অস্পৃশ্য যন্ত্রণা
অস্পৃশ্য যন্ত্রণা
আমি মানব মন্ডল। পেটের দায়ে আবুধাবি তে ছোট খাটো চাকরি করি। কর্মজীবন শুরু সাংবাদিক হিসেবে তাই পুরাতন অভ্যাস বসত এখনো সাহিত্য অনুশীলন করি। মুলত লিটল ম্যাগাজিন থেকে লেখালেখি শুরু করেছিলাম। নিজে স্বপ্ন অনুঘটক বলে একটা ছোট পত্রিকা সম্পাদনা করতাম। লিটলম্যাগ আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য হল সাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান এবং বাণিজ্যিকতার প্রভাবের বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদী ও পরীক্ষামূলক আন্দোলন পরিচালনা করা। এর লক্ষ্য হলো এমন সাহিত্য সৃষ্টি করা যা বাণিজ্যিক সুবিধার বাইরে এবং নতুন ধারার সাহিত্যচর্চার মাধ্যমে প্রচলিত সামাজিক ও সাহিত্যিক কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করে।
এবার বলবেন নতুন ধরনের সাহিত্য কথাটার মানে কি? রবীন্দ্রনাথ আর শ্রীজাত লেখার মিল পান কি?? জীবনানন্দ দাশ আর নজরুল লেখার মধ্যে কতটা পার্থক্য দেখেছেন?? সাহিত্য সমাজের আয়না। সমাজ দর্শন বদলায়। অথচ প্রতিষ্ঠানিক বানিজ্যিক সংস্থা সাহিত্য সেই রূপ বদলাতে চায় না। বরং নিজেদের স্বার্থের দর্শন চাপিয়ে দেয়। আমি লেখা লেখি সুচনা করেছিলাম একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে। তখন বাংলা সাহিত্যের বিষয় মানে যুবতীর কোল মাগুর মাছের ঝোল, আমরা মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে পুলেরা ঐ সব আদর্শশুন্য ,ভোগবাদী, আর্ট ফর আর্ট সেক সাহিত্যে নিজের ভালোলাগা খুজে পাচ্ছিলাম না। সফল না হলেও শুরু করলাম , পজিট্রন কবিতা লেখা। নাম শুনে বুঝতে পারছেন ছোট কবিতা সহজ সরল ভাষায়। জাপানি ছোট কবিতা হাইকু মতো এগুলো, প্রকৃতির উপর আলোকপাত করে ,প্রকৃতি বা ঋতুভিত্তিক চিত্র ফুটিয়ে তোলে। তবে সেনরিউ বলে ও দেশে কবিতা লেখা হতো যা গঠনগতভাবে হাইকু-এর মতো হলেও এটি মানব প্রকৃতি এবং এর দুর্বলতাগুলো নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক বা বিদ্রূপাত্মকভাবে লেখা হতো সেগুলো। তবে আমাদের কবিতা গুলো সহজ সরল ভাষায়। যুবক বয়স হতাশা ভুগছিল তখন তাই কবিতা গুলো ছিল ধনাত্মক আশাবাদী।
