে নিয়ে বেড়াবো ওকে। আমি অনেক দিন গ্রামে যাই না। ওর সাথে গ্রাম দেখতে যাবো। "
রাজ বাবু বললেন " ঠিক আছে। ডিয়ার। তুমি ড্রাইড করবে না। আমি রামুকে ফোন করছি, ও নিয়ে যাবে যেখানে যাবে তোমরা। "
রুবি বললো " নো বেবি তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। আমরা শান্তি নিকেতন বা বোলপুর যাবো না। কোন অফবিট বিশুদ্ধ গ্রামে যাবো। যেটা মানব ই আমাদের নিয়ে যেতে পারে। '
আমি আমতা আমতা করে বললাম। " কিন্তু কাল তো আমার হবে না কাজ আছে। "
রবি বললো " শোনা তুমি মিথ্যা কথা বলতে শিখলি কবে থেকে এতো। তোর আবার কিসের কাজ। তুই আমাদের খোঁজ খবর রাখিস না। কিন্তু আমরা তোর খবর নিই নিয়মিত। তোর ভাই তো বলে ছুটি এসে তুই রাতটুকু বাড়ি থাকিস। ভোরের বেলায় খেয়ে দেয়ে বেড়িয়ে যাস কোন অচেনা অজানা গ্রামে। রাতে ফিরিস।তালপাতার হাত পাখা, মাটির পুতুল, ঝুড়ির মতো অপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনে এনে ঘর ভর্তি করিস। "
সঙ্গীতা বললো " সে ছাড়া ওর কাজ থাকতেই পারে। কিন্তু আমি পরশু জর্ডান চলে যাবো আর কোন দিন কি আমাদের দেখা হবে বলল। তাছাড়া অভিদা আসবে বলছে কাল। "
অভি দার নাম শুনেই রাজি হেয়ে গেছিলাম আমি। অভিদার থেকে আমি গান লেখা শিখতে চেয়েছিলাম একটা সময়। কিন্তু সকালে বালিগঞ্জ স্টেশন গিয়ে জানতে পারলাম কেউ আসছে না। রুবি জানতো আমি একা দেখা করতে চাইলে দেখা করতাম না। তাই ওরা মিথ্যা কথা বলেছে। শেষে আমি ওর সাথে সারাদিন ঘুরলাম।
ট্রেন জার্নি করে ও খুব ক্লান্ত । তাই রুবির অনুরোধ অনুযায়ী ওকে আমি ওর বাড়ি পৌছে দিতে গেলাম। ও ওর নিজের বাড়িতে নিয়ে এলো। এখানে কুড়ি বছর আগে এসে বুঝতে পেরেছিলেন। আমাদের সম্পর্কটা বামন হয়ে চাঁদে হাত দেওয়ার মতো। তাই সেই দিন আমি আমাদের মধ্যে সম্পর্কটা ভেঙে দিয়েছিলাম।
ওর বাবা মারা গেছে। একতালার একটা ঘরে পড়ে আছে চাকরবাকরে ভরসায়। তবে ও প্রতি দিন দেখা করতে আসে ওর মায়ের সাথে। ও আমাকে নিয়ে তিনতালায় চলে গেলো। ও একটু ফ্রেস হয়ে বললো "খুব মাথা যন্ত্রণা করছে। একটু মাথা টিপে দিবি.."
ওর আবদার মেনে নিলাম। মাথা টিপে দিতে ও আর অন্যকিছুর জন্য আবদার করলো। মেনে নিয়ে আমি ডুবলাম অন্য নেশায়। একদিন হলে সেটা ধরে নেওয়া যেতো দূরঘটনা, আমরা নিয়মিত দেখা করতে থাকলাম। দূরে কোথাও গেলে রাজ বাবু গাড়ির ব্যবস্থা করে দিতো। সব ঠিক ঠিক চলছিলো।
সেইদিন রাতে ওর ওয়াস রুমে স্নান করতে গিয়ে দেখলাম ওর কামড়ে দাগ করে দিয়েছে বুকের মধ্যে। একটু হাসলাম পরেই চোখ ডরে উঠলো জ্বলে। নীলাঞ্জনা অফিসে তখন ওভার টাইম চলছে। অফিস থেকে এসে ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়ে। ও ঘুমিয়ে পরলেও আমি ওর মাথায় গায়ে হাত বুলিয়ে দিতাম। হঠাৎ সেইদিন দেখলাম ওর পিঠে একটা আঁচরের দাগ।
ওকে ৎকিছু না জিজ্ঞাসা করে ওর ফোনটা ঘাটাল। ও ঠিক রুবি মতো প্রদীপকে ফোন ম্যাসেজ লিখেছিলো। " আমার সাথে আর আমার বরের কোন সম্পর্ক নেই। আগে তেমন সম্পর্ক ছিলো না। ও আমাকে তেমন সময় দেয় না।তোমাকে আকড়ে বাঁচাতে চাই তাই। "
সেই দিন আমি কিছু বলি নি ওদের। মনে মনে বলেছিলাম বিশ্বাস ঘাতক। প্রদীপের মতো রাজ বাবুও আমাকে বিশ্বাস করে। তাহলে আমিও তো আজ বিশ্বাস ঘাতক।
,,,,