যাইহোক তারপর জীবন সংগ্রাম যোগ দিতে বাধ্য হয়ে লেখালেখি অনিয়মিত হয়ে গেলো। অনেক চেষ্টা করেও অর্থনৈতিক ভাবে সফল হলাম না তাই বছর দশকের সম্পর্কে ভেঙে দিয়ে স্ত্রী চলে গেলে অন্যকোন মানুষের হাতে ধরে। সব আঘাত ভুলতে সাহিত্য অনুশীলন আবার শুরু করলাম। আজকাল লেখালেখি না করতে পারলে ভীষণ কষ্ট হয়। এটা একটা অভ্যাস দাড়িয়ে গেছে।আমার কাছে রাইটার্স ব্লক একটা অসুখের মতো।রাইটার্স ব্লক হলো এমন একটি অবস্থা যেখানে একজন লেখক সৃজনশীলতা অনুভব করতে পারেন না এবং লিখতে সমস্যা হয়। এটি কোনো দক্ষতা বা প্রতিশ্রুতির অভাবের কারণে নয়, বরং চাপ, উদ্বেগ, ভয় এবং ক্লান্তি-র মতো শারীরিক ও মানসিক কারণ থেকে ঘটে। এই অবস্থা কাটিয়ে উঠতে নিয়মিত লেখার অভ্যাস চালিয়ে ছোট ছোট পদক্ষেপ নেওয়ার মতো কৌশল ব্যবহার করা যেতে পারে। আমি অন্যান্য লেখকের লেখা পড়ি। সেই দিন আমার বন্ধু মানিক রায়ের লেখা পড়লাম
"জীবন আসলে কখনোই বড়ো বড়ো ঘটনার মধ্যে লুকিয়ে থাকে না। সে লুকিয়ে থাকে খুব ছোটো ছোটো অনুভূতির মাঝে, সকালের নরম আলোয়, এক চুমুক চায়ের উষ্ণতায়, কারও বলা ‘ভালো থেকো’-র সহজ শব্দে। আমরা যখন এই সূক্ষ্ম মুহূর্তগুলোকে উপেক্ষা করি, তখনই জীবন নিঃশব্দে দূরে সরে যায়।
অনেকে ভাবে, জীবন মানে বড়ো কিছু অর্জন করা, নাম, যশ, খ্যাতি পাওয়া। কিন্তু আসল জীবন শুরু হয় তখনই, যখন আমরা নিজেকে গড়ার পথ খুঁজে পাই। যে মানুষ নিজেকে গড়ে তুলতে জানে না, সে যত সুযোগই পাক না কেন, তার জীবন কখনও সুশোভিত হয় না। গাছের মূলে যদি জলের অভাব থাকে, কুঁড়ি যতই আসুক, তা ফুল হয়ে ফুটবে না, ঝরে যাবেই।
শৈশবের দিনগুলোই আসলে আমাদের ভবিষ্যতের প্রথম পাঠশালা। তখন যে জীবনকে চিনতে শেখে, নিজের স্বপ্নের রূপরেখা আঁকে, সে পরবর্তীকালে নিজেই নিজের শিক্ষক হয়ে ওঠে। কঠোর অধ্যবসায়, পরিশ্রম আর আত্মশাসনের মধ্যে দিয়ে যে এগোয়, তার জীবন একদিন নিজেই হয়ে ওঠে এক শিল্পকর্ম। কিন্তু যে ছোটোবেলায় অবহেলায় সময় হারায়, সে বড়ো হয়ে বুঝতে পারে, সময় তাকে হারিয়ে দিয়েছে।
আগোছালো জীবন ঠিক যেন একটা ভাঙা আয়না। যতই সাজাতে চাই, প্রতিচ্ছবি বিকৃত হয়ে যায়। আমাদের সম্পর্কগুলোও তাই, যেখানে শৃঙ্খলা নেই, আত্মসম্মান নেই, নিজের প্রতি দায়বদ্ধতা নেই, সেখানে ভালোবাসাও টেকে না। সম্পর্ক গড়ে ওঠে পারস্পরিক শ্রদ্ধায়, আর টিকে থাকে আত্মবিশ্বাসে। নিজের ভেতর যদি অস্থিরতা আর অবহেলা থাকে, তবে বাইরের কোনও মানুষই সেখানে স্থায়ী হতে পারে না।
মানিক রায় ২৩ অক্টোবর ২০২৫ একটা ব্যাক্তিগত পোস্ট পড়লাম সেই দিন। "আমাদের চারপাশে অনেকেই থাকে, যারা সত্যিই চায় আমরা ভালো থাকি। তারা চায় আমরা সফল হই, হাসি মুখে বাঁচি। কিন্তু নিজের জীবন যদি নিজের কাছেই গৌণ হয়ে যায়, যদি আমরা নিজেই নিজেকে অবহেলা করি, তবে সেই শুভানুধ্যায়ীরাও একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়ে। তারা বুঝে নেয়, যে নিজেকে ভালো রাখতে চায় না, তাকে কেউ ভালো রাখতে পারে না।
জীবন নীরব শিক্ষক। সে কখনও চিৎকার করে না, শুধু সময়ের সঙ্গে প্রতিফলন হয়ে ফিরে আসে। যে একসময় জীবনকে অবহেলা করেছে, জীবনও একদিন তাকে অবহেলাই করে। চারপাশে মানুষ থাকলেও সে একা হয়ে যায়, কারণ নিজের ভেতরকার শূন্যতা কোনও ভিড় পূরণ করতে পারে না। তখন বোঝা যায়, একাকিত্ব শুধু নিঃসঙ্গতার আরেক নাম নয়, বরং এটা জীবনের এক গভীর উপলব্ধি।
সেই একাকিত্বের মুহূর্তেই মানুষ বুঝতে পারে, কত ছোটো ছোটো অনুভূতিই আসলে জীবনকে অর্থ দেয়। কোনও এক সকালে পাখির ডাক, পুরোনো বন্ধুর একটা চিঠি, কিংবা নিজের অতীতের কোনও ছোট্ট সাফল্য, এসবই জীবনকে স্পর্শ করে যায়। আর তখন আমরা বুঝি, জীবন কখনোই আমাদের তুচ্ছ করেনি, আমরাই তাকে গুরুত্ব দিতে ভুল করেছি।
জীবনের সৌন্দর্য বাইরে নয়, ভেতরে। যে নিজের ভেতরের বিশৃঙ্খলাকে সামলাতে পারে, সে বাইরের ঝড়কেও হাসিমুখে সামলায়। তাই জীবনকে উপভোগ করতে হলে আগে তাকে সম্মান করতে হবে, তার প্রতিটা মুহূর্তকে, প্রতিটা ব্যর্থতাকে, প্রতিটা ছোটো ছোটো অর্জনকেও।
জীবন একটা আয়না। যেমনভাবে আমরা তার দিকে তাকাই, তেমনভাবেই সে আমাদের প্রতিচ্ছবি ফিরিয়ে দেয়। অবহেলায় তাকালে মুখও অস্পষ্ট হয়ে যায়, কিন্তু ভালোবাসা দিয়ে তাকালে, সেই আয়নায় দেখা যায় এক উজ্জ্বল, আত্মবিশ্বাসী মানুষ, যে জানে, জীবন তুচ্ছ নয়, বরং তা এক অনন্ত শিল্পকর্ম, যাকে প্রতিদিন একটু একটু করে গড়ে তোলা যায়।"
কি সুন্দর না লেখাটা??প্রেরণা দেয় এর জীবনের গল্পটাও। অর্থনৈতিক ভাবে সফল হলো না মানুষটা কোন দিন। ছাপাখানা নেই নিজের। ছোট একটা ঘর একটা বারবার খারাপ হওয়া কম্পিউটার। অথচ প্রকাশনা চালাচ্ছে। জানেন ওর জন্য আজ কলকাতার বই পাড়ার দেপিয়ে বেড়াচ্ছে আমার কিছু সাহিত্যিক বন্ধু বান্ধব। নোট বন্দী কোরনা মহামারী পর ওর অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হয়ছে। নয়তো তার আগে এসব সনামধন্য লোকজনরা ওর বাড়িতে এসে সাকল বিকাল চা জলখাবার খেয়ে ওর সংগ্রহের বই পড়ে সময় কাটাতো। বিভিন্ন প্রকাশকের কাছে লেখা পাঠাতো ওর সুপারিশ নিয়ে। আজ কেউ ওর বাড়ি ছায়া মারায় না। পথে ঘটে দেখা হলে শুভাকাঙ্ক্ষী হিসাবে বলে। ' মেয়েটা বড় হলো ওর বিয়ের কথা ভাবো। মধ্যবিত্ত ঘরে জন্মে তুমি কি পাগলামি করছো। বড় প্রকাশক তুমি কোন দিন হবে পাড়বে না, আমাদের লেখা আজকাল কেউ পড়ে না। তুমি তো নতুন লেখকদের লেখা ছাপাও।"
ও চুপচাপ হেটে যায়। বুকের ভিতর একটা অস্পৃশ্য যন্ত্রণা নিয়ে।
,,, ,,,
